২৪৮. যুদ্ধে পরাজয়ে দুর্য্যোধনের মর্ম্মান্তিক খেদ

২৪৮তম অধ্যায়

যুদ্ধে পরাজয়ে দুর্য্যোধনের মর্ম্মান্তিক খেদ

দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে কর্ণ। তখন মহাবীর অর্জ্জুন গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ৰসেনের সহিত সমাগত হইয়া সহাস্য-মুখে কহিলেন, সখে! তুমি এক্ষণে আমার ভ্রাতৃগণকে পরিত্যাগ কর; আমরা জীবিত থাকিতে উহাদিগের এইরূপ অবমাননা নিতান্ত অযোগ্য হইতেছে।” আমরা যে প্রকার অভিসন্ধি করিয়া নগর হইতে নিৰ্গত আদ্যোপান্ত সমস্তই অর্জ্জুনের কর্ণগোচর করিলেন। আমি তৎকালে নিতান্ত লজ্জিত হইয়া মনে করিলাম, ভগবতী বসুন্ধরা বিদীর্ণ হইলে এখনই ইহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করি।

“অনন্তর গন্ধর্ব্বেরা পাণ্ডবগণের সহিত ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট উপস্থিত হইয়া আমাদিগের দুৰ্ম্মন্ত্রণা ও বন্ধনবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত সমস্তই নিবেদন করিল। হে কর্ণ। আমি প্রিয়াসমক্ষে বদ্ধ ও শক্রবশংবদ হইয়া রাজা যুধিষ্ঠিরের উপহারস্বরূপ হইলাম; ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি আছে? আমি যাহাদিগকে রাজ্য হইতে নিষ্কাশিত করিয়াছি এবং যাহারা আমার পরমশক্র, এক্ষণে তাহারাই আমার বন্ধনমোচন ও জীবন প্রদান করিল। ফলতঃ এইরূপ অপমান সহ্য করিয়া জীবনধারণ করা অপেক্ষা যদি রণক্ষেত্রে বিপক্ষহস্তে আমার মৃত্যু হইত, তাহা হইলে মঙ্গলের বিষয় হইত। কারণ, গন্ধর্ব্বহস্তে মৃত্যু হইলে ভূমণ্ডলে আমার প্রভূত যশোরাশি বিস্তীর্ণ হইত এবং আমিও ইন্দ্রসদনে অক্ষয় পুণ্যলোক লাভ করিতাম। এক্ষণে আমি যেরূপ কর্ত্তব্য অবধারণা করিয়াছি, শ্রবণ কর।

দুৰ্য্যোধনের প্রাণত্যাগে সংকল্প

“অদ্য তোমরা আমার দুঃশাসন প্রভৃতি ভ্রাতৃগণ ও বন্ধুবান্ধবদিগের সহিত নগরে প্রতিগমন কর। আমি এই স্থানেই প্ৰায়োপবেশন করিব। শক্ৰকৃত অপমান সহ্য করিয়া আর পুরপ্রবেশ করিব না। পূর্ব্বে আমি শক্রগণের মাননাশ ও সুহৃজ্জনের মানবৰ্দ্ধন করিতাম, আজি সুহৃদগণের শোক ও শত্রুপক্ষের হর্ষবৰ্দ্ধন করিয়া বারণাবতনগর অভিগমনপূর্ব্বক মহারাজকে কি বলিব? আর ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিদুর, বাহ্লিক, সঞ্জয় ও সোমদত্ত প্রভৃতি অন্যান্য বৃদ্ধ-সম্মত ব্যক্তি, প্রধান প্রধান শিল্পী, ব্ৰাহ্মণ এবং উদাসীনেরাই বা আমাকে কি বলিবেন এবং আমিই বা তাঁহাদিগকে কি প্রত্যুত্তর প্রদান করিব? আমি শক্রগণের মস্তকে অবস্থান ও বক্ষস্থলে বিক্রম প্রকাশ করিয়া আত্মদোষে স্থানভ্রষ্ট হইয়াছি, এই কথা এক্ষণে তাঁহাদিগের নিকট কিরূপে কহিব?

“দুর্ব্বিনীত ব্যক্তি শ্ৰী, বিদ্যা ও ঐশ্বৰ্য্য লাভ করিয়া কখন নিরবচ্ছিন্ন সুখস্বচ্ছন্দে নিরাপদে কালযাপন করিতে পারে না। দেখ, বলগর্ব্বিত হইয়া আমার কি দশা ঘটিয়াছে। আমি মোহাবিষ্ট হইয়া এইরূপ অন্যায় গর্হিত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলাম বলিয়া এক্ষণে বিষম সঙ্কটে নিপতিত হইয়াছি; অতএব আমি প্ৰায়োপবেশন করিব, আমার জীবনধারণে আর প্রয়োজন নাই। আমি বিপৎকালে শত্রুকর্ত্তৃক উদ্ধৃত, উপহাসিত ও যেরূপ অপমানিত হইয়াছি, তাহাতে ক্ষণমাত্ৰও জীবনধারণ করিতে অণুমাত্র অভিলাষ করি না।”

