৫৭. দুৰ্য্যোধনসহ নকুলসহদেবযুদ্ধ

৫৭তম অধ্যায়

দুৰ্য্যোধনসহ নকুলসহদেবযুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহারথ কর্ণ, চেদি ও কেকয়পরিবৃত ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে স্বয়ং অবরোধ করিয়া শরনিকরে নিবারণ করিলেন। তৎপরে তিনি মহাবীর ভীমের সমক্ষেই চেদি, কারূষ ও সৃঞ্জয়গণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। তখন ভীমপরাক্রম ভীমসেন কর্ণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক তৃণদহনপ্রবৃত্ত হুতাশনের ন্যায় রোষে প্রজ্বলিত হইয়া কৌরবসৈন্যাভিমুখে গমন করিলেন; মহাবীর সূতপুত্রও মহাধনুর্দ্ধর পাঞ্চাল, কেকয় ও সৃঞ্জয়গণকে সংহার করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় সংশপ্তকগণকে বিনাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। হে মহারাজ! এইরূপে ক্ষত্রিয়গণ সেই অনলসঙ্কাশ তিন মহারথকর্ত্তৃক নিতান্ত নিপীড়িত ও বিনষ্ট হইতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহারাজ দুৰ্য্যোধন একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া নয়বাণে নকুলকে বিদ্ধ করিয়া শরনিকরে তাঁহার চারিটি অশ্বকে নিপীড়িত করিলেন এবং খরধার ক্ষুরদ্বারা সহদেবের কাঞ্চনধ্বজ খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর নকুল সাত ও সহদেব পাঁচশরে দুৰ্য্যোধনকে বিদ্ধ করিলেন; রাজা দুৰ্য্যোধনও পাঁচ পাঁচ শরে তাঁহাদের বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিয়া দুইভল্লে শাসন ও শর ছেদনপূর্ব্বক পুনরায় তাঁহাদিগকে ত্রিসপ্ততিশরে বিদ্ধ করিলেন।। তখন দেবকুমারতুল্য মহাবীর নকুল ও সহদেব অবিলম্বে ইন্দ্ৰচাপসদৃশ অন্য দুই কার্ম্মুক গ্রহণপূর্ব্বক মহাদেব যেমন পর্ব্বতের উপর বারিবর্ষণ করে, তদ্রূপ রাজা দুৰ্য্যোধনকে লক্ষ্য করিয়া অনবরত শনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহারাজ দুৰ্য্যোধন একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক নকুল ও সহদেবকে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। তৎকালে কেবল তাঁহার শরাসন মণ্ডলীকৃত ও শরনিকর অনবরত নিপতিত হইতেছে, ইহাই নিরীক্ষিত হইতে লাগিল। তিনি দিবাকরের করজালের ন্যায় শরজালে দিত্মণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে রণস্থল শরময়, নভস্থল শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইলে নকুল ও সহদেবের রূপ কালান্তক যমের ন্যায় লক্ষিত হইতে লাগিল। ঐ সময় মহারথগণ রাজা দুর্য্যোধনের পরাক্রম সন্দর্শন করিয়া যমজ নকুল ও সহদেবকে যমরাজের সন্নিহিত বলিয়া অনুমান করিতে লাগিলেন।

