২২৮. কার্ত্তিকেয়ের ইন্দ্ৰপদ প্ৰত্যাখ্যান

২২৮তম অধ্যায়

কার্ত্তিকেয়ের ইন্দ্ৰপদ প্ৰত্যাখ্যান

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে রাজন! হিরন্ময়ালোচন স্কন্দ দেব হিরন্ময় কবচ, হিরন্ময় মালা, হিরন্ময় চুড়া ও হিরন্ময় মুকুট পরিধান করিয়া উপবেশন করিলে স্বয়ং কমলারূপা শ্ৰী মূর্ত্তিমতী হইয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন। সর্ব্বসুলক্ষণসম্পন্ন ষড়ানন লক্ষ্মীর সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়া পৌর্ণমাসী-সমুদ্ভাসিত শশীর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা ব্ৰাহ্মণগণ তাঁহাকে যথাবিধি পূজা করিয়া কহিলেন, “হে হিরণ্যগৰ্ভ! তোমার মঙ্গল হউক; তুমি সর্ব্বলোকে কল্যাণকর হও; তুমি ছয় রাত্রিমাত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছি; ইতিমধ্যে সমুদয় লোক তোমার বশবর্ত্তী হইয়াছে, অতএব হে সুরোত্তম! তুমি এই সমস্ত লোককে অভয় প্ৰদান করিয়া ইন্দ্ৰতুত্বপদে অধিরোহণ কর।”

“স্কন্দ কহিলেন, “হে তপোধনগণ! ইন্দ্র সমুদয় লোকের কি কর্ম্ম করিয়া থাকেন এবং কি প্রকারে বা দেবগণকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করেন?”

“ঋষিগণ কহিলেন, ‘সুররাজ ইন্দ্ৰ সন্তুষ্টচিত্তে প্ৰজাগণকে বল, তেজ, সুখ প্রভৃতি সমুদয় অভিলষণীয় বস্তু প্ৰদান, দুষ্টের দমন, শিষ্টের প্রতিপালন ও সমুদয় চরাচর জগৎকে স্ব স্ব কাৰ্য্যে অনুশাসন করেন। যে স্থানে সূৰ্য্য নাই, সে স্থানে তিনিই সূৰ্য এবং যে স্থানে চন্দ্ৰ নাই, সে স্থানে তিনিই চন্দ্ৰমা হয়েন। তিনি কারণবশতঃ অগ্নি, বায়ু, পৃথিবী ও জল হইয়া থাকেন। হে বীর! বিপুল-বলশালী ইন্দ্রের এই সকল কর্ত্তব্য কর্ম্ম, তুমিও বীরশ্রেষ্ঠ; অতএব আমাদের ইন্দ্ৰত্বপদে অধিষ্ঠিত হও।”

“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে মহাবাহো! তুমি আজি ইন্দ্ৰত্বপদে অভিষিক্ত হইয়া আমাদিগের সুখসৌভাগ্যবিধান কর।” স্কন্দ কহিলেন, “হে শত্ৰু! তুমি বিজয়ী হইয়া অনাকুলিত চিত্তে ত্ৰৈলোক্যশাসন করা; আমি তোমার কিঙ্কর হইয়া থাকিব; ইন্দ্ৰত্বপদ আমার অভীন্সিত নহে।”

