২৯৯. কুণ্ডলাহরণপৰ্বাধ্যায়

২৯৯তম অধ্যায়

কুণ্ডলাহরণপৰ্বাধ্যায়

জনমেজয় কহিলেন, হে ব্ৰহ্মান! মহর্ষি লোমশ রাজা যুধিষ্ঠিরকে দেবরাজের এই বাক্য কহিয়াছিলেন যে, “হে ধর্ম্মরাজ! তোমার হৃদয়ে যাহার ভয় নিরন্তর জাগরকে রহিয়াছে ও তুমি যাহার বিষয় কুত্ৰাপি কীর্ত্তন কর নাই, ধনঞ্জয় এ স্থান হইতে প্রস্থান করিলে আমি তাহা অপহরণ করিব।” হে মহর্ষে। এক্ষণে তাহার বৃত্তান্ত কীর্ত্তন করুন।

কর্ণের কুণ্ডলঘটিত দিবাকর প্রদত্ত স্বপ্ন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! তুমি যাহা জিজ্ঞাসা করিলে, তদ্বিষয় কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। অরণ্যমধ্যে পাণ্ডবদিগের দ্বাদশ বৎসর অতিক্রান্ত হইলে একদা সুররাজ ইন্দর তাঁহাদিগের হিতচিকীৰ্ষ হইয়া কর্ণসমীপে ভিক্ষার্থে গমন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। সহস্ররশ্মি [সূৰ্য্য] ও সহস্ৰলোচনের [ইন্দ্র] অভিপ্রায় অবগত হইয়া অপত্যস্নেহবশতঃ করুণার্দ্রহৃদয়ে রজনীযোগে কর্ণের নিকট আগমন করিলেন। সত্যপরায়ণ মহাবীর কর্ণ তৎকালে বিশ্রব্ধচিত্তে [বিশ্বস্ত] মহামূল্য শয়নে শয়ান ও নিদ্রিত ছিলেন; দিবাকর বেদবিৎ ব্ৰাহ্মণের বেশ ধারণা করিয়া স্বপ্নযোগে তাঁহাকে সান্তনাপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “বৎস কর্ণ! আমি সৌহার্দ্দবশতঃ তোমার পরম হিতকর বাক্য কহিতেছি, শ্রবণ করা। দেবরাজ পাণ্ডবগণের হিতাভিলাষে ব্রাহ্মণবেশে কুণ্ডলাপহরণ করিবার নিমিত্ত তোমার সমীপে আগমন করিবেন। তিনি তোমার এই স্বভাব অবগত হইয়াছেন এবং সমস্ত জগতেও ইহা প্রচারিত হইয়াছে যে, তুমি কাহারও নিকটে প্রার্থনা কর না; কিন্তু সাধুগণ বিশেষতঃ ব্রাহ্মণগণ তোমার নিকটে যাহা প্রার্থনা করেন সাধ্যমতে অবশ্যই তাহা প্ৰদান করিয়া থাক, কাহাকেও প্রত্যাখ্যান কর না। পাকশাসন তোমার এবংবিধ স্বভাব অবগত হইয়া তোমার নিকট কুণ্ডল ও কবচ ভিক্ষা করিতে আসিবেন। তুমি যাচমান পুরন্দরকে কুণ্ডলযুগল প্ৰদান না করিয়া সাধ্যানুসারে অনুনয়-বিনয় করিবে, ইহাই তোমার পক্ষে শ্রেয়ষ্কর। তিনি কুণ্ডললাভের নিমিত্ত তোমাকে বহুবিধ কারণ প্রদর্শনপূর্ব্বক বাগজাল বিস্তার করিবেন; তুমি রত্ন, স্ত্রী, গো প্রভৃতি অন্যান্য নানা ধনদ্বারা তাঁহাকে নিবারিত করবে। যদি তাহা না করিয়া সহজাত কুণ্ডলদ্বয় প্রদান কর, তাহা হইলে তুমি অবশ্যই গতায়ু হইয়া অচিরকালমধ্যে কালগ্রাসে নিপতিত হইবে। হে মানদ! তুমি কবচ ও কুণ্ডলযুগল সম্পন্ন বলিয়াই সমরে অরাতিগণের অবধ্য হইয়াছ। তোমার রত্নময় কবচ ও কুণ্ডলদ্বয় অমৃত হইতে সমুত্থিত হইয়াছে; অতএব যদি জীবিত থাকিতে বাসনা কর, তাহা হইলে উহা রক্ষা করা তোমার অবশ্যকর্ত্তব্য।”

