২০৮. কর্ম্মানুরূপ সুখদুঃখবিধান-যৎপুরুষকার কর্ত্তব্যতা

২০৮তম অধ্যায়

কর্ম্মানুরূপ সুখদুঃখবিধান-যৎপুরুষকার কর্ত্তব্যতা

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে পাণ্ডব! ধার্ম্মিকবর ধর্ম্মব্যাধ পুনর্ব্বার দ্বিজসত্তম কৌশিককে কহিল, “হে কৌশিক! বৃদ্ধপরম্পরায় কহিয়া থাকেন, বেদপ্রমাণিক ধর্ম্মই যথার্থ ধর্ম্ম, উহার গতি আতি সূক্ষ্ম, উহার শাখা বহুল ও অনন্ত, প্রাণসঙ্কট ও বিবাহকাল উপস্থিত হইলে মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করা দোষাবহ নহে, এই প্রকার স্থলে মিথ্যা সত্যে ও সত্য মিথ্যায় পরিবর্ত্তিত হইয়া থাকে, অতএব যাহা সাধারণের একান্ত হিতজনক, তাহাই সত্য। দেখুন, ধর্ম্মের গতি কি সূক্ষ্ম। যাহা ধর্ম্মের নিতান্ত বিপরীত, তাহাও ধর্ম্মমধ্যে পরিগণিত হইল।

‘লোকে যে কিছু শুভ বা অশুভ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে, কোননা-কোন সময়ে অবশ্যই তাহার ফল-ভোগ করিয়া থাকে। কেহ কেহ বিষম শোচনীয় দশা-প্ৰাপ্ত হইয়া দেবগণকে সাতিশয় তিরস্কার করিয়া থাকে; কিন্তু সেই সমস্ত অনভিজ্ঞ লোকেরা স্ব স্ব কর্ম্মদোষ দর্শন করে না। চপল, শঠ ও মুখেরা নিরবচ্ছিন্ন সুখদুঃখের বিপৰ্য্যয় প্রাপ্ত হইয়া থাকে, কিন্তু প্ৰজ্ঞ, গুরুপদেশ বা পৌরুষ এইরূপ লোক-সকলকে কদাচ বিমুক্ত করিতে সমর্থ হয় না।

“যদি পুরুষকারের ফল স্বাধীন হইত, তাহা হইলে সকলেই আপন আপন প্রবৃত্তি-সমুদয় চরিতার্থ করিতে পারিত। সংযতচিত্ত, মতিমান, কাৰ্য্যদক্ষ, সাধু ব্যক্তিরাও স্ব স্ব কর্ম্মফলভোগে বঞ্চিত হইয়া থাকেন। আর কেহ বা হিংসা ও প্রতারণাপরতন্ত্র হইয়া নিরবচ্ছিন্ন সুখস্বচ্ছন্দে কালব্যাপন করিতেছে; কেহ কেহ নিশ্চেষ্ট ও উপবিষ্ট থাকিয়া প্রভূত ধনের অধীশ্বর হইতেছে; কেহ বা অতিরিক্ত পরিশ্রম করিয়াও প্রাপ্য অর্থ প্ৰাপ্ত হইতেছে না।

‘লোকে পুত্রের নিমিত্ত পরমশ্রদ্ধা ও ভক্তিসহকারে দেবাৰ্চনা ও তপানুষ্ঠান করে, সেই পুত্ৰ জননীগর্ভে দশ মাস বাস করিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া কুলকলঙ্কীভূত হইয়া উঠে। কেহ বা পিতৃসঞ্চিত কল্যাণকর ধন, ধান্য ও ভোগসম্পন্ন হইয়া জন্মগ্রহণ করে। ইহলোকে মনুষ্যের রোগসকল স্ব স্ব কাৰ্য্যপ্রভাবেই প্রাদুর্ভূত হয় বটে, কিন্তু ব্যাধ যেমন মৃগগণকে বধ করে, সুনিপুণ ঔষধসম্পন্ন চিকিৎসকেরা তদ্রূপ সেই সকল ব্যাধির প্রতিবিধান করিয়া থাকেন। কাহার বা আহার-সামগ্ৰীর অভাব নাই, কিন্তু সে গ্ৰহণীরোগগ্ৰস্ত হইয়া আহার করিতে সমর্থ হয় না। কেহ বা ভূজবল প্রকাশপূর্ব্বক বহু ক্লেশে ভোজনদ্রব্য উপার্জ্জন করিয়া থাকে।

