২৩০. দেবসেনাপতি কার্ত্তিকেয়ের সামরিক সজ্জা

২৩০তম অধ্যায়

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে রাজন! স্কন্দ সমুদয় মাতৃগণের প্রিয়কাৰ্য্য সম্পাদন করিলে পর স্বাহা কহিলেন, “বৎস! তুমি আমার পুত্র, অতএব তোমাকর্ত্তৃক আমার প্রীতিকর কাৰ্য্য অনুষ্ঠিত হয়, ইহাই নিতান্ত বাসনা।” স্কন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবতি! আপনি কীদৃশী প্রীতির অভিলাষিণী?”

“তিনি কহিলেন, “আমি দক্ষ প্ৰজাপতির প্ৰিয়তমা কন্যা, আমার নাম স্বাহা, বাল্যাবধি হুতাশনের প্রতি আমার সাতিশয় অনুরাগ জন্মিয়াছে, কিন্তু তিনি তাহা সম্যক অবগত নহেন। যাহা হউক, এক্ষণে অভিলাষ যে, নিরন্তর হুতাশনের সহিত বাস করিয়া কালযাপন করি।”

“স্কন্দ কহিলেন, “দেবি! অদ্যাবধি সৎপথস্থিত ব্ৰাহ্মণের মন্ত্রপূত হব্য-কব্য প্রভৃতি দ্রব্যজাত ‘স্বাহা’ বলিয়া হুতাশনে প্রদান করিবেন, তাহা হইলে সর্ব্বদাই আপনার অনল-সহবাস হইবে, সন্দেহ নাই। স্বাহা স্কন্দের এতাদৃশ বাক্য-শ্রবণে পরমপ্রীতি ও যথাবিধি পূজিত হইয়া তাঁহার পূজা করিয়া চিরপ্রার্থিত ভর্ত্তা পাবকের সহিত সম্মিলিত হইলেন।

“অনন্তর ভগবান প্রজাপতি স্কন্দকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে ত্ৰৈলোক্যবিজয়িন! তুমি তোমার পিতা ত্রিপুরনিসূদন মহাদেবের নিকট গমন কর। মহাদেব অগ্নিতে এবং ঊমা স্বাহাতে সমাবিষ্ট হইয়া লোকহিতার্থে তোমাকে উৎপাদন করিয়াছেন; তুমি সকলের অজেয়। মহাত্মা রুদ্র ঊমাযোনিতে শুক্র নিক্ষেপ করেন; সেই শুক্র পঞ্চধা বিভক্ত হইয়া পঞ্চ স্থানে নিপতিত হয়। প্রথমতঃ তাহা হইতে মিঞ্জিকা-মিঞ্জিক মিথুন উৎপন্ন হইয়া এই পর্ব্বতে পতিত হয় এবং লোহিত-সাগরে তাহার এক ভাগ, সূৰ্য্যরশ্মিতে কিঞ্চিৎ ভূলোকে কিঞ্চিৎ ও বৃক্ষে তাহার কিয়দংশ পতিত হইয়াছিল। এইরূপে স্থানে স্থানে তোমার নানা প্রকার পরিষদগণ সঞ্জাত হইয়াছে; তাহারা সকলেই অতি ভীষণ ও পিশিতাশন [মাংসভোজী]। তখন পিতৃবৎসল স্কন্দ ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া পিতা মহাদেবের সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক তাঁহার পূজা করিলেন।

“ধনার্থী ও ব্যাধিপ্রশমনার্থী লোকে অর্ক [আকন্দফুল]-পুষ্পদ্বারা সেই পঞ্চগণের পূজা করিবে। বালকহিতার্থে রুদ্রসম্ভব মিঞ্জিকা-মিঞ্জিক মিথুনকে সর্ব্বদাই নমস্কার করিবে। যে শুক্রাংশ বৃক্ষে নিপতিত হইয়াছিল, তাহা হইতে মানুষমাংসাদত [নরমাংসভোজী] কতিপয় দেবী সমুৎপন্ন হইয়াছেন; তাঁহারা বৃদ্ধিকানামে প্রসিদ্ধ, প্রজার্থী লোকে তাঁহাদিগকে নমস্কার করিবে। হে রাজন! এইরূপে অসংখ্য পিশাচগণ সঞ্জাত হইয়াছে।

