২৯০. রাক্ষস-গৃহবাস-দোষাশঙ্কায় রামের সীতাত্যাগ

২৯০তম অধ্যায়

রাক্ষস-গৃহবাস-দোষাশঙ্কায় রামের সীতাত্যাগ

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! রঘুকুলতিলক রাম সুরদ্বেষী নিশাচর রাক্ষসরাজ দশাননকে সংহার করিয়া লক্ষ্মণ ও অন্যান্য সুহৃদগণ-সমভিব্যাহারে পরম পরিতুষ্ট হইলেন। দেবগণ ও ঋষিগণ রাবণ নিহত হইয়াছে দেখিয়া মহাবাহু রামকে আশীর্ব্বাদ ও স্তব করিতে লাগিলেন। গন্ধর্ব্বগণ তাঁহার মস্তকোপরি পুষ্পবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। দেব, গন্ধর্ব্ব ও মহর্ষিগণ রামকে পূজা করিয়া স্ব স্ব স্থানে গমন করাতে নভোমণ্ডল একেবারে যেন মহোৎসবময় হইয়া উঠিল।

“মহাযশাঃ রাম এই দুর্জ্জয় দশাননের প্রাণসংহার করিয়া বিভীষণকে লঙ্কা প্ৰদান করিলেন। তখন মহাপ্ৰজ্ঞ অবিন্ধ্যনামা বৃদ্ধ মাত্য বিভীষণ-সমভিব্যাহারে সীতাকে লইয়া রামসমীপে আগমনপূর্ব্বক অতি দীনস্বরে কহিল, “হে মহাত্মন! এই সচ্চরিত্রা জানকী-দেবীকে গ্ৰহণ করুন।’ ইক্ষ্বাকুবংশাবতংস দাশরথি রাক্ষসামাত্যের বাক্যশ্রবণে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া বাস্পাভিষিক্তা, পতিবিরহে একান্ত কৰ্শিতা, মলিনকলেবরা, মলিনবাসনা, জটিলা, যানস্থা জানকীকে অবলোকন করিলেন। অনন্তর তিনি তাঁহার সতীত্ব-বিষয়ে সন্দিহান হইয়া কহিলেন, বৈদেহি! তুমি মুক্ত হইয়াছ, যথা ইচ্ছা হয় গমন কর। আমার যাহা কর্ত্তব্য, তাহা সম্পাদন করিয়াছি। হে ভদ্রে! আমি থাকিতে রাক্ষসগৃহে বাস করিয়া জরাক্রান্ত হওয়া তোমার উচিত নহে; এই ভাবিয়া আমি দশাননকে সংহার করিয়াছি। হে শুভে! অস্মদ্বিধ ধর্ম্মজ্ঞ ব্যক্তি কিরূপে পরহস্তগত নারীকে পুনরায় গ্রহণ করিবে? অতএব হে মৈথিলি! তুমি সচ্চরিত্রী হও বা অসচ্চরিত্ৰই হও, আমি কুকুরোচ্ছিষ্ট হবির ন্যায় তোমাকে পরিত্যাগ করিলাম।’

“জনকনন্দিনী রামের সেই হৃদয়মর্ম্মচ্ছেদী দারুণ বাক্য-শ্রবণে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া ছিন্নমূল কদলীর ন্যায় সহসা ধরাতালে নিপতিত হইলেন। তাঁহার মুখচন্দ্র রামদর্শনজনিত হর্ষে বিকচকমলের ন্যায় প্রফুল্ল হইয়াছিল, এক্ষণে তাঁহার সেই মুখমণ্ডল পরুষবাক্য-শ্রবণে নিশ্বাসোপহত দর্পণের ন্যায় তৎক্ষণাৎ মলিন হইয়া গেল। লক্ষ্মণ ও সমুদয় বানরগণ রামের নির্দ্দয়বাক্য-শ্রবণে মৃতের ন্যায় নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিলেন।

“তখন জগৎস্রষ্টা বিশুদ্ধাত্মা পদ্মযোনি, সুররাজ শক্ৰ, অগ্নি, বায়ু, যম, বরুণ, যক্ষাধিপতি কুবের, সপ্তর্ষিমণ্ডল ও দিব্যভাস্করকলেবর রাজা দশরথ দীপ্তিশালী, মহার্হ হংসযুক্ত-বিমানে আরোহণপূর্ব্বক বামসমীপে সমুপস্থিত হইলেন। সেই সময় অন্তরীক্ষ দেব ও গন্ধর্ব্বকুলে সঙ্কুল হওয়াতে নক্ষত্রমালামণ্ডিত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।

