২৯৬. সত্যবানের আকস্মিক শিরঃপীড়া—তদগ্ৰহণার্থ যমের আগমন

২৯৬তম অধ্যায়

সত্যবানের আকস্মিক শিরঃপীড়া—তদগ্ৰহণার্থ যমের আগমন

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “তখন বীৰ্য্যবান সত্যবান ভাৰ্য্যাসমভিব্যাহারে বহুবিধ ফল আহরণপূর্ব্বক তদ্বারা স্থালী পরিপূর্ণ করিয়া কাষ্ঠ আহরণ করিতে লাগিলেন। কাষ্ঠ পাটন [ছেদন] করিতে করিতে সাতিশয় ব্যায়াম হওয়াতে তাহার গাত্ৰ হইতে স্বেদ বিনির্গত হইতে লাগিল ও মস্তকে বেদনা জন্মিল। তখন তিনি প্ৰাণপ্ৰিয়া প্ৰণয়িনীর সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘সাবিত্ৰী! প্রভূত পরিশ্রম হওয়াতে আমার শিরঃপীড়া হইয়াছে। ফলতঃ আমি নিতান্ত অসুস্থ হইয়াছি, আমার মস্তব যেন শূলদ্বারা বিদ্ধ হইতেছে। অতএব প্রিয়ে! একবার নিদ্রা যাইতে নিতান্ত বাসনা হইতেছে, আর একমুহূর্ত্তও দণ্ডায়মান থাকিতে পারি না।’

“পতি প্ৰণা সাবিত্রী সত্যবানের বাক্য-শ্রবণমাত্র তাহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া ভূতলে উপবেশনপূর্ব্বক স্বীয় ক্ৰোড়ে তাঁহার মস্তক স্থাপন করিলেন এবং নারদের বাক্য স্মরণপূর্ব্বক সেই মুহুর্ত্ত, ক্ষণ, বেলা ও দিবস অনুধ্যান করিতে লাগিলেন। ক্ষণেক পরে দেখিলেন, এক রক্তবাসা, বদ্ধমৌলি, সাক্ষাৎ দিবাকরের ন্যায় তেজস্বী, শ্যামবর্ণ, রক্তনয়ন, ভয়ানক পুরুষ পাশ হস্তে করিয়া সত্যবানের পার্শ্বে দণ্ডায়মান হইয়া তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতেছেন।

“সাবিত্রী তাঁহাকে দেখিবামাত্ৰ শনৈঃ শনৈঃ স্বামীর মস্তক ভূতলে সংস্থাপন করিয়া সসম্ভ্রমে গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক কম্পিত-হৃদয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “হে দেবেশ! আপনার অমানুষ আকৃতি দেখিয়া আপনাকে দেবতা বলিয়া জ্ঞান হইতেছে। অতএব অনুগ্রহ করিয়া বলুন, আপনি কে? কি অভিলাষেই বা এখানে আসিয়াছেন?”

“যম কহিলেন, “হে সাবিত্ৰী! তুমি পতিব্ৰতা ও তপানুষ্ঠানসম্পন্না, এই নিমিত্ত তোমার নিকট আত্মপরিচয় প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। আমি যম, অদ্য তোমার পতি সত্যবানের আয়ুঃশেষ হইয়াছে, আমি উহাকে বন্ধনপূর্ব্বক লইয়া যাইব; এই আমার অভিলাষ।”

“সাবিত্রী কহিলেন, “হে ভগবন! শ্রুত আছি যে, আপনার দূতেরাই মানবগণকে লইয়া যায়; তবে আপনি স্বয়ং কি নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন?”

