২৯৩. সত্যবানকে পতিরূপে গ্রহণে সাবিত্রীর সংকল্প

২৯৩তম অধ্যায়

সত্যবানকে পতিরূপে গ্রহণে সাবিত্রীর সংকল্প

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “অনন্তর একদা মহারাজ মদ্রাধিপতি নারদের সহিত সভামধ্যে সমুপবিষ্ট হইয়া কথোপকথন করিতেছেন, এমন সময়ে সাবিত্রী মন্ত্রিগণ-সমভিব্যাহারে সমুদয় তীর্থ ও আশ্রম পৰ্যটন করিয়া তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। রাজনন্দিনী স্বীয় পিতাকে নারদ-সমভিব্যাহারে উপবিষ্ট দেখিয়া মস্তকদ্বারা উভয়ের পাদবিন্দন করিলেন।

“তখন নারদ অশ্বপতিকে কহিলেন, “রাজন! তোমার এই দুহিতাটি কোথায় গিয়াছিল, কোথা হইতেই বা আগমন করিল? কন্যাটির যৌবনাবস্থা হইয়াছে, তথাপি কেন সৎপাত্রে সম্প্রদান করিতেছ না?’

“অশ্বপতি কহিলেন, “হে দেবর্ষে। আমি উহাকে সৎপাত্রসাৎ করিবার মানসে পাঠাইয়াছিলাম; এক্ষণে আপনি উহার মুখে শ্রবণ করুন, কাহাকে পতিত্বে বরণ করিয়াছে।’ দেবর্ষিকে এই কথা বলিয়া সাবিত্রীকে কহিলেন, ‘বৎসে! কাহাকে পতি করিতে মনস্থ করিয়াছ, বিশেষ করিয়া বল।’

“সাবিত্ৰী পিতার বাক্য-শ্রবণে উহা দেববাক্যতুল্য জ্ঞান করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে পিতঃ! পরমধার্ম্মিক দুমৎসেননামা ভূপতি শাল্ব-দেশের অধীশ্বর ছিলেন। কিয়দ্দিন পরে দুর্ব্বিপাকবশতঃ তাঁহার নেত্রদ্বয় বিনষ্ট হইয়া যায়। ঐ সময়ে তাঁর একমাত্র পুত্রের অতি শৈশবাবস্থা ছিল। রন্ধ্রান্বেষণকারী [ছিদ্রান্বেষী] বৈরিগণ তাঁহাকে অন্ধ ও তাঁহার পুত্রকে নিতান্ত বালক দেখিয়া তাহার রাজ্যাপহরণ করে। ভূপতি এইরূপে রাজ্যচ্যুত হইয়া সেই বালকপুত্র ও ভাৰ্য্যা-সমভিব্যাহারে অরণ্যে আগমনপূর্ব্বক তপানুষ্ঠানপরায়ণ হইয়াছেন। তাঁহার সেই পুত্রের নাম সত্যবান। সত্যবান নগরে জন্মগ্রহণ করিয়া তপোবনে পরিবর্দ্ধিত হইয়াছেন। তিনিই আমার অনুরূপ পতি। আমি মনে মনে তাহাকে বরণ করিয়াছি।’

“তখন নারদ অশ্বপতিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভূপতে! তোমার কন্যা বিশেষ না জানিয়া গুণবান। সত্যবানকে বরণ করিয়া কি অকাৰ্য্য করিয়াছে! সত্যবানের পিতা-মাতা সতত সত্যবাক্য প্রয়োগ করিয়া থাকেন বলিয়া ব্ৰাহ্মণগণ উহার সত্যবান নাম রাখিয়াছেন। সত্যবান বালককালে সাতিশয় অশ্বপ্রিয় ছিল এবং মৃন্ময় অশ্বনির্ম্মাণ ও চিত্রফলকে অশ্বের আকার অঙ্কিত করিত বলিয়া উহাকে চিত্রাশ্ব বলিয়াও আহ্বান করেন।”

“রাজা কহিলেন, ‘হে দেবর্ষে রাজতনয় সত্যবান এক্ষণে তেজ, বুদ্ধি, ক্ষমা, পিতৃবাৎসল্য ও শৌৰ্য্যগুণে অলকৃত হইয়াছেন ত’?’

“নারদ কহিলেন, ‘সত্যবান্‌ সূর্য্যের ন্যায় তেজস্বী বৃহস্পতির ন্যায় বুদ্ধিমান, ইন্দ্রের ন্যায় বলবীৰ্য্যসম্পন্ন ও বসুধার ন্যায় ক্ষমাবান।’

“রাজা কহিলেন, ‘রাজনন্দন সত্যবান দাতা, ব্ৰহ্মপরায়ণ, রূপবান, উদারস্বভাব ও প্রিয়দর্শন ত’?”

