২৬২. যুধিষ্ঠিরসমীপে সশিষ্য দুর্ব্বাসার আতিথ্যপ্রার্থনা

২৬২তম অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরসমীপে সশিষ্য দুর্ব্বাসার আতিথ্যপ্রার্থনা

পাণ্ডবগণ ও দ্ৰৌপদীকে কৃতভোজন এবং সুখাসীন জানিয়া দশসহস্র শিষ্যে পরিবৃত হইয়া তাঁহাদিগের বসতি বনে উপস্থিত হইলেন। শ্ৰীমান যুধিষ্ঠির সেই অতিথিকে সমাগত দেখিয়া ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে তাঁহার অভিমুখে গমনপূর্ব্বক উত্তম আসনে উপবেশন করাইয়া এবং যথাবিধি পূজা ও আতিথ্য-গ্রহণে নিমন্ত্রণ কিরয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “শীঘ্র আহ্নিক সমাধান করিয়া আগমন করুন।” মহর্ষি দুর্ব্বাসা এই চিন্তা করিতে করিতে শিষ্যগণ-সমভিব্যাহারে স্নান করিতে গমন করিলেন যে, ইনি কি প্রকারে আমাকে ও আমার শিষ্যগণকে ভোজন করাইবেন?

অতিথিবৈমুখ্যভয়ে ভীতা দ্ৰৌপদীর স্তবে কৃষ্ণের আগমন

অনন্তর মহাযশাঃ দুর্ব্বাসা শিষ্যগণ-সমভিব্যাহারে সলিলে অবগাহন করিলেন। এদিকে রমণীরত্ন দ্রৌপদী অন্নের নিমিত্ত সাতিশয় চিন্তাপরায়ণ হইয়াও যখন কোন উপায় স্থির করিতে পারিলেন না, তখন মনে মনে কংসনিসূদন মধুসূদনকে স্তব করিতে লাগিলেন, “হে কৃষ্ণ! হে কৃষ্ণ মহাবাহো দেবকীনন্দন! হে অব্যয়! হে বাসুদেব! হে জগন্নাথ! হে প্রণতার্ত্তিবিনাশন! হে বিশ্বাত্মন! হে বিশ্বজনক! হে বিশ্বসংহারকারিন! হে বিপন্নপাল! হে গোপাল! হে প্ৰজাপাল! হে পরাৎপর্য! আমি তোমাকে নমস্কার করি। হে বরেণ্য! হে বরদ! হে অনন্ত! তুমি গতিহীনের গতি। হে পুরাণপুরুষ! হে প্ৰাণ! হে সর্ব্বসাক্ষিন! হে পরমারাধ্য! আমি তোমার শরণাপন্ন হইয়াছি; হে শরণাগতবৎসল! কৃপা করিয়া আমাকে রক্ষা কর। হে নীলোৎপলদলশ্যাম! হে পদ্মরুণেক্ষণ! হে পীতাম্বর! হে কৌস্তুভভূষণ! তুমি আদি ও অন্ত, তুমিই সকল ভূতের আশ্রয়, তুমিই পরতর জ্যোতি, তুমিই বিশ্বাত্মা, তুমিই সর্ব্বতোমুখ, তুমি সকলের বীজ ও সকল সম্পদের নিধান; তুমি যাহাকে রক্ষা কর, তাহার পাপভয় সুদূরপরাহত হয়। তুমি পূর্ব্বে যেমন সভামধ্যে দুঃশাসন হইতে আমাকে মুক্ত করিয়াছিলে, এক্ষণে এইরূপ এই সঙ্কট হইতে পরিত্ৰাণ কর।”

অচিন্ত্যগতি ভক্তবৎসল বাসুদেব দ্রুপদনন্দিনীর স্তবে তাঁহার বিপদবৃত্তান্ত অবগত হইয়া পার্শ্বশায়িনী রুক্মিণীকে পরিত্যাগপূর্ব্বক ত্বরিতগমনে সেই বনে আগমন করিলেন। দ্রুপদনন্দিনী তাঁহাকে নয়নগোচর করিয়া প্ৰণতিপূর্ব্বক দুর্ব্বাসার আগমনবৃত্তান্ত-সকল নিবেদন করিলেন।

কৃষ্ণ কহিলেন, “দ্ৰৌপদি! আমি অত্যন্ত ক্ষুধিত হইয়াছি, অগ্রে আমাকে ভোজন প্রদান কর; পশ্চাৎ অন্যান্য কর্ম্ম করিও।”

দ্রৌপদী তাঁহার বাক্য-শ্রবণে লজ্জাবনতমুখী হইয়া কহিলেন, “দেব! আমার ভোজন পৰ্য্যন্ত সূৰ্য্যদত্ত স্থলী অন্নে পরিপূর্ণ থাকে, কিন্তু আজি আমি ভোজন করিয়াছি, এখন ত’ আর তাহাতে কিছুই নাই।”

কমলায়তলোচন বাসুদেব কহিলেন, “দ্ৰৌপদি! আমি ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হইয়াছি, এক্ষণে কি পরিহাস করা উচিত? শীঘ্র যাও, সেই স্থালী আনিয়া আমাকে প্রদর্শন কর।”

