২০২. বিষ্ণুনাভিপদ্মে ব্ৰহ্মার উৎপত্তি

২০২তম অধ্যায়

বিষ্ণুনাভিপদ্মে ব্ৰহ্মার উৎপত্তি

“অপরাজিত রাজর্ষি বৃহদশ্ব উতঙ্কের বাক্য-শ্রবণানন্তর কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “ভগবন! আমি অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করিয়াছি, অতএব আমাকে বিদায় করুন, আপনার আগমন কখনও বিফল হইবে না। আমার পুত্ৰ মহাবীর কুবলাশ্ব মহাভুজ পুত্ৰগণসমভিব্যাহারে আপনার অভিলষিত কাৰ্য্য সম্পাদন করিবে।” মহর্ষি উতঙ্ক ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাহার বাক্যে অনুমোদন করিলে তিনি পুত্রকে মাহাত্মা উতঙ্কের প্রিয়কার্য্য সম্পাদন করিতে অনুমতি প্ৰদান করিয়া অরণ্যে গমন করিলেন।”

রাজা যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবান! এই মহাবীৰ্য্য দৈত্য কে, কাহার পুত্র ও কাহার পৌত্র, ইহা জানিবার নিমিত্ত কৌতুহল জন্মিতেছে। আমি কখন ঈদৃশ বলবান দৈত্যের কথা শ্রবণ করি নাই; অতএব আপনি ইহার যথাভূত বৃত্তান্ত বিবৃত করিয়া বলুন।”

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! শ্রবণ করুন। সমুদয় চরাচর প্রলয়পয়োধি জলে বিলীন হইলে সর্ব্বলোকেশ্বর ভগবান বিষ্ণু সলিলরাশিমধ্যে শেষভুজঙ্গভোগে [অনন্তনাগের ফণায়] শয়নপূর্ব্বক যোগনিদ্রায় নিদ্রিত হইয়াছিলেন। তৎকালে এই ভূমণ্ডল তাঁহার শয়নভূত ভুজঙ্গভোগে সংসাক্ত ছিল। তিনি নিদ্রিত হইলে তাঁহার নাভিদেশে সূৰ্য্যসদৃশ প্রভাসম্পন্ন এক পদ্ম বিনির্গত হইল। তাঁহাতে বেদচতুষ্টয়, মূর্ত্তিচতুষ্টয় ও মুখচতুষ্টয়সম্পন্ন সাক্ষাৎ লোকগুরু পিতামহ সমুৎপন্ন হইলেন।

মধুকৈটভবধ-বৃত্তান্ত

“ব্ৰহ্মার জন্মগ্রহণের কিয়ৎকাল পরে মহাবলপরাক্রান্ত মধু ও কৈটভ নামে দানবদ্বীয় ভগবান বিষ্ণুকে বহুযোজন-বিস্তৃত ফণিফণায় শয়ান, কিরীটিকৌস্তভধারী, পীতকাষেয়বাসা ও সহস্ৰসূৰ্য্যসদৃশ দীপ্যমান দৃষ্টিগোচর করিয়া বিস্ময়সাগরে নিমগ্ন হইল এবং তাঁহার নাভিকমলে স্থিত কমললোচন কমলযোনিকে ভয়প্রদর্শন করিতে লাগিল। ব্ৰহ্মা অসুরভয়ে ভীত হইয়া যোগনিদ্রাভিভূত ভগবান বিষ্ণুর নাভিবিনিঃসৃত পদ্মনাল কম্পিত করিতে আরম্ভ করিলে তিনি প্ৰবোধিত হইলেন এবং বলবান দানবদ্বয়কে অবলোকন করিয়া তাহাদিগকে স্বাগত—জিজ্ঞাসানন্তর কহিলেন, “হে দানবদ্বয়! তোমাদিগের প্রতি গ্ৰীত হইয়াছি; অতএব তোমরা বর গ্রহণ কর।”

“তাহারা সহাস্যমুখে কহিল, ‘হে সুরোত্তম! আরা উভয়ে বরদাতা; অতএব তুমি কোন বিচার না করিয়া অবিলম্বে আমাদের নিকট বর প্রার্থনা কর।’

“ভগবান কহিলেন, ‘তোমরা অসামান্যবীর্য্যসম্পন্ন, তোমাদের সমান পৌরুষশালী আর কেহই নাই, অতএব আমি লোকহিতার্থী হইয়া তোমাদিগের নিকট এই বর প্রার্থনা করিতেছি। যে, আমি যেন তোমাদিগকে বধ করিতে সমর্থ হই।”

“মধুকৈটভ কহিল, “হে পুরুষোত্তম! আমরা সত্য ও ধর্ম্মের নিতান্ত অনুরক্ত; বল, শম, ধর্ম্ম, তপস্যা, চরিত্র ও দমে আমাদিগের সমান কেহ নাই। পূর্ব্বে আমরা স্বেচ্ছাচারসময়েও মিথ্যা কহি নাই; অতএব এক্ষণে কি নিমিত্ত অন্যথা করিব? কিন্তু মহৎ গোলযোগ উপস্থিত হইল, তুমি যাহা কহিলে, তাহা প্রতিপালন করা অত্যন্ত কঠিন; কারণ, আমরা পূর্ব্বে তোমাকে এই বর প্রদান করিয়াছিলাম যে, তুমি আমাদিগকে অনাবৃত আকাশে বধ করিবে এবং আমরা তোমার পুত্ৰ হইব। তুমি এক্ষণে তাহার প্রতিকার কর, আমরা যাহা প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহার যেন অন্যথা না হয়।’

“অনন্তর ভগবান বিষ্ণু ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাহাদিগের অভিলাষ পরিপূর্ণ করিতে অঙ্গীকার করিলেন এবং ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া যখন দেখিলেন, কি আকাশ, কি পৃথিবী কুত্ৰাপি অনাবৃত স্থান নাই, তখন স্বকীয় অনাবৃত উরুদেশে নিশিতধার চক্রদ্বারা মধুকৈটভের শিরশেছদন করিলেন।”