“পিতৃরাজ সাবিত্রীর বাক্য শ্রবণানন্তর তীহাকে প্রীত করিবার নিমিত্ত আপনার আগমন-হেতু কহিতে লাগিলেন, “হে শুভে! এই সত্যবান পরমধার্ম্মিক, রূপবান ও গুণসাগর, আমার দূতেরা ইহাকে লইয়া যাইলে নিতান্ত অন্যায় হয়, এই বিবেচনায় স্বয়ং আগমন করিয়াছি।”

সত্যবানের প্রাণময় জীবাত্মার আকর্ষণকারী যমের সহিত সাবিত্রীর উক্তি-প্ৰত্যুক্তি

“কৃতান্ত এই বলিয়া সত্যবানের দেহমধ্য হইতে এক পাশবদ্ধ অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষকে বলপূর্ব্বক আকর্ষণ করিয়া নিষ্কাশিত করিলেন। প্ৰাণ সমুদ্ধৃত হইবামাত্র সত্যবানের দেহ শ্বাসরহিত, প্রভাশূন্য, চেষ্টবিহীন ও নিতান্ত অপ্রিয়দর্শন হইল। তখন যম সেই অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষকে বন্ধন ও গ্রহণপূর্ব্বক দক্ষিণদিকে চলিলেন। ব্ৰতসিদ্ধা পতিপ্ৰাণা সাবিত্রী দুঃখার্ত্তচিত্তে তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন।

“পিতৃপতি সাবিত্রীকে আপনার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিতে দেখিয়া কহিলেন, “সাবিত্ৰী! প্রতিনিবৃত্ত হও, শীঘ্ৰ গিয়া সত্যবানের ঔদ্ধদেহিক কাৰ্য্য সমাধান কর। তোমা হইতে তোমার ভর্ত্তা আনৃণ্য [ঋণমুক্তি-সম্যকরূপে গাৰ্হস্থ্যপালনে পারত্রিক বন্ধনচ্ছেদ] লাভ করিয়াছেন। তুমি যাহা কর্ত্তব্য তাহা সম্পাদন করিয়াছ।”

“সাবিত্রী কহিলেন, “আমার স্বামী যে স্থানে নীত হয়েন অথবা স্বয়ং গমন করেন, আমারও সেই স্থানে গমন করা কর্ত্তব্য, ইহাই নিত্যধর্ম্ম। হে মহাত্মন! তপস্যা, গুরুভক্তি, ভর্ত্তৃস্নেহ, ব্রত ও তোমার প্রসাদে আমার গতি অপ্ৰতিহত হইয়াছে। হে ধর্ম্মরাজ! এক্ষণে আমি মিত্ৰতাপূর্ব্বক তোমাকে যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। অজিতেন্দ্ৰিয় ব্যক্তি বনে আসিয়া গাৰ্হস্থ্য, ব্ৰহ্মচৰ্য্য অথবা সন্ন্যাসধর্ম্ম অনুষ্ঠান করে না, জিতেন্দ্ৰিয় ব্যক্তিরাই আশ্রমধর্ম্ম প্রতিপালন করিয়া থাকেন, তন্মধ্যে গাৰ্হস্থ্য ধর্ম্মই বিজ্ঞান [শাস্ত্রজ্ঞান-জ্ঞানলাভের উপায়] প্ৰাপ্তির কারণ। সকল আশ্রমিকেরাই প্রথমতঃ ঐ ধর্ম্ম সম্যকরূপে অনুষ্ঠান করিয়া জ্ঞান উপার্জ্জন করিয়াছেন; এই নিমিত্ত মাদৃশ লোক পূর্বোক্ত দ্বিতীয় বা তৃতীয় আশ্রম অবলম্বন করিতে অভিলাষ করে না এবং পণ্ডিতগণ এই নিমিত্তই প্রথম আশ্রমকে প্রধান বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করেন।”

“যম কহিলেন, “হে অনিন্দিতে! নিবৃত্ত হও; আমি তোমার সুব্যক্ত ও যুক্তিযুক্ত বাক্যে পরিতুষ্ট হইয়াছি, এক্ষণে তুমি বর প্রার্থনা কর; সত্যবানের জীবন ভিন্ন যে যে বর প্রার্থনা করিবে, সমুদয়ই তোমাকে প্রদান করিব।”

