২৬১. দ্রৌপদীহরণপৰ্ব্বাধ্যায়

২৬১তম অধ্যায়

দ্রৌপদীহরণপৰ্ব্বাধ্যায়

জনমেজয় কহিলেন, হে মহামুনে! মহাত্মা পাণ্ডবগণ অরণ্যমধ্যে মুনিগণ-সমভিব্যাহারে বিচিত্ৰ কথাপ্রসঙ্গে চিত্তবিনোদনপূর্ব্বক দ্রুপদ-নন্দিনীর ভোজন পৰ্য্যন্ত আদিত্যপ্রদত্ত অক্ষয়ান্নে ও নানাবিধ আরণ্যক মৃগমাংসে অন্নার্থী ব্রাহ্মণগণের তৃপ্তিসাধন করিয়া সময়াতিপাতে প্ৰবৃত্ত হইলে কৰ্ণ, শকুনি ও দুরাত্মা ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ তাঁহাদিগের সহিত যেরূপ আচরণ করিয়াছিল, তাহা কীর্ত্তন করুন।

দূর্য্যোধনসমীপে দুর্ব্বাসার আতিথ্যস্বীকার

বৈশম্পায়ন কহিলেন, নরনাথ! বনবাসী পাণ্ডবগণ নগরনিবাসী মানবের ন্যায় জীবিকা নির্ব্বাহ করিতেছেন শ্রবণ করিয়া রাজা দুৰ্য্যোধন এবং কপটাচারণপরায়ণ কৰ্ণ, দুরাত্মা দুঃশাসন প্রভৃতি সকলে বিবিধ উপায়দ্বারা পাণ্ডবগণের অনিষ্টচিন্তা করিতেছে, এমন সময়ে মহাযশাঃ দুর্ব্বাসা দশসহস্র শিষ্য-সমভিব্যাহারে যাদৃচ্ছাক্রমে তথায় সমুপস্থিত হইলেন। শ্ৰীমান দুৰ্য্যোধন ও তাহার ভ্রাতৃগণ পরমকোপন তপস্বীকে অবলোকন করিয়া বিনয়, প্রশ্রয় ও দম অবলম্বনপূর্ব্বক আতিথ্যদ্বারা তাঁহাকে আমন্ত্রণ এবং কিঙ্করবৃত্তি গ্রহণ করিয়া যথাবিধি পূজা করিলেন।

তিনি যে কয়েক দিবস তথায় অবস্থিতি করিয়াছিলেন, রাজা দুৰ্য্যোধন শাপভায়ে শঙ্কিত হইয়া আলস্য পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহার পরিচর্য্যা করিলেন। মহাতপঃ দুর্ব্বাসা ক্ষুধিত হইয়াছি, ‘শীঘ্র অন্ন প্রদান কর’ বলিয়া স্নান করিতে গমন করিলেন; কিন্তু বহুক্ষণের পর প্রত্যাগত হইয়া ‘আজি আহার করিব না, আজি আমার ক্ষুধা নাই’ বলিয়া অদর্শন হইতেন; পুনরায় সহসা আগমনপূর্ব্বক কহিতেন, “ত্বরান্বিত হইয়া আমাকে ভোজন করাও।” নিকৃতিপরায়ণ [শঠতাশ্রয়ী] দুর্ব্বাসা কখন নিশীথসময়ে উত্থান করিয়া পূর্ব্ববৎ অন্ন প্রস্তুত করাইতেন; কিন্তু তাহা ভোজন করিতেন না; প্রত্যুত তিরস্কার করিতেন। যখন রাজা দুৰ্য্যোধন তাঁহার তাদৃশ ব্যবহারও নির্ব্বিকারচিত্তে সহ্য করিতে লাগিলেন, তখন তিনি তাঁহার প্রতি পরিতুষ্ট হইয়া কহিলেন, “হে ভারত! তোমার কল্যাণ হউক। এক্ষণে বর প্রার্থনা কর, আমি প্রীত হইলে তোমার কিছুই দুষ্প্রাপ্য থাকিবে না।”

সশিষ্য দুর্ব্বাসাকে যুধিষ্ঠিরের আতিথ্যগ্ৰহণে দুৰ্য্যোধনের প্রার্থনা

দুর্ম্মতি দুৰ্য্যোধন ইতিপূর্ব্বে কর্ণ ও দুঃশাসনাদির সহিত মন্ত্রণা করিয়া প্রার্থনীয় বিষয় স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন; এক্ষণে শুদ্ধাত্মা মহর্ষির বাক্যশ্রবণে আপনাকে পুনর্জাত বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন এবং অতিমাত্র হর্ষোৎফুল্প হইয়া তাঁহার নিকটে এই প্রার্থনা করিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! রাজা যুধিষ্ঠির আমাদিগের কুলের জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ, গুণবান এবং শীলসম্পন্ন। তিনি এক্ষণে ভ্রাতৃগণের সহিত বনে বাস করিতেছেন, অতএব আপনি যেমন আমার নিকট সশিষ্যে আতিথ্যগ্রহণ করিয়াছেন, সেইরূপ তাঁহার নিকটও আতিথ্যগ্রহণ করুন। যে সময়ে সুকুমারী দ্রুপদকুমারী ব্ৰাহ্মণ ও স্বামীগণের ভোজনাবসানে স্বয়ং ভোজন করিয়া সুখে বিশ্রাম করিবেন, তৎকালেই আপনাকে তথায় গমন করিতে হইবে, আমার প্রতি এই অনুগ্রহ প্ৰদৰ্শন করুন।”

বিপ্ৰশ্রেষ্ঠ দুর্ব্বাসা কহিলেন, “আমি তোমার প্রতি প্রীতিবশতঃ অবশ্যই তাহা করিব।” এই বলিয়া অভিলষিত স্থানে প্রস্থান করিলেন। রাজা দুৰ্য্যোধন কৃতাৰ্থম্মান্য হইয়া হর্ষোৎফুল্লবদনে করদ্বারা কর্ণের করগ্রহণ করিলেন।

কৰ্ণ তাঁহার ভ্রাতৃগণের সমক্ষে কহিলেন, “হে কৌরব! সৌভাগ্যক্রমে তোমার অভিলাষ পূর্ণ হইল; তোমার শত্ৰুগণ দুস্তর ব্যসনাৰ্ণবে নিমগ্ন হইল এবং পাণ্ডবগণ দুর্ব্বাসার ক্রোধানলে পতিত হইল।” এইরূপে দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি সকলে পরমপ্রীতচিত্তে হাস্য করিতে করিতে স্ব স্ব নিকেতনে গমন করিল।