১১৫. পাণ্ডবগণের পরশুরামাশ্ৰম মহেন্দ্ৰপর্ব্বতে গমন

১১৫তম অধ্যায়

পাণ্ডবগণের পরশুরামাশ্ৰম মহেন্দ্ৰপর্ব্বতে গমন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে মহেন্দ্ৰপর্ব্বতে এক রজনীমাত্র বাস করিয়া তাপসদিগের সৎকার করিলে মহর্ষি লোমশ ভৃগু, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ ও কাশ্যপসন্নিধানে যুধিষ্ঠিরের পরিচয় প্রদান করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির তাহাদিগের নিকটস্থ হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে অভিবাদনপূর্ব্বক অকৃতব্ৰণনামা মহাবীর রামানুচরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! ভগবান পরশুরাম কোন দিবসে তাপসদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আগমন করিবেন? আমি সেই সুযোগেই তাঁহাকে সন্দর্শন করিতে ইচ্ছা করিয়াছি।” অকৃতব্ৰণ কহিলেন, “মহারাজ! আপনি যে এ স্থানে আগমন করিয়াছেন, ইহা ভগবান পরশুরাম প্রভাব বলে অবগত হইয়াছেন। আপনার প্রতি তাঁহার যে প্রকার প্রীতি আছে, ইহাতে বোধ হয়, তিনি অনতিকালমধ্যেই আপনাকে দর্শন দিবেন। তাপসেরা চতুর্দ্দশী ও অষ্টমীতে তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিয়া থাকেন; আগামীকল্য চতুর্দ্দশী হইবে।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “আপনি ভগবান পরশুরামের একান্ত অনুগত; সুতরাং অতীত বৃত্তান্ত প্রত্যক্ষবৎ দর্শন করিয়া থাকেন; অতএব এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, ক্ষত্ৰিয়েরা কিরূপে ও কি কারণে ভগবান রামকর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন?”

অকৃতব্ৰণ কহিলেন, মহারাজ! আমি ভৃগুবংশাবতংস। পরশুরাম ও হৈহয়াধিপতি কর্ত্তবীৰ্য্যের অত্যাশ্চৰ্য্য বিচিত্ৰ চরিত্র কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। মহাবীৰ্য্য কর্ত্তবীৰ্য্যের সহস্ৰ বাহু ছিল। তিনি দত্তাত্ৰেয়দত্ত বরপ্রভাবে কাঞ্চনময় বিমান ও সসাগরা ধরার একাধিপত্য লাভ করেন। তাঁহার রথের গতি সর্ব্বত্র অপ্ৰতিহত ছিল।

তীর্থপ্রসঙ্গে কার্ত্তবীৰ্য্যকথা কীর্ত্তন

অনন্তর কার্ত্তবীৰ্য্য সেই রথে আরোহণ করিয়া বরপ্রভাবে চতুর্দ্দিকে দেব, যক্ষ ও ঋষি প্রভৃতি প্রাণীগণের পীড়ন করিতে লাগিল। তখন মহর্ষিগণ ও দেবগণ একত্র সমবেত হইয়া অসুরনিসূদন দেবদেব বিষ্ণুকে কহিলেন, “ভগবান! সৃষ্টিরক্ষার নিমিত্ত আপনি মহাবীৰ্য্য কার্ত্তবীৰ্য্যকে সংহার করুন; সে দিব্যবিমানে আরোহণপূর্ব্বক শচীসহায় বাসবকেও পরাভব করিয়াছে।” তখন ত্ৰিলোকপূজিত বিষ্ণু ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্রের সহিত কার্ত্তবীৰ্য্যবিনাশার্থে মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। দেবরাজ তদ্বিষয়ে সমস্ত হিতজনক কথা নিবেদন করিলেন; ভগবান বিষ্ণু তাহা স্বীকার করিয়া স্বীয় রমণীয় বদরিকাশ্রমে প্রবেশ করিলেন।

কান্যকুব্জ-দেশে মহাবলপরাক্রান্ত গাধি-নামা সুপ্ৰসিদ্ধ এক মহীপাল ছিলেন, তিনিও সেই সময়ে বন্যপ্রবেশ করিলেন। বনবাসকালে তাঁহার সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী এক কন্যা জন্মগ্রহণ করিল। অনন্তর ভার্গব গাধিরাজ-সন্নিধানে তাহাকে প্রার্থনা করিলে তিনি কহিলেন, “হে তপোধন! আমার পূর্ব্বপুরুষপরম্পরায় এইরূপ একটি নিয়ম প্রচলিত হইয়া আসিতেছে যে, আমরা কন্যাদানকালে অভ্যন্তররক্ত ও বহিঃশ্যাম কর্ণসংযুক্ত পাণ্ডুকলেবর তরস্বী সহস্ৰ অশ্ব শুল্ক গ্রহণ করিয়া থাকি, কিন্তু আমি আপনার নিকট শুল্ক প্রার্থনা করিতে পারি না, অথচ আপনার সদৃশ ব্যক্তিকে কন্যাদান করাই আমার একান্ত উদ্দেশ্য।” ঋচীক কহিলেন, “মহারাজ! আমি আপনাকে অভ্যন্তররক্ত ও বহিঃশ্যাম কর্ণসংযুক্ত পাণ্ডুকলেবর তরস্ব সহস্ৰ অশ্ব শুল্ক প্রদান করিব; আপনি আমাকে কন্যাদান করুন।”