দেবসেনাপতি কার্ত্তিকেয়ের সামরিক সজ্জা

“সম্প্রতি কার্ত্তিকেয়ের ঘণ্টা ও পতাকার উৎপত্তিবিষয় কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ঐরাবতের বৈজয়ন্তীনামে দুইটি লোহিতবর্ণ ঘণ্টা ছিল; দেবরাজ স্বয়ং উহা আনয়নপূর্ব্বক একটি বিশাখকে, অপরটি স্কন্দকে প্ৰদান করিলেন। তিনি দেবপ্রদত্ত সমস্ত ক্রীড়নকদ্বারা ক্রীড়া করিয়া পিশাচ ও দেবগণে পরিবৃত হইয়া কাঞ্চনশৈলে অবস্থিতি করিলেন। তাঁহার সন্নিধানবশতঃ কুসুমকানন-সুশোভিত সেই নগপতিও পরামরমণীয় শোভাসম্পন্ন হইয়াছিল। যেমন সূর্য্যসন্নিধানে সুচারুকন্দর মন্দরের শোভা হয়, তদ্রূপ স্কন্দের সন্নিধানে শ্বেতপর্ব্বত অতীব প্রতিভাত হইয়া উঠিল। তথায় কানন-সকল করবীর, পারিজাত, জবা, অশোক ও কদম্ব প্রভৃতি প্রফুল্ল কুসুমসমূহে বিরাজিত, জবা, অশোক ও কদম্ব প্রভৃতি প্রফুল্ল কুসুমসমূহে বিরাজিত রহিয়াছে, নানাজাতীয় দিব্যমৃগ ও পক্ষিগণ বিচরণ করিতেছে, অতি গভীরনিঃস্বন দেবতা ও দেবর্ষিগণ নিয়ত বাস করিতেছেন, অপ্সরা ও গন্ধর্ব্বনিবহ নিরন্তর নৃত্য করিতেছে এবং সর্ব্বদাই প্রাণীগণের আনন্দধ্বনি সমুত্থিত হইতেছে। ফলতঃ দেবরাজাধিষ্ঠিত সমস্ত জগৎ সেই শ্বেতাচলে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে।

“মহাত্মা কার্ত্তিকেয় সমস্ত জগতের আধারভূত সেই পর্ব্বতে প্রত্যহ অভিনব বস্তু-সন্দর্শনদ্বারা নয়ন ও মন পরিতৃপ্ত করিতে লাগিলেন, কিন্তু দৃষ্টপূর্ব্ব বস্তুর দর্শননিবন্ধন ক্লেশের লেশও অনুভব করেন নাই।

“অনন্তর ভগবান পাবকি [অগ্নির পুত্র কীর্ত্তিকেয়] সৈনাপত্যে অভিষিক্ত হইলে ভূতভাবন ভবানীপতি আহ্লাদিত হইয়া পার্ব্বতী-সমভিব্যাহারে সহস্ৰসিংহ-সংযোজিত লোহিতবর্ণ সমুজ্জ্বল রথে আরোহণপূর্ব্বক ভদ্রবটে গমন করিলেন। মৃগেন্দ্ৰগণ মুহুর্ত্তকালমধ্যে নভোমণ্ডলে সমুত্থিত হইয়া গভীর-গর্জ্জনে চরাচর ত্ৰাসিত করিতে লাগিল; বোধ হইল যেন, তাহারা আকাশমণ্ডল গ্রাস করিতে উদ্যত হইয়াছে। সৌদামিনী-সমভিব্যাহারে সূৰ্য্য যেমন শক্ৰশরাসনসনাথ জলধরপটলে শোভমান হয়েন, তদ্রূপ পশুপতি পার্ব্বতীসমভিব্যাহারী সেই রথে দীপ্তি পাইতে লাগিলেন।

