২০৬. কৌশিকের ধর্ম্মব্যাধসমীপে গমন

২০৬তম অধ্যায়

কৌশিকের ধর্ম্মব্যাধসমীপে গমন

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “রাজন! দ্বিজোত্তম কৌশিক সেই পতিব্ৰতাকথিত আশ্চৰ্য্য বৃত্তান্ত চিন্তা করিয়া আপনাকে নিতান্ত ঘৃণিত ও অপরাধিবৎ বোধ করিতে লাগিলেন। তিনি যখন চিন্তা করিয়াও স্বধর্ম্মের সূক্ষ্মতম গতি বোধগম্য করিতে অসমর্থ হইলেন, তখন স্থির করিলেন যে, মিথিলাতে যে ধর্ম্মব্যাধ বাস করে, ধর্ম্মজিজ্ঞাসার নিমিত্ত তাহার সমীপেই গমন করি। মহাত্মা কৌশিক মনে মনে সেই পতিব্ৰতাকথিত অগোচর সম্পন্ন বলাকাবৃত্তান্ত ও ধর্ম্মসংক্রান্ত বিবিধ বাক্য চিন্তা করিতে করিতে ভূরি ভূরি অরণ্য, গ্রাম ও নগর অতিক্রম করিয়া মিথিলা নগরে উপস্থিত হইলেন। তিনি সেই জনক-পরিপালিত পুরীতে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, কোন স্থানে বিমান-সকল শোভা পাইতেছে; স্থানে স্থানে প্রশস্ত রথ্যা প্ৰণালীক্ৰমে সুচারুরূপে নির্ম্মিত হইয়াছে; কোন স্থানে অশ্ব, কোন স্থানে রথ, কোন স্থানে অন্যান্য যান সকল শোভমান হইতেছে; কোন স্থানে বা যোদ্ধৃগণ ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতেছে। সমুদয় স্থানই উৎসবানন্দে পরিপূর্ণ। সমুদয় লোকই হৃষ্টপুষ্ট, নগরের চতুর্দ্দিকই ধর্ম্মালয়, যজ্ঞোৎসব ও সুরম্য হম্ম্য-সমূহে পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে।

“ব্রাহ্মণ এবম্প্রকার বহুসমৃদ্ধিশালী স্থান-সকল অতিক্রম করিয়া ধর্ম্মব্যাধের বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করাতে তত্ৰত্য দ্বিজগণ তাঁহাকে সকল বৃত্তান্ত কহিলেন, তিনি তদনুসারে তথায় গমনপূর্ব্বক দেখিলেন, তপস্বী ব্যাধ সূনা [বধ্যভূমি—পশুবধিস্থান] মধ্যে আসীন হইয়া মৃগ ও মহিষের মাংস বিক্রয় করিতেছে।

ধর্ম্মব্যাধের ধর্ম্মব্যাখ্যা

“মহাত্মা কৌশিক সেই স্থানে ক্রেতৃজনসংবাধ [জনতা] অবলোকন করিয়া একান্তে দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন। ব্যাধ ব্ৰাহ্মণের আগমনবৃত্তান্ত মনে মনে অবগত হইয়া সহসা সম্ভ্রমসহকারে উত্থানপূর্ব্বক তাহার নিকটে গমন করিয়া কহিল, “হে দ্বিজোত্তম! আমি আপনাকে অভিবাদন করি, আপনার ত’ সকল কুশল? হে বিপ্ৰ! এই ব্যাধকে কি করিতে হইবে, আদেশ করুন। সেই পতিব্ৰতা রমণী আপনাকে মিথিলায় আগমন করিতে কহিয়াছেন, আপনি যে নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন, আমি তৎসমুদয় অবগত আছি।”