যমরাজ হইতে সাবিত্রীর পঞ্চবরপ্রাপ্তি-পতির জীবনলাভ

“সাবিত্রী কহিলেন, “আমার শ্বশুর রাজ্যচ্যুত হইয়া অরণ্যে বাস করিতেছেন। তাঁহার নয়নদ্বয় বিনষ্ট হইয়াছে। তিনি তোমার প্ৰসাদে চক্ষুলাভ এবং অগ্নি ও দিবাকরের ন্যায় বল ধারণ করুন।”

“যম কহিলেন, “অনিন্দিতে! আমি ঐ বর প্রদান করিলাম। তুমি যাহা প্রার্থনা করিয়াছ, তাহাই হইবে। দেখিতেছি, তুমি পথশ্ৰান্ত হইয়াছ, অতএব এক্ষণে নিবৃত্ত হও, নতুবা আরও শ্রান্তি হইবে।”

“সাবিত্ৰী কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! আমি যখন স্বামীর সমীপে রহিয়াছি, তখন আমার পরিশ্রমের বিষয় কি? স্বামীই আমার একমাত্র গতি। অতএব তুমি যে স্থানে স্বামীকে লইয়া যাইবে, আমিও তথায় গমন করিব; এক্ষণে পুনর্ব্বার কিঞ্চিৎ কহিতেছি, শ্রবণ কর। সাধুগণের সহিত একবারমাত্র সমাগমে মিত্ৰতা জন্মে; সাধুসমাগম কদাপি নিস্ফল হয় না; এই নিমিত্ত সাধুসংসর্গে বাস করা কর্ত্তব্য।’

“যম কহিলেন, “হে ভাবিনি! তুমি যে বাক্যবিন্যাস করিলে, উহা হৃদয়রঞ্জন, হিতকর এবং বুধগণেরও বোধবৰ্দ্ধন। তুমি সত্যবানের জীবন ভিন্ন দ্বিতীয় বর প্রার্থনা কর।” সাবিত্রী কহিলেন, “আমার শ্বশুর পূর্ব্বাপহৃত রাজ্য লাভ করুন এবং স্বধর্ম্ম হইতে অপরিচ্যুত থাকুন; আমি তোমার নিকট এই দ্বিতীয় বার প্রার্থনা করি।”

“যম কহিলেন, “রাজা দ্যুমৎসেন অচিরে স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হইবেন; স্বধর্ম্ম হইতেও পরিচ্যুত হইবেন না। রাজপুত্র! তোমার কামনা পরিপূর্ণ করিলাম, এক্ষণে প্রতিনিবৃত্ত হও, নতুবা পরিশ্রান্ত হইবে।”

“সাবিত্রী কহিলেন, “হে দেব! প্ৰজাগণ তোমারই নিয়মে নিগৃহীত হইতেছে এবং তুমিই নিয়মপূর্ব্বক তাহাদিগকে কামনাসকল প্ৰদান করিতেছ। এই নিমিত্ত তোমার যমত্ব সুবিখ্যাত হইয়াছে। যমরাজ! এক্ষণে আমার এই বাক্য শ্রবণ কর। কায়মানোবক্য সকলের প্রতি অদ্রোহ, অনুগ্রহদান করাই সাধুগণের সনাতনধর্ম্ম। এই ভূমণ্ডলমধ্যে প্রায় সমুদয় মনুষ্যগণই ভক্তিপ্রবণ; সজ্জনগণ শক্রগণকেও দয়া করিয়া থাকেন।”

“যম কহিলেন, “হে শুভে! পিপাসু ব্যক্তির যেমন পানীয়, তদ্রূপ তোমার এই বাক্যও সকলের আদরণীয়; অতএব সত্যবানের জীবন ভিন্ন যে বর ইচ্ছা প্রার্থনা কর।”

