২১২. দেহে প্ৰাণাদি পঞ্চবায়ুর কার্য্য

২১২তম অধ্যায়

দেহে প্ৰাণাদি পঞ্চবায়ুর কার্য্য

‘ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে নরোত্তম! বিজ্ঞানাখ্য তেজোধাতু পার্থিব দেহ আশ্রয় করিয়া কেন দেহাভিমানী হয় এবং প্ৰাণাদি বায়ু নাড়ীমার্গে অবলম্বন করিয়া কি প্রকারে দেহচেষ্টাসকল বিধান করে?”

“ব্যাধ কহিল, “হে ব্ৰহ্মন! বিজ্ঞানোপাধিক বহ্নি চিদাত্মাকে আশ্রয় করিয়া শরীরকে সচেতন করে; প্ৰাণ বিজ্ঞান ও চিদাত্মার সহিত মিলিত হইয়া চেষ্টামান হয়; বিজ্ঞানাত্মা, চিদাত্মা ও প্রাণের সমষ্টিই জীবাত্মা; ইহাতেই ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান সমুদয় প্রতিষ্ঠিত আছে, ইনি সর্ব্বভূতের শ্রেষ্ঠ এবং সকলের কারণ; আমরা ইহার উপাসনা করিয়া থাকি। এই জীবই সর্ব্বভূতের আত্মা; ইনিই সনাতন পুরুষ; ইনিই মহান, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও শব্দাদি বিষয়। ইঁহার দ্বারাই লোকসকলের আন্তরিক ও বাহ্যিক চেষ্টা সম্পন্ন হয়। ইনি উপাধির আবেশ প্রভাবে জীবভাবলাভানন্তর জঠরানল আশ্রয়পূর্ব্বক মূত্রাশয় ও পুরীষাশয়ে পৃথক, পৃথক গতি লাভ করেন। মূত্র ও পুরীষারাশি বহন করিয়া অপানবায়ু পরিবর্ত্তিত হইয়া থাকে, সেই এক অপানবায়ু প্ৰযত্ন, কর্ম্ম ও বল এই ত্ৰিবিধ বিষয়ে বিদ্যমান থাকে। অধ্যাত্মবেত্তা মহাত্মারা তাহাকেই উদানবায়ু বলিয়া কীর্ত্তন করেন। আর যে বায়ু মনুষ্যের শরীরসন্ধিতে সন্নিবিষ্ট আছে, তাহাই ব্যান বলিয়া অভিহিত হয়।

“ত্বগাদিমধ্যে ব্যাপ্ত জঠরানল বায়ুপ্রেরিত হইয়া অন্নাদি রস, শোণিতাদি ধাতু ও পিত্তাদি দোষসমুদয় পরিণত করিয়া সঞ্চরণ করিতেছে। প্ৰাণাদি বায়ুর একত্ৰ সন্নিপাতহেতু সঙ্ঘর্ষণ জন্মে; সেই সঙঘর্ষনজনিত উষ্মাকেই জঠরাগ্নি কহে, উহাতেই দেহীদিগের অন্নাদি ভুক্তবস্তু-সকল পরিপাক হইয়া থাকে। সমান ও উদানমধ্যে প্রাণ ও অপানবায়ু সমাহিত আছে, তন্নিমিত্ত প্ৰাণ, অপান ও সমান সপ্তবায়ুর সঙঘর্ষজনিত অনল সপ্তধাতুময় দেহকে সম্যক পরিবৰ্দ্ধিত করিতেছে। সেই অগ্নির পায়ু পৰ্য্যন্ত প্ৰদেশকে অপান বলিয়া নির্দেশ করে। সেই অপান হইতে দেহীদিগের প্রাণাদি পঞ্চবায়ুর প্রবাহ সঞ্জাত হইতেছে। অগ্নিবেগে উৰ্দ্ধগামী প্ৰাণ অপানান্তে প্রতিহত ও ঊৰ্দ্ধে উত্থিত হইয়া পুনর্ব্বার অগ্নিকে উৎক্ষিপ্ত করে। নাভির অধোভাগ পাকস্থলী ও উৰ্দ্ধভাগ আমাশয়। নাভিমধ্যে প্ৰাণসকল প্রতিষ্ঠিত আছে। শরীরস্থ নাড়ীসকল প্ৰাণ প্রভৃতি দশবিধ বায়ুদ্বারা প্রেরিত ও হৃদয় হইতে উদ্ধ, অধঃ ও তিৰ্য্যগভাবে প্রবৃত্ত হইয়া অন্নারস-সকল বহন করিতেছি। জিতক্লম ও ধীর যোগীরা এই নাড়ীপথদ্বারা ব্ৰহ্মাকে লাভ করিয়া থাকেন এবং মস্তকে আত্মাকে ধারণ করেন। এইরূপে সর্ব্বদেহে প্রাণ ও অপান বায়ু বিস্তীর্ণ রহিয়াছে।