দুৰ্য্যোধন-ধৃষ্টদ্যুমযুদ্ধ—দুৰ্য্যোধন-পরাজয়

“তখন পাণ্ডবসেনাপতি মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন নকুল ও সহদেবকে অতিক্রমপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনসন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া শরনিকরে তাঁহাকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন; ক্রোধনস্বভাব দুৰ্য্যোধনও ধৃষ্টদ্যুম্নকে প্রথমতঃ পঞ্চবিংশতি ও তৎপরে পঞ্চযষ্টি শরে বিদ্ধ করিয়া সুতীক্ষ্ণ ক্ষুরপ্ৰদ্বারা তাঁহার সশর শরাসন ও হস্তাবাপ [দস্তানা] ছেদনপূর্ব্বক সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন রোষকষায়িতলোচনে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন স্ববীর্য্যপ্রভাবে প্রজ্বলিত হইয়াই যেন সেই ছিন্ন কার্ম্মুক পরিত্যাগপূর্ব্বক ভারসহনক্ষম অন্য এক শরাসন গ্রহণ করিয়া দুর্য্যোধনের সংহারবাসনায় নিশ্বসন্ত পন্নগের ন্যায় পঞ্চদশ নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। সেই শিলানিশিত নারাচনিকর পরিত্যক্ত হইবামাত্র দুৰ্য্যোধনের সুবর্ণখচিত বর্ম্ম ভেদ করিয়া মহাবেগে বসুধাতলে প্রবিষ্ট হইল। তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধন সেই ধৃষ্টদ্যুম্ননিক্ষিপ্ত নারাচে গাঢ়তর বিদ্ধ, ছিন্নবৰ্ম ও জর্জ্জুরীকৃতকলেবর হইয়া, বসন্তকালে কুসুমসমূহসুশোভিত কিংশুকবৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া একভল্লে ধৃষ্টদ্যুম্নের কার্ম্মুক ছেদনপূর্ব্বক সত্বর দশসায়কে তাঁহার ললাটদেশ বিদ্ধ করিলেন। সেই কর্ম্মারপরিমার্জ্জিত নারাচনিকর দ্রুপদতনয়ের আননে সংলগ্ন হইয়া প্রফুল্ল কমলমধ্যস্থ মধুলোলুপ ভ্রমরপংক্তির। ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। অনন্তর মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন সেই ছিন্ন শরাসন পরিত্যাগপূর্ব্বক সত্বর অন্য এক ধনু ও ষোড়শ ভল্ল গ্রহণ করিলেন এবং পাঁচভল্লে দুর্য্যোধনের অশ্ব ও সারথিকে সংহার করিয়া একবল্লে শরাসন ছেদনপূর্ব্বক দশভল্লে তাঁহার সুসজ্জিত রথ, ছত্র, শক্তি, খ, গদা ও ধ্বজ ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলিলেন। তখন পার্থিবগণ দুর্য্যোধনের হেমাঙ্গদসমলঙ্কৃত বিচিত্র মণিময় নাগধ্বজ খণ্ড খণ্ড নিরীক্ষণ করিয়া চমৎকৃত হইলেন। ঐ সময় কুরুরাজের ভ্রাতৃগণ তাঁহাকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে রাজা দণ্ডধার ধৃষ্টদ্যুম্নসমক্ষে অসভ্রান্তমনে দুৰ্য্যোধনকে স্বরথে আরোপিত করিয়া তথা হইতে অপসৃত হইলেন।

সঙ্কুলযুদ্ধ–কর্ণকরে জিষ্ণুপ্রমুখ মহারথবধ

“এদিকে মহাবীর কর্ণ সাত্যকিকে পরাজিত করিয়া দুর্য্যোধনের হিতার্থে দ্রোণঘাতী ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি ধাবমান হইলেন; সাত্যকিও কুঞ্জর যেমন প্রতিপক্ষ কুঞ্জরের জঘনদেশে দশনাঘাত করে, তদ্রূপ সূতপুত্রের পশ্চাদ্ভাগে শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! তখন কর্ণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের মধ্যস্থলে বীরগণের ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল। কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষীয় কোন বীরই তৎকালে সমরে পরাঙ্মুখ হইলেন না।

