২৫৫. দুৰ্য্যোধনযজ্ঞে পাণ্ডবগণের নিমন্ত্রণ-প্রত্যাখ্যান

২৫৫তম অধ্যায়

দুৰ্য্যোধনযজ্ঞে পাণ্ডবগণের নিমন্ত্রণ-প্রত্যাখ্যান

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! তখন সমুদয় শিল্পী, অমাত্যগণ এবং মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর দুৰ্য্যোধনের সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! মহামূল্য সুবৰ্ণময় লাঙ্গল ও যজ্ঞের অন্যান্য দ্রব্য-সমূহ প্ৰস্তুত এবং শুভ সময়ও সমুপস্থিত হইয়াছে।” মহারাজ দুৰ্য্যোধন ইহা শ্রবণ করিয়া যজ্ঞ আরম্ভ করিতে অনুমতি করিলে পরে সেই ক্ৰতু যথাশাস্ত্ৰ অনুষ্ঠিত হইতে লাগিল। দুৰ্য্যোধন স্বয়ং শাস্ত্রানুসারে দীক্ষিত হইলেন। ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও যশস্বিনী গান্ধারী সাতিশয় প্ৰহৃষ্টমনে ভূপতিগণ ও ব্ৰাহ্মণসমূদয়ের নিমন্ত্রণের নিমিত্ত চতুর্দ্দিকে শীঘ্রগামী দূতসকল প্রেরণ করিতে লাগিলেন। দূতগণ তাঁহাদের অনুমতি প্ৰাপ্তিমাত্র দ্রুতপদসঞ্চারে গমন করিতে লাগিল। ঐ সময় দুঃশাসন উহাদের মধ্যে একজনকে কহিলেন, “হে দূত! তুমি দ্বৈতবনে গমনপূর্ব্বক পাপাত্মা পাণ্ডব ও তত্রস্থ বিপ্রসমুদয়কে নিমন্ত্রণ করিয়া আইস।”

দূত দুঃশাসনের আজ্ঞানুসারে পাণ্ডবগণ-সমীপে গমনপূর্ব্বক প্ৰণাম করিয়া কহিতে লাগিল, “হে মহারাজ! নরপতি দুৰ্য্যোধন স্ববীৰ্য্যার্জ্জিত অৰ্থজাতদ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠান করিতেছেন, যাবতীয় ভূপতি ও ব্রাহ্মণসকল তথায় আগমন করিতেছেন। কৌরবকুলগ্রণী নরনাথ দুৰ্য্যোধন আপনাকে আমন্ত্রণ করিবার নিমিত্ত আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন; তাহার মানস যে, আপনি তথায় উপস্থিত হইয়া যজ্ঞ দর্শন করেন।”

মহারাজ যুধিষ্ঠির দূতের বাক্য-শ্রবণানন্তর কহিলেন, “আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণের কীর্ত্তিবৰ্দ্ধন মহারাজ দুৰ্য্যোধন যে অত্যুৎকৃষ্ট যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতেছেন, ইহা পরমসৌভাগ্যের বিষয়, কিন্তু আমরা এক্ষণে কোনমতেই তথায় যাইতে পারিব না। আমাদিগকে অবশ্যই ত্ৰয়োদশ বর্ষ নিয়মানুসারে প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করিতে হইবে।”

ধর্ম্মরাজের বাক্যাবসান হইলে মহাবলপারাক্রান্ত ভীমসেন কহিলেন, “হে দূত! তুমি দুৰ্য্যোধনের সমীপে শীঘ্ৰ গিয়া বল যে, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ত্রয়োদশ বৎসর অতীত হইলে পর যখন যুদ্ধযজ্ঞে অস্ত্ৰাগ্নির মধ্যে তাহাকে নিক্ষেপ করিবেন, সেই সময় তাহার সহিত ইঁহার সাক্ষাৎকার হইবে। আর যখন ইনি সমরানলদগ্ধ ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণের উপর ক্রোধহবিঃ নিক্ষেপ করিবেন, তৎকালে আমিও তথায় গমন করিব।” মহাবীর বৃকোদর এই কথা বলিয়া নিস্তব্ধ হইলেন; অন্যান্য পাণ্ডবগণের কেহই কোন কটুক্তি করিলেন না। তখন দূত তথা হইতে দুৰ্য্যোধনসমীপে গমনপূর্ব্বক সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিল।

অনন্তর নানা জনপদের অধিপতি ভূপতিগণ ও ব্রাহ্মণ-সমুদয় হস্তিনানগরে আগমন করিতে লাগিলেন। তাঁহারা যথাবিধি পূজিত হইয়া পরামপ্রীত হইলেন। তখন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সমুদয় কৌরবগণে পরিবৃত হইয়া পরম পরিতুষ্ট-চিত্তে বিদুরকে কহিলেন, “হে ক্ষত্তঃ! যজ্ঞসদনে সমাগত সমুদয় লোক যাহাতে উত্তমরূপে ভোজন করিতে পায়, শীঘ্ৰ তদ্বিষয়ে চেষ্টা কর।” মহামতি বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের আদেশানুসারে যথাবিধি অন্ন, পান, গন্ধ, মাল্য ও বিবিধ প্রকার বস্ত্ৰদ্বারা সর্ব্ববর্ণের পূজা করিতে লাগিলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধন সমাগত ভূপতিবর্গের অবস্থানের নিমিত্ত উত্তমোত্তম গৃহ-সমুদয় নির্ম্মাণ করাইয়া দিলেন। পরিশেষে যজ্ঞ সমাপ্ত হইলে পর তাহাদিগকে ও ব্রাহ্মণগণকে বিবিধ ধন প্রদান ও সাত্ত্বনাপূর্ব্বক বিদায় করিয়া ভ্রাতৃগণ, কর্ণ ও শকুনিসমভিব্যাহারে হস্তিনানগরে প্রবেশ করিলেন।