“ধনপতি কুবের গুহ্যকগণ-পরিবৃত হইয়া সুরুচির পুষ্পকরথে আরোহণপূর্ব্বক মহাদেবের অগ্ৰে অগ্ৰে চলিলেন; দেবরাজ ইন্দ্ৰ দেবগণ-সমভিব্যাহারে ঐরাবতে আরোহণ করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলেন। যুদ্ধবিশারদ বহুসংখ্যক দেবতা বসু ও রুদ্রগণের সহিত মিলিত হইয়া তাঁহার দক্ষিণপার্শ্বে গমন করিতে লাগিলেন, মাল্যভরণবিভূষিত যক্ষ, রক্ষ ও গ্ৰহগণপরিবৃত মহায্যক্ষও সেই পক্ষ আশ্রয় করিয়া চলিলেন।

“ঘোররূপ যম ভয়ঙ্করব্যাধিশত-পরিবেষ্টিত হইয়া গমন করিতে লাগিলেন। অতি ভীষণ, সুতীক্ষ্ন, ত্ৰিশিখর, বিজয়াখ্য রুদ্রশূল তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। উগ্রপাশ সলিলাধিপতি ভগবান বরুণদেব বিবিধ প্রকার জলজন্তুগণ-পরিবৃত হইয়া ধীরে ধীরে চলিলেন। রুদ্রের পট্টিশ-অস্ত্ৰ, গদা, মুষল, শক্তি প্রভৃতি অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ সমভিব্যাহারে বিজয়ের অনুগমন করিল। পট্টিশের পশ্চাৎ রুদ্রের ছত্র, তাহার পশ্চাৎ কমণ্ডলু ও তাহার দক্ষিণপার্শ্বে দেবপূজিত পরামশোভমান দণ্ড গমন করিতে লাগিল। ভৃগু ও অঙ্গিরা প্রভৃতি ঋষিগণ তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারে চলিলেন।

“মহাতেজাঃ ভগবান রুদ্র বিমলস্যন্দনাধিষ্ঠিত হইয়া দেবগণের সন্তোষোৎপাদনপূর্ব্বক পট্টিশ প্রভৃতি অস্ত্ৰ-শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া অনুগমন করিলেন। দেবতা, ঋষি, গন্ধর্ব্ব, ভুজগ, অপ্সরা, নদী, হ্রদ, সমুদ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, দেবশিশু ও বরাঙ্গনাগণ পুষ্পবৃষ্টি করিতে করিতে রুদ্রের অনুগামী হইলেন। মেঘ-সকল মহাদেবকে প্ৰণাম করিয়া তাহার অনুগমন করিল। নিশোকর মহাদেবের মস্তকে শুভ্ৰ ছত্র ধারণ করিলেন, বায়ু ও অগ্নি চামর ব্যজন করিতে লাগিলেন। রাজর্ষিগণ বৃষধ্বজের স্তব করিয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। গৌরী, বিদ্যা, গান্ধারী, কেশিনী ও সাবিত্রী প্রভৃতি সকলে পার্ব্বতীর অনুগামিনী হইলেন। ইন্দ্রপ্রমুখ দেবগণ সেনামুখে অবস্থিতি করিয়া তাহার আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে লাগিলেন।

“যে রুদ্রসখা রাক্ষসগ্রহ সর্ব্বদা শ্মশানে ব্যাপৃত থাকে, সে পতাকা গ্রহণ করিয়া অগ্ৰে অগ্ৰে চলিল এবং লোকনিন্দদায়ক পিঙ্গলাখ্য যক্ষেন্দ্রও তাঁহার অনুগমন করিল। এইরূপে মহাদেব পরমসুখে গমন করিতে লাগিলেন। তৎকালে তাঁহার অগ্ৰে কি পশ্চাতে অপর কোন ব্যক্তির গমন করিবার ক্ষমতা ছিল না। যিনি শিব, ঈশ, রুদ্র, পিতামহ ও মহেশ্বর বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছেন, মানবগণ সৎকর্ম্মানুষ্ঠানদ্বারা বিবিধ ভাব-সহকারে তাহার অর্চনা করিয়া থাকে।

“এইরূপে কৃত্তিকানন্দন দেবসেনাপতি সুরসেনাপরিবৃত হইয়া দেবদেবের অনুগমন করিলেন। অনন্তর মহাদেব তাঁহাকে কহিলেন, “হে মহাবল! তুমি-নিরন্তর অতন্দ্ৰিত হইয়া সপ্তম দেববাহিনীকে রক্ষা করিবে।” কাৰ্ত্তিকেয় বিনয়নম্রবাক্যে কহিলেন, “তাত! আমি সর্ব্বদাই প্রতিপালন করিব, সন্দেহ নাই, এক্ষণে যদি অন্য কোন কর্ত্তব্য কর্ম্ম থাকে, তাহাও শীঘ্র অনুমতি করুন।”

