২৩৬. দুৰ্য্যোধনের প্রতি কৰ্ণ, শকুনির আস্বস্তি আশংকা

২৩৬তম অধ্যায়

দুৰ্য্যোধনের প্রতি কৰ্ণ, শকুনির আস্বস্তি আশংকা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! দুষ্টমতি শকুনি রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বাক্য শ্রবণ করিয়া কর্ণের সহিত দুৰ্য্যোধনসমীপে সমুপস্থিত হইয়া অবসরক্ৰমে কহিলেন, “মহারাজ! তুমি মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডবগণকে প্রব্রাজিত করিয়াছি; এক্ষণে দেবরাজের ন্যায় একাকী এই সাম্রাজ্য ভোগ কর। এক্ষণে সকল ভূপালই তোমার নিকট করপ্রদ হইয়াছেন এবং তুমিও পাণ্ডবগণের পূর্ব্বপ্রণয়িনী লক্ষ্মীকে ভ্রাতৃবর্গের সহিত সম্যকরূপে অধিকার করিয়াছ। আমরা পূর্ব্বে ইন্দ্রপ্রস্থে গমন করিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরের যেরূপ সমৃদ্ধি দেখিয়াছিলাম, এক্ষণে তোমারও তদ্রূপ অবলোকন করিতেছি।

“তুমি স্বীয় বুদ্ধিবলে রাজা যুধিষ্ঠির হইতে রাজলক্ষ্মী আত্মসাৎ করিয়াছ, এক্ষণে অতি অল্প দিবস হইল, তোমার বিপক্ষেরা ক্লেশে সময় অতিবাহিত করিতেছে; সুতরাং তোমার সুখসম্ভোগাভিলাষ চরিতার্থ করিবার বিলক্ষণ অবকাশ রহিয়াছে। আর অন্যান্য রাজারাও তোমার নির্দেশ প্রতিপালন করিবার নিমিত্ত নরিন্তর উন্মুখ হইয়া আছেন। গ্রাম, নগর ও আকারে পরিপূর্ণ, শৈলকাননোপশোভিত এই সসাগরা ধরাও তোমার সম্পূর্ণরূপে অধিকৃত হইয়াছে।

“হে কুরুশ্রেষ্ঠ! এক্ষণে তুমি ব্রাহ্মণগণকর্ত্তৃক স্তূয়মান ও ভূপালবৰ্গকর্ত্তৃক পূজ্যমান হইয়া সুখে কালাতিপাত করিতেছ। যেমন রশ্মিমালী সূৰ্য্য স্বর্গে দেবতাদিগের মধ্যে দীপ্তি পান, তদ্রূপ তুমি স্বীয় পৌরুষপ্রভাবে এই ধরাতলে দেদীপ্যমান হইতেছে। দ্বাদশ-রুদ্রপরিবেষ্টিত গন্ধর্ব্বরাজ ও দেবগণপরিবৃত দেবরাজের ন্যায় তুমি কৌরববৰ্গ-পরিবেষ্টিত হইয়া সাতিশয় বিরাজমান হইতেছ। যাহারা তোমার আদেশপালনে অনাদর প্রদর্শন করিয়া থাকে, আমরা সেই অরণ্যবাসী পাণ্ডবদিগকে শ্ৰীহীন দেখিব, সন্দেহ নাই। শুনিতে পাই, এক্ষণে তাহারা বনবাসী ব্রাহ্মণগণের সহিত দ্বৈতবনে এক সরোবর-সন্নিধানে বাস করিতেছে। অতএব তুমি প্রচণ্ড দিবাকরের ন্যায় তেজঃপ্রভাবে তাহাদিগকে সমধিক সন্তপ্ত করিবার নিমিত্ত পরম শ্ৰীসম্পন্ন হইয়া তথায় গমন কর।

“হে কুরুশ্রেষ্ঠ!’ এক্ষণে তাহারা রাজ্যচ্যুত, শ্ৰীভ্রষ্ট ও অসমৃদ্ধ হইয়াছে, কিন্তু তুমি রাজ্যেশ্বর, শ্ৰীমান ও সুসমৃদ্ধ; সুতরাং এই অবসরেই তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করা তোমার সর্ব্বতোভাবে বিধেয়; তাহারা মহাভিজাত্যসম্পন্ন সকলমঙ্গলাস্পদ নহুষতনয় রাজা যযাতির ন্যায় তোমাকে সন্দর্শন করিবে। সুহৎ ও শত্ৰুগণ [সুহৃদের হর্ষ-শক্রর শোক] পুরুষের লক্ষ্মীকে প্রদীপ্ত দেখিলে তাহাদিগের হর্ষ ও শোকসাগর একেবারে উদ্বেল [বেলাভূমির অতিক্রমকারী] হইয়া উঠে। যেমন উত্ত্বঙ্গ শৈলশৃঙ্গারোহী ব্যক্তি জগতীস্থ সমস্ত বস্তুই অধীন ও নীচ বোধ করে, ক্ষেমাস্পদ ব্যক্তি একান্ত দুর্দ্দশাগ্ৰস্ত শক্রগণকে তদ্রূপ বোধ করিয়া থাকে। হে মহারাজ! ইহা অপেক্ষা সুখের বিষয় আর কি আছে?

“পুত্র, ধন ও রাজ্য লাভ করিলে যেরূপ প্রীতিলাভ হয়, শত্রুদিগের দুঃখ-দর্শনে তদপেক্ষা সমধিক প্রীতিলাভ হইয়া থাকে। তুমি সফলকাম হইয়া বল্কলাজিনধারী ধনঞ্জয়কে আশ্রমস্থ দেখিয়া সন্তুষ্ট হইবে এবং দিব্যাম্বরবিভূষিত তোমার প্রিয়তমা-সকল বল্কলাজিন-সংবৃতা একান্ত দুঃখিত দ্রৌপদীর সহিত সাক্ষাৎ করিলে সে ইহাদিগকে দেখিয়া নিতান্ত নির্ব্বেদগ্ৰস্ত হইয়া ধনহীন জীবন ও আপনার নিন্দা করিবে। অধিক কি, সে সভামধ্যে তাদৃশ অপমান সহ্য করিয়া যেরূপ বিমনাঃ হইয়াছিল, তোমার প্রিয়তমাদিগকে অলঙ্কৃতা অবলোকন করিয়া অদপেক্ষা সমধিক বিমনাঃ হইবে, সন্দেহ নাই।” কর্ণ ও শকুনি রাজা দুৰ্য্যোধনকে এইরূপ কহিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন।