২৪৫. চিত্রসেনের মুখে দুর্য্যোধনের দুরভিসন্ধি প্রকাশ

২৪৫তম অধ্যায়

চিত্রসেনের মুখে দুর্য্যোধনের দুরভিসন্ধি প্রকাশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় গন্ধর্ব্বসেনাগণমধ্যে চিত্ৰসেনকে কহিলেন, “হে বীর! আপনি কি নিমিত্ত কৌরবগণের নিগ্রহে প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন? আর কি নিমিত্তই বা সভায় দুৰ্য্যোধনকে নিগ্ৰহ করিলেন?”

চিত্ৰসেন কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! আমি স্বস্থানে অবস্থিতি করিয়াই দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়াছিলাম। সেই মন্দমতি মনে করিয়াছিল যে, পাণ্ডবগণ বনমধ্যে অনাথের ন্যায় বাস করিতেছে, এই সময় আমি বিবিধ দাস, দাসী, হস্তী, অশ্ব প্রভৃতি সম্পত্তি-সমভিব্যাহারে তাহাদিগের দুর্দ্দশা দর্শন করিব। আর এই সমস্ত কৌরবগণ দ্রৌপদীকে উপহাস করিবার নিমিত্ত এখানে আসিয়াছিল। সুররাজ ইন্দ্র উহাদের দুরভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া আমাকে আদেশ করিলেন যে “তুমি ত্বরায় গিয়া অমাত্য সমবেত দুৰ্য্যোধনকে বন্ধন করিয়া আনয়ন কর; অর্জ্জুন ও তাহার ভ্রাতৃগণকে সর্ব্বতোভাবে রক্ষা করিও। ধনঞ্জয় তোমার প্রিয়সখা ও শিষ্য।” হে পাণ্ডব! আমি সুররাজের বচনানুসারে এখানে আগমন করিয়া এই দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনকে বন্ধন করিয়াছি; এক্ষণে ইহাকে লইয়া সুরলোকে ইন্দ্ৰসন্নিধানে গমন করিব।”

অর্জ্জুনের অনুরোধে সপরিবার দুর্য্যোধনের গন্ধর্ব্ব-পাশমুক্তি

অর্জ্জুন কহিলেন, “হে চিত্ৰসেন! আপনি যদি আমার প্রিয়ানুষ্ঠান করিতে ইচ্ছা করেন, তবে দুৰ্য্যোধনকে পরিত্যাগ করুন, কারণ, দুৰ্য্যোধন আমাদের ভ্রাতা; উহাকে মুক্ত করা ধর্ম্মরাজের নিতান্ত অভিপ্রেত।”

চিত্ৰসেন কহিলেন, “এই পাপাত্মা দুৰ্য্যোধনকে মুক্ত করা কোনক্রমে উচিত নহে। এই মন্দমতি ধর্ম্মরাজ ও দ্রৌপদীকে বঞ্চনা করিয়াছিল। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ইহার দুষ্টভিপ্রায় জানিতে পারেন নাই। চল, তাহার নিকট গিয়া সমুদয় বৃত্তান্ত বর্ণন করি; পরে তিনি যাহা কহিবেন, তদনুসারে কার্য্য করা যাইবে।”

অনন্তর তাঁহারা সকলে একত্র হইয়া রাজা যুধিষ্ঠিরের সমীপে গমনপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনের অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করিলেন। অজাতশত্রু ধর্ম্মরাজ সমুদয় বৃত্তান্ত শ্রবণানন্তর কৌরবগণ ও তাঁহাদিগের অঙ্গ নাগণকে মুক্ত করিয়া দিলেন এবং গন্ধর্ব্বদিগকে প্রশংসা করিয়া কহিলেন, “হে গন্ধর্ব্বগণ! তোমরা যে সমর্থ হইয়াও এই দুর্ব্বত্ত দুৰ্য্যোধন এবং ইহার অমাত্য, জ্ঞাতি ও বান্ধববর্গের কোন হিংসা কর নাই, ইহা পরমসৌভাগ্যের বিষয়; তোমরা আমার যথেষ্ট উপকার করিয়াছ। এই দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্রতনয়কে মুক্ত করাতে আমার কুলমৰ্য্যাদা রক্ষা হইল। তোমাদের দর্শনে পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি, আজ্ঞা কর, কি অভিলাষ সম্পাদন করিব? তোমরা স্ব স্ব অভিলাষ পূর্ণ করিয়া সত্বর গমন কর, বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই।”

চিত্ৰসেনপ্রমুখ গন্ধর্ব্বগণ ধীমান যুধিষ্ঠিরের অনুমতি প্রাপ্ত হইয়া অপ্সরাগণ-সমভিব্যাহারে হৃষ্টচিত্তে স্বস্থানে প্ৰস্থান করিলেন। কৌরবগণ যে সমুদয় গন্ধর্ব্বকে সংগ্রামে নিহত করিয়াছিল, দেবরাজ ইন্দ্ৰ অমৃতবর্ষণদ্বারা তাহাদিগকে পুনর্জীবিত করিলেন। পাণ্ডবগণ এইরূপে জ্ঞাতিগণ ও তাঁহাদের পত্নী-সমুদয়কে বিমুক্ত করিয়া পরামপ্রীত হইলেন। অনন্তর কৌরবগণ স্ত্রীপুত্ৰসমভিব্যাহারে তাঁহাদিগের পূজা করিলে তাহারা তখন যজ্ঞমধ্যস্থ অনলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।

ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির প্রণয়বাক্যে ভ্রাতৃগণ-সমবেত দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, “হে ভ্ৰাতঃ! তুমি আর কখনও এরূপ সাহস করিও না, অসমসাহসিক ব্যক্তি কদাপি সুখী হইতে পারে না। যাহা হউক, এক্ষণে নির্ব্বিঘ্নে ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে পরমসুখে গৃহে গমন কর, অন্তঃকরণে কোনপ্রকার দুঃখচিন্তা করিও না।”

নরপতি দুৰ্য্যোধন রাজা যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক এইরূপ অনুজ্ঞাত ও তাঁহাকে অভিবাদনপূর্ব্বক যৎপরোনাস্তি লজ্জিত হইয়া বিকলেন্দ্ৰিয় আতুরের ন্যায় শনৈঃ শনৈঃ স্বীয় নগরাভিমুখে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। পূর্ব্ববৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া দুঃখে তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইতে লাগিল। এইরূপে ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ গমন করিলে ভ্রাতৃচতুষ্টয়সমবেত ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণকর্ত্তৃক প্রশংসিত ও অমরমণ্ডলমধ্যবর্ত্তী সুররাজের ন্যায় তপোধনগণে সমাবৃত হইয়া পরমহ্লাদে সেই দ্বৈতবনে বাস করিতে লাগিলেন।