“অনন্তর মহারথ কর্ণ সত্বর পাঞ্চালগণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। সেই মধ্যাহ্নকালে উভয়পক্ষের অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যসকল বিনষ্ট হইতে লাগিল। তখন পাঞ্চালগণ বিহঙ্গেরা যেরূপ আবাসবৃক্ষে ধাবমান হয়, তদ্রূপ কর্ণকে পরাজয় করিবার বাসনায় তাতাঁর অভিমুখে ধাবমান হইল; মহাবীর কর্ণও রোষপরবশ হইয়া প্রাণপণে যুদ্ধে প্রবৃত্ত ব্যাঘ্রকেতু, সুশৰ্মা, চিত্র, উগ্ৰায়ুধ, জয়, শুক্ল, রোচমান ও সিংহসেন–এই কয়টি পাঞ্চালদেশীয় প্রধান বীরকে লক্ষ্য করিয়া শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন ঐ সমুদয় বীরেরা রথসমূহদ্বারা মহারথ কর্ণকে পরিবেষ্টন করিলেন। সূতপুত্র তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ঘোরতর সমরে প্রবৃত্ত সেই আটজন মহাবীরকে সুনিশিত আটশরে আহত করিয়া সমরবিশারদ অন্যান্য অসংখ্য বীরকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি জিষ্ণু, জিষ্ণুকর্ম্মা, দেবাপি, ভদ্র, দণ্ড, চিত্রায়ুধ, চিত্র, হরি, সিংহকেতু, রোমান ও শলভ এবং চেদিদেশীয় বহুসংখ্যক মহারথকে বিনাশ করিলেন। ঐ বীরগণের বধসাধনসময়ে কর্ণের কলেবর রুধিরলিপ্ত হইয়া রুদ্রদেবের দেহের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। ঐ সময় করিনিকর কর্ণশীরে তাড়িত ও নিতান্ত ভীত হইয়া রণস্থল একান্ত আকুলিত করিয়া চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল এবং কতকগুলি কর্ণশরে নিহত হইয়া ঘোরতর চীৎকারপূর্ব্বক বজ্রবিদলিত অঞ্চলের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইতে লাগিল। নিহত হস্তী, অর্শ ও মখুয্যের দেহে সূতপুত্রের গমনপথ সমার্ণ হই। হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ তৎকালে যেরূপ করিলেন, আপনার পক্ষীয় ভীষ্ম, দ্রোণমুখ কোন যোগাই গণস্থলে সেরা অদ্ভুত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে সমর্থ হয়েন নাই। ঐ মহাবীর অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, রথ ও মনুষ্যগণকে বিনষ্ট করিলেন এবং সিংহ যেমন মৃগযূথমধ্যে নির্ভয়ে বিচরণপুর্ব্বক তাহাদিগকে বিদ্রাবিত করে, তদ্রূপ তিনি পাঞ্চালগণের মধ্যে নিঃশঙ্কচিত্তে সঞ্চরণ করিয়া তাহাদিগকে দ্রাবিত করিতে গাগিলেন। ঐ সমস্ত মহারথ সিংহের মুখকুহরে প্রবিষ্ট মৃগগণের ন্যায় 
সূ
তপুত্রের সমক্ষে সমাগত হইয়া পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলেন। মনুষ্যগণ যেমন অগ্নির উত্তাপে দগ্ধ হয়, তদ্রূপ সৃঞ্জয়গণ কর্ণের রোসানলে দগ্ধ হইতে লাগিল। হে মহারাজ! এইরূপে চেদি, কৈকয় ও পাঞ্চালগণমধ্যে অনেকেই কর্ণের শরে সমাহত হইয়া স্ব স্ব নামোল্লেখপূর্ব্বক নিহত হইল। তৎকালে মহাবীর কর্ণের পরাক্রমদর্শনে আমার বোধ হইয়াছিল যে, পাঞ্চালগণমধ্যে কোন বীরই জীবিতাবস্থায় কর্ণের হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হইবে না।