“রুদ্র কহিলেন, “হে বৎস! তুমি কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে আমাকে সন্দর্শন করিলে অবশ্যই তোমার মঙ্গল হইবে।” এই বলিয়া মহেশ্বর রুদ্র স্কন্দকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক গমনে আদেশ প্ৰদান করিলেন।

মহিষাসুর-সৈন্যের সহিত দেবগণের সংঘর্ষ

“অনন্তর অতি ভয়ঙ্কর উৎপাত-সকল উপস্থিত হইল। দেবগণ সহসা মোহে আক্রান্ত ও অভিভূত হইলেন, নক্ষত্রপুঞ্জের সহিত নভোমণ্ডল অকস্মাৎ প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল, বিশ্বসংসার একেবারে ঘোরতর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইল। মেদিনীমণ্ডল বিলক্ষণ শব্দায়মান, সহসা বিমোহিত ও কম্পিত হইতে লাগিল। ভূতভাবন ভগবান শঙ্কর, দেবী পার্ব্বতী, দেবগণ ও মহর্ষিগণ ইঁহারা সকলে এই ভয়ানক ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া বিলক্ষণ ক্ষুভিত হইলেন।

“অনন্তর পর্ব্বতাম্বুদসন্নিভ [পর্ব্বতপ্রমাণ বিশাল মেঘতুল্য] পয়োধরাকার বিবিধায়ুধধারী প্রচণ্ড সৈন্যমণ্ডলী দৃষ্টিগোচর হইল। সেই অসংখ্য দানবদল তর্জ্জনগর্জ্জনপূর্ব্বক ভগবান শঙ্কর ও অমরগণের প্রতি ধাবমান হইয়া তাঁহাদের সৈন্যের প্রতি অনবরত শরজাল, প্রাস, অসি, পরিঘ, শতঘ্নী, গদা ও পর্ব্বতসকল নিক্ষেপ করিতে লাগিল। তখন দেবসৈন্যেরা দানবশর-প্রহারে নিতান্ত পীড়িত ও সমরে পরাঙ্মুখ হইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। শত শত হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতি ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া গেল। যেমন হুতাশন সমস্ত কানন দগ্ধ করিয়া থাকে, তদ্রূপ দানবেরা শরাগ্নিদ্বারা দেব-সৈন্যদিগকে দগ্ধ করিতে লাগিল। দেবগণ তখন দানবদলের শরাঘাতে বিদীৰ্ণমণ্ডক, ক্ষতবিক্ষতিকায় ও নিঃসহায় হইয়া অনাথের ন্যায় পলায়ন করিলেন।

“অনন্তর দেবরাজ ইন্দ্র সৈন্যগণকে দানব-ভয়ে পলায়ন করিতে দেখিয়া প্ৰবোধবাক্যে কহিতে লাগিলেন, “হে বীরগণ! তোমাদিগের মঙ্গল হইবে, তোমরা ভয় পরিত্যাগ করিয়া পুনরায় অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক অক্লিষ্টচিত্তে পূর্ব্ববৎ বলবিক্রম প্রকাশ কর ও ভীষণদর্শন দুর্বৃত্ত দানবগণকে পরাজয় করিতে আমার সহিত অগ্রসর হও!” দেবগণ এই কথা শ্রবণ করিয়া আশ্বস্তমনে ইন্দ্রের আশ্রয়লাভপূর্ব্বক দৈত্যগণের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। তখন তাঁহারা মহাবল বায়ু, মহাভাগ সাধ্য ও বসুগণের সহিত ক্ৰোধাভরে দৈত্যগণের প্রতি ধাবমান হইয়া শর বর্ষণ আরম্ভ করিলেন।

