২৮১. রামকর্ত্তৃক সীতান্বেষণে সুগ্ৰীবকে ত্বরান্বিতকরণ

২৮১তম অধ্যায়

রামকর্ত্তৃক সীতান্বেষণে সুগ্ৰীবকে ত্বরান্বিতকরণ

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! এদিকে রাম ও লক্ষ্মণ বানররাজ সুগ্ৰীবকর্ত্তৃক পালিত হইয়া মাল্যবান-পর্ব্বতের উপর বাস করিতে লাগিলেন। একদা রাম রজনীযোগে নির্ম্মল নভস্তলে চন্দ্ৰমা সমুদিত হইয়াছে ও গ্রহনক্ষত্ৰাদি তাহার চতুর্দ্দিকে শোভা পাইতেছে অবলোকনপূর্ব্বক নিদ্রিত হইলে প্রভাতকালীন কুমুদ, উৎপল, পদ্ম প্রভৃতি বিবিধ পুষ্পের পরিমলবাহী সুগন্ধ গন্ধবহের সুখস্পর্শে প্রতিবোধিত [জাগ্ৰত] হইলেন। তখন তিনি, সীতা রাক্ষসগারে বদ্ধ রহিয়াছেন, স্মরণ করিয়া সাতিশয় উৎকণ্ঠিতচিত্তে লক্ষ্মণকে কহিলেন, “হে সৌমিত্রে! তুমি কিষ্কিন্ধ্যা-নগরীতে সেই গ্ৰাম্যধর্ম্মনিরত [কামাদিভোগে আসক্ত] স্বার্থসাধনতৎপর কৃতঘ্ন বানররাজের নিকট গমন কর। যে কুলাধম মূঢ়কে আমি রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়াছি, গোপুচ্ছ প্রভৃতি নানাবিধ বানরনিবহ ও ঋক্ষগণ সতত যাহাকে ভজনা করিয়া থাকে, আমি যাহার নিমিত্ত তোমার সমভিব্যাহারে কিষ্কিন্ধ্যার উপবনে বালীকে বধ করিয়াছি, এক্ষণে সেই বানরাপসদ সুগ্ৰীবকে নিতান্ত কৃতঘ্ন বলিয়া বোধ হইতেছে। ঐ দুরাত্মা আমার এই দুর্দ্দশা একবার মনেও করে না। ইহাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে, সে মৎকৃত উপকার অল্পজ্ঞান করিয়া আমার অবমাননাপূর্ব্বক নিয়ম-প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইয়াছে। হে ভ্ৰাতঃ! তুমি তথায় গমন করিলেও যদি সেই দুরাত্মা নিশ্চেষ্ট ও কামবৃত্তিপরতন্ত্র হইয়া থাকে, তবে বালীর ন্যায় তাহাকেও যমালয়ে প্রেরণ করিও। আর যদি সে আমাদিগের কার্য্যসাধনে একান্তমনে নিযুক্ত হয়, তাহা হইলে তাহাকে এখানে আনয়ন করিও; সত্বর হও, বিলম্বে প্রয়োজন নাই।”