সঙ্কুলযুদ্ধ–কর্ণকর্ত্তৃক পাণ্ডবসৈন্যনিপীড়ন

“অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কর্ণশরে পাঞ্চালগণকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া ক্রোধভরে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, সহদেব, নকুল, জনমেজয়, সাত্যকি, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ও প্রভদ্রকগণ এবং অন্যান্য অসংখ্য বীর অগ্রসর হইয়া কর্ণকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক তাঁহার উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর সূতপুত্র গরুড় যেমন পন্ন গগণকে আক্রমণ করে, তদ্রূপ একাকী সেই সমস্ত চেদি, পাঞ্চাল ও পাণ্ডবদিগকে আক্রমণ করিলেন। অনন্তর দেবাসুরসংগ্রামের ন্যায় তাঁহাদিগের সহিত কর্ণের ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। দিবাকর যেমন অন্ধকার নিরাস করেন, মহাবীর সূতপুত্র একাকীই অনাকুলিত চিত্তে সেই একত্র সমবেত শরনিকরবর্ষী বীরদিগকে পরাভূত করিতে আরম্ভ করিলেন।

“ঐ সময় মহাবীর ভীমসেন কর্ণকে পাণ্ডবগণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত দেখিয়া ক্রোধভরে যমদণ্ডসদৃশ শরজালদ্বারা চতুর্দ্দিকে কৌরবসৈন্যগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। তিনি একাকী বাহ্লীক, কৈকয়, মৎস্য, বাসাত্য, মদ্র ও সৈন্ধবদিগের সহিত ঘোরতর সমরানল প্রজ্বলিত করিয়া অলৌকিক শোভাধারণ করিলেন। করনিকর তাঁহার নারাচে মর্ম্মদেশে সাতিশয় তাড়িত হইয়া মেদিনীমণ্ডল বিকশিত করিয়া আরোহীর সহিত ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। আরোহিবিহীন অসমুদয় ও পদাতিগণ ভীমশরে নির্ভিন্নকলেবর হইয়া অনবরত রুধিরমনপূর্ব্বক সমরশয্যায় শয়ন করিল। অসংখ্য রথী ভীমভয়ে নিতান্ত ভীত ও পতিতায়ুধ হইয়া প্রাণপরিত্যাগপূর্ব্বক ভূতলে নিপতিত হইলেন। তখন রণস্থল অশ্বারোহী, সারথি, পদাতি, অশ্ব, গজ ও ভীমের সায়কসমুদয়ে সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। দুর্য্যোধনের সৈন্যগণ ভীমভয়ে ভীত, প্রভাহীন, উৎসাহশূন্য ও দীনভাবাপন্ন হইয়া স্তম্ভিতের ন্যায় অবস্থান করিয়া শরৎকালীন নিশ্চেষ্ট মহাসাগরের ন্যায় অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল। হে মহারাজ! উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণ পরস্পর সংহারে প্রবৃত্ত হইয়া রুধিরধারায় সমাচ্ছন্ন হইল। এইরূপে মহাবীর সূতপুত্র পাণ্ডবসৈন্যদিগকে ও ভীমসেন কৌরবসৈন্যগণকে বিভ্রাবিত করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! সেই ঘোরতর অদ্ভুত সংগ্রামসময়ে মহাবীর অর্জ্জুন বহুসংখ্যক সংশপ্তককে নিহত করিয়া বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে জনার্দ্দন! এক্ষণে এই বলসমুদয় ছিন্নভিন্ন হইয়াছে। মহারথ সংশপ্তকগণ আমার বাণ নিবারণ করিতে অসমর্থ হইয়া সিংহশব্দার্ত্ত মৃগযূথের ন্যায় অনুগামীদিগের সহিত পলায়ন করিতেছে। এদিকে সৃঞ্জয়সৈন্যগণ কর্ণশরে বিদলিত হইতেছে। ঐ দেখ, ধীমান্ কর্ণের হস্তিকক্ষাধ্বজ সৈন্যমধ্যে বিরাজিত রহিয়াছে। ঐ মহাবীর মহাহ্লাদে যুধিষ্ঠিরের বলমধ্যে বিচরণ করিতেছে। অন্য কোন মহারথই উহাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবেন না। তুমিও সূতপুত্রের বল ও পরাক্রম অবগত আছ; অতএব আমার মতে অন্যান্য বীরগণকে পরিত্যাগ করিয়া সূতপুত্র যে স্থানে আমাদিগের সৈন্য বিদ্ৰাবিত করিতেছে, সেই স্থানে গমন করা কৰ্ত্তব্য। অথবা তোমার যাহা অভিরুচি, তাহাই অনুষ্ঠান কর।