“কৌশিক প্রথমে ব্যাধের সম্ভাষণমাত্রেই বিস্মিত হইয়াছিলেন; এক্ষণে আবার তাহার মুখ হইতে আপনার গৃঢ় অভিপ্ৰায় প্রকাশ হইল দেখিয়া সমধিক বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। অনন্তর ব্যাধ কহিল, ভগবান! এই দেশ আপনার অপরিচিত, অতএব যদি আপনার ইচ্ছা হয়, তবে চলুন, গৃহে গমন করি।” ব্রাহ্মণ ধর্ম্মব্যাধের বাক্য অনুমোদন করিলে সে পরমহ্লাদপূর্ব্বক ব্ৰাহ্মণকে অগ্রসর করিয়া আপন আলয়ে গমন করিল। ব্ৰাহ্মণ তাহার রমণীয় গৃহে প্রবেশ এবং আসন, পাদ্য, আচমনীয় গ্রহণপূর্ব্বক সুখোপবিষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘তাঁত! এই মাংসবিক্রয়কর্ম্ম তোমার নিতান্ত অযোগ্য বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। বলিতে কি, আমি তোমার এই বিসদৃশ ব্যাপার নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত অনুতাপিত হইয়াছি।”

“ব্যাধ কহিল, “হে দ্বিজবর! আমি স্বীয় ধর্ম্মানুসারে পূর্ব্বপুরুষপরম্পরাগত কুলোচিত কর্ম্মই অনুষ্ঠান করিয়া থাকি; অতএব আপনি জাতক্ৰোধ হইবেন না। আমি বিধিবিহিত কর্ম্মের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক বৃদ্ধ ও গুরুজনদিগকে সর্ব্বপ্রযত্নে সেবা করিয়া থাকি, সত্যবাক্য ব্যবহার করি, কাহারও প্রতি অসূয়া প্রদর্শন করি না, যথাসাধ্য দান করি; দেবতা, অতিথি ও ভৃত্যগণের ভুক্তশেষ ভোজন করিয়া থাকি, কাহারও কখন কিঞ্চিন্মাত্র কুৎসা বা নিন্দা করি না। হে দ্বিজোত্তম! পূর্ব্বকৃত কর্ম্মকর্ত্তার অনুগমন করে, তদনুসারে কৃষি, গোরক্ষণ, বাণিজ্য, দণ্ডনীতি ও ত্রয়ী পভৃতি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায় ভিন্ন ভিন্ন লোকের উপজীবিকা হইয়া উঠে। শূদ্রের কর্ম্ম সেবা, বৈশ্যের কৃষি, ক্ষত্ৰিয়ের সংগ্রাম ও ব্রাহ্মণের ব্রহ্মচৰ্য্য, তপস্যা, মন্ত্র ও সত্য। রাজা স্বকর্ম্মানুগত প্ৰজাগণকে ধর্ম্মানুসারে শাসন করেন এবং কর্ম্মচ্যুত ব্যক্তিগণকে স্ব স্ব কর্ম্মে নিযুক্ত করেন। সর্ব্বদা নৃপতিগণকে ভয় করিবে, কারণ, তাহারা প্ৰজাগণের অধীশ্বর হইয়া শরনিবারিত মৃগের ন্যায় ধর্ম্মস্রষ্ট প্ৰজাগণকে কুকর্ম্ম হইতে নিবারিত করেন।

“হে দ্বিজোত্তম! এই জনকরাজ্যে এক ব্যক্তিও কুকর্মী নাই, চতুবিধ বর্ণই স্ব স্ব কর্ম্মের অনুষ্ঠানে অনুরক্ত। রাজা জনক আপনার পুত্ৰ দণ্ডার্হ হইলে তাহারও দণ্ডবিধান করিয়া থাকেন। তিনি কদাচ ধার্ম্মিকের গ্লানি বা হানি করেন না। তিনি শ্ৰী, রাজ্য ও দণ্ড প্রভৃতি সমুদয় রাজকাৰ্য্যই আচার, ব্যবহার ও ধর্ম্মানুসারে পৰ্য্যবেক্ষণ করিয়া থাকেন। সকল রাজারাই স্বীয় ধর্ম্মানুসারে উন্নতি বাসনা করেন এবং সমুদয় বৰ্ণকে প্রতিপালনপূর্ব্বক কালব্যাপন করিয়া থাকেন।

