২৭১. জয়দ্ৰথবিমোক্ষণপর্ব্বাধ্যায়

২৭১তম অধ্যায়

জয়দ্ৰথবিমোক্ষণপর্ব্বাধ্যায়—ভীমকর্ত্তৃক জয়দ্রথের কেশাকর্ষণ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা জয়দ্ৰথ উদ্যতায়ুধ মহাবীর ভীমার্জ্জুনকে নিরীক্ষণ করিয়া প্রাণরক্ষার নিমিত্ত বেগে ধাবমান হইল। ভীমও তৎক্ষণাৎ রথ হইতে অবতীর্ণ ও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া তদীয় কশাপাশ গ্ৰহণ করিলেন। পরে তাহাকে উত্তোলিত করিয়া ভূতলে নিক্ষেপ ও জটাজুট গ্রহণপূর্ব্বক অনবরত প্রহার করিতে লাগিলেন। জয়দ্ৰথ ধরাতল হইতে গাত্ৰোত্থান করিবার উপক্ৰম করিতেছে, ইত্যবসরে মহাবীর ভীম তাহার মস্তকে পদাঘাত ও বক্ষঃস্থলে জানুদ্বয় আরোপিত করিয়া বারংবার কূর্পর [কনুই]-প্রহার করিতে লাগিলেন। তখন জয়দ্ৰথ তাঁহার প্রহারে পীড়িত হইয়া করুণস্বরে বিলাপ ও পরিতাপপূর্ব্বক মূর্চ্ছিত হইল।

অনন্তর অর্জ্জুন এই ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া ভীমসেনকে কহিলেন, “হে ভীম! রাজা যুধিষ্ঠির দুঃশলার বিষয় উল্লেখ করিয়া যে কথা কহিলেন, তাহা এক্ষণে স্মরণ করা কর্ত্তব্য।” ভীম কহিলেন, “এই পাপাচার দ্রৌপদীকে ক্লেশ প্ৰদান করিয়াছে; আমি ইহাকে অবশ্যই বিনাশ করিতাম, কিন্তু ধর্ম্মরাজ একান্ত কৃপাপরতন্ত্র এবং তুমিও দুর্বুদ্ধিপ্রভাবে বারংবার আমাকে নিষেধ করিতেছ, সুতরাং এক্ষণে আমি তদ্বিষয়ে ক্ষান্ত হইলাম।” এই বলিয়া ভীমসেন অৰ্দ্ধচন্দ্ৰবাণদ্বারা জয়দ্রথের মস্তকের পঞ্চস্থান মুণ্ডিত করিয়া পঞ্চচুড় [অপমানচিহ্নস্বরূপ বিকৃতাকার কেশকর্ত্তন] করিয়া দিলেন; কিন্তু সে বাঙনিস্পত্তিও করিতে পারিল না।

অনন্তর বৃকোদার তাহাকে ভৎসনা করিয়া কহিলেন, “রে মূঢ়! যদি তুই জীবিতলাভের অভিলাষ করিস, তাহা হইলে আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ করা। সভামধ্যে আমাদিগের দাস বলিয়া তোকে পরিচয় দিতে হইবে; ইহাতে সম্মত হইলে আমি তোর জীবন প্রদান করিব। যুদ্ধনির্জ্জিত শত্রুর প্রতি এইরূপই ব্যবহার করা চিরপ্রসিদ্ধ।” জয়দ্ৰথ অগত্যা তৎক্ষণাৎ তাঁহার বাক্য স্বীকার করিল।

দ্ৰৌপদীর দয়ায় পাশাবদ্ধ জয়দ্রথের মোচন

অনন্তর মহাবল ভীমসেন ভূপৃষ্ঠে বিচেষ্টমান ধূল্যবলুষ্ঠিতকলেবর জয়দ্রথকে বন্ধন করিয়া রথারোহণপূর্ব্বক অর্জ্জুনের সহিত আশ্রমস্থ রাজা যুধিষ্ঠিরের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং তদবস্থ শক্ৰকে তাঁহার সমীপে অৰ্পণ করিলেন। ধর্ম্মরাজ তাহাকে দেখিবামাত্র সহাস্যমুখে ভীমসেনকে কহিলেন, “হে ভীম! তুমি অবিলম্বে ইহাকে মুক্ত কর।” ভীম কহিলেন, “মহারাজ! এই নরাধম। আমাদের দাসত্ব স্বীকার করিয়াছে; অতএব আপনি ইহার পরিত্যাগের বিষয় দ্রৌপদীকে জিজ্ঞাসা করুন।” তখন রাজা যুধিষ্ঠির প্রণয়সম্ভাষণপূর্ব্বক ভীমকে কহিলেন, “যদি আমার বাক্য রক্ষা করা কর্ত্তব্য বলিয়া বোধ হয়, তবে অচিরাৎ এই দুরাচারকে পরিত্যাগ কর।” অনন্তর দ্ৰৌপদী ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অভিপ্ৰায় বুঝিতে পারিয়া মহাবীর ভীমকে কহিলেন, “এই দুরাচার তোমাদিগের দাসত্বস্বীকার করিয়াছে এবং তুমি ইহার মুণ্ড মুণ্ডিত করিয়া পঞ্চচুড়াসম্পন্ন করিয়াছ; অতএব ইহাকে শীঘ্রই মুক্ত কর।’