“নিশিত শর-সকল দৈত্যকলেবরে নিপতিত হইয়া প্রচুর পরিমাণে রুধিরপান করিতে লাগিল। ভুজঙ্গ যেমন গিরিদরী [গিরিগুহা] হইতে বিনির্গত হয়, তদ্রূপ দেবশরনিকর দৈত্যদেহ ভেদ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল; অসুরগণের শরীর শরনির্ভিন্ন হইয়া ছিন্ন অভ্রখণ্ডের ন্যায় তদ্দণ্ডেই ধরাতলশায়ী হইতে লাগিল। দৈত্যসেনা এই সকল ভয়ঙ্কর ব্যাপার অবলোকন করিয়া একান্ত শঙ্কিত ও সাতিশয় ভীত হইয়া সমরে পরাঙ্মুখ হইল। তখন দেবগণ উদ্যতায়ুধ হইয়া প্ৰহৃষ্টমনে কোলাহল করিতে লাগিলেন, তূরী প্রভৃতি বহুবিধ সুমধুর বাদ্য-সকল অনবরত বাদিত হইতে লাগিল।

মহিষাসুরের সমরাঙ্গনে আগমন

“এইরূপে দেব ও দানবগণের শোণিত-পঙ্কিল তুমুল সংগ্রাম হইতে লাগিল। ইত্যবসরে দেবতারা দেখিলেন, দানবেরা ভীষণ সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক সুরগণকে সংহার করিতেছে এবং তুরী, ভেরী প্রভৃতি নানাবিধ বাদ্যধ্বনি হইতেছে। দেখিতে দেখিতে মহিষনামে মহাবলপরাক্রান্ত এক দৈত্য-বীর অতি প্ৰকাণ্ড পর্ব্বত হস্তে লইয়া সহসা অসুর-সৈন্য হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল। দেবগণ ঘটনাবলী-পরিবেষ্টিত সূর্য্যমণ্ডলের ন্যায় সেই মহিষাসুরকে নিরীক্ষণ করিয়া ভীতমনে পলায়ন করিতে লাগিলেন।

“মহিষাসুর তাঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া পর্ব্বত নিক্ষেপ করিলে অযুতসংখ্যক দেব-সৈন্য সেই পর্ব্বত-প্ৰহারে কলেবর পরিত্যাগ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল। অনন্তর মহিষাসুর অন্যান্য দানবের সহিত দেবগণের অন্তঃকরণে সাতিশয় ভয় উৎপাদন করিয়া ক্ষুদ্ৰমৃগানুসারী সিংহের ন্যায় রণক্ষেত্রে বিচরণ করিতে লাগিল। তখন দেবতারা তাহাকে অবলোকন করিয়া ভীতমনে অস্ত্ৰ-শস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক বাসবের সহিত পলায়ন করিলেন।

“অনন্তর মহিষাসুর রোষকলুষিত-মনে দ্রুতপদে রুদ্রের রথসন্নিধানে গমন করিয়া দূর গ্রহণ করিলে ভূলোক ও দ্যুলোক শব্দদায়মান হইয়া উঠিল, জলদজালতুল্য মহাকায় দৈত্যসকল সিংহনাদ করিতে লাগিল এবং মহর্ষিগণ বিমোহিত হইলেন। তখন অসুরেরা মনে করিল, এইবার আমরা সম্পূর্ণ জয়লাভ করিব।

কার্ত্তিকেয়-কর্ত্তৃক মহিষাসুরসংহার

“রণস্থল এইরূপ তুমুল হইয়া উঠিলে ভগবান শঙ্কর মহিষাসুরকে সংহার করিবার নিমিত্ত তদীয় অন্তকস্বরূপ কার্ত্তিকেয়কে স্মরণ করিলেন। মহিষ তখন দেবগণের ভয় ও অসুরদিগের হর্ষবৰ্দ্ধনপূর্ব্বক সিংহনাদ করিতে লাগিল। ইত্যবসরে লোহিতাম্বরসংবীত, রক্তমাল্যবিভূষিতসুবৰ্ণবর্ম্মধারী ভগবান স্কন্দ কনকসঙ্কাশ রথে আরোহণপূর্ব্বক প্রচণ্ড সূৰ্য্যের ন্যায় ক্ৰোধে নিতান্ত অধীর হইয়া তথায় সমুপস্থিত হইলেন। তখন দেবসৈন্যেরা তাঁহাকে দেখিবামাত্র সত্বর সমরাভিমুখে ধাবমান হইল। মহাবল মহাসেন প্রজ্বলিত শক্তি পরিত্যাগ করিয়া তৎক্ষণাৎ মহহিষাসুরের মস্তকচ্ছেদন করিলে, সে তখন প্ৰাণ পরিত্যাগ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল। তাহার পর্ব্বতাকার মস্তক ভূতলে পতিত হইবামাত্র উত্তর-কুরুর ষোড়শ-যোজন-বিস্তীর্ণ দ্বার অবরুদ্ধ হইয়া গেল। তত্ৰত্য অন্যান্য সকলেরই গতিবিধি রোধ হইল; সেজন্য উত্তর কৌরবেরা অন্য পথ দিয়া অক্লেশে গমনাগমন করিতে লাগিল।