“গুরুজনহিতানুষ্ঠান-নিরত লক্ষ্মণ ভ্রাতার বচনানুসারে দিব্যাকামুক ও শর গ্রহণপূর্ব্বক কিষ্কিন্ধ্যায় গমন করিয়া নিৰ্ভয়ে পুরপ্রবেশ করিলেন। বানররাজ সুগ্ৰীব লক্ষ্মণকে ক্রুদ্ধ জানিতে পারিয়া সসম্ভ্রমে প্রত্যুদগমনপূর্ব্বক সস্ত্রীক হইয়া পূজা করিলেন। তখন সুমিত্ৰানন্দন নির্ভীকচিত্তে সুগ্ৰীবসন্নিধানে সমুদয় রামবাক্য কহিলেন। বানররাজ লক্ষ্মণের মুখে রামের আদেশ শ্রবণানন্তর ভৃত্য ও পত্নী-সমভিব্যাহারে কৃতাঞ্জলিপুটে নিতান্ত বিনীতভাবে কহিলেন, “হে লক্ষ্মণ! আমি মেধাহীন, অকৃতজ্ঞ বা নির্দ্দয় নহি। আমি সীতার অন্বেষণের নিমিত্ত যেরূপ প্ৰযত্ন করিতেছি, শ্রবণ কর। সুশিক্ষিত বানরগণকে চতুর্দ্দিকে প্রেরণ করিয়াছি, তাহাদিগকে একমাস পরে প্রত্যাগমন করিতে নিয়ম করিয়া দিয়াছি। ঐ সমুদয় বানর পর্ব্বতবনগ্রামনগর-সমবেত সমুদয় মেদিনীমণ্ডলে সীতার অন্বেষণ করবে। হে সৌমিত্রে! একমাস পূর্ণ হইবার আর পঞ্চরাত্ৰিমাত্র অবশিষ্ট আছে। ঐ পঞ্চরাত্ৰ অতীত হইলে তুমি রাম-সমভিব্যাহারে শুভসংবাদ শ্রবণ করিবে।’ লক্ষ্মণ সুগ্ৰীবের বাক্যশ্রবণে ক্ৰোধ পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহাকে প্রতিপূজন করিলেন। অনন্তর তিনি বানররাজকে সমভিব্যাহারে লইয়া রামসমীপে গমনপূর্ব্বক সুগ্ৰীবের কাৰ্য্যারম্ভের বিষয় নিবেদন করিলেন।

“ক্রমে ক্রমে বানরসমূহ সমাগত হইতে লাগিল। পূর্ব্ব, উত্তর ও পশ্চিম এই তিনদিকে যে সমুদয় বানর গমন করিয়াছিল। সকলেই প্রত্যাবর্ত্তন করিল; কিন্তু কেবল যাহারা দক্ষিণাভিমুখে গমন করিয়াছিল, তাহারাই প্রত্যাগত হইল না। সমাগত বানরগণ রামসমীপে আগমনপূর্ব্বক কহিল, “মহাশয়! আমরা সসাগরা সদ্বীপা সমুদয় মেদিনীমণ্ডল পরিভ্রমণ করিয়াছি; কিন্তু কোন স্থানেই সীতা বা রাবণের উদ্দেশ প্রাপ্ত হই নাই।” তখন বৈদেহীবিয়োগবিধুর রঘুনন্দন দক্ষিণদিকে উপস্থিত বানরগণের নিকট জানকীর বার্ত্তাশ্রবণের আশায় কথঞ্চিৎ জীবনধারণ করিতে লাগিলেন।

“দুইমাস অতীত হইলে পর একদা কতকগুলি বানর সত্বর সুগ্ৰীবসন্নিধানে সমাগত হইয়া কহিল, “মহারাজ! হনুমান, অঙ্গদ ও অন্যান্য যে সমুদয় বানরগণকে দক্ষিণদিকে প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহারা আসিয়া আজি আপনার চিররক্ষিত যত্নপূর্ব্বক পরিবর্দ্ধিত মধুবনে প্রবেশপূর্ব্বক সমুদয় ফলভক্ষণ করিতেছে।” কপিরাজ সুগ্ৰীব হনুমান প্রভৃতি বানরগণের সেই প্রণয়সূচক কাৰ্য্য-শ্রবণে তাঁহাদিগকে কৃতকাৰ্য্য বিবেচনা করিয়া আপনাকে কৃতাৰ্থ জ্ঞান করিলেন। তখন তিনি রামসমীপে ঐ বৃত্তান্ত কহিলে রামও মৈথিলী দৃষ্ট হইয়াছেন বলিয়া আনুমান করিলেন।

হনুমানের মুখে সীতার সংবাদপ্রাপ্তি

“অনন্তর হনুমান প্রভৃতি বানরগণ বিশ্রান্ত হইয়া রামলক্ষ্মণসন্নিধানে বানররাজ সুগ্ৰীবের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। রঘুবংশাবতংস রাম হনুমানের গতি ও মুখবর্ণ নিরীক্ষণ করিয়া সীতা দৃষ্ট হইয়াছেন বলিয়া প্রত্যয় করিলেন। তখন পূর্ণমানস হনুমান প্রভৃতি বানরগণ রাম, লক্ষ্মণ ও সুগ্ৰীবকে যথাবিধি প্ৰণাম করিলে রাম সশর শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক সেই সমুদয় বানরগণকে কহিতে লাগিলেন, ‘তোমরা কি কৃতকার্য্য হইয়াছ? আমায় কি জীবিত রাখিবে? আমি কি যুদ্ধে শত্রুবিনাশ করিয়া জানকীকে আনয়সপূর্ব্বক পুনরায় আযোধ্যায় রাজ্য করিব? আমি সীতার উদ্ধারসাধন ও সংগ্রামে শক্রগণকে বিনাশ না করিয়া কোনক্রমেই ক্ষান্ত হইব না। আমি হৃতদার ও অবমানিত হইয়া কদাচ জীবন ধারণ করিব না।’

