২৮৯. রাবণ-বধ

২৮৯তম অধ্যায়

রাবণ-বধ

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর দশগ্ৰীব ইন্দ্ৰজিতের বধবার্ত্তা-শ্রবণে ক্ৰোধে নিতান্ত অধীর হইয়া রত্নালঙ্কৃত রথে আরোহণপূর্ব্বক যুদ্ধাৰ্থ বহির্গত হইলেন। ঘোররূপ রাক্ষসগণ বিবিধ আয়ুধ ধারণপূর্ব্বক তাঁহার সমভিব্যাহারে চলিল। রাবণ কপীন্দ্ৰকুলের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিয়া রামের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন অঙ্গদ, মৈন্দ, নীল, নল, হনুমান ও জাম্ববান ক্ৰোধাভরে তাঁহাকে নিবারণ করিল এবং রাবণের সমক্ষেই শিলা ও বৃক্ষ নিক্ষেপপূর্ব্বক রাক্ষসসৈন্য সংহার করিতে লাগিল।

“অনন্তর রাবণ সৈন্যগণকে বিনষ্ট হইতে দেখিয়া মায়া সৃষ্টি করিলেন। তখন তাঁহার কলেবর হইতে শর, শক্তি ও ঋষ্টিধারী রাক্ষসগণ নিৰ্গত হইতে লাগিল। রাঘব দিব্যাস্ত্ৰজাল বিস্তার করিয়া সেই সমস্ত রাক্ষসকে বিনাশ করিলেন। তখন রাবণ পুনর্ব্বার মায়া সৃষ্টি করিলেন; কতকগুলি নিশাচর রামের রূপ ধারণ করিয়া লক্ষ্মণের প্রতি এবং কতকগুলি রাক্ষস লক্ষ্মণের রূপ ধারণ করিয়া রামের প্রতি ধাবমান হইল। সেই রাক্ষসেরা শর-শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক রামলক্ষ্মণকে অৰ্চনা করিয়া রামের নিকট উপস্থিত হইল। তখন ইক্ষ্বাকুনন্দন লক্ষ্মণ রাবণের মায়া অবগত হইয়া অবিচলিতচিত্তে রামকে কহিলেন, ‘আৰ্য্য! রাক্ষসেরা আমাদিগের প্রতিরূপ [মায়াকল্পিত নরতুল্য আকৃতি] পরিগ্রহ করিয়াছে; এক্ষণে ইহাদিগকে বিনাশ করুন।’ লক্ষ্মণ এই কথা বলিবামাত্র রামচন্দ্ৰ অতিমাত্র ত্বরান্বিত হইয়া সেই সমস্ত মায়াবী রাক্ষসকে শমনভবনে প্রেরণ করিলেন।

“অনন্তর ইন্দ্রসারথি মাতলি সূৰ্য্যসঙ্কাশ-রথে হরিদ্বর্ণ অশ্ব যোজনা করিয়া রামসন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিলেন, ‘হে রাম! দেবরাজ ইন্দ্র এই রথে আরোহণ করিয়া রণস্থলে দৈত্যদানবদিগকে সংহার করিয়াছেন; এক্ষণে আমি ইহার সারথ্য করিতেছি; আপনি ইহাতে আরূঢ় হইয়া অবিলম্বে রাবণকে বিনাশ করুন।’ তখন মাতলির বাক্যে উহা রাক্ষসী মায়া বলিয়া রামের শঙ্কা জন্মিলে বিভীষণ কহিলেন, ‘হে রাম! ইহা দুরাত্মা রাবণের মায়া নহে; অতএব আপনি এই ইন্দ্রপ্রেরিত স্যন্দনে [রথে] স্বচ্ছন্দে আরোহণ করুন।’

‘রঘুকুলোদ্বহ [রঘুকুলশ্রেষ্ঠ] রাম বিভীষণ-বাক্য অনুমোদন করিয়া প্ৰহৃষ্টমনে রথারোহণপূর্ব্বক ক্ৰোধাভরে দশগ্ৰীবের প্রতি গমন করিলেন। তখন সকল ভূত হাহাকার করিতে লাগিল; দেবলোকে দেবতারা পটহ বাদনপূর্ব্বক সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে রাম ও রাবণের এরূপ তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইল যে, উহার উপমা কুত্ৰাপি দৃষ্ট হয় না। রাবণ ব্ৰহ্মদণ্ডের ন্যায় ভয়ঙ্কর এক শূল উদ্যত করিয়া রামের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। রাম সুতীক্ষ্ন শরদ্বারা সত্বর তাহা ছেদন করিলেন। ইহা দেখিয়া রাবণের অন্তঃকরণে সাতিশয় ভয়সঞ্চার হইল।

“অনন্তর দশগ্রীব ক্রুদ্ধ হইযা রামের প্রতি শূল, মুষল, পরশু, শতঘ্নী, ভুশুণ্ডী, শক্তি প্রভৃতি বহুবিধ অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগ করিলেন। তখন বানরেরা এইরূপ বিকৃত মায়া নিরীক্ষণ করিয়া ভীতমনে চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল। ইত্যবসরে রাম সুবৰ্ণপুঙ্খাসম্পন্ন সুমুখ সুতীক্ষ্ন একশর তূণীর হইতে উদ্ধৃত করিয়া ব্ৰহ্মান্ত্রের সহিত যোগ করিলেন। ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ তদর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া, রাবণের পরমায়ু অতি অল্পমাত্র অবশিষ্ট আছে, এইরূপ কল্পনা করিতে লাগিলেন।

“পরে রাম সমুদ্যত ব্ৰহ্মদণ্ডের ন্যায় রাবণান্তকর অতি ভয়ঙ্কর সেই শর সত্বর পরিত্যাগ করিবামাত্ৰ নিতান্ত ভীষণ হুতাশন প্ৰচণ্ডরূপে প্রজ্বলিত হইয়া সারথি, রথ ও অশ্বের সহিত রাবণকে ভস্মসাৎ করিল। গন্ধর্ব্ব, চারণ, কিন্নর ও দেবগণ রাবণকে বিনষ্ট বিলোকন করিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট ও হৃষ্ট হইলেন। তখন পঞ্চভূত তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল এবং তিনি সকল লোক হইতে অন্তরিত হইলেন। তাঁহার শরীর, ধাতু, মাংস ও রুধির—সকলই বিনষ্ট হইয়া গেল; আর কোন চিহ্নই রহিল না।”