“হে ব্ৰহ্মন! আমি স্বয়ং পশুহত্যা করি না; অন্যের হত বরাহ ও মহিষের মাংস সর্ব্বদা বিক্রয় করিয়া থাকি। আমি মাংস ভোজন করি না; শাস্ত্ৰবিহিত নিয়মানুসারে স্ত্রীসহবাস ও সমস্ত দিন উপবাসী থাকিয়া রাত্ৰিতে ভোজন করি। যে ব্যক্তি এইরূপ নিয়মানুষ্ঠান করে, সে কদাচার হইলেও ক্রমে ক্ৰমে সদাচার হইয়া উঠে।

“নরেন্দ্রগণের অত্যাচারবশতঃ মহান ধর্ম্ম সঙ্কীর্ণ হয়, অধর্ম্ম উৎপন্ন হয়, পরিশেষে প্ৰজাগণও সঙ্করদোষে দূষিত হয় এবং রাজ্যমধ্যে ভীষণাকৃতি, বামন, কুব্জ, স্কুলমস্তক, ক্লীব, অন্ধ, বধির ও স্তব্ধলোচন মানবগণ উৎপন্ন হয়। ফলতঃ পার্থিবগণের অধর্ম্মই প্ৰজাগণের বিনাশের মূল। রাজা জনক সর্ব্বদা স্বধর্ম্মানুগত হইয়া অনুগ্রহসহকারে ধর্ম্মানুসারে প্রজাগণের পর্যবেক্ষণ করিয়া থাকেন, এই নিমিত্ত তাঁহার রাজ্যও নিরাময়।

যাহারা আমাকে নিন্দা করে এবং যাহারা প্রশংসা করে, আমি বিনয়সম্পন্ন কর্ম্মদ্বারা তাঁহাদিগের সকলকেই পরিতুষ্ট করি। সতত সাধ্যানুসারে অন্নদান, তিতিক্ষা, ধর্ম্মনিত্যতা ও সকলকে সমুচিত প্ৰতিপূজা করি। ত্যাগই মনুষ্যগণের প্রধান কর্ম্ম। মিথ্যাবাক্য একেবারে পরিত্যাগ করিবে, অযাচিত হইয়াও অন্যের প্রিয়কাৰ্য্য সম্পাদন করিবে; কাম, ক্ৰোধ বা দ্বেষের বশীকৃত হইয়া ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিবে না। প্রিয়ঘটনায় অতিমাত্র হৃষ্ট হইবে না, অপ্ৰিয় ঘটিলেও একান্ত ম্রিয়মাণ হইবে না; অর্থকষ্ট উপস্থিত হইলে মুহ্যমান হইবে না এবং ধর্ম্মও পরিত্যাগ করিবে না। যদি কিঞ্চিৎ অপকর্ম্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাহা হইলে পুনরায় আর সে কর্ম্ম করিবে না। যাহা কল্যাণকর বোধ করিবে, তাহাতেই সতত অনুরক্ত থাকিবে, পাপীর প্রতি পাপাচরণ করিবে না; প্রত্যুত সর্ব্বদা সাধুই হইবে। যে ব্যক্তি পাপাচরণ করিতে ইচ্ছা করে, সে স্বতঃই বিনষ্ট হয়। পাপাত্মা অসাধুগণের এই প্রকার অসাধু আচরণ। যাহারা ধর্ম্ম নাই মনে করিয়া সাধুগণকে উপহাস ও ধর্ম্মের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে, তাহারা নিঃসন্দেহ বিনাশপ্ৰাপ্ত হয়।

“পাপাত্মা ব্যক্তি আধ্মাত ভস্ত্রার [ভস্ত্রায় বায়ুগ্রহণ ও নিঃসরণ জন্য উর্দ্ধাধঃ আকর্ষণ] ন্যায় বৃথা নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস পরিত্যাগ করিতেছে; অহঙ্কারী মূঢ়গণের চিন্তা নিতান্ত অসার। যেমন প্রভাকর দিবাভাগে রূপ-সকল প্রকাশিত করেন, সেইরূপ তাহাদিগের অন্তরাত্মাই কেবল তাহাদিগের রূপ আবিষ্কৃত করেন। মুখ ব্যক্তি কেবল আত্মশ্লাঘা-দোষে লোকের নিকট প্রভাহীন থাকে, কিন্তু কৃতবিদ্য ব্যক্তি ভ্ৰষ্টশ্রী হইলেও শোভমান হয়েন। অন্যের নিন্দা ও আত্মপ্রশংসা না করেন, এমন গুণসম্পন্ন লোক এই জগতীতলে অতি দুর্লভ। কুকর্ম্ম করিয়া অনুতাপ করিলে পাপ হইতে মুক্ত হয় এবং “পুনরায় এতাদৃশ কর্ম্ম করিব না” বলিয়া নিশ্চয় করিয়া কোনপ্রকার সৎকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে দ্বিতীয় পাপ হইতে মুক্ত হইয়া থাকে। ধর্ম্মবিষয়ে এই প্রকার শ্রুতি নয়নগোচর হয়।