“অনন্তর পবননন্দন হনুমান কহিলেন, “হে রাম! আমি আপনাকে একটি প্ৰিয়বাক্য কহিতেছি, শ্রবণ করুন। আমি আপনার জানকীকে নিরীক্ষণ করিয়াছি। আমরা বহুকাল অচলাকর [পর্ব্বতময়]-অরণ্যপরিপূর্ণ দক্ষিণদিক অনুসন্ধান করিয়া একান্ত ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হইয়া অতি গভীর এক গুহা অবলোকন করিলাম। ঐ গুহা বহুযোজন আয়ত, গাঢ় তিমিরে নিরন্তর সমাচ্ছন্ন, কীটকূলসঙ্কুল ও নিরবচ্ছিন্ন নিবিড় কাননে পরিপূর্ণ রহিয়াছে।

“আমরা তন্মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক বহুদূর গমন করিয়া দিবাকরের আলোক ও ময়দানবের পূর্ব্বভবন সুরম্য এক হর্ম্য অবলোকন করিলাম, সেই স্থানে প্ৰভাবতীনামী এক বর্ষীয়সী তাপসী তপস্যা করিতেছেন। আমরা তদ্দত্ত পানভোজনে পরিতৃপ্ত ও লব্ধবল হইয়া আপনার নির্দ্দিষ্ট পথ অবলম্বন-পূর্ব্বক গুহা হইতে বহির্গত হইলাম। পরে সহ্য, মলয় ও দদ্দুর-পর্ব্বত এবং অগাধ নীরনিধি নিরীক্ষণপূর্ব্বক মলয় পর্ব্বতে আরোহণ করিয়া সাতিশয় বিষণ্ন, ব্যথিত ও জীবিতাশায় নিরাশ হইলাম। আমরা সেই বহুযোজনবিস্তীর্ণ তিমিমকরনক্রসার্থ-পরিপূর্ণ মহার্ণব কিরূপে উল্লঙ্ঘন করিব, ইহাই নিতান্ত দীনমনে বারংবার ভাবিতে লাগিলাম।

‘অনন্তর আমরা সেই স্থানে প্ৰায়োপবেশনে কৃতসঙ্কল্প ও একত্ৰ সমাসীন হইয়া প্রসঙ্গক্রমে গৃধ্ররাজ জটায়ুর কথা কীর্ত্তন করিতে লাগিলাম। ইত্যবসরে উত্তুঙ্গ শৈলশৃঙ্গসদৃশ ঘোররূপ অতি ভীষণ এক পক্ষী নিরীক্ষণ করিলাম। সে আমাদিগকে ভক্ষণ করিবার অভিলাষে উপস্থিত হইয়া কহিল, ‘অহে! কে আমার ভ্রাতা জটায়ুর কথা কীর্ত্তন করিতেছ? আমি তাহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা সম্পাতি। একদা আমরা পরস্পর স্পৰ্দ্ধা করিয়া সূৰ্য্যসদনে উপস্থিত হইলে তাঁহার উত্তাপে আমার পক্ষ দগ্ধ হইয়া গেল, কিন্তু জটায়ুর পক্ষসকল তদ্রূপই রহিল। আমি দগ্ধপক্ষ হইয়া তৎক্ষণাৎ এই গিরিপৃষ্ঠে নিপতিত হইলাম।”