“সাবিত্রী কহিলেন, “আমার পিতার সন্তান-সন্ততি নাই, অতএব যেন তাহার বংশধর একশত ঔরসপুত্র জন্মে; আমি তোমার নিকটে এই তৃতীয় বর প্রার্থনা করিতেছি।”

“যম কহিলেন, “হে ভদ্রে! তোমার পিতার বংশধর সুতেজাঃ শতপুত্র সমুৎপন্ন হউক। হে রাজপুত্র! এক্ষণে কৃতকামা হইলে, প্রতিনিবৃত্ত হও; দেখ, তুমি অতি দূরপথে আগমন করিয়াছ।”

“সাবিত্রী কহিলেন, “হে ঈশ্বর! আমি যখন স্বামীর সন্নিধানে রহিয়াছি, তখন ইহা আমার দূরপথ নহে। আমার মন ইহা অপেক্ষা দূরতর পথে ধাবমান হইতেছে। তুমি গমন করিতে করিতেই আমার কথা শ্রবণ কর। তুমি ভগবান বিবস্বানের তনয়, এই নিমিত্ত পণ্ডিতগণ তোমাকে বৈবস্বত বলিয়া থাকেন। আর প্ৰজাগণ ইহ-সংসারে তোমার পক্ষপাত-রহিত ধর্ম্মশাসনে সঞ্চরণ করিতেছে, এই জন্য তুমি ধর্ম্মরাজ বলিয়া প্ৰসিদ্ধ হইয়াছ। হে ধর্ম্মরাজ! সাধু ব্যক্তিকে যতদূর বিশ্বাস করা যায়, আপনার প্রতিও তত বিশ্বাস হয় না, এই নিমিত্ত সকলেই সাধু ব্যক্তির উপরে বিশ্বাস ও প্রণয় স্থাপন করিতে অভিলাষী হয়।”

“যম কহিলেন, ভদ্রে! তুমি যেরূপ কহিলে, আর কাহারও নিকটে এতাদৃশ বাক্য শ্রবণ করি নাই, আমি ইহাতে পরমপ্রীতি প্রাপ্ত হইলাম, অতএব সত্যবানের জীবন-বিনা চতুর্থ বর গ্রহণ করিয়া প্রতিনিবৃত্ত হও।”

“সাবিত্রী কহিলেন, ‘সত্যবোনের ঔরসে আমার গর্ভে বলবীৰ্য্যশালী কুলবৰ্দ্ধন একশত পুত্ৰ হইবে, আমি এই চতুর্থ বর প্রার্থনা করি।”

“যম কহিলেন, “অবলে! তোমার বলবীৰ্য্যশালী আনন্দবৰ্দ্ধন শতানন্দন হইবে, এক্ষণে নিবৃত্ত হও; আর পরিশ্রম-স্বীকারে প্রয়োজন নাই; অনেকদূর আগমন করিয়াছ।”

সজ্জনেরা অবসন্ন বা ব্যথিত হয়েন না, সজ্জনের সহিত সজ্জনের সমাগম কদাপি বিফল হয় না এবং সজ্জনেরা সজ্জনের সমীপে ভীত হয়েন না। সজ্জনেরাই সত্যদ্বারা সূৰ্য্যকে চালিত করিতেছেন, সজ্জনেরাই তপদ্বারা পৃথিবী ধারণ করিতেছেন, সজ্জনেরাই ভূতভবিষ্যতের, গতি এবং সজ্জনেরা সজ্জনসমাজে কদাচ অবসন্ন হয়েন না। সাধুগণ পরস্পর অপেক্ষা না করিয়া আৰ্য্যগণের পূজনীয় জ্ঞানেই চিরকাল পরোপকার করিয়া থাকেন। সাধুগণের প্ৰসাদ কখন বিফল হয় না এবং তাঁহাদিগের নিকটে অর্থ বা মানেরও হানি হয় না; অর্থ ও মান এই তিনিই সাধুসমীপে অব্যাহত থাকে, অতএব সাধুগণ সকলের রক্ষাকর্ত্তা।”

