২৩৯. মৃগয়ারত দুৰ্য্যোধনের প্রতি গন্ধর্ব্বরোষ

২৩৯তম অধ্যায়

মৃগয়ারত দুৰ্য্যোধনের প্রতি গন্ধর্ব্বরোষ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন বহুতর অরণ্য অতিক্রম করিয়া পরিশেষে আভীরপল্লীতে সমুপস্থিত হইলেন। তথায় পরিচারকদিগকে আদেশ করিবামাত্র তাহারা ছায়াবহুল মহীরুহ সম্পন্ন প্রসন্নসলিলযুক্ত ও সর্ব্বগুণোপেত প্রদেশে দুৰ্য্যোধনের গৃহ নির্ম্মাণ করিতে লাগিল এবং তাঁহারই গৃহ-সন্নিধানে শকুনি, কর্ণ ও রাজসহোদরদিগের পৃথক পৃথক গৃহ প্রস্তুত করিল।

দুৰ্য্যোধন তথায় বাস করিয়া শতসহস্ৰ গো সন্দর্শনপূর্ব্বক গণনা ও চিহ্নদ্বারা তাহাদিগকে সম্যক বিদিত হইলেন। পরে বৎসসকলকে যথাক্রমে অঙ্কিত করিয়া তাঁহাদিগকে দমনক [বন্ধনাদিদ্বারা দমনযোগ্য] বলিয়া নির্দেশপূর্ব্বক বালবৎসা ধেনু-সকলকেও গণনা করিলেন। অনন্তর ত্ৰিবৰ্ষবয়স্ক বৃষদিগের সংখ্যা-নিরূপণ এবং তৎসমুদয় অঙ্কিত করিয়া গোপালগণের সমভিব্যাহারে পর্য্যটন করিতে লাগিলেন। পৌরজন ও বহুসংখ্যক সৈন্যগণ অমরসমূহের ন্যায় স্বেচ্ছানুসারে তথায় বাস করিতে লাগিল। তখন নৃত্যগীতবাদ্যানুরক্ত গোপ ও গোপাঙ্গনীগণ বিবিধ অলঙ্কার পরিধান করিয়া দুৰ্য্যোধনের নিকট উপনীত হইল। দুৰ্য্যোধন অঙ্গ নাগণপরিবৃত হইয়া হৃষ্টান্তঃকরণে তাহাদিগকে বহুবিধ অন্ন ও পানীয় প্রদানপূর্ব্বক প্রার্থনাধিক অর্থ দান করিলেন।

অনন্তর তাঁহারা মৃগয়ার্থ নিৰ্গত হইয়া মৃগ, মহিষ, বরাহ, গবয় ও ভলুকদিগের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন। রাজা দুৰ্য্যোধন বহুসংখ্যক বন্য-মাতঙ্গগণকে নিশিত শরদ্বারা ছিন্ন-ভিন্ন করিয়া রমণীয় প্রদেশে মৃগয়া করিতে লাগিলেন। পরে গোরস [দুগ্ধ] পান ও অন্যান্য মাংস উপযোগ করিয়া মত্ত-মধুকরসেবিত, ময়ূরগণের কেকারবিমুখরিত, পরমরমণীয় বন ও উপবন-সকল অবলোকনপূর্ব্বক সপ্তচ্ছদ, পুন্নাগ ও বকুলসমাকীর্ণ অতিপবিত্র দ্বৈতবণ-নামক সরোবরে উপস্থিত হইলেন। রাজা যুধিষ্ঠির যদৃচ্ছাক্রমে ঐ সরোবরের চতুস্পার্শ্বে গৃহ নির্ম্মাণপূর্ব্বক ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্রের ন্যায় পরম-সমৃদ্ধিসম্পন্ন হইয়া সহধর্ম্মিণী দ্রৌপদীর সহিত একদিবসসাধ্য যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন।

রাজা দুৰ্য্যোধন ঐ সরোবরের একপার্শ্বে ক্রীড়ানিবাস পস্তুত করিবার নিমিত্ত শতসহস্র পরিচারকদিগকে আদেশ করিলেন। তাহারা রাজাজ্ঞা প্ৰাপ্তিমাত্র সরোবরের অভিমুখে ধাবমান হইল। পূর্ব্বে গন্ধর্ব্বরাজ স্বীয় সন্তানগণ, অপ্সরাগণ ও দেববৃন্দে পরিবৃত হইয়া অলকা হইতে আগমনপূর্ব্বক তথায় বিহার করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত ঐ সরোবর সমাবৃত ছিল। রাজপরিচারকেরা তথায় উপস্থিত হইলে দ্বারপালগণ তাহাদিগকে নিবারণ করিল। তখন ভৃত্যগণ তথা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া ভূপালসন্নিধানে আদ্যোপান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলে রাজা দুৰ্য্যোধন ঐ অপ্ৰিয়বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র শীঘ্ৰ গিয়া গন্ধর্ব্বদিগকে অপসারিত কর’, এইরূপ আদেশ প্রদান করিয়া যুদ্ধদুর্ম্মদ সৈন্যগণকে প্রেরণ করিলেন।

অনন্তর সেনানায়কেরা রাজার নির্দেশানুসারে সেই সরোবর-সন্নিধানে গমন করিয়া গন্ধৰ্ব্বগণকে কহিল, “হে গন্ধর্ব্বগণ! মহাবলপরাক্রান্ত ধৃতরাষ্ট্রতনয় রাজা দুর্য্যোধন বিহার করিবার নিমিত্ত এই স্থানে আগমন করিতেছেন, অতএব তোমরা সত্বর অপসৃত হও।” গন্ধর্ব্বেরা এই কথা শ্রবণ করিয়া হাস্যমুখে অতি কঠোরবাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক কহিলেন, “রে মূঢ় সৈন্যগণ! তোদের রাজা দুৰ্য্যোধন নিতান্ত মন্দবুদ্ধি, অদ্যাপি তাহার চেতনা হয় নাই; কেন না, যেমন দেবগণ বৈশ্যদিগকে আজ্ঞা করিয়া থাকেন, তদ্রূপ সেও আমাদিগকে আজ্ঞা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। তোদেরও মৃত্যু নিতান্ত সন্নিকট। কারণ, তোরা তাহারই নির্দেশানুসারে আমাদিগকে এইরূপ কহিতেছিস। অতএব এ স্থান হইতে পলায়ন কর, নচেৎ অদ্যই শমন-সদনে গমন করিবি।” তখন সেনানায়কেরা গন্ধৰ্ব্বগণের এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র অতিমাত্র বেগে ধাৰ্ত্তরাষ্ট্রসন্নিধানে গমন করিল।