অনন্তর জয়দ্ৰথ বন্ধনবিমুক্ত ও একান্ত বিহ্বল হইয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের পাদবিন্দনপূর্ব্বক সম্মুখীন মুনিগণকে অভিবাদন করিল। তখন ধর্ম্মরাজ অর্জ্জুন পরিগৃহীত জয়দ্রথকে নিরীক্ষণ করিয়া দয়াদ্ৰচিত্তে কহিলেন, “হে নরাধম! এক্ষণে তুমি দাসত্ব হইতে বিমুক্ত হইলে; কিন্তু এরূপ গৰ্হিত কর্ম্ম আর কদাচ করিও না। তুমি নিতান্ত ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রাশয়েরাই তোমার একমাত্ৰ সহায়। তুমি পরস্ত্রীলোলুপ; তোমায় ধিক! তোমার ন্যায় নীচপ্রকৃতি না হইলে আমাদিগকে গতাসু বোধ করিয়া এইরূপ অন্যায় আচরণে কোন ব্যক্তি প্রবৃত্ত হইতে পারে?” অনন্তর তিনি সদয়হৃদয়ে কহিলেন, “এক্ষণে তুমি হস্ত্যশ্ব-রথাপদাতি সমভিব্যাহারে স্বনগরাভিমুখে গমন কর; আর কদাচ অধর্ম্মপথে পদার্পণ করিও না, প্রার্থনা করি, তোমার ধর্ম্মবুদ্ধিই পরিবর্দ্ধিত হউক।”

পাণ্ডবপরাভবার্থ জয়দ্রথের শিবোপাসনা-বরলাভ

অনন্তর মহারাজ জয়দ্ৰথ নিতান্ত ক্ষুন্ন-মনে লজ্জাবনতমুখে গঙ্গাদ্বারভিমুখে যাত্ৰা করিয়া ভূতভাবন ভগবান শঙ্করের শরণাপন্ন হইল এবং অতি কঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক অনতিকালমধ্যেই তাঁহাকে প্রীত ও প্ৰসন্ন করিলে দেবদেব ত্ৰিলোচন তথায় আবির্ভূত হইয়া পূজোপহার গ্রহণপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস! তুমি এক্ষণে বর প্রার্থনা কর।” জয়দ্ৰথ কহিল, “ভগবন! আমি পঞ্চপাণ্ডবকে যুদ্ধে পরাজয় করিব।” শঙ্কর কহিলেন, “না, তুমি কেবল মহাবাহু অর্জ্জুন ব্যতিরেকে সেই অজেয় ও অবধ্য পাণ্ডবগণকে পরাজয় করিতে পরিবে। পূর্ব্বকালে নররূপী অর্জ্জুন ভগবান নারায়ণের সহিত বদরিকাশ্রমে তপস্যা করিয়াছিলেন। তিনি ত্ৰিলোকের অজেয় ও দেবগণেরও দুরধিগম্য, তিনি আমা হইতে পাশুপত-অস্ত্র ও লোকপালদিগের নিকট বজ্র প্রভৃতি মহাস্ত্ৰসকল প্রাপ্ত হইয়াছেন। প্ৰলয়কাল উপস্থিত হইলে চরাচরগুরু ভগবান বিষ্ণু কলাগ্নিরূপ পরিগ্রহ করিয়া শৈলকাননসম্পন্ন সসাগরা সদ্বীপা পৃথিবী ও পাতালতল দগ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হয়েন। তৎকালে সৌদামিনী-জালমণ্ডিত ঘনমণ্ডলী অন্তরীক্ষে উত্থিত হইয়া অতি গভীর গর্জ্জন ও রথাক্ষতুল্য স্থূলধারে অনবরত বারিবর্ষণপূর্ব্বক চতুর্দ্দিক পরিপূর্ণ করিয়া সেই প্ৰজ্বলিত হুতাশন নির্ব্বাণ করিয়া থাকে। চারি সহস্ৰ যুগ অতিক্রান্ত হইলে এ পৃথিবী এককালে সলিলমধ্যে নিমগ্ন হইয়া যায়; চন্দ্র, সূৰ্য্য, গ্রহ, নক্ষত্র ও পবন কিছুই লক্ষিত হয় না; কেবল একমাত্র অসীম সাগর নেত্ৰগোচর হইয়া থাকে।