“যম কহিলেন, “হে পতিব্ৰতে! আমি তোমার সুবিন্যস্ত। ধর্ম্মসংহিত বাক্য যত শ্রবণ করিতেছি, ততই আমার ভক্তিবৃত্তি তোমার প্রতি উচ্ছলিত হইতেছে। অতএব তুমি পুনরায় অভিলষিত বর গ্রহণ কর।”

“সাবিত্রী কহিলেন, “হে মানদ! স্বামীর ঔরস-পুত্র যেরূপ, ক্ষেত্ৰজাদি পুত্ৰ তদ্রূপ নহে। বিশেষতঃ পতি ব্যতীত আমি জীবনধারণে সমর্থনহি, অতএব সত্যবান জীবিত হউক, এই বর প্রার্থনা করি। আমি স্বামিবিনাকৃত [পতি ব্যতীত] সুখ, স্বামিবিনাকৃত স্বৰ্গ অথবা স্বামিবিনাকৃত শ্ৰীর অভিলাষিণী নহি এবং স্বামী ব্যতীত জীবনধারণ করিতেও আমার প্রবৃত্তি নাই। তুমিই আমাকে শতপুত্ৰতা বর প্রদান করিয়াছ এবং তুমিই আমার পতিকে অপহরণ করিতেছ। অতএব হে ধর্ম্মরাজ! সত্যবান জীবিত হউন, এই বর প্রার্থনা করি, তাহা হইলেই তোমার বাক্য সত্য হইবে।”

“ধর্ম্মরাজ যম আনন্দিতচিত্তে ‘তথাস্তু’ বলিয়া সত্যবানকে পাশমুক্ত করিলেন এবং সাবিত্রীকে কহিলেন, “হে কুলনন্দিনি! এই তোমার ভর্ত্তাকে মুক্ত করিয়া দিলাম; ইনি রোগমুক্ত, কৃতাৰ্থ ও তোমারই বশীভুত হইয়া তোমার সহিত চারিশত বৎসর জীবিত থাকিবেন। ইনি যজ্ঞ ও ধর্ম্মদ্বারা খ্যাতিলাভ এবং তোমার গর্ভে শতপুত্র উৎপাদন করিবেন। তোমার নামে তোমার পুত্ৰগণের নামধেয় লইবে। তাহারাও রাজা, পুত্রপৌত্ৰশালী ও সুবিখ্যাত হইয়া পরমসুখে কালব্যাপন করিবে; তোমার পিতা ও তোমার মাতা মালবীর গর্ভে মালবনামে বংশধর ইন্দ্রসদৃশ শতপুত্ৰ উৎপাদনা করিবেন।”

“প্রতাপবান ধর্ম্মরাজ সাবিত্রীকে এইরূপ বর প্রদানপূর্ব্বক নিবৃত্ত করিয়া স্বস্থানে প্ৰস্থান করিলেন। সাবিত্রীও স্বামীকে প্ৰতিলাভ করিয়া, যে স্থানে তাঁহার মৃত-কলেবর পতিত রহিয়াছে, সেই স্থানে সমুপস্থিত হইলেন। তথায় ভূমিনিপতিত ভর্ত্তাকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক আপন উৎসঙ্গে [ক্ৰোড়ে] তাহার মস্তক আরোপিত করিয়া উপবেশন করিলেন। সত্যবান সংজ্ঞালাভ করিয়া প্রবাসাগত ব্যক্তির ন্যায় প্রণয়িনীর প্রতি বারংবার সপ্ৰেমদৃষ্টিপাতপূর্ব্বক কহিলেন, “কি কষ্ট! আমি এত অধিকক্ষণ নিদ্রিত ছিলাম? প্রিয়ে! তুমি কি নিমিত্ত আমাকে জাগরিত কর নাই? আর যিনি আমাকে আকর্ষণ করিতেছিলেন, সেই শ্যামবর্ণ পুরুষ কোথায়?”