ইন্দ্রের অনুরোধে কার্ত্তিকেয়ের দেব-সৈনাপত্য গ্ৰহণ

“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে বীর! তুমি অতি অদ্ভুত বল ধারণ করিয়াছ, অতএব দেবগণের অরাতিকুল নির্ম্মল কর। লোকে তোমার তেজোদর্শনে অতিশয় বিস্মিত হইয়াছে। আমি দুর্ব্বলতাপ্রযুক্ত পরাজিত হইয়াছি, অতএব ইন্দ্ৰত্বপদে অধিরূঢ় হইলে সকলে আমাকে অবজ্ঞা করিবে। তাহাতে আমাদিগের সুহৃদ্ভেদ হইবারও বিলক্ষণ সম্ভাবনা আছে। আমাদিগের প্রণয়ভঙ্গ হইলে উদ্যোগী সাবধান শাত্ৰবগণ অবিলম্বেই তাহা অবগত হইবে, পরে প্রজাগণও পরস্পর অন্যতর পক্ষে পক্ষপাতনিবন্ধন দুই দলে বিভক্ত হইবে। এইরূপ ভূতভেদকালে আমাদিগের পরস্পরের বিগ্ৰহঘটনারও অসম্ভাবনা নাই, তাহা হইলে তখন তুমি নিঃশঙ্ক-চিত্তে আমাকে পরাজয় করিবে। অতএব হে মহাবল! তুমি কোন বিচার না করিয়া অবিলম্বে ইন্দ্ৰত্বপদে আরোহণ কর।”

“স্কন্দ কহিলেন, “হে শত্ৰু! তুমিই ত্ৰৈলোক্যের অধীশ্বরী; আমি তোমার আজ্ঞাবহ ও অনুগত; এক্ষণে কি করিব, অনুমতি কর।”

“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে মহাবল! আমি তোমার বাক্যে ইন্দ্ৰত্বপদে অধিরোহণ করিব, সন্দেহ নাই। কিন্তু তুমি যদি যথার্থই আমার শাসনরক্ষা করিতে উৎসুক হইয়া থাক, তাহা হইলে দেবগণের সৈনাপত্যে অভিষিক্ত হও।”

“স্কন্দ কহিলেন, “হে সুররাজ! দেবগণের অর্থসিদ্ধি, গো-ব্ৰাহ্মাণের হিতসাধন ও দানবগণের উৎসাদন করিবার নিমিত্ত আমাকে সৈনাপত্যে অভিষিক্ত কর।”

“তখন ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ স্কন্দদেবকে সৈনাপত্যে অভিষিক্ত করিলে মহর্ষিগণ তাঁহার পূজা করিতে লাগিলেন। তাঁহার মস্তকে কাঞ্চনময় ছত্র সুসমৃদ্ধ বহ্নিমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। যশস্বী ত্রিপুরারি দেবি-সমভিব্যাহারে আগমনপূর্ব্বক তাহার গলদেশে বিশ্বকর্ম্মবিনির্ম্মিত কাঞ্চনময়ী মালা প্ৰদান করিয়া অৰ্চনা করিলেন।

“ব্রাহ্মণগণ অগ্নিকে রুদ্র বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন, এই রুদ্ররূপে অনলকর্ত্তৃক উৎকৃষ্ট শুক্ৰে শ্বেতপর্ব্বতে মৃত্তিকাগণের প্রযত্নে স্কন্দদেব জন্মগ্রহণ করেন, এই জন্য ইনি রুদ্রপুত্ৰ বলিয়া প্ৰসিদ্ধ হইলেন। দেবগণ রুদ্রকে তাহার অভিনন্দন করিতে দেখিয়া তাহাকে রুদ্রসূনু [রুদ্রসূত] বলিয়া থাকেন। ফলতঃ তিনি রুদ্ররূপ বহ্নির ঔরসে ঋষিপত্নীরূপধারিণী স্বাহা হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছেন।

“শ্ৰীমান পাবকানন্দন অজীর্ণ [অম্লান]-রক্তাম্বরপরিবেষ্টিত কলেবর হইয়া লোহিত-বসনদ্বয়সংবলিত অংশুমানের ন্যায় দীপ্তি পাইতে লাগিলেন। তাঁহার রথে অগ্নিপ্রদত্ত কুকুট কেতুভূত [পতাকাস্বরূপ] হইয়া কালানলের ন্যায় শোভা ধারণা করিল। যে শক্তি দেবগণের জয়বদ্ধিনী এবং সর্ব্বভূতের চেষ্ট, বল, প্রভা ও শান্তি, তিনি তাহাতে সমাবিষ্ট হইলেন। তাঁহার সহজাত কবচ শরীরমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াছিল; যুদ্ধকাল উপস্থিত হইলেই উহা আবির্ভূত হইত। শক্তি, ধর্ম্ম, বল, তেজ, কান্তি, সত্য, উন্নতি, ব্রাহ্মনত্ব, অসম্মোহ, ভক্তগণের পরিরক্ষণ, অরাতিগণের নির্দ্দলন ও লোকাভিরক্ষণ এই সমস্ত গুণ র্ত্তাহার জন্মকালেই সমুৎপন্ন হইয়াছিল।