“তখন স্কন্দদেব বারংবার শক্তি নিক্ষেপপূর্ব্বক শক্রগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। দেব ও দানবেরা এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার স্বচক্ষে প্ৰত্যক্ষ করিলেন। এইরূপে মহাসেন অনবরত শরবর্ষণ করিয়া শত্ৰুগণকে নিঃশেষপ্রায় করিলে পর নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ তদীয় পরিষদবর্গ প্ৰহৃষ্ট মনে অবশিষ্ট অসুরগণকে সংহার করিয়া তাহাদিগের মাংসভক্ষণ ও শোণিতপান করিতে লাগিল। সূৰ্য্যদেব যেমন অন্ধকার ধ্বংস ও অনল যেমন মহীরুহগণকে ভস্মসাৎ করিয়া থাকে, তদ্রূপ কার্ত্তিকেয় স্বকীয় অদ্ভুত বল-বীৰ্য্যপ্রভাবে শত্ৰুগণকে সংহার করিলেন।

“এইরূপে ক্ষণকালমধ্যেই দানবকুল নির্মূল হইলে তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের সন্নিধানে গমন করিলেন। ইন্দ্ৰ তাঁহাকে উপনীত দেখিয়া আলিঙ্গনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে স্কন্দ! যে মহিষদৈত্য ব্ৰহ্মদত্ত-বীরপ্রভাবে দেবগণকে তৃণতুল্য জ্ঞান করিত, তুমি সেই দেবকণ্টক অসুরকে বিনাশ করিয়াছ। পূর্ব্বে যাহারা আমাদিগকে যুদ্ধে একান্ত পরিতাপিত করিয়াছিল শত মহিষাসুরতুল্য বলশালী সেই অসুরগণ আজি তোমা হইতেই বিনষ্ট হইয়াছে এবং তোমারই পরিষদবর্গ অবশিষ্ট অসুরদিগের রুধিরপান ও মাংসভক্ষণ করিয়াছে। তুমি দেবাদিদেব মহাদেবের ন্যায় শত্ৰুগণের অজেয়; তোমার এই প্রাথমিক অদ্ভুত কর্ম্ম ত্ৰিলোকে প্রখ্যাত এবং এই কীর্ত্তি চিরস্থায়িনী হইবে, অধিক কি, অদ্যাবধি দেবগণ তোমার বশংবদ হইয়া রহিলেন।”

“এই বলিয়া দেবরাজ ইন্দ্র ভগবান ত্ৰ্যম্বকের অনুজ্ঞানুসারে দেবগণের সহিত স্বস্থানে প্রস্থান করিলে দেবাদিদেব রুদ্র দেবগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “তোমরা স্কন্দকে আমার সদৃশ প্রভাবসম্পন্ন জ্ঞান করিবে, এক্ষণে আমি ভদ্রবটে চলিলাম।” এইরূপ নির্দেশ করিয়া তিনি গমন করিলেন। হে মহারাজ! কৃত্তিকানন্দন স্কন্দ এইপ্রকারে অসুরদিগকে সংহার করিয়া মহর্ষিগণের পূজা গ্রহণপূর্ব্বক এক দিবসে ত্ৰৈলোক্য জয় করিলেন। যে ব্ৰাহ্মণ সমাহিত হইয়া স্কন্দের এই জন্মবৃত্তান্ত পাঠ করেন, তাঁহার পুষ্টি ও স্কন্দের সলোকতা লাভ হয়।”