কৃষ্ণবাক্যে অর্জ্জুনকর্ত্তৃক বহু শত্রুসৈন্যবধ

“মহাত্মা হৃষীকেশ অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণ করিয়া হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘হে পাণ্ডব! অবিলম্বে কৌরবগণকে বিনাশ কর।’ হে মহারাজ! তখন ধনঞ্জয়ের হংসবর্ণ সুবর্ণভূষণালঙ্কৃত অশ্বগণ কেশবকর্ত্তৃক সঞ্চালিত হইয়া আপনার সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিল। তাহাদের প্রবেশকালে আপনার সৈন্যগণ চারিদিকে ধাবমান হইল। ধনঞ্জয়ের সেই কম্পিতপতাকাবিরাজিত মেঘগম্ভীরগর্জনন বানরধ্বজ মহারথও বিমান যেমন স্বর্গে গমন করে, তদ্রূপ অনায়াসে কৌরবসৈন্যমধ্যে গমন করিল। এইরূপে সেই সমরনিপুণ রোষারুণনেত্র মহাবীর কেশব ও অর্জ্জুন তলশব্দে সংক্রুদ্ধ মাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায় ক্রোধান্বিতচিত্তে সেই বিপুল সৈন্য বিদারণপূর্ব্বক তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া ঋত্বিকগণকর্ত্তৃক সমাহূত যজ্ঞস্থলে সমাগত অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ন্যায় শোভমান হইলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন রথ ও অশ্বসমুদয়কে মর্দ্দিত করিয়া পাশধারী অন্তকের ন্যায় বাহিনীমধ্যে বিচরণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন সৈন্যমধ্যে ধনঞ্জয়কে বিক্রম প্রকাশ করিতে অবলোকন করিয়া পুনরায় সংশপ্তকগণকে অভিমুখীন হইতে আদেশ করিলেন। বীরগণ তাঁহার আজ্ঞা শ্রবণমাত্র সহস্র রথ, তিনশত হস্তী, চতুর্দ্দশসহস্র অশ্ব ও দুইলক্ষ ধনুর্ধারী যুদ্ধকোবিদ [রণপণ্ডিত] পদাতিসমভিব্যাহারে একেবারে চতুর্দ্দিক হইতে শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক অর্জ্জুনকে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। তখন অরাতিনিপাতন ধনঞ্জয় সংশপ্তকগণের শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া স্বীয় উগ্রতা প্রদর্শনপূর্ব্বক তাহাদিগকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিলে, তাহার মূর্তি সকলেরই প্রেক্ষণীয় হইয়া উঠিল। তাঁহার সৌদামিনীসমপ্রভ সুবর্ণভূষিত অনবরতনিক্ষিপ্ত শরজালে নভোমণ্ডল সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। অনন্তর মহাবীর পাণ্ডুনন্দন চতুর্দ্দিকে সরলাগ্র সুকর্ণপুঙ্খ শরনিকর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলে বোধ হইতে লাগিল যেন, সমুদয় প্রদেশ সর্পে সমাচ্ছন্ন হইয়াছে এবং তাহার তলশব্দে সমুদ্র, পর্ব্বত, ভূমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও নভোমণ্ডল বিকম্পিত হইতেছে।

