০৭৮. সুভদ্রার বিলাপ

৭৮তম অধ্যায়

সুভদ্রার বিলাপ

সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! পুত্রশোকাধিকাতরা সুভদ্রা মহাত্মা কেশবের বাক্য শ্রবণ করিয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন; হে বৎস! হতভাগিনীর পুত্র! তুমি পিতৃতুল্য পরাক্রান্ত হইয়া যুদ্ধে কি প্রকারে নিধন প্রাপ্ত হইলে! আমি কি করিয়া তোমা, ইন্দীবরশ্যাম, সুদর্শন, চারুলোচন মুখমণ্ডল রণরেণু সমাচ্ছন্ন অবলোকন করিব! হে সমরাপরাঙ্মুখ মহাবীর। আজি তুমি সমরাঙ্গনে নিপতিত হওয়াতে মনুষ্যগণ তোমাকে ভূতলে সমুদিত চন্দ্রের ন্যায় অবলোকন করিতেছে। হায়! পূর্ব্বে যাহার শয্যা মনোহর আস্তরণে সমাচ্ছন্ন থাকিত, আজি সেই সুখলালিত অভিমন্যু বাণবিদ্ধ হইয়া কি প্রকারে ভূমিতলে শয়ান রহিয়াছে! যে মহাভুজ বীর পূর্ব্বে বরাঙ্গনাগণের সহবাসে কালযাপন করিত, আজি সে যুদ্ধে নিপতিত হইয়া কি প্রকারে শিবাগণের সহবাসী হইয়া আছে! সূত, মাগধ ও বন্দীগণ হৃষ্ট হইয়া যাহাকে স্তব করিত, আজি রাক্ষসগণ তাহার নিকট ভীষণ রবে চীৎকার করিতেছে! হা বৎস! পাণ্ডব, বৃষ্ণি ও পাঞ্চালগণ তোমার সহায় থাকিতে কে তোমাকে অনাথের ন্যায় সংহার করিল! হে পুত্র! তোমাকে দর্শন করিয়া এই মন্দ ভাগিনীর নয়ন যুগল পরিতৃপ্ত হয় নাই; অতএব আজি আমি তোমার চন্দ্রানন নিরীক্ষণ করিবার নিমিত্ত অবশ্যই শমন ভবনে গমন করিব। বিশাললোচনশালী মনোহর কেশকলাপ-সম্পন্ন চারু-বাক্যযুক্ত সুগন্ধ ও ব্রণশুন্য তোমার সেই মুখমণ্ডল আবার কবে আমার নয়নগোচর হইবে। ভীমসেন, ধনঞ্জয় ও অন্যান্য ধনুর্দ্ধরগণের বীরত্বে ধিক, বৃষ্ণিবীরগণের বীরত্বে ধিক্‌, পাঞ্চালগণের সামর্থ্যে ধিক্‌ এবং কৈকেয়, চেদি, মৎস্য ও পাঞ্চালগণকেও ধিক্; তুমি সংগ্রামে গমন করিলে ইহারা তোমাকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইলেন না। আমার শোকব্যাকুল লোচন অভিমন্যুর অদর্শনে সমুদায় পৃথিবী শূন্যের ন্যায় অবলোকন করিতেছে। হে বীর! তুমি বাসুদেবের ভাগিনেয়; গাণ্ডীবধস্বার পুত্র ও স্বয়ং অতিরথ; তুমি আজি সমরে নিপতিত হইয়াছ, ইহা আমি কি প্রকারে অবলোকন করিব! হে বীর! তুমি স্বপ্নগত ধনের ন্যায় দৃষ্ট ও বিনষ্ট হইলে। হায়! এখন জানিলাম মনুষ্যগণের সমুদায় দ্রব্যই জলবুদের ন্যায় অনিত্য। হা বৎস! তোমার এই তরুণী ভার্য্যা মনোবেদনায় নিতান্ত কাতর হইয়াছে; আমি কি প্রকারে ইহাকে সান্ত্বনা করিব। বৎস! আমি তোমার দর্শনে নিতান্ত উৎসুক, কিন্তু তুমি আমাকে ফলকালে পরিত্যাগ করিয়া অকালে প্রস্থান করিলে। যখন তুমি কেশবসনাথ হইয়াও সংগ্রামে অনাথের ন্যায় নিহত হইয়াছ, তখন কৃতান্তের গতি প্রাঙ্গণেরও নিতান্ত দুর্জ্ঞেয়, সন্দেহ নাই। হে বৎস! যাগশীল, দানশীল, ব্রাহ্মণ, কৃতাত্মা ব্রহ্মচারী, পুণ্যতীর্থাবগাহী, কৃতজ্ঞ, বদান্য, গুরু শুক্রযানরিত ও সহস্র দক্ষিণাপ্রদ ব্যক্তির যে গতি, তোমার সেই গতি লাভ হউক। অপরাঙ্মুখ বীরগণ যুদ্ধ করিতে করিতে অরাতিগণকে নিহত করিয়া পশ্চাৎ স্বয়ং নিহত হইলে যে গতি প্রাপ্ত হন, তুমি সেই গতি লাভ কর। যাঁহারা সহস্র গোদান, যজ্ঞার্থে দান, উপকরণ-সম্পন্ন অভিমত গৃহ দান, শরণ্য ব্রাহ্মণগণকে রত্ন দান এবং দণ্ডার্হকে দণ্ড প্রদান করেন, তাঁহাদিগের যে পবিত্র গতি, তোমার সেই গতি লাভ হউক। শংসিতব্ৰত মুনিগণ ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা এবং পুরুষগণ এক মাত্র পত্নী পরিগ্রহ দ্বারা যে গতি প্রাপ্ত হয়েন, তুমি সেই গতি লাভ কর। ভূপালগণ সদাচার, চারি বর্ণের মনুষ্যগণ পুণ্য ও পুণ্যবানেরা পুণ্যের সুরক্ষণ দ্বারা যে সনাতন গতি লাভ করেন, তুমি সেই গতি প্রাপ্ত হও। যাঁহারা দীনগণের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করেন, যাঁহারা সতত সংবিভাগ করেন, যাঁহারা পিশুনতা হইতে নিবৃত্ত হইয়াছেন, যাঁহারা সতত ব্ৰতানুষ্ঠান ধর্ম্মানুশীলন ও গুরু শুশ্রূষায় নিরত থাকেন, অতিথিগণ যাঁহাদের নিকট বিমুখ হন না, যাঁহারা নিতান্ত ক্লিষ্ট, বিপন্ন ও পুত্র শোকানলে দগ্ধ হইয়াও আত্মার ধৈৰ্য্য রক্ষা করেন, যাঁহারা সর্ব্বদা মাতাপিতার সেবায় নিরত থাকেন এবং আপনার পত্নীতে নিরত হন, যে মনীষিগণ পরদারপরাঙ্মুখ হইয়া ঋতু কালে স্বীয় ভাৰ্য্যা গমন করেন, যাহারা গত মৎসর হইয়া সৰ্ব্বভূতের প্রতি সমদৃষ্টি হন, যাঁহারা অন্যের মর্ম্মপীড়া প্রদানে বিরত থাকেন, যাঁহারা ক্ষমাশীল হন এবং যাঁহারা মধু, মাংস, মদ্য, দম্ভ, মিথ্যা ও পরপীড়ন পরিত্যাগ করেন, তুমি কাঁহাদিগের গতি লাভ কর। হ্রীমান, সৰ্ব্বশাস্ত্রজ্ঞ, জ্ঞানতৃপ্ত, জিতেন্দ্রিয় সাধুগণের যে গতি, তোমারও সেই গতি হউক।

