১১২. ঋষ্যশৃঙ্গের বিলাসবিমোহন

১১২তম অধ্যায়

ঋষ্যশৃঙ্গের বিলাসবিমোহন

“ঋষ্যশৃঙ্গ কহিলেন, “পিতঃ! অদ্য এই আশ্রমে নাতিখর্ব্ব ও নাতিদীর্ঘ এক জটিল ব্ৰহ্মচারী আগমন করিয়াছিলেন; তাঁহাকে অবলোকন করিলে দেবতা বলিয়া প্রতীতি হয়। তাঁহার বর্ণ সুবৰ্ণসদৃশ, লোচন কমলের ন্যায় আয়ত ও স্নিগ্ধ, রূপ সাতিশয় মনোহর, প্রভা সূৰ্য্যের ন্যায়, তাহাঁর মস্তকে হিরণ্যরজ্জুগ্রথিত সুদীর্ঘ নীল নির্ম্মল জটাভার; কণ্ঠে আকাশবিকাশিনী সৌদামিনীর ন্যায় আলাবাল [কলসহার—কণ্ঠাভরণবিশেষ। ঐ হারে কলসীর মত মালা থাকায় বৃক্ষের মূলে জল দিবার জন্য গোলাকারে খনিত আলবালনামক জলাধারের সহিত তুলিত হইয়াছে।] বিলম্বিত রহিয়াছে; বক্ষঃস্থলে লোমসম্পর্কশূন্য অতি মনোহর বর্তুলাকৃতি দুইটি মাংসপিণ্ড [স্তনচিহ্ন] রহিয়াছে; কটিদেশের ক্ষীণতা, যার-পর-নাই শোভা বিস্তার করিতেছে। তাহার পরিহিত চীরমধ্য হইতে আমার এই মেখলা [কাঞ্চী— কটিবন্ধনভূষণ]-র ন্যায় হিরন্ময়ী মেখলা প্রকাশিত হইতেছে। চরণদ্বয়ে সুমধুর শব্দায়মান এক আশ্চৰ্য্য বস্তু [কিঙ্গিণী-ঘুঙুর-দেওয়া নূপুর] দীপ্তি পাইতেছে; পাণিদ্বয়ে মদীয় অক্ষমালাসদৃশ কূজিত কলাপকদ্বয় [হস্তদ্বয়ের শব্দায়মান কঙ্কণ] নিবদ্ধ রহিয়াছে।

তিনি যখন কর বা চরণ-সঞ্চালন করেন, তখন তাঁহার করনিবদ্ধ কলাপক ও চরণাবরূঢ় সেই অদ্ভুত বস্তু সরোবরবিহারী মত্ত মরালকুহের ন্যায় কলরব করিতে থাকে। তাঁহাকে চীরসকল আমার এই চীরখণ্ড অপেক্ষা শতগুণে মনোহর ও অদ্ভুতদৰ্শন। যে সময় তাঁহার মোহন মুখমণ্ডল হইতে অমৃতায়মান বাণী নিঃসারিত হয়, তখন অন্তঃকরণ আহ্লাদে পরিপূর্ণ ও পুলকিত হইতে থাকে। ফলতঃ তাঁহার সেই সেই পুংস্কোকিলকলবিড়ম্বিনী [কোকিলের মধুরস্বর হইতেও উত্তম] বাণী শ্ৰবণগোচর করিয়াই আমার অন্তরাত্মা আকুল হইয়া উঠিয়াছে। যেমন বসন্তকালে কাননসকল মলয়ানিলপরিচালিত হইয়া সুশোভিত ও আমোদিত হয়, তদ্রূপ সেই ব্ৰহ্মচারী সামান্য সমীরণ সেবন করিয়াও অসামান্য সৌরভ ও শোভা বিস্তার করিতে লাগিলেন। তাহার সুসংযত জটাসমূহ ললাটদেশে বক্রভাবে দ্বিধাবিভক্ত হইয়া বিন্যস্ত রহিয়াছে; কর্ণদ্বয় চিত্ৰিত চক্রবাকসমূহে আবৃত বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। যখন তিনি দক্ষিণ করে একটি বৃত্তাকার বিচিত্র ফল গ্রহণ করিয়া, সেটি বারংবার ভূমিতে নিক্ষেপ করিলে তাহা উৰ্দ্ধে উঠিতেছিল, আবার ভূমিতে পড়িতেছিল, তিনি বায়ুহিল্লোলিত তরুর ন্যায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহাকে অভিঘাত করিতেছিলেন; আমি সেই দেবকুমারসদৃশ ব্ৰহ্মচারীকে অবলোকন করিয়া যৎপরোনাস্তি প্রীত ও অনুরক্ত হইয়াছি। তিনি আমাকে আলিঙ্গন করিয়া জটাভার গ্রহণপূর্ব্বক আমার মস্তক অবনমিত ও তদীয় মুখমণ্ডল আমার মুখোপরি বিন্যস্ত করিয়া যে শব্দ করিয়াছিলেন, তাহাতেই আমার কলেবর পুলকিত হইয়া রহিয়াছে।

আমি তাঁহার নিমিত্ত এই সকল ফল ও পাদ্য আহরণ করিয়াছিলাম, তিনি তাহাতে অভিনন্দন করিলেন না, বরং আমাকে কতকগুলি ফল প্রদান করিয়া কহিলেন, ‘আমাদিগের ব্ৰত এই প্রকার।’ আমি তাঁহার প্রদত্ত যে-সকল ফল ভোজন করিলাম, উহা কোনক্রমেই আস্বাদনে, ত্বকে ও সারাংশে এই সকল ফলের তুল্য নহে। সেই উদারমূর্ত্তি ব্ৰহ্মচারী আমাকে পান করিবার নিমিত্ত যে সলিল প্ৰদান করিয়াছিলেন, উহা পান করিয়া সমধিক হৃষ্টচিত্ত হইলাম এবং তৎকালে পৃথিবীকে কম্পমানা বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তিনি এই স্থানে পট্টসূত্রে গ্রথিত এই সমস্ত বিচিত্র সুরভিমাল্য বিকীর্ণ করিয়া স্বীয় আশ্রমে প্রস্থান করিয়াছেন। তিনি গমন করাতে আমি নিতান্ত বিচেতন হইয়াছি ও আমার কলেবর একান্ত পরিতাপিত হইতেছে। আমি তাঁহার সমীপে শীঘ্ৰ গমন করিতে বাসনা করি অথবা আমার অভিলাষ যে, তিনি এই স্থানে চিরকাল যেরূপ তপশ্চৰ্য্যা করেন, আমি তাঁহার সহিত সেইরূপ তপানুষ্ঠান করিতে একান্ত অভিলাষ করি। সেইরূপ তপস্যা করিতে আমি নিতান্ত অভিলাষী। তাঁহার আদর্শনে আমার চিত্ত সাতিশয় কাতর হইতেছে।”