২২৫. ঋষিপত্নীগণকর্ত্তৃক কার্ত্তিকেয়-রক্ষাবিধান

২২৫তম অধ্যায়

ঋষিপত্নীগণকর্ত্তৃক কার্ত্তিকেয়-রক্ষাবিধান

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীৰ্য্য কীর্ত্তিকেয় জন্মগ্রহণ করিলে ভয়ানক উৎপাত উপস্থিত হইতে লাগিল। স্ত্রী-পুরুষের বৈরভাব, শীত-গ্ৰীষ্মের একান্ত প্রাদুর্ভাব ও দিঙ্মুণ্ডল, নভঃস্থল এবং গ্রহসকল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। পৃথিবী ভীষণরূপে শব্দায়মান হইতে লাগিল। মহর্ষিগণ চতুর্দ্দিকে এইরূপ ভয়ঙ্কর উৎপাত সন্দর্শনে উদ্বিগ্নমনে সকলের শান্তি বিধান করিতে লাগিলেন। চৈত্ররথ-কাননে যাহারা নিয়ত বাস করিতেছিল, তাহারা ভগবানপাবক সপ্তর্ষিগণের ছয় পত্নীর সহিত সমাগত হইয়া এই অনর্থপরম্পরা ঘটাইতেছেন, এই কথা বারংবার কহিতে লাগিল। কেহ কেহ সুপর্ণীকে গমন করিতে দেখিয়া কহিল, “তোমা হইতেই এই অনৰ্থপতি হইতেছে।” কিন্তু স্বাহা যে এরূপ অনুষ্ঠান করিয়াছেন, কেহই ইহার বিন্দুবিসর্গও অনুধাবন করিতে পারিল না। অনন্তর সুপর্ণী ‘এইটি আমারই পুত্ৰ’ এই বলিয়া সে কার্ত্তিকেয়-সন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিল, “হে বৎস! আমি তোমার জননী।”

“বনবাসীরা কহিল, “এই ছয় ঋষিপত্নীই ষড়াননের প্রসূতি।” এইরূপে সপ্তর্ষিগণ সন্তানোৎপত্তিসংবাদ শ্রবণ করিয়া তৎক্ষণাৎ দেবী অরুন্ধতী ব্যতিরেকে ছয় পত্নীকে পরিত্যাগ করিলেন, তখন স্বাহা সপ্তর্ষিগণকে কহিলেন, এইটি আমারই পুত্র। সুপর্ণী যাহা কহিয়াছে, তাহা নিতান্ত বিরুদ্ধ। বিশ্বামিত্ৰ সপ্তর্ষিগণের যজ্ঞসম্পাদনপূর্ব্বক প্রচ্ছন্নভাবে কামানলদদ্ধ পাবকের পশ্চাদ্ভাগে উপস্থিত হইয়াছিলেন, এই নিমিত্ত তিনি এই বিষয়ের আদ্যোপান্ত সমস্ত অবগত আছেন। তিনি প্রথমতঃ কুমারের শরণাপন্ন হইয়া স্তব করেন; পরে ত্রয়োদশ প্রকার মাঙ্গলিক কৌমারকাৰ্য্য সম্পাদন ও জাতকর্ম্মাদি ক্রিয়াসকল সমাধান করিয়াছেন এবং লোকহিতার্থে ষড়াননের মাহাত্ম্যকীর্ত্তন, কুক্কুট-অস্ত্রের সাধন এবং শক্তি-দেবী ও পারিষদবর্গের আরাধনা করেন; এই কারণে তিনি কুমারের অতি পীতিভাজন হইয়াছেন।

“মহাতপাঃ বিশ্বামিত্ৰ স্বাহার মুনিপত্নীরূপ-ধারণ অবগত হইয়া সপ্তর্ষিদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে মহর্ষিগণ! আপনাদিগের সহধর্ম্মিণীরা কিছুমাত্র অপরাধ করেন নাই।” সপ্তর্ষিগণ বিশ্বামিত্ৰমুখে আদ্যোপান্ত এই কথা শ্রবণ করিয়াও সন্দিগ্ধমনে স্ব স্ব পত্নী দিগকে পরিত্যাগ করিলেন।