“এই অবসরে সহস্ৰাক্ষ, সহস্রপাদ ও সহস্রামস্তক-সম্পন্ন ভগবান নারায়ণ সেই অগাধ জলধিজলে সহস্ৰসূৰ্য্যসন্নিভ সহস্ৰফণাধারী শশিমৃণালব্ধবল শেষসৰ্পে শয়ন করিয়া থাকেন। তৎকালে তিনি স্বীয় নিদ্রার নিমিত্ত রজনীকে নিরবচ্ছিন্ন গাঢ়তার তিমিরে আচ্ছন্ন করিয়া রাখেন, পরে সত্ত্বগণের উদ্রেকে প্রবুদ্ধ হইয়া ত্ৰিলোককে কেবল শূন্যময় অবলোকন করেন। জলের নাম নার, প্ৰলয়কালে ভগবান তাহাতেই শয়ন করিয়াছিলেন, এই কারণে তিনি নারায়ণ বলিয়া বিখ্যাত।

“অনন্তর ভগবান নারায়ণ প্ৰজা সৃষ্টি করিবার নিমিত্ত ধ্যানস্থ হইলে তাঁহার নাভিসরোবর হইতে এক পদ্ম সমুত্থিত হইল। সর্ব্বলোকপিতামহ ব্ৰহ্মা সেই নাভিপদ্মে সমুদ্ভূত ও উপবিষ্ট হইয়া নিখিল বিশ্ব লোকশূন্য অবলোকনপূর্ব্বক আপনার মন হইতে মরীচি প্রভৃতি মহর্ষিগণকে সৃষ্টি করিতে লাগিলেন। অনন্তর তাঁহারা স্থাবর-জঙ্গমাত্মক ভূতসকলকে সৃষ্টি করিতে লাগিলেন। প্রজাপতি ব্ৰহ্মা ব্ৰহ্মমূর্ত্তিদ্বারা সৃষ্টি, পৌরুষী মূর্ত্তিদ্বারা রক্ষা ও রৌদ্রীভাবে সকল সংহার করিয়া থাকেন।

“হে সিন্ধুপাতে! বোধ হয় তুমি বেদবেদাঙ্গপারগ ব্ৰাহ্মণ ও মুনিগণমুখে ভগবান বিষ্ণুর অদ্ভুত কর্ম্মসমুদয় শ্রুত হইয়া থাকিবে। এই অবনীমণ্ডল জলপ্লাবিত হইলে তিনি বর্ষারজনীখদ্যোতের ন্যায় ইতস্ততঃ সঞ্চারণপূর্ব্বক পৃথিবী উদ্ধার করিবার উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন, “আমি কি প্রকার আকার পরিগ্রহ করিয়া পৃথিবী উদ্ধার করিব?” অনন্তর দিব্যচক্ষুঃপ্রভাবে জলবিহারযোগ্য বরাহরূপ তাঁহার স্মৃতিপথে সমুদিত হইলে তিনি শতযোজন-বিস্তৃত শতযোজন-আয়ত বেদোক্ত বরাহমূর্ত্তি পরিগ্রহ করিলেন। তাঁহার দংষ্ট্রাসকল অতি তীক্ষ্ন, শরীর পর্ব্বতের ন্যায় উন্নত ও নবীন জলধরের ন্যায় নীলবৰ্ণ এবং তঁহার গভীর গর্জ্জন মেঘ-নির্ঘোষসদৃশ।

