২২৩. কার্ত্তিকেয়-ভাবিপত্নী দেবসেনার পরিচয়

২২৩তম অধ্যায়

কার্ত্তিকেয়-ভাবিপত্নী দেবসেনার পরিচয়

“কন্যা কহিলেন, “আমি প্রজাপতির কন্যা, আমার নাম দেবসেনা, আমার ভগিনীর নাম দৈত্যসেনা; কেশী দানব পূর্ব্বে তাঁহাকে হরণ করিয়াছে। হে সুররাজ! আমরা দুই ভগিনী আমোদ-প্ৰমোদ করিবার নিমিত্ত প্ৰজাপতির অনুজ্ঞাগ্রহণপূর্ব্বক সখীগণ-সমভিব্যাহারে সতত এই মানসশৈলে সমাগত হইতাম। সেই সময় মহাসুর কেশী প্রত্যহই আমাদিগকে হরণ করিবার চেষ্টা করিত। দৈত্যসেনা কেশীর প্রতি অনুরক্ত ছিল, কিন্তু আমি ঐ দানবকে অবজ্ঞা করিতাম, এই নিমিত্ত সে তাহাকে আমার সমক্ষে হরণ করিতে পারে নাই। পরে সে অবসর পাইয়া দৈত্যসেনাকে হরণ করিয়াছে, এক্ষণে আমাকেও লইয়া যাইতেছিল, কেবল আপনিই অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়া পরিত্রাণ করিয়াছেন। হে দেবেন্দ্ৰ! এক্ষণে কৃপা করিয়া একজন দুর্জ্জয় ব্যক্তিকে আমার পতিরূপে নির্দ্দিষ্ট করুন।”

“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে বালে! দাক্ষায়ণী আমার মাতা, তুমি আমার মাতৃষ্বসার কন্যা। এক্ষণে তুমি আমার সমীপে স্বীয় বলের কথা প্ৰকাশ করিয়া বল।’

“কন্যা কহিলেন, ‘হে মহাবাহো! আমি অবলা, কিন্তু পিতৃবর- প্রভাবে অসামান্য বলবীৰ্য্যসম্পন্ন সুরাসুর-নমস্কৃত এক ব্যক্তি আমার পতি হইবেন।”

‘ইন্দ্ৰ কহিলেন, “তোমার পতির বল কিরূপ হইবে? আমি তোমার নিকট তদ্বিষয় বিশেষরূপে শ্রবণ করিতে বাসনা করি, তুমি অতি শীঘ্ৰ তাহা বল।”

“কন্যা কহিলেন, “হে ভগবান! যে মহাবলপরাক্রান্ত বীরপুরুষ আপনাকে সমভিব্যাহারে লইয়া সমরে সমুদয় দেব, দানব, যক্ষ, কিন্নর, উরগ, রাক্ষস ও দুষ্ট দৈত্যগণকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবেন, তিনিই আমার পতি হইবেন।”

“দেবরাজ তাঁহার বাক্য শ্রবণানন্তর সাতিশয় দুঃখিত হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, এই দেবী যাদৃশ পতির অভিলাষ করিতেছেন, তদ্রূপ ব্যক্তি ত’ এক্ষণে বর্ত্তমান নাই। পরে দেবরাজ শতক্রতু দেখিলেন, মহাদ্যুতি ভাস্কর উদয়াচলে সমুদিত এবং চন্দ্রমা তাঁহার শরীরে প্রবিষ্ট হইতেছেন। সেই রৌদ্র-মুহূর্তে অমাবস্যা সমুপস্থিত হইল, উদয়াচলে দেবাসুরের ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল। প্ৰাতঃকালে রক্তবর্ণ মেঘবৃন্দে আবৃত ও পূর্ব্বদিগভাগ লোহিতবর্ণ হইল। ভগবান হুতাশন ভার্গবগণ ও আঙ্গিরসগণকর্ত্তৃক পৃথগ্বিধ মন্ত্র পাঠ্যপূর্ব্বক হুতহব্য গ্রহণ করিয়া সূৰ্য্যে প্রবেশ করিতেছেন। অমাবস্যা প্রভৃতি পর্ব্বসকলে চতুর্বিংশতি দিবাকর সমুপস্থিত হইয়াছেন।

“ভগবান পুরন্দর শশীদিবাকরের একতা ও সেই রৌদ্রসমবায় সমবলোকন করিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, সূৰ্য্য ও চন্দ্ৰমার ঘোর পরিবেশ দৃষ্ট হইতেছে, এই রজনীর অবসানে অবশ্যই মহাযুদ্ধ হইবে, নদীর তরঙ্গ শোণিতময় ও প্রতিকুলগামী হইয়াছে; উল্কামুখী শৃগালিনী সূৰ্য্যাভিমুখী হইয়া চীৎকার করিতেছে ও সূৰ্য্যের সহিত চন্দ্রের অদ্ভূত সমাগম হইয়াছে। স্পষ্টই বোধ হইতেছে, ভগবান চন্দ্ৰমা যে পুত্র উৎপাদন করিবেন, তিনিই এই দেবীর ভর্ত্তী হইবেন অথবা সর্ব্বগুণসম্পন্ন অগ্নি যাঁহাকে উৎপাদন করিবেন, তিনিই ইহার পতি হইবেন।” ভগবান ইন্দ্র এইরূপ চিন্তা করিয়া দেবসেনাকে গ্রহণপূর্ব্বক ব্ৰহ্মলোকে গমন করিয়া পিতামহকে কহিলেন, “হে বিধাতঃ! আপনি এই রমণীয় উপযুক্ত পতি নির্দেশ করিয়া বলুন।”