‘হে তপোধন!! শোকমোহপরিপ্লুত ও সমরপরাঙ্মুখ লোকসকল এইরূপে প্ৰবল কাৰ্য্যপ্রবাহে পতিত হইয়া বারংবার পীড়িত ও অবশ হইতেছে, কিন্তু মৃত্যুমুখে নিপতিত বা জরাজীর্ণ হয় না, প্রত্যুত সকলেই সর্ব্বকামসম্পূর্ণ হইয়া থাকে। জিতেন্দ্ৰিয় ব্যক্তির অপ্রিয় কিছুই নাই। সকলেরই প্রাধান্যলাভের স্পৃহা আছে এবং সকলেই স্বশক্তি অনুসারে তদ্বিষয়ে একান্ত যত্ন করিয়া থাকে; কিন্তু উহা তদ্রূপ ঘটিয়া উঠে না। অনেককে তুল্যানক্ষত্র ও তুল্যমঙ্গলসম্পন্ন দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু কর্ম্মানুসারে তাঁহাদিগের ফলবৈষম্য দৃষ্ট হইয়া থাকে। কেহ বিশিষ্টরূপ চেষ্টা করিয়াও অভিলষিত-কর্ম্ম-সম্পাদনে স্বয়ং সমর্থ হয় না, কিন্তু সামান্যতঃ কতপ্রকার কাৰ্য্যসিদ্ধি হইয়া থাকে। হে ব্ৰহ্মন! এইরূপ শ্রুতি আছে যে, জীব নিত্য ও শরীর অনিত্য। মৃত্যুকালে কেবল শরীরনাশ হয়, কিন্তু কর্ম্মনিবন্ধন জীব অন্য দেহে সংক্রান্ত হইয়া থাকে।”

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে ব্যাধ! জীব কি নিমিত্ত নিত্য হয়, ইহা সবিস্তার শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে।” ব্যাধ কহিল, “হে ব্ৰহ্মন! দেহনাশকালে জীবের বিনাশ হয় না, কিন্তু মৃত্যু হইল, এই অমূলক কথা কেবল মুখেরাই কহিয়া থাকে। জীব দেহ হইতে অন্তর্হিত হইয়া দেহান্তরে গমন করে, উহাই পঞ্চত্ব বলিয়া অভিহিত হয়। এই জীবলোকে জীবই কর্ম্মফল ভোগ করে, তদ্বিষয়ে অন্যের অধিকার নাই। কর্ম্মের বিনাশ নাই, জীব যে কিছু শুভাশুভ কাৰ্য্য সম্পাদন করে, তাহাকেই তাহার ফলভোগ করিতে হয়। মনুষ্য এই জীবলোকে জন্ম পরিগ্রহ করিয়া জন্মান্তরীণ কর্ম্মের ফলভোগ করিয়া থাকে, তদনুসারে কেহ বা কর্ম্মানুসারে পুণ্যকাৰ্য্যদ্বারা পুণ্যাত্মা, কেহ বা পাপকর্ম্মদ্বারা পাপাত্মা হয়।”

মনুষ্যজন্মের কারণ-কর্ত্তব্য নির্ণয়

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে ব্যাধ! মনুষ্য কিরূপে উৎপন্ন হয়। আর কি কারণেই বা পাপাত্মা ও পুণ্যশীল হয়, এবং পবিত্র ও অপবিত্ৰ জাতি প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে?” ব্যাধ কহিল, “হে বিপ্ৰ! আমি সত্বর অতি সংক্ষেপে এই বিষয় কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। জন্মের বিষয় পিণ্ডোৎপত্তি-প্রকাশক গ্রন্থে বিশেষরূপে বৰ্ণিত আছে, কিন্তু আপাততঃ দৃশ্যমান উৎপত্তি কেবল পূর্ব্বকর্ম্মফল মাত্ৰ। মনুষ্য জন্ম পরিগ্রহ করিয়া কর্ম্মবীজসম্ভার সঞ্চয় করিয়া পুনরায় সঞ্জাত হয়। পুণ্যকর্ম্মকারী পুণ্যযোনি ও পাপকর্ম্মকারী পাপযোনিতে উৎপন্ন হইয়া থাকে। জীব একমাত্ৰ শুভকর্ম্মপ্রভাবে দেবত্ব ও শুভাশুভ উভয়বিধ কর্ম্মদ্বারা মনুষ্যত্ব লাভ করে। নিরয়গামী পাপাত্মা নিরবচ্ছিন্ন অশুভ-কর্ম্ম-সম্পাদনদ্বারা তির্য্যগ্‌যোনি প্রাপ্ত হইয়া থাকে।