ধর্ম্মব্যাধের মোক্ষাধর্ম্ম ব্যাখ্যা

“লিঙ্গশরীরাত্মক ও প্ৰাণাদি ষোড়শকলাসম্পন্ন, সুতরাং মূর্ত্তিমান আত্মাকে নিত্য যোগবলে অবগত হইবে। স্থালীসমাহিত অগ্নির ন্যায় যিনি ঘোড়শকলায় নিরন্তর অবস্থিতি করেন, তাঁহাকে আত্মা বলিয়া জানিবে, পদ্মপত্ৰস্থ জলবিন্দুর ন্যায় যে দেব ষোড়শকলায় অবস্থান করিতেছেন, তিনিই নিত্যপরমাত্মা ও যোগ লভ্য। জীবাত্মা সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণের আশ্রয় ও নির্গুণ পরমাত্মার বশংবদ। জড়—শরীরাদি জীবের উপভোগ্য বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন। আত্মা জীবরূপে স্বয়ং চেষ্টমান হইয়া ঈশ্বরীরূপে সকলকে চেষ্টমান করেন। আত্মজ্ঞানীরা সেই আত্মাকে জীব ও ঈশ্বর অপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং সপ্তভুবন-প্রবর্ত্তক বলিয়া কীর্ত্তন করেন। এইরূপে ভূতাত্মা সর্ব্বভুতে প্রকাশমান হইতেছেন। জ্ঞানবানের সূক্ষ্মবুদ্ধিদ্বারা তাঁহাকে দর্শন করিয়া থাকেন। চিত্তের প্ৰসন্নতাবলে শুভাশুভ সমুদয় কমই বিনষ্ট হইয়া যায়, পরিশেষে সেই বিশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তি ব্ৰহ্মাসাক্ষাৎকারজনিত অনন্ত সুখসম্ভোগ করেন। যেমন পরিতৃপ্ত ব্যক্তি পরমসুখে নিদ্রিত হয় এবং সমীরণ-শূন্য প্রদেশে সুচারুরূপে প্ৰদীপিত দীপ যেমন সমুজ্জ্বলিত হইতে থাকে, আত্মপ্রসাদশালী ব্যক্তিও তদ্রূপ লক্ষিত হয়েন। অল্পাহারী বিশুদ্ধচিত্ত পুরুষ পূর্ব্ব রাত্ৰিতেই হউক বা পর-রাত্ৰিতেই হউক, নিরন্তর যোগসাধন ও হাদয়ে আত্মাকে সন্দর্শন করিয়া প্ৰদীপ্ততর দীপের ন্যায় মনোদ্বীপদ্বারা নিগুণ আত্মাকে অবলোকন করিয়া মুক্তিলাভ করেন।

‘সকল প্রকার উপায় উদ্ভাবনপূর্ব্বক ক্রোধ ও লোভকে বশীভূত করিলে লোকের পবিত্রতা-সম্পাদন হইয়া থাকে; তপস্যা কেবল সেতুস্বরূপ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। ক্ৰোধ উপস্থিত হইলে তপস্যা হয় না, মাৎসৰ্য্যের উদয় হইলে ধর্ম্মলাভ হয় না, মানাপমানের ভয় থাকিলে বিদ্যালাভ হয় না ও প্ৰমত্ত হইলে আত্মসাক্ষাৎকার লাভ হয় না। অতএব উক্ত দোষ-সকল পরিত্যাগ করিবে। অনুশংসতাই উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম, ক্ষমাই পরম বল, আত্মজ্ঞানই অতিপ্রধান জ্ঞান এবং সত্যই পরমপবিত্ৰ ব্ৰত। যাহা সাধারণের হিতজনক, তাহাই সত্য, সত্যই শ্রেয়োলাভের অদ্বিতীয় উপায়, সত্যপ্রভাবেই যথার্থ জ্ঞান ও হিতসাধন হয়।

‘যাঁহার সকল অনুষ্ঠানই কামনাশূন্য আর যিনি বিষয়বাসনাসকল একেবারে বিসর্জ্জন করিয়াছেন, তিনিই যথার্থ বুদ্ধিমান ও উদাসীন। গুরু এইরূপ উদাসীন ব্যক্তিকে যোগ শ্রবণ না করাইয়া সঙ্কেতদ্বারা তদ্বিষয়ে উপদেশ প্ৰদান করিবেন। ভোগ তৃষ্ণতে চিত্তের ঔদাস্য হইলে ক্ৰমে ক্ৰমে ব্রহ্মে প্রীতি জন্মে, তাঁহাকেই যোগসংজ্ঞিত ব্ৰহ্মসংযোগ বলিয়া জানিবে। সকলের সহিত মৈত্রীভাব সংস্থাপন করিবে, কোন প্রাণীকে হিংসা ও কদাচ কাহার সহিত বিবাদ করিবে না। বুদ্ধিপূর্ব্বক প্রতিগ্রহ পরিত্যাগ করিয়া ইহকাল ও পরকালে বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া সতত যতব্রত হইবে। অকিঞ্চনত্ব, সন্তোষ, নিরাশিত্ব, আচাপল্য ও আত্মজ্ঞান এই কয়েকটি বস্তুই সর্বোৎকৃষ্ট, ইহাদিগকে হৃদয়ে অবকাশ-দান করা অবশ্য কর্ত্তব্য।

তপঃপরায়ণ, দান্ত, সংযতাত্মা, অজিত, জয়াভিলাষী ও নিম্পৃহ মুনিগণের সহিত সর্ব্বদা সঙ্গত হইবে। যিনি সুখদুঃখ সমুদয় পরিত্যাগপূর্ব্বক সর্ব্ববিষয়ে একান্ত নিম্পূহ তিনিই গুণাগুণসম্পন্ন, ললনাদিসঙ্গহীন, জীবাত্মনিষ্পপাদ্য, জ্ঞানাধিগম্য, স্বৰ্গাদিসুখবিশিষ্ট এবং জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়স্বরূপ ব্ৰহ্মলাভ করিতে সমর্থ হয়েনি। হে দ্বিজোত্তম! আমি যেরূপ শ্রবণ করিয়াছি, সংক্ষেপে তাহাই কহিলাম, এক্ষণে আর কি কীর্ত্তন করিব, বলুন।’ ”