অনন্তর ঋচীক এইরূপ অঙ্গীকার করিয়া বরুণের নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে বরুণ! আমাকে শুল্কার্থ অভ্যন্তররক্ত ও বহিঃশ্যাম কর্ণসংযুক্ত পাণ্ডুকলেবর তরী সহস্ৰ অশ্ব প্ৰদান কর।” বরুণ তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ সেইরূপ সহস্ৰ অশ্ব প্ৰদান করিলেন। হে মহারাজ! যে স্থান হইতে সেই সমস্ত অশ্ব উৎপন্ন হইয়াছিল, তাহা অশ্বতীৰ্থ বলিয়া বিখ্যাত আছে। তৎপরে বিবাহকাল উপস্থিত হইলে দেবগণ বরযাত্রী হইয়া আগমন করিতে লাগিলেন। গাধিরাজ সহস্ৰ অশ্বলাভ ও দেবীসমাগম সন্দর্শনপূর্ব্বক কন্যকুব্জে ভাগীরথীতীরে স্বসুতা সত্যবতীকে মহর্ষি ঋচীকহস্তে সম্প্রদান করিলেন।

জমদগ্নির জন্ম

অনন্তর ঋচীক এইরূপে ধর্ম্মপত্নী লাভ করিয়া সন্তোষ-সহকারে স্বেচ্ছানুসারে বিহার করিতে লাগিলেন। এই অবসরে মহর্ষি ভৃগু তথায় সমুপস্থিত হইয়া সপত্নীক পুত্রকে সন্দর্শন করিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইলেন। দম্পতি সুরগণ-বন্দিত সুখাসীন মহাগুরু ভৃগুকে অৰ্চনা করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার সন্নিধানে উপবেশন করিলেন। তখন ভৃগু প্ৰহৃষ্টমনে স্নুষাকে কহিলেন, “হে বৎসে! তুমি বর প্রার্থনা কর। তোমার অভীষ্ট বর-প্রদান করিব।” সত্যবতী আপনার ও জননীর পুত্ৰলাভার্থ তাহাকে প্রসন্ন করিলেন। অনন্তর ভগবান ভৃগু প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া কহিলেন, “হে ভদ্রে! তুমি ও তোমার জননী পুংসবনাৰ্থ [গর্ভে পুরুষ-সন্তান জন্মিবার সংস্কারবিশেষ] ঋতুস্নাতা হইলে উভয়কেই দুইটি পৃথক পৃথক বৃক্ষ আলিঙ্গন করিতে হইবে। তুমি উড়ুম্বর ও তোমার জননী অশ্বত্থ-বৃক্ষকে আলিঙ্গন করবে। আর আমি এই চরুদ্বয় প্রদান করিতেছি; তোমাদিগের উভয়কেই ইহা ভোজন করিতে হইবে। আমি বিশ্ব-ব্ৰহ্মাণ্ড অনুসন্ধান করিয়া পরমযত্নসহকারে এই চরু প্ৰস্তুত করিয়াছি।” এই বলিয়া মহামুনি ভৃগু সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন। কিন্তু সত্যবতী ও তাঁহার মাতা বৃক্ষ-আলিঙ্গন ও চরুভোজন-বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতচরণ করিলেন।

বহুকাল অতীত হইলে ভগবান ভৃগু দিব্যজ্ঞানপ্রভাবে এই ব্যাপার অবগত হইয়া পুনরায় তথায় উপস্থিত হইলেন এবং সুষা সত্যবতীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে ভদ্রে! আমি যেরূপ আদেশ করিয়াছিলাম, তাহার বিপরীতচরণদ্বারা তোমরা চরুভোজন ও বৃক্ষ-আলিঙ্গন করিয়াছ; এই নিমিত্ত তুমি ও তোমার জননী উভয়েই বিরুদ্ধ-গুণশালী পুত্র লাভ করিবে; তোমার গর্ভে ক্ষত্ৰিয়-বৃত্তিধারী এক ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করিবে এবং তোমার মাতার গর্ভে ব্ৰাহ্মণাচারসম্পন্ন মহাবীৰ্য্য সৎপথগামী এক পুত্ৰ জন্মিবে।” এই কথা শুনিয়া সত্যবতী বারংবার বিনয়বচনে শ্বশুরকে কহিলেন, “ভগবন! আমার যেন কদাচ এরূপ পুত্র না হয়, প্রত্যুত এতল্পক্ষণাক্রান্ত পৌত্র জন্মে, তাহাতে ক্ষতি নাই।” তখন ভৃগুমুনি ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাহার বাক্যে অনুমোদন করিলেন। অনন্তর সত্যবতী যথাযোগ্য অবসরে তেজঃপুঞ্জকলেবর জমদগ্নিনামক এক পুত্র প্রসব করিলেন। জমদগ্নি ক্রমশঃ পরিবর্দ্ধিত হইয়া বেদধ্যয়নদ্বারা অনেকানেক ঋষিকে অতিক্রম করিতে লাগিলেন এবং কৃৎস্ন ধনুর্ব্বেদ ও চতুর্ব্বিধ অস্ত্ৰ বিভাকরসমপ্ৰভাসম্পন্ন জমদগ্নিকে অধিকার করিল।