‘মনুষ্য জন্ম, মৃত্যু ও জরাজনিত দুঃখপরম্পরাপ্রভাবে নিরন্তর সন্তপ্ত হয় ও আত্মকৃত দোষে ক্রমাগত যোনিসঞ্চরণ করিয়া থাকে এবং কর্ম্মনিবন্ধন সহস্ৰ সহস্ৰ তিৰ্য্যগযোনি ও নিরয়গামী হয়। তাহারা কালগ্রাসে নিপতিত হইয়া আত্মকৃত সমস্ত অশুভকর্ম্মদ্বারা একান্ত দুঃখিত হয় এবং সেই দুঃখভোগ করিবার নিমিত্ত অশুভ যোনি প্রাপ্ত হইয়া থাকে। পরে পুনর্ব্বার বহুতর অশুভকর্ম্মসম্পাদকপূর্ব্বক অপথ্যভোজী রোগীর ন্যায় অশেষ ক্লেশ ভোগ করে। ইহলোকে দুঃখার্তের সংখ্যাই অধিক; যাহাদিগকে সুখী বলিয়া বোধ হয়, বিশেষ অনুসন্ধান করিয়া দেখিলে তাহাদিগেরও সুখ নামমাত্র।

‘মনুষ্য দুর্ব্বিষহ ক্লেশপরম্পরায় কর্ম্মের ভোগ ও বিষয়বাসনানিবন্ধন চক্ৰবৎ নিরবচ্ছিন্ন এই সংসারে পরিভ্রমণ করিতেছে; কিন্তু সুখের লেশমাত্র প্রাপ্ত হয় না। যদি মানব বীতরাগ ও সৎকর্ম্ম দ্বারা বিশুদ্ধ হয়, তাহা হইলে নিশ্চয় তপস্যা ও যোগসাধনে তাহার প্রবৃত্তি জন্মে এবং স্বকীয় বহুবিধ কর্ম্মবলে অনেকানেক লোক লাভ করিয়া থাকে। সেই সকল লোকে গমন করিয়া তাহাকে আর শোকের বশীভূত হইতে হয় না।

“পাপপরায়ণ ব্যক্তি পাপাচরণপূর্ব্বক ক্ৰমাগত উহাতেই লিপ্ত থাকে, কোনক্রমেই মুক্ত হইতে পারে না; অতএব পাপাচার পরিহার করিয়া পুণ্যকর্ম্মসম্পাদনে তৎপর হইবে। অসূয়াশূন্য কৃতজ্ঞ পুরুষ সুখ, ধর্ম্ম, অর্থ ও স্বৰ্গ প্রাপ্ত হয়েন। সংস্কারসম্পন্ন, দান্ত, প্ৰজ্ঞ ও জিতেন্দ্ৰিয় ব্যক্তি ইহলোক ও পরলোকে পরমসুখে কালব্যাপন করেন। সতত সজ্জনসমাচরিত ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিবে। শিষ্টলোকের ন্যায় কাৰ্য্যসাধন করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। লোককে ক্লেশ প্রদান না করিয়া আপনার জীবিকা নির্ব্বাহ করিবে। শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন শিষ্টপ্রকৃতির মানবেরা ধর্ম্মসঙ্কর ব্যতিরেকে কেবল স্বধর্ম্মানুসারে কর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া থাকে। তাহারা ধর্ম্মবলে প্রীতিলাভ ও ধর্ম্মকে আশ্রয় করিয়াই জীবিকা নির্ব্বাহ করে এবং সেই ধর্ম্মসঞ্চিত ধন দ্বারা নানাবিধ গুণপ্রসবকারী কর্ম্মের অনুষ্ঠান করে।