“ভগবান-বিষ্ণু এবংবিধ বরাহরূপ পরিগ্রহ করিয়া সাগরসলিলে প্রবেশপূর্ব্বক একমাত্র দশনদ্বারা মেদিনীমণ্ডল উদ্ধার করিয়া স্বস্থানে স্থাপন করিলেন। অনন্তর তিনি অপূর্ব্ব নরসিংহবিগ্ৰহ পরিগ্রহ করিয়া দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর সভামণ্ডপে গমন করিলেন। দানবরাজ সেই অদৃষ্টপূর্ব্ব অপূর্ব্ব নরসিংহরূপ নিরীক্ষণ করিয়া রোষকষায়িত-লোচনে এক সুতীক্ষ্ন শূল উদ্যত করিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইল। তখন ভগবান নৃসিংহদেব ক্ৰোধাভরে খরনখরপ্রহারে তাহার উরুস্থল বিদীর্ণ করিলেন।

“তখন ভগবান নারায়ণ লোকের হিতসাধনাৰ্থ মহর্ষি কশ্যপের ঔরসে অদিতিগর্ভে জন্মপরিগ্রহ করিলেন। অদিতি সহস্ৰ বৎসর অতিক্রান্ত হইলে নবীননীরদশ্যামল, দণ্ড ও কমণ্ডলুধারী, জটামণ্ডিতমস্তক, শ্ৰীবৎসলাঞ্ছিতবক্ষ, যজ্ঞোপবীতসম্পন্ন বামনাকার এক পুত্র প্রসব করিলেন। বামনদেব বৃহস্পতি-সমভিব্যাহারে দানবরাজ বলির যজ্ঞদর্শনার্থ তথায় উপস্থিত হইলেন। দৈত্যরাজ বলি সেই অদ্ভুত বামনরূপ নিরীক্ষণ করিয়া হৃষ্টান্তঃকরণে কহিলেন, “হে বিপ্র! আপনার প্রতি সাতিশয় প্ৰসন্ন হইয়াছি, এক্ষণে যাহা অভিলাষ হয়, প্রার্থনা করুন।”

“বামনদেব ‘স্বস্তি’ বলিয়া হস্তোত্তোলনপূর্ব্বক রাজাকে আশীৰ্বাদপূর্ব্বক সহাস্যমুখে কহিলেন, “মহারাজ! আপনি আমাকে ত্রিপাদমাত্র ভূমি প্রদান করুন।” দানবরাজ তৎক্ষণাৎ প্রীতমনে বামনের মনোরথ পূর্ণ করিলেন। তখন বিক্রমশালী বামনদেব দিব্যরূপ পরিগ্রহ করিয়া ত্ৰিবিক্রমপ্রভাবে দানব-হস্ত হইতে পৃথিবী প্রত্যাহরণপূর্ব্বক দেবরাজ ইন্দ্রকে প্ৰদান করিলেন। ঐ বামনের সহিত দেবতারাও ভূতলে প্রাদুর্ভূত হয়েন এবং তিনি পৃথিবীতে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছেন, এ নিমিত্ত এ জগৎ বৈষ্ণব জগৎ বলিয়া অভিহিত হয়।

“হে বৎস! বামনাবতারের বিষয় সম্যকরূপ কীর্ত্তন করিলাম। এক্ষণে ভগবান বিষ্ণু সনাতন ধর্ম্মস্থাপন, আসতের নিগ্রহ ও যদুবংশ ধ্বংস করিবার নিমিত্ত পৃথিবীতে কৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন। সাধুলোকেরা তাঁহাকে অনাদি, অনন্ত, অজ ও অজিত বলিয়া কীর্ত্তন করেন। তিনি পীতাম্বর ও শঙ্খচক্ৰগদাধারী, তাঁহার বক্ষঃস্থল শ্ৰীবৎসভূষিত। সেই ভূতভাবন ভগবান কৃষ্ণ অর্জ্জুনকে সতত রক্ষা করিয়া থাকেন; এই নিমিত্ত অর্জ্জুন দেবগণেরও অজেয় হইয়াছেন; সুতরাং মনুষ্যেরা তাঁহাকে কিরূপে পরাজয় করিবে? অতএব তুমি একদিন অর্জ্জুন ব্যতীত সসৈন্য পাণ্ডবচতুষ্টয়কে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে।”

এই বলিয়া ভগবান ত্ৰিলোচন দেবী পার্ব্বতীর সহিত নানা প্রহরণধারী, বিকট, বামন, কুব্জ ও বিকৃত নয়ন প্রভৃতি পরিষদবর্গে পরিবৃত হইয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলে রাজা জয়দ্ৰথ স্বভবনাভিমুখে প্রত্যাগমন করিল এবং পাণ্ডবেরাও সেই কাম্যাকবনে অবস্থান করিতে লাগিলেন।

জয়দ্রথবিমোক্ষণপৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।