“সাবিত্রী কহিলেন, “জীবিতনাথ! তুমি বহুক্ষণ আমারই উৎসঙ্গে নিদ্রিত ছিলে। যে পুরুষের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছ, তিনি লোকসংহৰ্তা যম; কিয়ৎক্ষণ হইল স্বস্থানে গমন করিয়াছেন। হে রাজপুত্ৰ! তোমার নিদ্ৰাভঙ্গ ও বিশ্রামলাভ হইয়াছে; এক্ষণে যদি সামর্থ্য থাকে, শীঘ্ৰ গাত্ৰোত্থান কর। দেখ, অন্ধকার-রজনী উপস্থিত হইতেছে।”

“তখন সত্যবান সুপ্তোত্থিতের ন্যায় গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক সমুদয় দিক ও অরণ্যানী নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “হে সুমধ্যমে! আমার এই মাত্ৰ স্মরণ হইতেছে যে, আমি ফালমাত্ৰ আহার করিয়া তোমার সহিত অরণ্যানীমধ্যে আগমন করিয়াছিলাম। পরে কাষ্ঠপাটন করিতে করিতে শিরঃপীড়ায় প্রচণ্ড পরিতাপিত, ও নিতান্ত অধৈৰ্য্য হইয়া তোমার উৎসঙ্গে শয়ন করিলাম এবং তৎপরে তোমার আলিঙ্গনপাশে বদ্ধ হইয়া নিদ্রায় নিতান্ত অভিভূত হইলাম। হে প্রিয়ে! তৎপরে যে ঘোর তিমিরবর্ণ [ভীষণ কৃষ্ণবর্ণ] মহাতেজঃ পুরুষকে অবলোকন করিয়াছিলাম, তাহা স্বপ্ন কি সত্য, কিছুই জানি না। তুমি যদ্যপি তাহার বিষয় অবগত থাক, বিশেষ করিয়া বল।”

সাবিত্রী-সত্যবানের স্বীয় আশ্রমে যাত্ৰা

সাবিত্রী কহিলেন, “নাথ! এক্ষণে রজনী উপস্থিত হইয়াছে, অবিলম্বে পিতামাতার নিকটে গমন করা তোমার নিতান্ত আবশ্যক; অতএব শীঘ্ৰ গাত্ৰোত্থান কর; কল্য সমুদয় বৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক নিবেদন করিব। ঐ দেখ, তামসী [অন্ধকার রাত্রি] উপস্থিত, দিবাকর অস্তমিত হইয়াছেন। নিশাচরগণের নিষ্ঠুরতর নিনাদ, মৃগগণের সঞ্চারিশব্দ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হইতে শিবগণের ভয়ঙ্কর চীৎকার শ্রবণ করিয়া আমার হৎকম্প হইতেছে।”

“সত্যবান কহিলেন, “এই ভয়ঙ্কর বন অন্ধতমসে [অন্ধকার] আচ্ছন্ন হইয়াছে, এক্ষণে তুমি কোনক্রমেই ইহাতে পথ নিরীক্ষণ ও গমন করিতে সমর্থ হইবে না।”

“সাবিত্রী কহিলেন, “নাথ! তোমাকে পীড়ত দেখিতেছি। অতএব যদ্যপি তমসাবৃত পথে গমন করিতে অসমর্থ হও, তবে অদ্য এই স্থানেই অবস্থান কর। ঐ দেখ, স্থানে স্থানে শুষ্ক তরুসকল প্রজ্বলিত হইতেছে; আমি তাহা হইতে অগ্নি আনয়ন করিয়া এই সমস্ত কাষ্ঠ প্ৰজ্বলিত করি; তুমি তদ্বারা শরীরগ্লানি অপনোদন কর। হে নাথ! অদ্য রাত্রি এই স্থানেই অতিবাহিত করা যাউক, কল্য প্ৰভাতে কাননসকল প্রকাশিত হইলে আশ্রমে গমন করিব।”