“এইরূপ অনুষ্ঠান করিলেই লোক-সকল ধর্ম্মাত্মা বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়া থাকে। তাহাদিগের চিত্ত প্ৰসন্ন ও পরিশুদ্ধ হয়, তাহারা বন্ধুগণের সহিত সন্তুষ্ট হইয়া পরলোকে অশেষ সন্তোষলাভ করে এবং ধর্ম্মের ফলস্বরূপ অভিলাষানুরূপ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, গন্ধ ও প্রভুত্ব প্রাপ্ত হয়। তাহারা ধর্ম্মের ফললাভে পরিতৃপ্ত না হইয়া জ্ঞানপ্রভাবে নিৰ্বেদ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি পৃথিবীতলে দোষাদির বশীভূত হয়েন না, প্রত্যুত তিনি বিষয়ারসাস্বাদনে বিরক্তিভাব প্ৰকাশ করেন এবং কোনক্রমেই স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ করেন না; তিনি লোকসকলকে বিনশ্বর বিলোকন করিয়া, সর্ব্বপরিত্যাগে কৃতসঙ্কল্প হইয়া, পরিশেষে মোক্ষলাভের উপায় উদ্ভাবনপূর্ব্বক তৎসাধনে যত্নশীল হয়েন।

‘হে দ্বিজসত্তম! মনুষ্য এইরূপে বৈরাগ্য অবলম্বন ও পপকর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া সনাতনধর্ম্ম ও মোক্ষ লাভ করে। তপস্যা মুক্তির আদি কারণ শম এবং দম, তদ্বারা মনুষ্য অভিলষিত সমস্ত বস্তুই প্রাপ্ত হইয়া থাকে। ইন্দ্ৰিয়-নিরোধ, সত্য ও দমদ্বারা পরমোৎকৃষ্ট ব্ৰহ্মপদ প্ৰাপ্ত হয়।”

‘ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে ব্যাধ! ইন্দ্ৰিয় কাহাকে কহে? তাহার নিগ্ৰহ কিরূপে করিতে হয়? তাহার ফলই বা কি প্রকার এবং মনুষ্যগণ কিরূপেই বা তাহার ফললাভ করিতে পারে? হে ধর্ম্মজ্ঞ! আমি এই সকল বিষয় প্রকৃতরূপে শ্রবণ করিতে ইচ্ছা! করি।’ ”

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! ধর্ম্মব্যাধ ব্ৰাহ্মণকর্ত্তৃক এইরূপ উক্ত হইয়া যে প্রত্যুত্তর করিয়াছিল, তাহা শ্রবণ করা। ব্যাধ কহিল, “হে দ্বিজোত্তম! মনুষ্যের মন প্রথমতঃ রূপ, রস, গন্ধ প্রভৃতির বিজ্ঞানার্থ প্রবর্ত্তিত হয়, পরিশেষে তদ্বিষয়ে কৃতকাৰ্য্য হইয়া রাগ ও দ্বেষ ভজনা করে। অনন্তর তন্নিমিত্ত যত্ন, মহৎ মহৎ কাৰ্য্যারম্ভ এবং পুনঃ পুনঃ অভিলষিত রূপ-রস-গন্ধাদির সেবা করিয়া থাকে। পরে রাগ, দ্বেষ, লোভ ও মোহ যথাক্রমে প্রাদুর্ভূত হইয়া উঠে। লোভাভিভূত ও রাগদ্বেষবিমোহিত ব্যক্তির যথার্থ ধর্ম্মবুদ্ধি তিরোহিত হইয়া কপটধর্ম্মে প্রবৃত্তি জন্মে। তখন সে কপট ধর্ম্মাচরণে প্রবৃত্ত হইয়া কুটিল ব্যবহারদ্বারা ধনোপার্জ্জন করিতে থাকে, এইরূপে ধনাগম সিদ্ধ হইলে বুদ্ধি তাঁহাতে আসক্ত হয় এবং পাপচিকীর্ষ উত্তরোত্তর প্রবল হইয়া উঠে। সেই শমদমাদিশূন্য, বেদমাৰ্গপরিভ্রষ্ট, বন্ধুবান্ধব ও পণ্ডিতগণকর্ত্তৃক নিবারিত হইলেও “আমি নির্লিপ্ত ও উদাসীন” বলিয়া আত্মপরিচয় প্ৰদান করে।