“ধর্ম্মশীল ব্যক্তি অজ্ঞানবশতঃ পাপাচরণ করিলেও নিম্পাপ থাকিতে পারেন, কারণ, প্রমাদাবশতঃ যে পাপ অনুষ্ঠিত হয়, উপার্জ্জিত ধর্ম্ম হইতে তাহার বিনাশ হয়। পপকর্ম্ম করিয়া অস্বীকার করিলে স্বীয় অন্তরাত্মা ও দেবগণ তাহা দেখিতে পান। যিনি ধনাদি দানপূর্ব্বক সাধুগণের ন্যূনতা পরিহার করিয়াছেন এবং শ্রদ্ধান্বিত ও অসূয়াশূন্য হয়েন, তিনি আপনার মোক্ষের উপায় সঙ্কলন করেন। যে ব্যক্তি প্রথমে পাপাচরণ করে, সে যদি পুনরায় কল্যাণপথের পান্থ হয়, তাহা হইলে সে ব্যক্তি মহামেঘবিনিমুক্ত চন্দ্ৰমার ন্যায় সর্ব্বপাপ হইতে মুক্তিলাভ করে। যেমন আদিত্য উদিত হইয়া অন্ধকার বিনষ্ট করেন, সেইরূপ কল্যাণকর কর্ম্মসমুদয় পাপ বিনষ্ট করে।

“হে দ্বিজোত্তম! লোভই সমুদয় পাপের আশ্রয়; অনধীতশাস্ত্ৰ, অদূরদর্শী, লুব্ধ ব্যক্তিই পাপে অনুরক্ত হয়। অধার্ম্মিক ব্যক্তি তৃণাচ্ছাদিত কুপের ন্যায় কপট-ধর্ম্মরূপ আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত হইয়া থাকে, বাহ্যে তাহাদিগের পবিত্র, ভাব, দাম ও ধর্ম্মানুগত আলাপ, এ সকল দেখিতে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু শিষ্টাচার তাহাদিগের নিকট সুদূরপরাহত।

“মহাপ্ৰাজ্ঞ ব্রাহ্মণ ধর্ম্মব্যাধকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হে নরোত্তম! আমি কি প্রকারে শিষ্টাচার অভিজ্ঞতা লাভ করিতে পারি? হে ধার্ম্মিকশ্রেষ্ঠ। মহামতে! তোমার নিকট এই বিষয় সবিশেষ জানিবার নিমিত্ত আমার একান্ত ঔৎসুক্য জন্মিয়াছে, অতএব যথাযোগ্য বর্ণনা করিয়া পরিতৃপ্ত কর।’

“ব্যাধ কহিল, “হে দ্বিজোত্তম! যজ্ঞ, দান, তপস্যা, বেদ ও সত্য এই পাঁচটি পবিত্র বিষয় শিষ্টাচারের অঙ্গ। যাহারা কাম, ক্ৰোধ, দম্ভ, লোভ ও কপটতা বশীভুত করিয়া “ইহাই ধর্ম্ম।” এইরূপ বোধে সন্তুষ্ট থাকেন, তাঁহারাই শিষ্ট ও শিষ্টগণের সম্মত। সেই সকল স্বাধ্যায়সম্পন্ন ব্যক্তিগণ কখন স্বেচ্ছাচার করেন না। সদাচারসংরক্ষণই সেই সকল শিষ্টগণের অদ্বিতীয় লক্ষণ।