“ব্ৰহ্মা কহিলেন, “হে দানবনিসূদন ইন্দ্ৰ! তুমি যেরূপ চিন্তা করিয়াছ, সেইরূপেই এক পুত্ৰ সমুৎপন্ন হইবে; সে তোমার সমভিব্যাহারে সেনানী-কাৰ্য্য সমাপন করিবে ও সেই বীরপুরুষ এই দেবীর পতি হইবে, সন্দেহ নাই।”

অগ্নি হইতে কাৰ্ত্তিকেয়োৎপত্তি প্ৰচেষ্টা

“যে স্থানে বশিষ্ঠ্যপ্রমুখ দেবর্ষিগণ যজ্ঞানুষ্ঠান করিতেছিলেন, সুররাজ শতক্ৰতু ব্ৰহ্মার বাক্য-শ্রবণানন্তর তাঁহাকে নমস্কার করিয়া সেই কন্যা-সমভিব্যাহারে তথায় সমুপস্থিত হইলেন। অন্যান্য সুর-সমুদয়ও সোমরসপিপাসু হইয়া ঐস্থানে আগমন করিয়াছিলেন। দ্বিজাতিগণ সুসমৃদ্ধ হুতাশনে যথাবিধি আহুতি প্রদান করিয়া পরিশেষে দেবগণের নামোল্লেখপূর্ব্বক আহুতি প্ৰদান করিতে লাগিলেন। ভগবান হুতাশন ঋষিগণকর্ত্তৃক আহত ও সহসা সূৰ্য্যমণ্ডল হইতে বিনিঃসৃত হইয়া বাক্যসংযমসহকারে নিয়মানুসারে তথায় আগমন করিলেন। তিনি মহর্ষিগণ-প্রদত্ত বিবিধ হব্য গ্রহণপূর্ব্বক দেবগণকে প্রদান করিয়া সে স্থান হইতে প্রস্থান করিতেছেন, এমত সময়ে সেই সকল মহাত্মা মহর্ষিগণের পত্নীরা তাঁহার নেত্রপথে পতিত হইলেন। তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ উপবিষ্ট, কেহ কেহ বা নিদ্রিত ছিলেন। ভগবান হুতাশন রুক্মবেদীর ন্যায়, চন্দ্ৰলেখার ন্যায়, হুতাশন-শিখার ন্যায় সেই ঋষিপত্নীকে অবলোকন করিয়া কন্দর্প শরে নিতান্ত কাতর হইলেন। তখন তিনি মনে মনে চিন্তা করিলেন, পতিব্ৰতা ঋষিপতনীগণ আমার প্রতি অনুরক্ত নহেন; তথাপি আমি উহাদিগকে অভিলাষ করিতেছি; আমার এ কি অন্যায় চিত্তবিকার উপস্থিত হইল! যাহা হউক, আমি প্রকাশ্যরূপে উহাদিগকে দর্শন বা কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে কখনই সমর্থ হইব না, অতএব গার্হাপত্যে [গাৰ্হাপত্যনামক অগ্নিশালা] প্রবেশপূর্ব্বক উহাদিগকে অনিমিষ-নয়নে নিরীক্ষণ করি।

“ভগবান হুতাশন মনে মনে ঐ রূপ স্থির করিয়া গার্হাপত্যে প্রবেশপূর্ব্বক মহর্ষি পত্নীগণকে নিরীক্ষণ করিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইতে লাগিলেন। তাঁহার শিখাসমুদয় এরূপ সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিল, দেখিলে বোধধ হয় যেন তিনি তৎসমুদয়দ্বারা মহর্ষিভাৰ্য্যাগণকে স্পর্শ করিতেছেন। ভগবান দহন এইরূপে মহিলাগণের বশবর্ত্তী হইয়া তাঁহাদিগের প্রতি মন সমর্পণপূর্ব্বক তথায় বহুদিবস বাস করিলেন। পরিশেষে তাঁহাদের অলাভে নিতান্ত সন্তপ্ত ও মরণে কৃতনিশ্চয় হইয়া বনে গমন করিলেন।

“ইতিপূর্ব্বে দক্ষদুহিতা স্বাহা ভগবান হুতাশনের প্রতি অনুরাগিণী হইয়াছিলেন। তিনি বহুদিন-অবধি দহনের ছিদ্রান্বেষণ করিতেছিলেন, কিন্তু বহ্নি নিতান্ত অপ্ৰমত্ত বলিয়া কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। দক্ষতনয়া এক্ষণে অতি কামার্ত্ত হইয়া বনে গমন করিয়াছেন জানিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন যে, আমি সপ্তর্ষিপত্নীগণের রূপ ধারণপূর্ব্বক অগ্নির নিকট গমন করি, তাহা হইলে তাঁহার পরিতোষলাভ ও আমারও মনোবাঞ্ছা পরিপূর্ণ হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”