“হে মহারাজ! এইরূপে মহারথ পাণ্ডুনন্দন দশসহস্র নরপালকে নিপাতিত করিয়া সত্বর সংশপ্তকসৈন্যের প্রপক্ষে গমন করিলেন। সংশপ্তকদিগের প্রপক্ষ কাম্বোজগণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়াছিল। মহাবীর ধনঞ্জয় তথায় সমুপস্থিত হইয়া, পুরন্দর যেমন দানবদিগকে বিদলিত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ সৈন্যগণকে প্রমথিত করিতে লাগিলেন। তিনি ভল্লদ্বারা আততায়ী অরাতিগণের শস্ত্রযুক্ত বাহু ও মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তাহারা অর্জ্জুনশরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গবিহীন ও আয়ুধশূন্য হইয়া বহু শাখাসঙ্কুল বাতাহত বনস্পতির ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুন হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিগণকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিলে কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণের কনিষ্ঠভ্রাতা তাঁহার উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন কুন্তীনন্দন দুই অর্দ্ধচন্দ্রবাণে তাঁহার পরিঘাকার ভুজদ্বয় ও ক্ষুরদ্বারা পূর্ণচন্দ্রসদৃশ মস্তক ছেদন করিলেন। কমললোচন প্রিয়দর্শন সুদক্ষিণানুজ অর্জ্জুনের শরে নিহত হইয়া শোণিতার্দ্রকলেবরে বজ্রবিদারিত গিরিশৃঙ্গের ন্যায়, কাঞ্চনস্তম্ভের ন্যায়, ভগ্ন সুমেরুপর্ব্বতের ন্যায় বাহন হইতে ভূতলে নিপতিত হইলেন। অনন্তর পুনরায় অতি অদ্ভুত ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। ঐ যুদ্ধে যোধগণের নানাপ্রকার অবস্থা ঘটিতে লাগিল। অর্জ্জুনের এক এক বাণে কাম্বোজ, যবন ও শকদেশসমুদ্ভূত অনেকানেক অশ্ব নিহত হইয়া রুধিরাক্তকলেবর হওয়াতে সমুদয়ই লোহিতবর্ণ হইয়া উঠিল। ঐ সময় অশ্বসারথিবিহীন রথী, আরোহিশূন্য অশ্ব, মহামাত্রহীন হস্তী ও হস্তিবিহীন মহামাত্রগণ পরস্পরের সংহারে প্রবৃত্ত হইলে ঘোরতর জনক্ষয়কর হইয়া উঠিল।

“এইরূপে মহাবীর ধনঞ্জয় সংশপ্তকগণের পক্ষ ও প্রপক্ষ বিনষ্ট করিলে মহাবীর অশ্বত্থামা সুবর্ণভূষিত কোদণ্ড বিধূনিত করিয়া সূর্য্যের করজালসদৃশ ঘোরতর শরজাল গ্রহণ করিয়া ক্রোধভরে মুখব্যাদানপূর্ব্বক দণ্ডধারী ক্রুদ্ধ অন্তকের ন্যায় সত্বর অর্জ্জুনের অভিমুখে গমন করিলেন। পাণ্ডবসৈন্যগণ সেই মহাবীরের অনবরত নিক্ষিপ্ত উগ্রতর শরনিকরে সমাহত হইয়া চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা হৃষীকেশকে রথোপরি অবস্থিত সন্দর্শন করিয়া পুনরায় প্রচণ্ড শরনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন রথস্থিত কেশব ও ধনঞ্জয় উভয়েই সেই শরজালে সমাচ্ছন্ন হইলেন। ঐ সময় প্রবল প্রতাপ দ্রোণতনয় তীক্ষ্ণশনিকরে জগতের রক্ষক কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে নিশ্চেষ্ট করিলে কি স্থাবর, কি জঙ্গম সকলেই হাহাকার করিতে লাগিল। সিদ্ধ ও চারণগণ জগতের হিত চিন্তা করিয়া চতুর্দ্দিক হইতে সমাগত হইলেন। হে মহারাজ! সেই যুদ্ধে অশ্বত্থামা কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে আচ্ছাদিত করিয়া যেরূপ পরাক্রম প্রকাশ করিলেন, ইতিপূর্ব্বে কখনই সেরূপ পরাক্রম আমার নয়নগোচর হয় নাই। ঐ সময় সিংহগর্জনের ন্যায় দ্রোণপুত্রের অরাতিবিত্ৰাসক [শত্রুর ভয়োৎপাদক] কার্ম্মুকশব্দ বারংবার শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। তাঁহার শরাসনজ্যা মেঘমধ্যস্থিত সৌদামিনীর ন্যায় শোভা ধারণ করিল। মহাবীর অর্জ্জুন তাদৃশ দৃঢ়হস্ত ও ক্ষিপ্রকারী হইয়াও তৎকালে অশ্বত্থামাকে অবলোকনপূর্ব্বক নিতান্ত মুগ্ধের ন্যায় আপনার পরাক্রম নিহত [নিস্তেজ] বোধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় অশ্বত্থামার মুখমণ্ডল ও কলেবর অতি দুর্নিরীক্ষ্য হইয়া উঠিল।