“আর গুরুশুশ্রূষা, সত্য, আক্ৰোধ, দান, এই চারিটি শিষ্টাচারের অঙ্গস্বরূপ। লোকে শিষ্টাচারে সম্পূর্ণরূপ মনোনিবেশ করিয়া যে-সকল আচারব্যবহারের অনুষ্ঠান করেন, তাহা সকলেরই গ্রাহ্য; কেহই অন্যথা করিতে পারে না। বেদের রহস্য সত্য; সত্যের রহস্য দম; দমের রহস্য ত্যাগ, এই সকল শিষ্টাচারের লক্ষণ; ফলতঃ ত্যাগ না থাকিলে দম থাকে না, দম না থাকিলে সত্য থাকে না, সত্যজ্ঞান না হইলে বেদ নিষ্ফল হয়।

‘যে-সকল মনুষ্য ভ্রান্তিবশতঃ ধর্ম্মের প্রতি অসূয়াপর হয়, তাহারা স্বয়ং অপথে পদার্পণ করে এবং যাহারা তাহাদের অনুগামী হয়, তাহারাও পীড্যমান হইতে থাকে। যাঁহারা সুসংযত, বেদানুরক্ত, দানপরায়ণ, ধর্ম্মপথের পান্থ ও সত্যধর্ম্মে সংসক্ত, তাঁহারাই শিষ্ট। শিষ্টাচারপরায়ণ ব্যক্তি বুদ্ধিকে সংযত করিয়া উপাধ্যায়ের মতানুবতী এবং ধর্ম্মার্থের পরিদর্শন হইয়া থাকেন।

‘নাস্তিক, অমৰ্য্যাকর, ক্রূর ও পাপমতিদিগকে পরিত্যাগ করুন, জ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করুন এবং ধার্ম্মিকগণের সেবা করুন। ধৈৰ্য্যময়ী নে কা অবলম্বন করিয়া কাম-ক্রোধরূপ যাদোগণসমাকীর্ণ পঞ্চেন্দ্ৰিয়রূপ সলিলে পরিপূর্ণ অতিদুৰ্গম জন্মনদী উত্তীর্ণ হউন। যেমন শুক্লবৰ্ণ বস্ত্র রঞ্জিত হইলে অপূর্ব্ব শ্ৰীধারণ করে, তদ্রূপ জ্ঞানযোগদ্বারা ক্ৰমে ক্রমে সঞ্চিতধর্ম্ম শিষ্টাচারে মিলিত হইলে পরামরমণীয় হইয়া উঠে।

‘অহিংসা ও সত্য-বচন সকল প্রাণীরই হিতকর, অহিংসা পরমধর্ম্ম, সেই অহিংসা সত্যেই প্রতিষ্ঠিত আছে। প্রবৃত্তিসকল সত্যসংসাক্ত হইলে বিচলিত হয় না, শিষ্টাচারসমন্বিত সত্যেরই অধিক গৌরব। সদাচারই সাধুগণের ধর্ম্ম ও সদাচারই সাধুগণের লক্ষণ।

‘যে জন্তুর যে প্রকার প্রকৃতি, সে তাঁহাই প্রাপ্ত হয়, অতএব পাপাত্মা ব্যক্তি কামক্রোধাদি দোষই প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে। ন্যায়ানুগত কাৰ্য্যই ধর্ম্ম ও অনাচারই অধর্ম্ম বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে। যাঁহাদিগের ক্ৰোধ নাই, অসূয়া নাই, অহঙ্কার নাই, মাৎসর্য্য নাই, কপটতা নাই ও যাঁহারা শান্তস্বভাব, যাঁহারা ত্ৰয়ী বিদ্যায় অভিজ্ঞ, শুদ্ধাচার, মনস্বী, গুরুশুশ্রীষায় নিযুক্ত ও দমপরায়ণ, তাঁহারাই শিষ্টাচারসম্পন্ন। যাঁহারা সত্যপরায়ণ, যাঁহাদিগের সদাচার অনন্যসাধারণ, যাঁহারা স্বকৃত সৎকর্ম্মদ্বারা সর্ব্বত্র সৎকৃত হয়েন, তাঁহাদিগের অন্তঃকরণ হইতে হিংসাদি দোষসকল তিরোহিত হয়। যে সকল মনীষী সাধুগণের আচরিত অনাদি অবিনশ্বর ধর্ম্মকে ধর্ম্ম বলিয়া বোধ করেন, তাঁহাদিগেরই স্বৰ্গলাভ হয়। আস্তিক, অভিমানশূন্য, বিপ্রসেবানিরত, শাস্ত্রাভিজ্ঞ ও সদাচারসম্পন্ন ব্যক্তিরাই স্বৰ্গে বাস করেন।