ভগবৎ তুষ্টিতে জগৎ তুষ্ট—দুর্ব্বাসাদির ক্ষুধানিবৃত্তি

দ্রৌপদী তাঁহার নির্ব্বন্ধাতিশয় উল্লঙ্ঘ করিতে অসমর্থ হইয়া স্থলী আনিয়া প্রদর্শন করিলেন। সেই স্থালীর কণ্ঠে কিঞ্চিৎ শাকান্ন সংলগ্ন ছিল, বাসুদেব তাহা ভোজন করিয়া কৃষ্ণাকে কহিলেন, “ইহাতে বিশ্বাত্মা প্রীত ও পরিতুষ্ট হউন” এবং ভীমসেনকে কহিলেন, “তুমি শীঘ্ৰ ব্ৰাহ্মণগণকে ভোজন করিতে আহ্বান কর।” দুর্ব্বাসা প্রভৃতি মুনিগণ স্নানার্থ দেবনদীতে গমন করিয়াছিলেন। মহাযশাঃ ভীমসেন ভোজনার্থ তাহাদিগকে আহ্বান করিতে গমন করিলেন; তাঁহারা তৎকালে সলিলে অবতীর্ণ হইয়া অঘমর্ষণ করিতেছিলেন। পরে সলিল হইতে উত্তীর্ণ হইয়া পরস্পর সান্নরস উদগার অবলোকন করিয়া পরম পরিতৃপ্ত হইলেন এবং দুর্ব্বাসার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “হে বিপ্রর্ষে আমরা রাজা যুধিষ্ঠিরকে অন্ন প্রস্তুত করিতে কহিয়া স্নানার্থ আগমন করিয়াছি, কিন্তু আমরা অধুনা এরূপ পরিতৃপ্ত হইয়াছি যে, কোন প্রকারেই আহার করিতে পারিব না; অতএব অকারণ পাকক্রিয়া অনুষ্ঠিত হইতেছে, এক্ষণে কি করিব?”

দুর্ব্বাসা কহিলেন, “আমরা বৃথা পাক নিমিত্ত রাজর্ষির নিকটে অপরাধী হইলাম, এক্ষণে এই অপরাধে পাণ্ডবগণ কোপদৃষ্টিতে আমাদিগকে ভস্মসাৎ না করেন, এমন উপায় চিন্তা কর। হে বিপ্ৰগণ! ধীমান অম্বরীষ-রাজর্ষির প্রভাবে স্মৃতিপথারূঢ় হইলে হরিপদাশ্রিত ব্যক্তিমাত্র হইতেই ভীত হইতে হয়। বিশেষতঃ পাণ্ডবগণ সকলেই মহাত্ম, ধর্ম্মপরায়ণ, শৌৰ্য্যশালী, কৃতবিদ্য, ব্রাতধারী, তপস্বী, সদাচাররত এবং নারায়ণপরায়ণ; তাঁহাদের ক্ৰোধানল উদ্দীপিত হইলে তুলারাশির ন্যায় আমাদিগকে ভস্মসাৎ করিতে পারে; অতএব তাঁহাদিগকে কিছু না বলিয়াই সকলে শীঘ্র পলায়ন কর।”

শিষ্যগণ দুর্ব্বাসার বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহার সমভিব্যাহারে দশদিকে পলায়ন করিলেন।

ভীমসেন দেবনদীতে মুনিগণকে অবলোকন না করিয়া ইতস্ততঃ তীর্থে তীর্থে অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। তথায় তাপসাগণের মুখে তাঁহাদিগের পলায়ন-বৃত্তান্ত শ্রবণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের নিকটে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া সমুদয় নিবেদন করিলেন। অনন্তর পাণ্ডবগণ তাঁহাদিগের প্রত্যাগমন-প্রত্যাশায় কিয়াৎকাল প্রতীক্ষা করিয়া এই চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, “দুর্ব্বাসা নিশীথসময়ে অকস্মাৎ আগমন করিয়া আমাদিগকে ছলনা করিবেন, তাহা হইলে আমরা কি প্রকারে দৈবোপপাদিত ক্লেশ হইতে পরিত্ৰাণ পাইতে পারিব?”

শ্ৰীমান্য বাসুদেব চিন্তাপরায়ণ পাণ্ডবগণকে মুহুর্মুহুঃ দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে দেখিয়া কহিলেন, “হে পাণ্ডবগণ! পাঞ্চালকুমারী কোপনস্বভাব দুর্ব্বাসা হইতে আপদ-ঘটনার সম্ভাবনা দেখিয়া আমাকে চিন্তা করিয়াছিলেন; আমি তন্নিমিত্ত সত্বর হইয়া আগমন করিয়াছি, অতএব দুর্ব্বাস হইতে আর কিছুমাত্র ভয় নাই। তিনি তোমাদিগের তেজে ভীত হইয়া পূর্ব্বেই পলায়ন করিয়াছেন। যাহারা ধর্ম্মের অনুগত, তাহারা কখনই অবসন্ন হয়েন না। হে পাণ্ডবগণ! তোমাদিগের কল্যাণ হউক, আমি এক্ষণে তোমাদিগকে আমন্ত্রণ করিয়া প্ৰস্থান করিলাম।”

পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী কেশবের বাক্য শ্রবণ করিয়া সুস্থচিত্ত হইলেন এবং কহিলেন, “হে গোবিন্দ! সিন্ধু-নিমগ্ন ব্যক্তির ভেলাপ্ৰাপ্তির ন্যায় আমরা তোমাকে প্রাপ্ত হইয়া এই আপদ হইতে উত্তীর্ণ হইলাম; তুমি এক্ষণে গৃহে গমন কর।”

বাসুদেব পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। পাণ্ডবগণ ও দ্ৰৌপদী প্রফুল্ল-চিত্তে বন হইতে বনান্তরে ভ্রমণপূর্ব্বক সুখে সময় যাপন করিতে লাগিলেন। হে রাজন! দুরাত্মা ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ এইরূপে পাণ্ডবগণের প্রতি যত অনিষ্টাচরণ করিয়াছিল, সমুদয়ই ব্যর্থ হইয়াছিল।