অর্জ্জুনযুদ্ধে অশ্বত্থামার পরাজয়

“হে মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন ও আচাৰ্য্যপুত্রের এইরূপ ভীষণ সংগ্রামে অশ্বত্থামা অধিকবল ও ধনঞ্জয় ন্যূনবল হইলে মহাত্মা হৃষীকেশ সাতিশয় রোষাবিষ্ট হইলেন। তিনি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক রোষকষায়িতলোচনে দগ্ধ করিয়াই যেন বারংবার অশ্বত্থামা ও অর্জ্জুনের উপর দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন এবং প্রণয়বাক্যে অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ভ্রাতঃ! আজ দ্রোণপুত্র তোমাকে অতিক্রম করাতে আমি নিতান্ত আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছি। আজ কি তোমার বলবীৰ্য্য অবসন্ন হইয়াছে? তোমার হস্তে বা রথে কি গাণ্ডীবশরাসন বিদ্যমান নাই? তোমার মুষ্টি ও বাহুদ্বয়ে কি কোন আঘাত হইয়াছে? আজ কি নিমিত্ত দ্রোণতনয়কে উদ্ধৃপ্ত দেখিতেছি? হে ধনঞ্জয়! গুরুপুত্রবোধে উহাকে উপেক্ষা করিও না। ইহা উপেক্ষার সময় নহে।’

“হে মহারাজ! মহাত্মা বাসুদেব এইরূপ কহিলে মহাবীর ধনঞ্জয় চতুর্দ্দশ ভল্ল গ্রহণপূর্ব্বক সত্বর দ্রোণতনয়ের ধ্বজ, ছত্র, পতাকা, রথ, শক্তি, গদা ও শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং সত্বর তাঁহার জত্রুদেশে দৃঢ়রূপে বৎসদন্ত শরনিকর প্রহার করিলেন। মহাবীর দ্রোণপুত্র সেই আঘাতে মূর্চ্ছিত হইয়া ধ্বজষ্টি অবলম্বন করিয়া রহিলেন। তখন তাঁহার সারথি তাঁহাকে শরপীড়িত ও বিসংজ্ঞ অবলোকন করিয়া পরিত্রাণার্থ রথ লইয়া অপসৃত হইল। ঐ অবসরে শত্রুতাপন ধনঞ্জয় মহাবীর দুৰ্য্যোধন। সমক্ষেই আপনার অসংখ্য সৈন্য বিনাশ করিলেন।

“হে মহারাজ! আপনার কুমন্ত্রণাতেই তৎকালে এইরূপ কৌরবসৈন্যগণের ঘোরতর বিনাশ উপস্থিত হইল। ঐ সময় ক্ষণকালমধ্যেই মহাবীর অর্জ্জুন সংশপ্তকগণকে, বৃকোদর কৌরবগণকে এবং কর্ণ পাঞ্চালগণকে বিমর্দ্দিত করিলেন। এইরূপে বীরজনক্ষয়কারক ঘোরতর সংগ্রাম উপস্থিত হইলে সমরাঙ্গনে চতুর্দ্দিকে অসংখ্য কবন্ধ সমুত্থিত হইল। তৎকালে রাজা যুধিষ্ঠির সমবেদনায় নিতান্ত কাতর হইয়া সমরস্থল হইতে একক্রোশ দূরে গমনপূর্ব্বক অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।”