“সত্যবান কহিলেন, “আমার শীরঃপীড়া নিবৃত্ত এবং অঙ্গসকলও প্রকৃতিস্থ হইয়াছে। এক্ষণে মাতাপিতার সমীপে গমন করিতে বাসনা করি। আমি পূর্ব্বে কখন নিয়মিত সময় অতিক্রম করিয়া আশ্রমে গমন করি নাই। মাতা সন্ধ্যা না হইতেই আমাকে রুদ্ধ করিতেন। আমি দিবাভাগে বহির্গত হইলেও আমার মাতাপিতা সস্তপ্ত হইতেন। পিতা আশ্রমবাসিগণের সমভিব্যাহারে আমাকে অন্বেষণ করিতেন। একবার তাঁহারা আমার বিলম্বে অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া আমাকে সাতিশয় তিরস্কার করিয়াছিলেন। আজি আমার নিমিত্ত তাঁহাদের কি অবস্থা ঘটিয়াছে, আমি তাহাই চিন্তা করিতেছি। নিশ্চয়ই আমার আদর্শনে তাঁহারা যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইলেন। একদা রাত্ৰিতে তাঁহারা নিতান্ত দুঃখিত হইয়া গলদশ্রুঞ্চলোচনে প্রীতিযুক্তবদনে আমাকে কহিয়াছিলেন, “বৎস! আমরা তোমা ব্যতীত মুহূর্ত্তমাত্র জীবনধারণ করিতে পারি না, তুমি আমাদিগকে ফলাদি আহরণ করিয়া না দিলে আমাদের জীবনধারণ করিবার উপায়ান্তর নাই, তুমি এই নয়নহীন স্থবিরদ্বয়ের যষ্টি; আমাদিগের বংশ, পিণ্ড, কীর্ত্তি ও সন্তান তোমাতেই প্রতিষ্ঠিত।” হে প্রিয়ে! আমার মাতাপিতা বৃদ্ধ হইয়াছেন, আমি তাঁহাদের যষ্টিস্বরূপ। আহা! না জানি, আদ্য আমার আদর্শননিবন্ধন তাঁহাদের কি অবস্থই ঘটিবে! আঃ পাপীয়সী নিদ্রে! কেবল তোর নিমিত্তই আমার পিতামাতা আমার জীবনে সংশয়াপন্ন হইয়াছেন। আমিও বিপন্ন ও সংশয়াপন্ন হইলাম। ফলতঃ আমি মাতাপিতা ব্যতীত প্ৰাণধারণ করিতে সমর্থ নাহি। নিশ্চয়ই আমার সেই অন্ধ পিতা এই সময়ে নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া আশ্রমবাসীদিগের প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করিতেছেন। প্ৰিয়ে! পিতা ও তাঁহার আশ্রিতা অতি দুর্ব্বলা জননীর নিমিত্তই আমার শোক-সাগর উচ্ছসিত হইয়াছে; আপনার নিমিত্ত নহে। হায়! আজি তাঁহারা আমার নিমিত্ত কতই পরিতাপ করিতেছেন। তাঁহারা জীবিত থাকিলেই আমি জীবিত থাকি। আমি এইমাত্র জানি যে, তাহাদিগের ভরণপোষণ ও প্রিয়ানুষ্ঠান করাই আমার নিতান্ত কর্ত্তব্য।’

