২০৩. মধুকৈটভ-পুত্ৰ ধুন্ধুবধ

২০৩তম অধ্যায়

মধুকৈটভ-পুত্ৰ ধুন্ধুবধ

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! পরাক্রান্ত ধুন্ধু সেই মধুকৈটভের পুত্র। ঐ ধুন্ধু একপদে দণ্ডায়মান ও ধমনিসন্ততশারীর [তপস্যাকৃশতায় শিরাব্যাপ্তদেহ] হইয়া তপস্যা করিয়াছিল। ব্ৰহ্মা তাহার প্রতি প্রীত হইয়া বরদানে উদ্যত হইলে সে কহিল, “হে ভগবান! দেব, দানব, যক্ষ, সর্প, গন্ধর্ব্ব ও রাক্ষসগণ যেন আমাকে বধ করিতে না পারে, এই আমার অভিলষণীয় বর।’ পিতামহ ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাহার প্রার্থনা পরিপূর্ণ করিলে সে যথাবিধি তাঁহার চরণবন্দনপূর্ব্বক সে স্থান হইতে প্ৰস্থান করিল।

“অনন্তর ধুন্ধু এইরূপ বরপ্রাপ্ত হইয়া পিতৃবধজনিত ক্ৰোধে অধীর হইয়া বারংবার বিষ্ণু প্রভৃতি দেবগণ ও গন্ধর্ব্বগণকে পরাজয়পূর্ব্বক উৎপীড়িত করিতে লাগিল। পরিশেষে বালুকাচ্ছাদিত উজ্জালক-সমুদ্রে আগমনপূর্ব্বক ভূমির অভ্যন্তরে বালুকায় বিলীন থাকিয়া উতঙ্কাশ্রমের উৎপাত স্বরূপ হইয়া উঠিল। ঐ দুষ্টাত্মা উতঙ্কাশ্রমের অনতিদূরে লোকবিনাশের নিমিত্ত তপোবল আশ্রয়পূর্ব্বক শয়ান হইয়া অগ্নিশিখার ন্যায় নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিল। এমন সময়ে মহারাজ কুবলাশ্ব বল, বাহন, উতঙ্ক ও একবিংশতি সহস্র পুত্র-সমভিব্যাহারে তাহাকে বধ করিতে যাত্ৰা করিলেন। ভগবান বিষ্ণু উতঙ্কের নিয়োগানুসারে ও লোকের হিতকামনায় স্বীয় তেজঃপ্রভাবে কুবলাশ্বশরীরে প্রবিষ্ট হইলেন।

“আকাশে ‘শ্ৰীমান অবধ্য কুবলাশ্ব ধুন্ধুমার হইবে’, এই মহান শব্দ সমুত্থিত হইল; দেবগণ চতুর্দ্দিক হইতে দিব্য-কুসুমকলাপ বিকীর্ণ করিলেন; দেবদুন্দুভি-সকল স্বতঃই শব্দায়মান হইয়া উঠিল; সুশীতল সমীরণ মন্দ মন্দ প্রবাহিত হইতে লাগিল; দেবরাজ ধরাতল পাংশুশূন্য করিবার নিমিত্ত বারিবর্ষণ করিলেন। দেব, গন্ধর্ব্ব ও মহর্ষিগণ ধুন্ধু ও কুবলাশ্বের সমর-দৰ্শন-সমুৎসুক হইয়া উপস্থিত হইতে লাগিলেন। অন্তরীক্ষে তাঁহাদিগের বিমানসকল নয়নগোচর হইতে লাগিল।