“অনন্তর দেবগণ কার্ত্তিকেয়ের জন্মবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া ইন্দ্ৰকে কহিলেন, “হে ত্ৰিদশনাথ! আপনি শীঘ্রই কার্ত্তিকেয়কে সংহার করুন, তাহার বলবীৰ্য্য নিতান্ত অসহ্য হইয়াছে; অতএব বিলম্ব করা উচিত নহে। যদি আপনি তাহাকে বিনাশ না করেন, তাহা হইলে সে আপনাকে ও আমাদিগকে ত্ৰৈলোক্যের সহিত পরাভব করিয়া নিশ্চয়ই ইন্দ্ৰত্ব অধিকার করিবো।” তখন দেবরাজ নিতান্ত ব্যথিত হইয়া দেবগণকে কহিলেন, “দেবগণ! সেই মহাবলপরাক্রান্ত বালক স্ববিক্রমপ্রভাবে বিশ্ববিধাতা ব্ৰহ্মাকেও বিনাশ করিতে পারে, অতএব আমি তাহাকে কিরূপে সংহার করিব?”

“দেবগণ কহিলেন, “হে ইন্দ্ৰ! এক্ষণে বুঝিলাম, আপনার বলবীৰ্য্য সমুদয় হ্রাস হইয়া গিয়াছে; নতুবা কি নিমিত্ত আপনি এরূপ কহিতেছেন? যাহা হউক, আদ্য অসাধারণক্ষমতাপন্ন লোকমাতা-সকল স্কন্দ-সন্নিধানে গমন করুন, ইঁজারাই তাহাকে বিনাশ করিবেন।” মাতৃগণ এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র ‘তথাস্তু’ বলিয়া প্ৰস্থান করিলেন।

“অনন্তর মাতৃগণ সেই অতুলবল বালককে অবলোকন করিয়া বিষণ্নবদনে মনে মনে চিন্তা করিলেন, ‘আমরা কোনরূপেই ইহাকে বিনাশ করিতে পারিব না।” পরে তাঁহারা কার্ত্তিকেয়ের শরণাপন্ন হইয়া কহিলেন, “হে বৎস! তুমি আমাদিগের পুত্রস্বরূপ, আমরা কোন অংশেই নিন্দনীয় নহি, এবং পুত্রবাৎসল্যও নিতান্ত বিহ্বল হইয়াছি, অতএব তুমি আমাদিগকে মাতৃভাবে অভিনন্দন কর।” কার্ত্তিকেয় এই কথা শ্রবণ করিয়া লোকমাতৃগণের স্তন্যপান-বাসনায় যথোচিত উপচারে অৰ্চনা ও তাঁহাদিগের মনোভিলাষ পূর্ণ করিলেন। এই অবসরে মহাবল অগ্নি তথায় উপস্থিত হইলে কুমার তাঁহার অৰ্চনা করিলেন। অগ্নি তৎকৃত সৎকারগ্রহণপূর্ব্বক মাতৃগণের সহিত মিলিত হইয়া তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া রক্ষা করিতে লাগিলেন। পরে মাতৃগণের ক্ৰোধপ্রভাবে এক নারী সমুৎপন্ন হইল। যেমন জননী স্বীয় সন্তানকে রক্ষা করিয়া থাকেন, তদ্রূপ ঐ নারী শূলধারণপূর্ব্বক এবং ক্রুরদর্শনা রুধিরপ্রিয়া লোহিতসাগর দুহিতার ন্যায় কার্ত্তিকেয়কে আলিঙ্গনপূর্ব্বক রক্ষা করিতে লাগিলেন। আগমনপ্ৰসিদ্ধ অগ্নি ছাগরূপী ও বহুসন্তানসম্পন্ন হইয়া সতত ক্রীড়নকদ্বারা অচলস্থ কুমার কার্ত্তিকেয়ের প্রীতিসম্পাদনা করিতেন।”