“গুরুভক্ত, গুরুপ্রিয়, ধর্ম্মাত্মা সত্যবান এইমাত্র বলিয়া বাহুযুগল উন্নত করিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া উঠিলেন। তখন ধর্ম্মচারিণী সাবিত্রী শোকবিহ্বল ভর্ত্তার নয়নযুগল হইতে অশ্রুধারা মার্জ্জন করিয়া কহিলেন, “আমি যদি তপানুষ্ঠান, দান ও আহুতি প্রদান করিয়া থাকি, তাহা হইলে শর্ব্বরী আমার শ্বশ্রূ, শ্বশুর ও ভর্ত্তার পক্ষে কল্যাণকরী হউক। আমি যে স্বৈর ব্যবহারেও কখন মিথ্যাবাক্য উচ্চারণ করি নাই, আজি সেই সত্য আমার শ্বশ্রূ ও শ্বশুরের অবলম্বন হউন।”

সত্যবান কহিলেন, “সাবিত্রি! আমি পিতামাতাকে দর্শন করিবার নিমিত্ত উৎসুক হইয়াছি, চল, আর বিলম্ব করিও না। সত্য কহিতেছি, যদ্যপি অদ্য জনক বা জননীর কিছুমাত্ৰ অমঙ্গল দেখি অবশ্যই প্ৰাণ পরিত্যাগ করিব। অতএব হে বরারোহে! যদি তোমার বুদ্ধি ধর্ম্মের অনুগামিনী হয়, যদি তুমি আমাকে জীবিত রাখিতে ইচ্ছা কর, যদি আমার প্ৰিয়াচরণ করা তোমার কর্ত্তব্য হয়, তাহা হইলে চল, ত্বরায় আশ্রমে গমন করি।

“সাবিত্রী সত্যবানের বাক্য শ্রবণমাত্র গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক আপনার কেশপাশ বন্ধন করিয়া বাহুযুগলদ্বারা সত্যবানকে উত্থাপিত করিলেন। সত্যবানও উত্থিত হইয়া হস্ত দ্বারা অঙ্গমার্জ্জন ও চতুর্দ্দিক অবলোকনপূর্ব্বক স্থলীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। তখন সাবিত্রী কহিলেন, “হে নাথ! কল্য ফল আহরণ করিও। আমি তোমার যোগক্ষেমসাধন এই পরশু লইয়া যাইব ।” এই বলিয়া সাবিত্রী তরুশাখা হইতে স্থালী ও পরশু গ্ৰহণ করিয়া সত্যবানের সমীপে আগমন করিলেন এবং স্বীয় বামস্কন্ধে সত্যবানের বাহু নিবেশিত করিয়া দক্ষিণকরে তাঁহাকে আলিঙ্গন- পূর্ব্বক ধীরে ধীরে গমন করিতে লাগিলেন।

“সত্যবান কহিলেন, “ভীরু! অভ্যাসবশতঃ এই সমস্ত পথ আমার বিদিত আছে এবং তরুরাজির অভ্যন্তর দিয়া জ্যোৎস্নাপাত হওয়ায় দৃষ্টিগোচরও হইতেছে; অতএব যে পথে আগমন করিয়া ফলাবয়চন করিয়াছি, সেই পথে গমন কর। এই পলাশখণ্ডে [পলাশবৃক্ষবহুল স্থানে] দুইটি পথ বিদ্যমান রহিয়াছে। ইহার উত্তরপথ অবলম্বন করিয়া গমন কর। প্রিয়ে! এক্ষণে আমি প্রকৃতিস্থ ও বলবান হিইয়াছি, তুমি ত্বরান্বিত হও; মাতাপিতাকে দর্শন করিবার নিমিত্ত আমার চিত্ত নিতান্ত উৎকলিকাকুল [সাতিশয় ব্যগ্র] হইয়াছে।” সত্যবান সাবিত্রীকে এইরূপ কহিতে কহিতে তাঁহার সমভিব্যাহারে দ্রুতপদসঞ্চারে আশ্রমাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন।”