২৪১. গন্ধর্ব্ব যুদ্ধে দুৰ্য্যোধনের পরাজয়-সপরিবার বন্ধন— সেনাগণের পাণ্ডবশরণাগতি

২৪১তম অধ্যায়

গন্ধর্ব্ব যুদ্ধে দুৰ্য্যোধনের পরাজয়-সপরিবার বন্ধন— সেনাগণের পাণ্ডবশরণাগতি

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! গন্ধর্ব্বগণকর্ত্তৃক মহারথ কর্ণ পরাভূত হইলে কৌরবসেনা সমরে পরাঙ্মুখ হইয়া পলায়ন করিল, কিন্তু দুৰ্য্যোধন সকলকে রণবিমুখ ও পলায়নপর নিরীক্ষণ করিয়াও স্বয়ং বিমুখ হইলেন না; তিনি কেবল একমাত্র সাহস সহায় হইয়া মহাবলপরাক্রান্ত দুর্জ্জয় গন্ধর্ব্ব-সৈন্যের উপর অনবরত শর-বর্ষণ করিতে লাগিলেন; গন্ধৰ্ব্বসেনা তদীয় অচিন্ত্য শর বর্ষণ সন্দর্শন করিয়া তাঁহাকে নিহত করিবার মানসে রথের চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিল এবং রথের ধ্বজ, সারথি, যূপ, সৈন্য, অশ্ব, ত্ৰিবেণু ও তল্প প্রভৃতি সমুদয় বস্তু বাণদ্বারা খণ্ড খণ্ড করিতে লাগিল।

মহাবাহু চিত্ৰসেন দুৰ্য্যোধনকে বিরথ ও ভূতলনিপতিত অবলোকন করিয়া নিকটে আগমনপূর্ব্বক জীবিতাবস্থায় তাঁহাকে গ্ৰহণ করিলেন এবং অন্যান্য গন্ধর্ব্বসকল মিলিত হইয়া, রথস্থ দুঃশাসনকে চতুর্দ্দিক হইতে আক্রমণ করিল এবং বিবিংশতি, চিত্ৰসেন, বিন্দ ও অনুবিন্দ প্রভৃতি ধার্ত্তরাষ্ট্র ও রাজপত্নী দিগকে লইয়া ইতস্ততঃ প্ৰস্থান করিল। এইরূপে মহীপতি দুৰ্য্যোধন অপহৃত হইলে তাঁহার সেনাগণ গন্ধর্ব্বগণকর্ত্তৃক তাড়িত হইয়া যানযুগ্ম, শকট, আপণ, বেশ্যা ও পূর্ব্বপলায়িত সেনাসমভিব্যাহারে পাণ্ডবগণের শরণাগত হইয়া কহিল, “হে পাণ্ডবগণ! গন্ধর্ব্বগণ মহারাজ দুৰ্য্যোধন, দুর্ব্বিষহ, দুৰ্ম্মুখ, দুর্জ্জন ও রাজপত্নী দিগকে বন্ধন করিয়া হরণ করিয়াছে, এক্ষণে আপনারা তাঁহাদিগের অনুগমন করুন।” দুৰ্য্যোধনের অমাত্যবর্গ এই কথা বলিয়া অতি দীনমনে বাষ্পকুললোচনে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের শরণাপন্ন হইল।

দুৰ্য্যোধন-নিৰ্য্যাতনে ভীমের প্রসন্নভাব

ভীমসেন সেই সকল বৃদ্ধ, দীনভাবাপন্ন, যুধিষ্ঠিরের অনুগ্রহপ্রার্থী, অতি কাতর, দুৰ্য্যোধনের অমাত্যদিগকে কহিলেন, “আমরা বদ্ধপরিকর হইয়া গজবাজী সংগ্রহপূর্ব্বক প্ৰযত্নাতিশয়সহকারে যে কাৰ্য্য করিতাম, আজি গন্ধর্ব্বরা তাহা সম্পন করিয়াছেন। মনুষ্যের মনোরথ-সকল সফল হয় না; তাহারা মনে মনে একপ্রকার চিন্তা করে, কিন্তু অন্য প্রকার ঘটিয়া উঠে; কপট দ্যূতবেদী ধৃতরাষ্ট্রের দুৰ্ম্মন্ত্রণার ফল এই। ইহা সকলেই অবগত আছেন যে, যাহারা অক্ষম ব্যক্তির প্রতি দ্বেষ করে, অবশ্যই তাহারা অন্যদ্বারা প্রতিফল প্রাপ্ত হয়।

“অদ্য গন্ধর্ব্বেরা আমাদিগের সমক্ষে এই অলৌকিক কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়াছেন। ইহা পরম সৌভাগ্যের বিষয় যে, আমাদিগের হিতচিকীর্ষু [উপকার করায় ইচ্ছুক] ব্যক্তিও ভূমণ্ডলে আছে, আমরা স্বচ্ছন্দে নিশ্চেষ্ট রহিয়াছি, কিন্তু অন্য লোকে আমাদিগের ভার অনায়াসে বহন করিল। যে দুর্ম্মতি মনে করিয়াছিল, আপনি পরমসুখে থাকিবেন, আর আমরা শীত, আতপ, বাতবর্ষার নিরতিশয় ক্লেশপরম্পরায় কালব্যাপন করিব, আদ্য সেই অধর্ম্মচারী দুরাত্মা কৌরবের স্বভাবানুবর্ত্তী লোকেরা পরাভব প্রত্যক্ষ করুক। আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি, কুন্তীতনয়েরা অনুশংস, কিন্তু যে ব্যক্তি ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে এই কুমন্ত্রণা প্রদান করিয়াছে, সেই অধার্ম্মিক।”

উগ্ৰস্বভাব ভীম ক্ৰোধে পরিপূর্ণ হইয়া কৌরবদিগের প্রতি এইরূপ কটুবাক্য প্রয়োগ করিতেছেন দেখিয়া রাজা যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভীমসেন! এ সময় এরূপ ব্যবহার করা পুরুষের উচিত নহে।”