সুভদ্রা দীন ও শোকাকুলা হইয়া এইরূপ বিলাপ করিতেছেন, এমন সময়ে দ্রুপদনন্দিনী উত্তরাকে সমভিব্যাহারে লইয়া তথায় আগমন করিলেন। তখন তাঁহারা সকলেই নিতান্ত দুঃখিত চিত্তে সাতিশয় রোদন ও বিলাপ করত উন্মতার ন্যায় সংজ্ঞাহীন হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। বাসুদেব নিতান্ত দুঃখিত হইয়া অচেতনপ্রায়, রোদনশীল, মৰ্ম্মবিদ্ধা, কম্পিত কলেবর ভগিনীর গাত্রে জলসেচন ও তাঁহাকে সমুচিত হিতবাক্যে আশ্বাস প্রদান করিয়া কহিলেন, সুভদ্রে! পুত্রের নিমিত্ত আর শোক করিও না; পাঞ্চালি! উত্তরাকে আশ্বাস প্রদান কর; ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ অভিমন্যু ক্ষত্রিয়গণের উপযুক্ত গতি লাভ করিয়াছে। হে বরাননে! আমার এই মানস যে, যশস্বী অভিমন্যু যে গতি লাভ করিয়াছেন, আমাদিগের কুলজাত পুরুষগণ সকলেই সেই গতি প্রাপ্ত হউন। তোমার মহারথ পুত্র একাকী যেরূপ কর্ম্ম করিয়াছে, আমরা ও আমাদের সুহৃগণ সকলে একত্র হইয়া সেইরূপ কর্ম্ম সম্পাদন করিতেছি।”

মহাবাহু বাসুদেব ভগিনী, দ্রৌপদী ও উত্তরারে এইরূপে আশ্বাসিত করিয়া পার্থের নিকট গমন পূর্ব্বক ভূপালগণ, বন্ধুগণ ও অর্জ্জুনকে অনুজ্ঞা করিয়া অন্তঃপুরে প্রবিষ্ট হইলেন। তাঁহারাও স্ব স্ব আলয়ে গমন করিলেন।