“তখন বৈদেহী উত্থিত হইয়া তাঁহাদের সমক্ষে রামকে কহিতে লাগিলেন, “হে রাজপুত্র! আমি ইহাতে তোমার কিছুমাত্র দোষ আশঙ্কা করি না। তুমি স্ত্রী ও পুরুষগণের রীতি বিশেষরূপে অবগত আছ; এক্ষণে আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। সদাগতি সমীরণ সর্ব্বভূতের শরীরে সতত সঞ্চরণ করিতেছেন। যদি আমি কোন প্রকার পাপাচরণ করিয়া থাকি, তবে সেই বায়ু এবং অগ্নি, জল, আকাশ ও পৃথিবী আমাকে পরিত্যাগ করুন। আমি তোমা বিনা আর কাহাকে স্বপ্নেও চিন্তা করি নাই। অতএব তুমি দেবগণের নির্দেশানুসারে আমার পতি হও।’

রামকর্ত্তৃক দেবগণসাক্ষ্যে নির্দোষ সীতার পরিগ্রহ

“সীতার ব্যাক্যাবসানে চতুর্দ্দিক প্রতিধ্বনিত ও বানরগণকে লোমাঞ্চিত করিয়া এক আকাশবাণী আবির্ভূত হইয়া উঠিল। বায়ু কহিলেন, “হে রাঘব! আমি সদাগতি বায়ু, তোমাকে সত্য কহিতেছি, মৈথিলীর কিছুমাত্ৰ পাপ নাই, তুমি ইঁহার সহিত সঙ্গত হইয়া স্বচ্ছন্দে সম্ভোগ কর।”

‘অগ্নি কহিলেন, “হে রঘুনন্দন! আমি সমুদয় ভূতের দেহাভ্যন্তরে অবস্থিতি করি, আমি জানি, মৈথিলী অণুমাত্রও অপরাধ করেন নাই।”

“বরুণ কহিলেন, “হে রাঘব! জননী পৃথিবী প্রাণীগণের শরীরে অবস্থিতি করেন; অতএব আমি কহিতেছি, তুমি জানকীকে গ্ৰহণ কর; ইনি কোনক্রমেই অপরাধী নহেন।”

“ব্ৰহ্মা কহিলেন, “হে পুত্র! তুমি রাজর্ষিধর্ম্ম ও সাধুশীল; অতএব বায়ু, অগ্নি ও বরুণ তোমার প্রণয়িনীর সতীত্ববিষয়ে যাহা কহিলেন, তাহার অসম্ভাবনা কি? তুমি দেব, গন্ধর্ব্ব, সর্প, যক্ষ, দানব ও মহর্ষিগণের শত্রু দুরাত্মা রাবণকে সংহার করিয়াছ। সেই পাপাত্মা আমার প্রসাদে সকলের অবধ্য হইয়াছিল। সেই দুরাত্মা কোন কারণবশতঃ কিয়ৎকাল উপেক্ষিত ছিল, পরে আপনার বধের নিমিত্ত সীতাকে হরণ করিয়া আনে। পূর্ব্বে নরকূবর রাবণকে অভিশাপ প্ৰদান করিয়াছিল যে, অকাম কামিনীকে বলাৎকার করিলে তোমার মস্তক শতধা হইয়া পড়িবে। আমি সেই নলকূবরশাপে নির্ভর করিয়া সীতাকে রক্ষা করিয়াছি, অতএব এ বিষয়ে কোন সংশয় না করিয়া জানকীকে গ্ৰহণ কর। হে অমরপ্রভ! তুমি আমরগণের মহৎকাৰ্য্য সাধন করিয়াছ।”

“দশরথ কহিলেন, “বৎস! আমি তোমার পিতা দশরথ, তোমার প্রতি সাতিশয় প্রীত হইয়াছি, হে পুত্ৰ! তোমার কল্যাণ হউক, আমি অনুজ্ঞা করিতেছি, তুমি স্বচ্ছন্দে গিয়া রাজ্যশাসন কর।”

“রাম কহিলেন, “হে রাজেন্দ্র! যদ্যপি আপনি আমার পিতা, তবে আমি আপনাকে অভিবাদন করি। আমি অবশ্যই আপনার আজ্ঞানুসারে অযোধ্যায় গমনপূর্ব্বক রাজ্যশাসন করিব।”

“দশরথ কমললোচন রামের বাক্য-শ্রবণে সাতিশয় হৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে পুনর্ব্বার কহিলেন, “হে মহাদ্যূতে! চতুর্দ্দশবর্ষ সম্পূর্ণ হইয়াছে, অতএব ত্বরায় অযোধ্যায় গমনপূর্ব্বক রাজ্যশাসন কর।”

“তখন রাজীবলোচন রামচন্দ্র দেবগণকে নমস্কারপূর্ব্বক ভাৰ্য্যার সহিত সম্মিলিত হইয়া শচীসহায় সুররাজের ন্যায় শোভমান হইলেন। তৎপরে অবিন্ধ্যাকে বর ও ত্ৰিজটা-রাক্ষসীকে অর্থ ও সম্মান প্ৰদান করিলেন।

“অনন্তর ব্ৰহ্মা ইন্দ্ৰাদি দেবগণের সমক্ষে রামকে কহিলেন, “হে কৌশল্যানন্দন! তুমি কি অভিলষিত বর প্রার্থনা কর?’