“কুবলাশ্ব বৈষ্ণব-তেজে আপ্যায়িত হইয়া পুত্ৰগণকে উজ্জাকসাগরের চতুর্দ্দিক বেষ্টনপূর্ব্বক খনন করিতে নিযুক্ত করিলেন। সপ্তাহ খননের পর বালুকার অভ্যন্তরে মহাবল ধুন্ধুদানবের সূৰ্য্যসদৃশ দীপ্যমান ভীষণ কলেবর দৃষ্টিগোচর হইল। কালানলতুল্য দীপ্তকলেবর ধুন্ধু তৎকাল পৰ্য্যন্তও সুপ্ত ছিল। কুবলাশ্বের পুত্ৰগণ তাহার চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া তীক্ষ্ন শর, গদা, মুষল, পট্টিশ, পরিঘ, প্রাস ও খড়্গদ্বারা তাহাকে আঘাত করিতে আরম্ভ করিল। মহাবল ধুন্ধু তাহাদিগের অস্ত্রাঘাতে জাতক্ৰোধ হইয়া সমুদয় অস্ত্ৰ ভক্ষণ করিয়া ফেলিল এবং তাহার মুখ হইতে সকললোকভয়াবহ সংবর্ত্তকসদৃশ হুতাশন বিনিঃসৃত হইয়া ক্ষণমাত্রে কুবলাশ্বের পুত্ৰগণকে ভস্মাবশেষ করিল। পুত্ৰগণ কপিল-কোপানল কবলিত সগরসন্তানগণের ন্যায়। ভস্মীভূত হইলে মহাতেজাঃ কুবলাশ্ব দ্বিতীয় কুম্ভকর্ণের ন্যায় প্রবুদ্ধ ধুন্ধুদানবের সমীপবর্ত্তী হইলেন। তাহার দেহ হইতে রাশীকৃত সলিল বিনিঃসৃত হইল; রাজা কুবলাশ্ব সেই বারিময় তেজ পান করিলেন, পরে যোগবারিদ্বারা ধুন্ধুর মুখবিনিঃসৃত অগ্নি-সমুদয় নির্ব্বাণ করিয়া ব্ৰহ্মাস্ত্রদ্বারা ক্রুরস্বভাব অদ্ভূত-পরাক্রম দানবকে ভস্মীভূত করিলেন।

“অনন্তর দেব ও মহর্ষিগণ প্রীত হইয়া কুবলাশ্বকে কহিলেন, “তুমি বর গ্রহণ কর।” তখন তিনি বিনীতভাবে অঞ্জলিবন্ধনপূর্ব্বক প্ৰফুল্লবদনে বলিলেন, “হে দেবগণ! আমি যেন দ্বিজাতিগণকে ধন দান করিতে পারি, অরাতিগণের অনভিভাবনীয় হই, নারায়ণের সহিত বিলক্ষণ সখ্য জন্মে, আমার অন্তঃকরণ যেন দ্রোহশূন্য হয়, সতত ধর্ম্মে অনুরাগ উৎপন্ন হয়, এবং আমি যেন স্বর্গে অক্ষয়বাস প্ৰাপ্ত হই।”

“দেবগণ প্রীতিপ্ৰফুল্লবদনে ‘তথাস্তু’ বলিয়া অভিলষিত বর প্ৰদান করিলেন; ঋষিগণ ও গন্ধর্ব্বগণ উতঙ্কের সহিত কুবলাশ্বকে বিবিধ আশীর্ব্বাদসহকারে সম্ভাষণ করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। সেই সময়ে কুবলাশ্বের দৃঢ়াশ্ব, কপিলাশ্ব ও চন্দ্ৰশ্বনামে তিনটি পুত্র অবশিষ্ট ছিল; তাঁহাদের হইতেই মহাত্মা ইক্ষ্বাকুর বংশপরম্পরা দীপ্যমান হইয়া উঠিল।”

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! রাজা কুবলাশ্ব এইরূপে ধুন্ধু-দৈত্যকে বধ করিয়া ধুন্ধুমারনামে বিখ্যাত হইলেন। আমি তোমার জিজ্ঞাসানুসারে ধুন্ধুমারের উপাখ্যান আনুপূর্ব্বিক বর্ণনা করিলাম, যে ব্যক্তি ইহা শ্রবণ করিবে, সে ধার্ম্মিক, পুত্রবান ও ঐশ্বৰ্য্যশালী হইবে এবং তাহার কিছুমাত্র ব্যাধিভয় থাকিবে না।”