কার্ত্তিকেয়ের দেবসেনা-পাণিগ্রহণ

“এবংবিধ গুণসম্পন্ন স্কন্দ দেবগণকর্ত্তৃক অভিষিক্ত ও অলঙ্কৃত হইয়া পরিপূর্ণ চন্দ্ৰমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। স্বাধ্যায়ধ্বনি, দেবগণের বাদ্যধ্বনি ও গন্ধৰ্ব্বগণের গীতধ্বনি সমুদ্ভূত হইতে লাগিল। দেবগণ, অপ্সরীগণ, পিশাচগণ ও অন্যান্য প্ৰাণীসকল অলঙ্কৃত হইয়া তাহাকে বেষ্টন করিয়া রহিলেন; তিনিও তাহাদের মধ্যবর্ত্তী হইয়া পরমানন্দে ক্রীড়া করিতে লাগিলেন। দেবগণ তাঁহাকে অবলোকন করিয়া তমোরাশিবিনাশী চন্দ্ররশ্মির ন্যায় বোধ করিয়াছিলেন।

“অনন্তর ‘তুমি আমাদের সেনাপতি হইলে’, এই কথা বলিতে বলিতে দেবসৈন্যগণ ষড়াননের চতুর্দ্দিকে আগমনপূর্ব্বক স্তব ও পূজা করিতে আরম্ভ করিলে তিনিও তাহাদিগকে সান্ত্বনা করিলেন।

“দেবরাজ ইতিপূর্ব্বে দেবসেনা নামী যে রমণীকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, ভগবান ব্ৰহ্মা স্বয়ং যাঁহাকে ‘রুদ্রসূতের প্রণয়িণী হইবে’ বলিয়া আশ্বাস দিয়াছিলেন, এক্ষণে কার্ত্তিকেয় সেনাপতিপদে অভিষিক্ত হইলে তিনি সেই কন্যাকে আনয়ন করিয়া কহিলেন, “হে সুরোত্তম! ভগবান ব্ৰহ্মা তোমার জন্মিবার অগ্ৰে ইহাকে তোমার পত্নীরূপে নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন; অতএব তুমি দেববিহিত বিধিপূর্ব্বক করকমলদ্বারা ইহার পাণিকমল পরিগ্রহ কর।”

“স্কন্দ ইন্দ্রের বাক্য শ্রবণ করিয়া যথাবিধি তাহার পাণিপীড়ন করিলে মন্ত্রবেত্তা বৃহস্পতি জপ ও হোমক্রিয়া নির্ব্বাহ করিলেন। ব্রাহ্মণগণ যাঁহাকে ষষ্ঠী, সুখপ্ৰদা লক্ষ্মী, সিনীবালী, অপরাজিতা ও কুহু বলিয়া নির্দেশ করেন, সেই দেবসেনা স্কন্দের মহিষী৷ হইলেন। যখন দেবসেনা সনাতন স্কন্দদেবের প্রণয়িনী পদে অধিষ্ঠিত হইলেন, তখন স্বয়ং লক্ষ্মী দেবী মূর্ত্তিমতী হইয়া তাঁহাকে আশ্রয় করিলেন। ভগবান কার্ত্তিকেয় পঞ্চমীতে লক্ষ্মীর সহিত সম্মিলিত হইয়াছিলেন, এই জন্য ঐ তিথি শ্ৰীপঞ্চমী এবং ষষ্ঠীতে তাঁহার প্রয়োজন-সকল সুসম্পন্ন হইয়াছিল, এই নিমিত্ত ষষ্ঠী মহাতিথি বলিয়া প্ৰসিদ্ধ হইল।”