‘বেদোক্ত পরমধর্ম্ম, ধর্ম্মশাস্ত্রোক্ত ধর্ম্ম ও শিষ্টাচার এই তিনটি শিষ্টদিগের ধর্ম্ম। যাঁহাদিগের বিদ্যায় পারদর্শিতা, তীর্থে অবগাহন, ক্ষমা, সত্য, সরলতা, সদাচার-দর্শন, সর্ব্বভূতে দয়া, অহিংসা, অপারুষ্য, দ্বিজগণে প্রীতি, শুভাশুভকর্ম্মের পরিণামদর্শন থাকে, যাঁহারা ন্যায়ানুগত, গুণবান, সর্ব্বলোকহিতৈষী, শত্রুযোগসম্পন্ন [ইন্দ্রতুল্য গুণশালী] স্বৰ্গজিৎ, সৎপথাবলম্বী, দাতা, দীনানুগ্রহকারী, সকলের পূজনীয়, শাস্ত্ৰসম্পন্ন, তপস্বী ও সর্ব্বভূতে দয়াবান, তাঁহারাই শিষ্টসম্মত শিষ্ট। যাহারা দানপরায়ণ তাঁহারা ইহলোকে উন্নত ও পরলোকে সুখময় লোক প্রাপ্ত হয়েন। যাঁহারা কলাত্র ও ভূত্যের পীড়াতে সতত অবহিত থাকেন, সাধ্যাতীত দান করেন, সর্ব্বদা সাধুসঙ্গ করেন, লোকযাত্ৰা, ধর্ম্ম ও আত্মহিতকর কর্ম্মসকল অবলোকন করেন, তাঁহারাই সাধু ও উন্নতিলাভ করেন। যাঁহারা অহিংসাপরায়ণ, সত্যবাদী, অনুশংস, ঋজু, অদ্রোহী, অনভিমানী, হ্রীমান [লজ্জাশীল], তিতিক্ষু, ধীমান, ধৃতিমান, সর্ব্বভুতে দয়বান ও কামদ্বেষ বিবজ্জিত, তাহারাই সাধু ও লোকসাক্ষী।

‘কখন পরের অনিষ্ট চিন্তা করিবে না, দান করিবে ও সত্যকথা কহিবে, সাধুগণ এই ত্ৰিবিধ ব্যবহারকে সৎপথ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করেন। শিষ্টাচারসম্পন্ন মহাত্মারা সর্ব্বত্ৰ দয়াবান ও সন্তুষ্ট হইয়া ধর্ম্মলাভ করেন; অসূয়া, ক্ষম, শান্তি, সন্তোষ, প্রিয়বাদিতা, কামক্ৰোধপরিত্যাগ ও শিষ্টাচার-নিষ্বেণ ইহাই তাহাদিগের ধর্ম্ম। তাঁহাদিগের কাৰ্য্য-সকল শাস্ত্রসম্মত ও পণ অতি উত্তম। ধর্ম্মানুগত ব্যক্তিরা শিষ্টাচার সেবা করেন। লোকে জ্ঞানপ্রাসাদে আরোহণ করিলে মহদ্‌ভয় হইতে পরিমুক্ত হয়। তাহারা বিবিধ লোকের আচার-ব্যবহার, পুণ্য ও পাপকাৰ্য্য-সকল পৰ্য্যবেক্ষণ করে। হে দ্বিজোত্তম! আমি যাহা শ্রবণ করিয়াছি, জ্ঞানানুসারে তৎসমুদয় আপনাকে কহিলাম।’ ”