‘অনন্তর আমরা সম্পাতিকে জটায়ুর মৃত্যুসংবাদ নিবেদন করিলে তিনি ঐ অপ্ৰিয় সমাচার কর্ণগোচর করিয়া বিষণ্নবদনে আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে কপীন্দ্ৰগণ! রাম কে? সীতা কি নিমিত্ত অপহৃত হইয়াছেন ও জটায়ুরই বা কি নিমিত্ত মৃত্যুঘটনা হইল? আমি এই সমস্ত সবিস্তরে শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।” তখন আমরা আপনার বিপদ-বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া আমাদিগের প্রয়োপবেশনের বিষয় সকল নিবেদন করিলাম।

‘অনন্তর সম্পাতি আমাদিগকে উত্থাপিত করিয়া কহিলেন, “আমি রাবণকে সবিশেষ জ্ঞাত আছি, সাগরপারে ত্ৰিকূটকন্দরে তাহার রাজধানী লঙ্কাও দেখিয়াছি। তথায় সীতাদেবী অবস্থান করিতেছেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

সীতার প্রত্যভিজ্ঞানপ্রাপ্তিতে রামে আশ্বস্তি

“তখন আমরা সমুদ্র লঙ্ঘন করিবার নিমিত্ত মন্ত্রণা করিতে লাগিলাম, কিন্তু কেহই তদ্বিষয়ে অধ্যবসায় প্রকাশ করিলেন না দেখিয়া পরিশেষে আমিই পিতা পবনকে অবলম্বন করিয়া জলরাক্ষসী বিনাশপূর্ব্বক সেই শতযোজন বিত্তীর্ণ অতি ভীষণ সলিলরাশি অনায়াসেই অতিক্রম করিলাম এবং রাক্ষসরাজ রাবণের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া অতি দীনা সতী সীতাকে নয়নগোচর করিলাম। তিনি স্বামী-সমাগমলালসায় মগ্ন হইয়া উপবাস ও তপস্যায় নিরন্তর মনোনিবেশ করিয়া আছেন, তাঁহার মস্তকে জটাভার, সর্ব্বাঙ্গ মললিপ্ত ও নিতান্ত কৃশ। আমি সেই সকল পৃথক পৃথক লক্ষণে তাঁহাকে সীতা বোধ করিয়া সম্মুখীন হইয়া কহিলাম, “আর্য্যে! আমি পবনাত্মজ হনূমান, রামের দৌত্যকার্য্যে নিযুক্ত হইয়া দেবীকে দর্শন করিবার নিমিত্ত আকাশমার্গ দিয়া এই স্থানে উপস্থিত হইয়াছি। এক্ষণে রাজকুমার রামলক্ষণ কুশলে আছেন। কপিবর সুগ্ৰীব প্রভৃতি সকল বানর তাঁহাদিগের রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছেন। রাম ও লক্ষ্মণ আপনার সর্ব্বাঙ্গীণ কুশল-সংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, বীরবর সুগ্ৰীবও মিত্ৰভাবে আপনার মঙ্গলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। রাম মহাবল কপিবল-সমভিব্যাহারে সত্বরই লঙ্কাপুরে উপস্থিত হইবেন। হে দেবি! আমি প্রচ্ছন্নরূপী রাক্ষস নহি, আমাকে প্রকৃত বানর বলিয়াই বিশ্বাস করবেন।”

“তখন জনকদুহিতা সীতা মুহুর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “বৎস! একদা শিষ্টতম রাক্ষস অবিন্ধ্য আমাকে কহিয়াছিল যে, কপীশ্বর সুগ্ৰীব হনূমান প্রভৃতি মন্ত্রিসমূহে সতত পরিবৃত থাকেন, তদনুসারে তোমাকে জানিতে পারিয়াছি। এক্ষণে তুমি প্রস্থান কর।” এই বলিয়া তিনি অভিজ্ঞান[প্রত্যয়জনক স্মারক চিহ্ন]স্বরূপ এই মণিটি আমাকে প্ৰদান করিয়া আপনার মনে বিশ্বাস জন্মাইবার নিমিত্ত কহিলেন, “রাম মহাগিরি চিত্ৰকূটে অবস্থানকালে এক কাককে লক্ষ্য করিয়া ইষীকাস্ত্র নিক্ষেপ করিয়াছিলেন।” অনন্তর আমি রাক্ষসকর্ত্তৃক ধৃত হইয়া লঙ্কাপুরী দগ্ধ করিয়া আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।” এই বলিয়া মহাবীর হনূমান রামকে অৰ্চনা করিলেন।”