৫৫. সঙ্কুলযুদ্ধ-কৃপকরে সুকেতুসংহার

৫৫তম অধ্যায়

সঙ্কুলযুদ্ধ-কৃপকরে সুকেতুসংহার

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় কৃতবর্ম্মা, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণ, উল্ক, সৌবল ও ভ্রাতৃগণপরিবেষ্টিত রাজা দুৰ্য্যোধন সমুদ্রমধ্যস্থ ভগ্ননৌকার ন্যায় স্বপক্ষীয় সেনাগণকে পাণ্ডবভয়ে নিতান্ত ব্যাকুলিত ও অবসন্ন অবলোকন করিয়া তাহাদিগকে রক্ষা করিলেন। অনন্তর মুহূর্ত্তকালমধ্যে ভীরুজনের ভয়জনক ও শূরগণের হর্ষবর্দ্ধন ভীষণ সংগ্রাম উপস্থিত হইল। কৃপনির্ম্মুক্ত শরনিকর শলভসমূহের ন্যায় সৃঞ্জয়গণকে সমাচ্ছন্ন করিল। তখন শিখণ্ডী রোষাবিষ্টচিত্তে সত্বর কৃপের প্রতি ধাবমান হইয়া তাঁহার চতুর্দ্দিকে শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন; মহাস্ত্রবিৎ কৃপাচাৰ্য্যও সেই শরবর্ষণ নিবারণ করিয়া সরোষনয়নে শিখণ্ডীকে দশবাণে বিদ্ধ করিলেন। তখন শিখণ্ডী রোষপরতন্ত্র হইয়া অজিহ্মগামী [অকুটিলগতি—সরলগামী] সাতবাণে কৃপাচাৰ্য্যকে বিদ্ধ করিলেন। মহারথ কৃপ শিখণ্ডীর শরে বিদ্ধ হইয়া নিশিতশরনিকরদ্বারা তাঁহার অশ্ব, সারথি ও রথ বিনষ্ট করিয়া ফেলিলেন। তখন মহারথ শিখণ্ডী সেই অশ্বহীন রথ হইতে অবরোহণপূর্ব্বক খড়্গ ও চর্ম্ম ধারণ করিয়া সত্বর কৃপাচার্য্যের প্রতি ধাবমান হইলেন, কৃপাচাৰ্য্যও নতপর্ব্বশরনিকরে সহসা সমাগত শিখণ্ডীকে সমাচ্ছন্ন করিয়া তত্ৰত্য জনগণকে চমৎকৃত করিলেন। হে মহারাজ! ঐ সময়ে আমরা শিখণ্ডীকে, নিশ্চেষ্ট হইয়া সমরে অবস্থান করিতে অবলোকন করিয়া উহা শিলাপ্লাবনের [জলে পাথর ভাসার মত] ন্যায় নিতান্ত অদ্ভুত জ্ঞান করিতে লাগিলাম। তখন মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডীকে কৃপের শরে সমাচ্ছন্ন দেখিয়া অবিলম্বে গোতমনন্দনের [কৃপাচার্য্যের] প্রতি ধাবমান হইলেন। মহারথ কৃতবর্ম্মা ধৃষ্টদ্যুম্নকে কৃপের রথাভিমুখে ধাবমান দেখিয়া সত্বর তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন। ঐ সময় ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরও পুত্র ও সৈন্যগণসমভিব্যাহারে কৃপাচার্য্যের অভিমুখে গমন করিতেছিলেন, তদ্দর্শনে মহাবীর অশ্বত্থামা তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। দুৰ্য্যোধন ত্বরান্বিত মহারথ নকুল ও সহদেবকে শরবর্ষণদ্বারা নিবারণ করিয়া আক্রমণ করিলেন। মহাবীর কর্ণ ভীমসেন এবং করূষ, কৈকেয় ও সৃঞ্জয়গণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা কৃপাচার্য্য শিখণ্ডীকে দগ্ধ করিবার নিমিত্তই যেন তাঁহার প্রতি সত্বর শরজাল পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর শিখণ্ডী বারংবার তলবারণ বিঘূর্ণনপূর্ব্বক তাঁহার সুবর্ণপুঙ্খ শরনিকর ছেদন করিতে লাগিলেন। তখন কৃপাচার্য্য অনতিবিলম্বে শরনিকরদ্বারা দ্রুপদপুত্রের শতচন্দ্রযুক্ত চর্ম্মচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল। মহাবীর শিখণ্ডী এইরূপে চর্ম্মবিহীন হইয়া করে তরবারিধারণপূর্ব্বক মৃত্যুর বশীভূত আতুরের ন্যায় কৃপের বশীভূত হইলেন।