“নারদ কহিলেন, ‘প্রিয়দর্শন সত্যবান সংস্কৃতিনন্দন রান্তিদেবের ন্যায় দানশীল; উশীনরতনয় শিবির ন্যায় ব্রহ্মনিষ্ঠ ও সত্যবাদী; যযাতির ন্যায় উদার এবং অশ্বিনীতনয়ের ন্যায় রূপবান। তপোবৃদ্ধ ও শীলবান ব্যক্তিরা সংক্ষেপে কহেন যে, মহাবলপরাক্রান্ত সত্যবান দান্ত, মৃদু, সত্যবাদী, জিতেন্দ্ৰিয়, বন্ধুজনপ্রিয়, অসূয়াশূন্য, লজ্জাশীল, ধৃতিমান, ঋজুস্বভাব ও মৰ্যাদাপালক।’

“অশ্বাপতি কহিলেন, ‘হে তপোধন! আপনি সত্যবানের গুণের কথাই কহিলেন, এক্ষণে উহার যে সমুদয় দোষ আছে, তাহার উল্লেখ করুন।’

“নারদ কহিলেন, সত্যবানের একমাত্ৰ দোষ আছে; ঐ দোষ তাহার উক্ত সমুদয় গুণের অন্তরায় হইয়াছে; উহা নিবারণ করিবার কিছুমাত্র উপায় নাই। অশেষগুণসাগর সত্যবান অল্পায়ুঃ অদ্যাবধি সংবৎসর পরিপূর্ণ হইলে অকালে কালকবলে নিপতিত হইবে।’

অল্পায়ু জানিয়াও তৎপ্রত্যাখ্যানে সাবিত্রীর অনিচ্ছা

“তখন ভূপতি স্বীয় কন্যাকে কহিলেন, “সাবিত্রি! তুমি অন্য পুরুষকে পতিত্বে বরণ কর। সত্যবানের এক মহাদোষ তাহার সমুদয় গুণকে গ্ৰাস করিয়াছে। ভগবান নারদ কহিতেছেন যে, অদ্যাবধি সংবৎসর পূর্ণ হইলেই সে শমনসদনে গমন করিবে।”

“সাবিত্রী কহিলেন, “দ্রব্যের অংশ একবারমাত্ৰ নিপতিত হয়; কন্যাকে একবারই প্ৰদান করে; “দিদামি” এই বাক্য একবারই বলে; হে পিতঃ! এই তিন কাৰ্য্য এক একবারই অনুষ্ঠিত হয়। অতএব সত্যবান দীর্ঘায়ুই হউন আর অল্পায়ুই হউন, সগুণই হউন বা নিগুণই হউন, আমি যখন একবার তাঁহাকে পতিত্বে বরণ করিয়াছি, তখন তিনিই আমার পতি; আমি কদাপি আর কাহাকেও বরণ করিব না। দেখুন, কর্ম্ম প্রথমতঃ মনোদ্বারা নিশ্চিত হয়, তৎপরে বাক্যদ্বারা অভিহিত ও তৎপশ্চাৎ কাৰ্য্যদ্বারা সম্পাদিত হয়; অতএব আমার মতে মনই প্ৰমাণ।”

“তখন নারদ ভূপতিকে কহিলেন, “হে রাজন! তোমার কন্যার বুদ্ধি নিতান্ত স্থির, উহাকে কখনই এই ধর্ম্মপথ হইতে চালিত করিতে পরিবে না। সত্যবানের যে সমুদয় গুণ আছে, তাহা অন্য কোন পুরুষেই নাই; অতএব আমি কহিতেছি, তুমি সত্যবানকে কন্যা সম্প্রদান কর।”

“রাজা কহিলেন, “হে দেবর্ষে! আপনার বাক্য লঙঘন করে কাহার সাধ্য? আপনি যাহা কহিলেন, উহা যথার্থ, আপনি আমার গুরু, আপনি যাহা কহিলেন, তাহাই করিব।”

“নারদ কহিলেন, “হে রাজন! তুমি নির্ব্বিঘ্নে সাবিত্রী প্রদান কর, আমি চলিলাম। তোমাদের সকলেরই মঙ্গল হউক।”

“দেবর্ষি নারদ এই কথা বলিয়া ঊৰ্দ্ধমাগে [আকাশপথে] গমন করিলেন। নরপতি অশ্বাপতিও দুহিতার বিবাহের আয়োজন করিতে লাগিলেন।”