“মনুষ্যের রাগদোষজনিত অধর্ম্ম ত্ৰিবিধ;—পাপ-চিন্তা, পাপকথন ও পাপাচরণ। অধর্ম্ম-প্রবিষ্ট ব্যক্তির সদগুণ-সকল বিনষ্ট হয়; পপকর্ম্মকারী ব্যক্তিরা পাপীর সহিত মিত্ৰতা স্থাপন ও তাহা হইতে দুঃখভোগ করিয়া পরিশেষে বিপন্ন হইয়া উঠে। হে দ্বিজসত্তম! এইরূপে লোক পাপী হয়। এক্ষণে কিরূপে ধর্ম্মলাভ হয়, তাহা শ্রবণ করুন। যে ব্যক্তি সমুদয় দোষ সবিশেষ পৰ্য্যালোচনা করিয়া কি সুখ, কি দুঃখ, সকল অবস্থাতেই সাধু ব্যবহার করে, তাহার বুদ্ধি ধর্ম্মে সাতিশয় অনুরক্ত হয়।”

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে সত্তম! তুমি যে সত্যধর্ম্ম কীর্ত্তন করিতেছ, তুমি ব্যতিত ইহার বক্তা অন্য আর কুত্ৰাপি দৃষ্টিগোচর হয় না; অতএব আমার বোধ হয়, তুমি দিব্যপ্রভাবসম্পন্ন কোন মহর্ষি হইবে।”

“ব্যাধ কহিল, “হে ব্ৰহ্মন! ইহলোকে ব্রাহ্মণেরাই মহাভাগ্য, অগ্ৰভুক ও পিতার স্বরূপ, তাঁহাদিগের প্রিয়কাৰ্য্য সম্পাদন করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। তাঁহাদিগের প্রিয়তম ব্ৰাহ্মীবিদ্যা কীর্ত্তন করিতেছি, প্রণিধানপূর্ব্বক শ্রবণ করুন।

‘এই প্রত্যক্ষ প্রমাণসিদ্ধ স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগৎ কোনক্রমেই কর্ম্মলভ্য নহে। সচরাচর বিশ্বই ব্ৰহ্মস্বরূপ, ব্ৰহ্ম আকাশ প্রভৃতি মহাভূতাত্মক; তাঁহার পর উৎকৃষ্ট বস্তু আর কিছুই নাই; আকাশ, বায়ু অগ্নি, জল এবং পৃথিবী এই পাঁচটি মহাভূত। শব্দ, স্পর্শ রূপ, রস এবং গন্ধ এই কয়েকটি মহাভূতের গুণ। তারত্ব, মন্ত্রত্ব প্রভৃতি শব্দাদির গুণ-সকলও পরস্পর-সংক্রান্ত হইয়া থাকে, শব্দস্পর্শাদি পূর্ব্ব-পূর্ব্ব গুণ-সকল পৃথিব্যাদি তিনটি গুণীতে যথাক্রমে বর্ত্তমান আছে। ষষ্ঠের নাম চেতনা, তাহা মন বলিয়া অভিহিত হয়। সপ্তমী বুদ্ধি; তৎপরে অহঙ্কার, পঞ্চ ইন্দ্ৰিয়, জীবাত্মা, সত্ত্ব, রজ এবং তম। এই সপ্তদশ রাশি মায়াসংজ্ঞ। মন, বুদ্ধি, পঞ্চ ইন্দ্ৰিয়, তদগ্ৰাহ্য ও শব্দাদি পঞ্চ মন্তব্য, বোদ্ধব্য, আকাশ্যাদি পঞ্চ, আত্মা, অহঙ্কার ও গুণত্ৰয়, এই চতুবংশতিগণ; ইহার মধ্যে কতকগুলি ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য ও কতকগুলি অতীন্দ্ৰিয়; এই সমস্ত কীর্ত্তন করিলাম, এক্ষণে আর কি শুনিতে অভিলাষ হয়, বলুন।’ ”