“তখন মহাবলপরাক্রান্ত চিত্রকেতুপুত সুকেতু শিখণ্ডীকে কৃপের শরে পরিবৃত ও নিতান্ত ক্লিষ্ট দেখিয়া সত্বর বিবিধ শরনিকরে কৃপাচার্য্যকে সমাচ্ছন্ন করিয়া তাঁহার রথাভিমুখে আগমন করিলেন। ঐ সময় শিখণ্ডী দ্বিজবর কৃপাচাৰ্য্যকে সুকেতুর সহিত যুদ্ধে নিযুক্ত দেখিয়া পলায়নে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহাবীর সুকেতু প্রথমতঃ নয়, তৎপরে সপ্ততি ও পুনরায় তিনবাণে কৃপকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার সশর শরাসন ছেদনপূর্ব্বক একবাণে সারথির মর্ম্মভেদ করিলেন। কৃপাচার্য্য তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া অন্য এক সুদৃঢ় শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক ত্রিংশৎ শরে সুকেতুর সমুদয় মর্ম্ম আহত করিলেন। মহাবীর সুকেতু কৃপাচার্য্যের শরাঘাতে বিকলাঙ্গ হইয়া ভূমিকম্পকালীন পাদপের ন্যায় রথোপরি কম্পিত হইতে লাগিলেন। দ্বিজবর কৃপাচার্য্য সেই অবসরে ক্ষুরপ্রদ্বারা তাঁহার উজ্জ্বল কুণ্ডল, উষ্ণীষ ও শিরস্ত্রাণসম্বলিত মস্তক ছেদন করিয়া শ্যেনাহৃত আমিষের ন্যায় ভূতলে নিপাতিত করিলেন। তৎপরে সুকেতুর কলেবরও রথ হইতে ধরাতলে নিপতিত হইল। এইরূপে মহাবীর সুকেতু নিহত হইলে তাঁহার সৈন্যগণ কৃপকে পরিত্যাগপূর্ব্বক দশদিকে পলায়ন করিতে লাগিল।

“এদিকে মহারথ কৃতবর্ম্মা সমরে ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিবারণ করিয়া আনন্দিতচিত্তে ‘থাক থাক্‌’ বলিয়া তর্জন করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! আমিষের নিমিত্ত ক্রুদ্ধ শ্যেনপক্ষিদ্বয়ের যেরূপ যুদ্ধ হয়, বৃষ্ণিপ্রবর কৃতবর্ম্মা ও পাঞ্চালতনয় ধৃষ্টদ্যুম্নের তদ্রূপ ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন কোপাবিষ্ট হইয়া হার্দ্দিক্যকে নিপীড়িত করিয়া নয়বাণে তাঁহার বক্ষঃস্থল আহত করিলেন; মহাবল কৃতবর্ম্মাও দ্রুপদতনয়ের শরে নিপীড়িত হইয়া শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহাকে রথ ও অশ্বের সহিত সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তখন রথারূঢ় ধৃষ্টদ্যুম্ন কৃতবর্ম্মার শরে পরিবৃত হইয়া জলধারাবর্ষী জলদজালে সমাবৃত সূর্য্যের ন্যায় অদৃশ্য হইলেন এবং ক্ষণকালমধ্যে কনকভূষিত বিশিখজালে সেই বাণসকল দূরীকৃত করিয়া কৃতবর্ম্মার প্রতি সুতীক্ষ্ণ শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন; সমরনিপুণ হার্দ্দিক্যও বহু সহস্র শরে সহসা সমাগত দুরাসদ শরবৃষ্টি নিরাকৃত করিলেন। তখন সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন স্বীয় শরজাল নিবারিত দেখিয়া কৃতবর্ম্মাকে নিবারণপূর্ব্বক ভল্লদ্বারা তাঁহার সারথিকে নিপাতিত করিলেন। হে মহারাজ! মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন এইরূপে মহাবলপরাক্রান্ত অরাতিকে পরাজিত করিয়া অবিলম্বে কৌরবগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন; কৌরবগণও সিংহনাদপরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি ধাবমান হইয়া পুনর্ব্বার যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন।”