২৫০. দুৰ্য্যোধনকে শকুনির সান্ত্বনাদান

২৫০তম অধ্যায়

দুৰ্য্যোধনকে শকুনির সান্ত্বনাদান

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপে রাজা দুৰ্য্যোধন প্ৰায়োপবেশনে কৃতনিশ্চয় হইলে সুবলনন্দন শকুনি তাহাকে কহিতে লাগিলেন “হে মহারাজ! কর্ণ যে-সকল কথা কহিয়াছেন, তুমি তৎসমুদয় শ্রবণ করিয়াছ, উহার সমুদয় বাক্যই ন্যায়ানুগত। তুমি কি নিমিত্ত সদুপার্জ্জিত বিপুল ঐশ্বৰ্য্য অকারণ পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রাণত্যাগে কৃতসংকল্প হইয়াছ? তুমি নিতান্ত অবোধ অথবা বৃদ্ধগণের নিকট সুদপদেশ প্রাপ্ত হও নাই। দেখ, যে ব্যক্তি সহসা সমুপস্থিত হর্ষ বা দুঃখের বেগ সংবরণ করিতে সমর্থ না হয়, সে সম্পত্তিসম্পন্ন হইলেও উদকমধ্যগত আম-পাত্রের [অদগ্ধ কাঁচামাটির পাত্র] ন্যায়। শীঘ্র বিনষ্ট হয়। রাজা সাতিশয় ভীত, ক্ষমতাশূন্য, দীর্ঘসূত্রী, প্রমত্ত, ব্যসনী ও বিষয়াসক্ত হইলে প্ৰজাগণ কখন তাহার প্রতি অনুরক্ত হয় না। পাণ্ডবগণ তোমার যথেষ্ট উপকার করিয়াছে; তদ্বিষয়ে তোমার শোক করা অনুচিত; বরং তাহাদিগের প্রত্যুপকার করাই তোমার পক্ষে একান্ত শ্রেয়স্কর। যে বিষয়ে তোমার হর্ষ প্রকাশ ও পাণ্ডবগণের সৎকার করা উচিত, তদ্বিষয়ে তুমি শোক করিয়া নিতান্ত বিপরীতচরণ করিতেছ। এক্ষণে প্ৰসন্ন হও; কদাচ প্ৰাণ পরিত্যাগ করিও না, সন্তুষ্ট-চিত্তে পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক উপকৃত হইয়াছ স্মরণ করিয়া তাহাদিগকে রাজ্য প্ৰদান কর; তাহা হইলে তোমার যশ ও ধর্ম্মলাভ হইবে। তুমি অবিলম্বে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সহিত সৌভ্রাত্ৰ সংস্থাপন করিয়া তাঁহাদিগকে তাঁহাদিগের পৈতৃক রাজ্য প্ৰদান কর; তাহা হইলে পরমসুখে চিরকাল যাপন করিবে।”

মহারাজ দুৰ্য্যোধন শকুনির বাক্য-শ্রবণানন্তর চরণতলে পতিত বিপরীতচেতাঃ দুঃশাসনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া – সোদরস্নেহবশতঃ বাহুযুগলদ্বারা তাহাকে উত্থাপিত করিয়া আলিঙ্গন ও মস্তকাঘ্রাণ করিলেন। কর্ণ, শকুনি ও অন্যান্য সুহৃদগণের সান্ত্বনাবাক্য শ্রবণে তাঁহার মন স্থির হওয়া দূরে থাকুক, প্রত্যুত, সমধিক নির্ব্বেদ ও ব্রীড়ার [লজ্জা] উদয় হওয়ায় নৈরাশ্য অবলম্বন করিলেন এবং দানবাক্যে কহিলেন, “কি ধর্ম্ম, কি ধন, কি সুখ, কি ঐশ্বৰ্য্য, কি প্ৰভুত্ব, কি ভোগ, কিছুতেই আমার আবশ্যকতা নাই, আমি প্রয়োপবেশনে কৃতনিশ্চয় হইয়াছি, তোমরা ইহার বিরুদ্ধে কোন পরামর্শ প্ৰদান করিও না। সকলে একত্র নগরে প্রতি গমনপূর্ব্বক আমার গুরুগণের সেবা কর।” তাহারা দুর্য্যোধনের বাক্যশ্রবণারন্তর পুনরায় তাঁহাকে কহিল, “মহারাজ ! আমরা আর প্রতিগমন করিব না, আমরা তোমা ব্যতিরেকে কদাচ সেই নগরে প্রবেশ করিতে পারিব না। এক্ষণে তোমার যেরূপ গতি, আমাদিগেরও সেইরূপ হইবে।”

মহারাজ দুৰ্য্যোধন সুহৃৎ, অমাত্য, ভ্রাতা ও স্বজনগণকর্ত্তৃক এইরূপ বহুপ্রকার অভিহিত হইয়াও আপনার প্রতিজ্ঞা হইতে বিচলিত হইলেন না। তিনি স্বৰ্গলাভবাসনায় জলস্পর্শপুর্ব্বক শুচি হইয়া ভূতলে কুশাস্তরণ সংন্তীর্ণ করিয়া তদুপরি উপবিষ্ট হইলেন। কুশ ও চীরবসন পরিধান, বাক্যসংযম ও মনের একাগ্রতা অবলম্বন করিয়া বাহ্য-ক্রিয়াসকল পরিত্যাগ করিলেন।

দুর্য্যোধনের মঙ্গলার্থ তদীয় জন্মান্তরীয় দানব-বান্ধবগণকৃত স্বস্ত্যয়ন

এই অবসরে সুরগণকর্ত্তৃক পরাজিত পাতালতলবাসী দারুণ দৈত্যদল দুৰ্য্যোধনকে মরণে কৃতনিশ্চয় জানিয়া ও জ্ঞাতিগণের ক্ষয় বুঝিতে পারিয়া বৃহস্পতি ও শুক্রাচাৰ্য্য-প্রোক্ত অথর্ব্ববেদবিহিত মন্ত্রপাঠ্যপূর্ব্বক যজ্ঞকর্ম্ম আরম্ভ করিল। যে সকল মন্ত্রজপসমাযুক্ত ক্রিয়া উপনিষদে অভিহিত হইয়াছে, তৎসমুদয়ের অনুষ্ঠান হইতে লাগিল, বেদবেদাঙ্গপারগ ব্রাহ্মণগণ সুসমাহিতচিত্তে অগ্নিতে আহুতি প্ৰদান করিতে লাগিলেন।

কর্ম্ম সকল সুচারুরূপে সম্পন্ন হইলে পর অদ্ভূতরূপশালিনী আজ্ঞাকারিণী এক দেবতা জৃম্ভণ করিতে করিতে প্রাদুর্ভূত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে দানবগণ! তোমাদিগের কি করিতে হইবে?” তখন দৈত্যগণ প্ৰফুল্লচিত্তে কহিল, “আপনি কৃতপ্রয়োপবেশন মহারাজ দুৰ্য্যোধনকে এই স্থানে আনয়ন করুন।” সেই দেবতা দৈত্যগণের বাক্যে সম্মত হইয়া, নিমেষমধ্যে সুযোধনসমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে লইয়া, পাতালতলে প্রবেশ করিয়া দানবগণের নিকট প্রদান করিলেন। দানবগণ দুৰ্য্যোধনকে সমানীত দেখিয়া রজনীযোগে সকলে একত্ৰ সমাসীন হইয়া হৃষ্টমনে উৎফুল্ললোচনে সম্মান প্রকাশ্যপূর্ব্বক কহিতে লাগিল।