কৰ্ণ কহিলেন, “ভগবন! আপনি কে ব্রাহ্মণবেশে প্রণয় প্রদর্শনপূর্ব্বক আমাকে উপদেশ প্রদান করিতেছেন, বলুন।”

সূর্য্য কহিলেন, “তাত! আমি সূর্য্য, সৌহার্দ্যনিবন্ধন তোমাকে দর্শন দিয়াছি। আমার কথা রক্ষা কর, তাহা হইলেই তোমার শ্ৰেয়েলাভ হইবে।”

কৰ্ণ কহিলেন, “যখন দিবাকর আজি আমার হিতান্বেষী হইয়া উপদেশ প্ৰদান করিয়াছেন, তখন আমি অবশ্যই শ্রেয়োলাভ করিব। কিন্তু হে বরদ! আমি প্ৰণয়পূর্ব্বক যাহা কহিতেছি, প্ৰসন্ন হইয়া শ্রবণ করুন। হে বিভাবসো! যদ্যপি আমি আপনার প্রতিভাজন হইয়া থাকি, তবে আমাকে ব্রত হইতে পরাঙ্মুখ করিবেন না। লোকমধ্যে আমার এই ব্ৰত প্রচারিত হইয়াছে যে, আমি ব্ৰাহ্মণগণকে প্ৰাণ পৰ্য্যন্ত প্ৰদান করিয়া থাকি; অতএব যদি দেবরাজ পাণ্ডবগণের হিতকামনায় আমার নিকটে বর্ম্ম ও কুণ্ডল ভিক্ষা করিতে আগমন করেন, আমি অবশ্যই তাঁহাকে উহা সমর্পণ করিব। আমি আমার ত্ৰিভুবন-সঞ্চারিণী কীর্ত্তি বিনষ্ট করিতে নিতান্ত পরাঙ্মুখ। মাদৃশ ব্যক্তির পক্ষে অকীৰ্তিকর প্রাণ প্রতিপালন অপেক্ষ যশস্কর মৃত্যুই শ্ৰেয়ঃ। অতএব যদ্যপি আখণ্ডল [ইন্দ্র] পাণ্ডবগণের হিতচিকীৰ্ষ হইয়া কুণ্ডলার্থে মৎসমীপে সমুপস্থিত হয়েন, আমি অবশ্যই তাঁহার মনোরথ পরিপূর্ণ করিব। তাহা হইলে সমস্ত জগতে আমার কীর্ত্তি ও তাঁহার অকীর্ত্তি দীপ্তি পাইতে থাকিবে।

“আমি প্ৰাণদান করিয়াও কীর্ত্তি লাভ করিতে বাসনা করি। কীর্ত্তিমান লোকেই স্বৰ্গলাভ করে এবং কীর্ত্তিভ্রষ্ট ব্যক্তি বিনষ্ট হয়। কীর্ত্তি মাতার ন্যায় পুরুষের জীবন রক্ষা করেন, কিন্তু কুকীর্ত্তি জীবিত মনুষ্যকেও গতজীবিত করিয়া ফেলে। বিধাতা স্বয়ং কহিয়াছেন যে, বিশুদ্ধ কীর্ত্তি পরলোকে পুরুষের প্রধান আশ্রয় হয়েন এবং ইহলোকে আয়ুর দীর্ঘতা সম্পাদন করেন। অতএব আমি শরীরজাত অচিরস্থায়ী কুণ্ডলদ্বয় প্রদান করিয়া চিরস্থায়িনী কীর্ত্তি লাভ করিব। ব্রাহ্মণগণকে যথাবিধি দান, দুষ্কর কর্ম্মের সংসাধন, সংগ্রামে অরাতিগণকে পরাজয় এবং পরিশেষে সমরানলে শরীরাহুতি প্ৰদান করিয়া কেবল কীর্ত্তি স্থাপন করিব। সংগ্রামে ভীত জীবিতাৰ্থী ব্যক্তিদিগকে অভয় প্রদান এবং বৃদ্ধ, বালক ও দ্বিজাতিগণকে মহাভয় হইতে পরিত্ৰাণ করিয়া ইহলোকে যশ ও পরলোকে স্বাগলাভ করিব। ফলতঃ নিশ্চয় জানিবেন যে, প্ৰাণদান করিয়াও কীর্ত্তি রক্ষা করাই আমার ব্ৰত। অতএব আমি দ্বিজবেশধারী পুরন্দরকে এই কীর্ত্তিকর ভিক্ষা প্রদান করিয়া চরমে দেবলোকে পরমপদে অধিরোহণ করিব।”