এইরূপে দুৰ্য্যোধন চিন্তাসাগরে একান্ত নিমগ্ন হইয়া দুঃশাসনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে দুঃশাসন! আমি সুপ্ৰণালীক্ৰমে কর্ণসৌবলপালিতা পৃথিবী শাসন কর। দেবরাজ ইন্দ্র যেমন দেবগণকে প্রতিপালন করিয়া থাকেন, তদ্রূপ তুমিও ভ্ৰাতৃগণকে বিশ্বাস্তচিত্তে পালন কর। বন্ধুবৰ্গ তোমাকে আশ্রয় করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করুক; তুমিই তাহাদিগের একমাত্ৰ গতি। তুমি অপ্ৰমত্তচিত্তে বিপ্ৰগণের সহিত সদ্বব্যহার করিবে। যাদৃশ ভগবান বিষ্ণু দেবগণকে প্রীত করিয়া থাকেন, তদ্রূপ তুমিও জ্ঞাতিবর্গের প্রতি প্রতিভাব রাখিবে, গুরুলোকদিগকে পালন করিবে। এক্ষণে তুমি সুহৃদগণের মানবৰ্দ্ধন ও শত্রুদিগকে ভৎসনা করিয়া পৃথিবী পালন কর।” এই বলিয়া রাজা দুৰ্য্যোধন দুঃশাসনকে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, “তুমি অবিলম্বেই পরমসুখে স্বনগরাভিমুখে গমন কর।”

অনন্তর দুঃশাসন অতি দীনমনে, গলদশ্রনয়নে ও গদগদ বচনে ‘মহারাজ! প্ৰসন্ন হউন” বলিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে প্ৰণিপাত করিলেন এবং একান্ত দুঃখিত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। তাঁহার নেত্র হইতে অনর্গল অশ্রুজল বিগলিত হইয়া দুৰ্য্যোধনের চরণযুগল অভিষিক্ত করিল। পরে ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আপনি যেরূপ কহিতেছেন, ইহা কদাচ হইবে না। যদি সমুদয় ভূমি বিদীর্ণ ও নভোমণ্ডল খণ্ড খণ্ড হয়, যদি দিবাকর প্রখর প্রভা, চন্দ্ৰমা শীতাংশুতা ও হুতাশন উত্তাপ পরিত্যাগ করেন, যদি সমীরণ শীঘ্ৰগামিতাবিরহিত, হিমাচল ইতস্ততঃ সঞ্চালিত ও সাগরবারি-সমুদয় শুষ্ক হইয়া যায়, তথাপি আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া কদাচ রাজ্যশাসন করিব না। হে মহারাজ! আপনিই আমাদিগের বংশে শত বৎসর রাজ্যপালন করিবেন।” দুঃশাসন এই বলিয়া জ্যেষ্ঠভ্রাতার চরণ স্পর্শ পূর্ব্বক, করুণস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন।

মহাবীর কর্ণ দুৰ্য্যোধন ও দুঃশাসনকে নিতান্ত দুঃখিত দেখিয়া ব্যথিত-মনে কহিলেন, “কৌরব! তোমরা অজ্ঞানবশতঃ প্রাকৃত লোকের ন্যায় কেন বিষন্ন হইতেছ? নিরন্তর শোকাভিভূত ব্যক্তির শোক কদাচ অপনীত হয় না। যখন শোক হইতেই ব্যাসন উপস্থিত হইতেছে, তখন তোমরা শোক করিয়া কি বিশেষ ফললাভ করিবে? অতএব এক্ষণে ধৈৰ্য্যাবলম্বন কর। শোকাকুল হইয়া শত্ৰুগণকে আনন্দিত করিও না। পাণ্ডবেরা যে তোমাকে বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়াছে, বিবেচনা করিলে তাহা তাহাদিগের নিতান্ত কর্ত্তব্য বলিয়াই বোধ হইবে, সন্দেহ নাই। কেন না, তাহারা তোমার আশ্রয়ে প্রতিপালিত হইয়া পরমসুখে বাস করিতেছে। ইহা প্ৰসিদ্ধই আছে যে, রাজ্যান্তর্ব্বাসী ব্যক্তিরা প্রতিনিয়তই রাজার প্রিয়কাৰ্য্যসাধন করিয়া থাকে। অতএব তন্নিমিত্ত সামান্য লোকের ন্যায় বৃথা শোক করা নিতান্ত অবিধেয়। তুমি প্রয়োপবেশন করিবে বলিয়া তোমার সহোদরেরা একান্ত বিষন্ন হইতেছে। এক্ষণে তুমিই উহাদিগকে আশ্বাসিত করিয়া পুনরায় নগরে গমন কর।”