১১০. কৌশিকী প্রমুখ তীৰ্থকথা

১১০তম অধ্যায়

কৌশিকী প্রমুখ তীৰ্থকথা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা কৌন্তেয় ক্ৰমে ক্রমে নন্দা ও অপরনিন্দা-নাম্নী পাপভয়বিনাশিনী উভয় তরঙ্গিণীতে গমন করিলেন। তথায় হেমকূটনামক অনাময় পর্ব্বতে গমনপূর্ব্বক ভুরি ভুরি অচিন্ত্য ও অদ্ভুত ব্যাপারসকল অবলোকন করিতে লাগিলেন। কাদম্বিনী সমীরণ বদ্ধ ও সহস্ৰ সহস্ৰ উপলখণ্ডসকলসঙ্কুল হইয়া রহিয়াছে; লোকে তদারোহণে অসমর্থতাবশতঃ বিষাদ-সাগরে মগ্ন হইয়া থাকে; প্রতিনিয়ত বায়ু প্রবাহিত হইতেছে; পয়োবাহ [জলধার-মেঘ] বর্ষণ করিতেছে এবং স্বাধ্যায়সংঘোষ [বেদপাঠ্যধ্বনি] শ্রীয়মাণ হইতেছে, কিন্তু কোন ব্যক্তিই অবলোকিত হইতেছে না। প্রতিদিন প্ৰাতঃকালে ও সায়ংসময়ে ভগবান হব্যবাহন দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকেন। তপঃপ্রত্যূহভূত [বিঘ্ন] মক্ষিকাসকল সকলকে দংশন করে; গমন করিবামাত্ৰ লোকের অন্তঃকরণে নির্ব্বেদ উপস্থিত হইয়াও তাহাদিগের স্ব স্ব আলয়সকল স্মৃতিপথে সমুদিত হয়। রাজা যুধিষ্ঠির সেই সকল রহস্যের মর্ম্মোদ্ভেদে অসমর্থ হইয়া লোমশকে তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।

লোমশ কহিলেন, “হে অরাতিসূদন! পূর্ব্বে আমরা যে প্রকার শ্রবণ করিয়াছি, তাহা কহিতেছি, একাগ্রামনাঃ হইয়া শ্রবণ করুন। এই ঋষভকূটপর্ব্বতে ঋষভনামে এক দীর্ঘায়ু কোপনস্বভাব তাপস ছিলেন। কোন সময়ে কতকগুলি লোক এই স্থানে উপস্থিত হইয়া তাহার সহিত সম্ভাষণ করিতে আরম্ভ করিলে তিনি রোষপরবশ হইয়া পর্ব্বতকে কহিলেন, “কোন ব্যক্তি এ স্থানে আসিয়া কথোপকথন করিলেই তুমি তাহার প্রতি প্রস্তর নিক্ষেপ করিবে।” বায়ুকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “তুমি শব্দ করিও না।” হে রাজন! যে ব্যক্তি এ স্থানে কথোপকথন করে, মেঘধ্বনি তৎক্ষণাৎ তাহাকে নিবারণ করে। মহর্ষি ঋষভ জাতক্ৰোধ হইয়া এই প্রকারে কোন কোন কর্ম্ম প্রতিষিদ্ধ ও কোন কোন কর্ম্ম বিধিবদ্ধ করিয়াছেন।

“একদা দেবগণ নন্দ-নদীতে আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময়ে কতকগুলি লোক দেবদর্শনলালসায় সহসা তথায় উপস্থিত হইল। পুরন্দর প্রভৃতি দেবগণ তাহাদিগকে দর্শন করিতে অনিচ্ছক হইয়া এই প্রদেশকে দুরারোহ আচলদ্বারা অতিদুৰ্গম করিলেন। তদবধি এই পর্ব্বতে আরোহণ করা দূরে থাকুক, কেহই ইহাকে দর্শন করিতে পারে না। প্রকৃত তপশ্চৰ্য্যা ব্যতীত কোন ব্যক্তিই ইহাকে অবলোকন বা ইহাতে অধিরোহণ করিতে সমর্থ হয় না। অতএব হে কৌন্তেয়! আপনি এক্ষণে মৌনাবলম্বন করুন।

“দেবগণ এই স্থানে যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন, অদ্যাপি তাহার চিহ্নস্বরূপ কুশাকার দুর্ব্বাসকল বিদ্যমান রহিয়াছে; যাহাতে এই ভূখণ্ড সঙ্কীর্ণ হইয়াছে এবং য়ূপাকৃতি বৃক্ষসকল তদীয় লক্ষণ প্রদর্শন করিতেছে। অদ্যাপি দেব ও ঋষিগণ এই স্থানে বাস করিতেছেন। প্ৰভাতে ও সায়ংকালে তাহাদিগেরই হুতাশন নয়নগোচর হইয়া থাকে। এ স্থানে স্নান করিলে তৎক্ষণাৎ পাপবিমুক্ত হয়। হে কুরুচুড়ামণি! আপনি ভ্রাতৃগণের সহিত এই নন্দ-নদীতে স্নান করুন, পরে কৌশিকী-নদীতে গমন করিবেন; সে স্থানে মহামুনি বিশ্বামিত্র অবগাহন করিয়া কঠোর তপস্যা অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে সেই শীতলসলিলশালিনী তরঙ্গমালিনী স্রোতস্বতী নন্দাতে স্নান করিয়া কৌশিকী নদীতে গমন করিলেন।

ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষির উৎপত্তি কথা

লোমশ কহিলেন, “হে ভারতবংশাবতংস! এই পবিত্রসলিলা সুরকল্লোলিনী কৌশিকী, ইহার অনতিদূরে ঐ পরিদৃশ্যমান বিশ্বামিত্রের পরামরমণীয় আশ্রমপদ বিরাজমান রহিয়াছে। এই স্থানেই মহাত্মা কাশ্যপের পুণ্যাখ্য আশ্রম। সংযতেন্দ্ৰিয় মহামুনি ঋষ্যশৃঙ্গ কাশ্যপবংশীয় বিভাণ্ডক ঋষির পুত্র। ভগবান ঋষ্যশৃঙ্গ এরূপ তপঃপ্রভাবসম্পন্ন যে, অনাবৃষ্টি-সময়ে বলবৃত্ৰসূদন নমুচিসূদনও তাহার ভয়ে বারিবর্ষণ করিয়াছিলেন। সেই কাশ্যপসৃত-অমিততেজঃ ঋষ্যশৃঙ্গ মৃগীগর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লোমপাদরাজ্য অতি অদ্ভুতম কর্ম্ম করিয়াছিলেন। তিন্নমিত্ত সেই প্রদেশে শস্য-সমৃদ্ধি সমুৎপাদিত হইলে, যেমন সবিতা ব্ৰহ্মাকে স্বীয় তনয়া সাবিত্রী সম্প্রদান করিয়াছিলেন, তদ্রূপ রাজা লোমপাদ ভগবান ঋষ্যশৃঙ্গকে শাস্তা-নামী দুহিতা সম্প্রদান করিলেন।”

যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবান! কাশ্যপতনয় ঋষ্যশৃঙ্গ কি প্রকারে হরিণীগর্ভে উৎপন্ন হইলেন? বিরুদ্ধযোনিসংসৃষ্ট হইয়াও কি প্রকারে তপস্যার অধিকারী হইয়াছিলেন? দেবরাজ ইন্দ্র কি জন্য এই বালকের ভয়ে অনাবৃষ্টি-সময়ে বর্ষণ করিলেন? রাজপুত্রী শান্তা কিরূপ রূপবতী ছিলেন, যিনি হরিণাকৃতি ঋষ্যশৃঙ্গের মন হরণ করিলেন? আর পরম-ধার্ম্মিক রাজর্ষি লোমপাদের রাজ্যে কি নিমিত্তই বা পাকশাসন [ইন্দ্র] বারিবর্ষণ করেন নাই? এই সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে অত্যন্ত কৌতুহল জন্মিয়াছে; অতএব মহর্ষি ঋষ্যশৃঙ্গের বিস্তারিত বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া আমার কৌতুহলাকুলিত চিত্তকে পরিতৃপ্ত করুন।”

লোমশ কহিলেন, “হে রাজন! অমোঘরেতাঃ পবিত্ৰচেতাঃ প্রজাপতিসমপ্রভ, ব্রহ্মর্ষি বিভাণ্ডকের সূত প্রতাপশালী ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি যেরূপে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করুন। দেবকল্প স্থবিরাভিমত কশ্যপতনয় বিভাণ্ডক ঋষি বাল্যাবস্থায় মহাহিদে কঠোর তপস্যা করিতে লাগিলেন। এইরূপে বহুকাল অতীত হইতে একদা উর্ব্বশীকে নয়নগোচর করিয়া তাঁহার রেতঃ স্থলিত হইবামাত্র সলিলে অবগাহন করিলেন। সেই সময়ে এক মৃগী তৃষিত হইয়া জলপান করিতে আসিয়াছিল, সে জলের সহিত ঐ রেতঃ পান করিয়া গর্ভিণী হইল। সেই মৃগী পূর্ব্বে এক দেবকন্যা ছিল; ভগবান ব্ৰহ্মা তাঁহাকে কহিয়াছিলেন, “তুমি মৃগী হইয়া তপস্বিপুত্ৰ প্ৰসবানান্তর বিমুক্ত হইবে।’ বিধিবাক্যের অমোঘত্ব ও ভবিতব্যতার অবশ্যম্ভাবিত্বনিবন্ধন মহাত্মা ঋষ্যশৃঙ্গ সেই হরিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার শিরোদেশে একটি শৃঙ্গ ছিল, এই নিমিত্ত তিনি ঋষ্যশৃঙ্গ বলিয়া বিখ্যাত হইলেন। মহাতপাঃ ঋষ্যশৃঙ্গ জন্মাবধি তপঃপরায়ণ হইয়া কেবল কাননমধ্যেই বাস করিতেন; পিতা ভিন্ন আর কোন মনুষ্যই তাহার নয়নগোচর হয় নাই; এই জন্য তঁ৷হার অন্তঃকরণ নিরন্তর ব্ৰহ্মচৰ্য্যানুষ্ঠানে ব্যাপৃত ছিল।

অনাবৃষ্টিক্লিষ্ট লোমপাদরাজ্যে ঋষ্যশৃঙ্গ-আনয়ন মন্ত্রণা

“সেই সময়ে দশরথের সখা লোমপাদ অঙ্গদেশের অধিরাজ হইয়াছিলেন। তিনি স্বচ্ছানুসারে ব্রাহ্মণের সহিত মিথ্যা-ব্যবহার ও পুরোহিত্যের প্রতি অত্যাচার করাতে ব্ৰাহ্মণেরা তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন; এ নিমিত্ত সহস্ৰলোচন তাহার রাজ্যে বারিবর্ষণ নিষেধ করিয়া প্ৰজাগণকে পীড়ন করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি তপঃপ্রভাবসম্পন্ন বারিবর্ষণক্ষম ব্ৰাহ্মণগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে ব্ৰাহ্মণগণ! পর্জ্জন্যপটল [মেঘমালা] কিরূপে বারিবর্ষণ করিবে, তাহার উপায় অন্বেষণ করুন।”

“পণ্ডিতগণ তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া স্বীয় স্বীয় অভিপ্ৰায় প্রকাশ করিতে লাগিলেন, তন্মধ্যে একজন মুনি রাজাকে কহিলেন, “হে রাজেন্দ্ৰ! ব্রাহ্মণেরা আপনার প্রতি রোষাপরবশ হইয়াছেন; অতএব তাঁহার প্রতিকার করিবার চেষ্টা করুন, আর ঋষ্যশৃঙ্গ সরলস্বভাবসম্পন্ন নারী-পরিচয়বর্জ্জিত আজন্ম-বনবাসী ঋষিকুমারকে আনয়ন করিবার উদযোগ করুন। সেই মহাতপাঃ আপনার দেশে প্রবেশ করিবামাত্ৰই বারিবর্ষণ হইবে, সন্দেহ নাই।”

“রাজা লোমপাদ এই কথা শ্রবণান্তর নিস্কৃতিলাভের নিমিত্ত দ্বিজাতিগণ-সমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে প্রসন্ন করিয়া পুনরায় প্রত্যাগমন করিলেন। প্ৰজাগণ তাঁহাকে প্রত্যাবৃত্ত অবলোকন করিয়া যৎপরোনাস্তি আনন্দিত হইল। অনন্তর তিনি মন্ত্রকোবিদ মন্ত্রিগণকে আহ্বান করিয়া ঋষ্যশৃঙ্গকে আনয়ন করিবার নিমিত্ত মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। লোমপাদ-মহীপতি শাস্ত্ৰজ্ঞ অর্থকুশল অমাত্যগণের সহিত উপায় অবধারণ করিয়া সুচতুরা কাৰ্য্যকুশলা বারবিলাসিনীগণকে আনয়ন করিতে আদেশ করিলেন। অনন্তর তাহারা সমাগত হইলে লোমপাদ কহিলেন, ‘হে বারবনিতাগণ! কোন উপায়ে ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষির বিশ্বাস বা লোভ উৎপাদন করিয়া এই দেশে তাহাকে আনয়ন কর।’

“বারবনিতাগণ রাজভয়ে ভীত ও বিবর্ণ এবং শাপভয়ে অচেতন্যপ্রায় হইয়া তৎকাৰ্য্যসম্পাদনে অস্বীকার করিলে তন্মধ্যে একজন প্ৰবীণা বারযোষা [বারবনিতা— বেশ্যা] ভূপতিকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ‘মহারাজ! যদ্যপি আপনি আমার অভিপ্রেত কতকগুলি উপভোগবস্তু প্ৰদান করেন, তাহা হইলে সেই ঋষিপুত্ৰ ঋষ্যশৃঙ্গকে আনয়ন করিতে যত্ন করি। বোধ করি, তাহাতে কৃতকাৰ্য্যও হইতে পারিব।’

“মহারাজ লোমপাদ সেই বারাঙ্গনার অভিপ্ৰায় অবগত হইয়া তাহাকে বিবিধ রত্ন ও প্রচুর ধন প্রদান করিলেন। বারবিলাসিনী সেই সমস্ত রত্নাদি গ্ৰহণ করিয়া কতকগুলি রূপযৌবনসম্পন্না কামিনী-সমভিব্যাহারে ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রমাভিমুখে গমন করিল।