ব্ৰহ্মার বরে রণমৃত বানারগণের পুনর্জীবন

“রাম কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে আমার ধর্ম্মপরায়ণতা ও শক্রগণের নিকট অপরাজয় এবং রাক্ষসনিহত বানরগণের পুনর্জীবন এই তিনটি বর প্রদান করুন।”

“ব্ৰহ্মা ‘তথাস্তু’ বলিয়া বরদান করিলে রাক্ষসনিহত বানরগণ সচেতন হইয়া সুপ্তোত্থিতের ন্যায় গাত্ৰোত্থান করিল। তখন ভাগ্যবতী সীতা হনুমানকে এই বলিয়া বর প্রদান করিলেন, “বৎস হনুমান! যতদিন শ্ৰীরামচন্দ্রের কীর্ত্তি বিদ্যমান থাকিবে, তুমিও ততদিন জীবিত থাকিবে এবং আমার প্রসাদকৃত দিব্য উপভোগসকল চিরকাল তোমার সমীপে সমুপস্থিত হইবে।”

“অনন্তর ইন্দ্ৰাদি দেবগণ সেই সকল অক্লিষ্টকর্মী বীরগণের সমক্ষেই অন্তর্হিত হইলেন। শক্রসারথি মাতলি রামচন্দ্ৰকে জানকীসমবেত নিরীক্ষণ করিয়া সুহৃদগণের সমক্ষে পরমপ্রীতচিত্তে কহিলেন, “হে সত্যপরাক্রম! আপনি দেব, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, মানুষ, অসুর ও পন্নগগণের দুঃখ অপনীত করিলেন। অতএব পৃথিবী যতদিন তাঁহাদিগকে ধারণ করিবে, ততদিন তাঁহারা আপনার নামকীর্ত্তন করিবেন।” মাতলি রামকে এই কথা বলিয়া তাঁহাকে পূজাপূর্ব্বক তাঁহার অনুজ্ঞাক্ৰমে সেই রথ লইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।

রামের অযোধ্যাগমন—অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান

“অনন্তর রাম লঙ্কা-রক্ষার উপায়বিধান করিয়া সীতা, লক্ষ্মণ, বিভীষণ ও সুগ্ৰীব প্রভৃতি বানরগণ-সমভিব্যাহারে পুষ্পকরথে আরোহণপূর্ব্বক অমাত্যগণসংবৃত হইয়া সেই সেতুদ্বারা সমুদ্র উত্তীর্ণ হইলেন এবং পূর্ব্বে সমুদ্রতীরে যে স্থানে শয়ন করিয়াছিলেন তথায় উপস্থিত হইয়া যথাকলে বানরগণকে পূজা ও বিবিধ রত্নপ্রদানদ্বারা সন্তুষ্টপূর্ব্বক বিদায় করিলেন। গোপুচ্ছ বানর ও ভাল্লুকগণ প্রস্থান করিলে শ্ৰীরামচন্দ্ৰ সুগ্ৰীব ও বিভীষণ সমভিব্যাহারে পুষ্পকরথে আরোহণপূর্ব্বক কিষ্কিন্ধ্যা-নগরীতে যাত্ৰা করিলেন। গমনকালে জানকীকে তত্ৰত্য কানন ও সমুদ্র প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। পরে কিষ্কিন্ধ্যায় উপস্থিত হইয়া কৃতকর্ম্মা অঙ্গদকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া যথাগত পথে অযোধ্যাভিমুখে গমন করিলেন। রাজেশ্বর রাম অযোধ্যায় উপস্থিত হইয়া হনুমানকে বক্তব্যবিষয়ে উপদেশ প্রদানপূর্ব্বক ভারতসমীপে প্রেরণ করিলেন। পবননন্দন নন্দিগ্রামে উপনীত হইয়া দেখিলেন, মলিন-কলেবর চীরবাসা ভরত শ্রীরামচন্দ্রের পাদুকাদ্বয় সম্মুখে রাখিয়া অধ্যাসীন আছেন।

“অনন্তর বীৰ্য্যবান রামলক্ষ্মণ ভরত ও শক্রয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া পরম আনন্দিত হইলেন। তাঁহারাও জ্যেষ্ঠভ্রাতার সহিত সম্মিলিত হইয়া ও বৈদেহীকে অবলোকন করিয়া হৰ্ষসাগরে নিমগ্ন হইলেন। তখন মহাত্মা ভরত প্রীতিপ্ৰফুল্লচিত্তে শ্ৰীরামচন্দ্রকে সেই নিক্ষিপ্ত [পূর্ব্বে দশরথকর্ত্তৃক বরপ্রদত্ত] রাজ্য প্রত্যর্পণ করিলেন।

“অনন্তর বশিষ্ঠ ও বামদেব একত্ৰ হইয়া বৈষ্ণবনক্ষত্রে অভিমত দিনে শৌৰ্য্যশালী রামকে অভিষিক্ত করিলেন। তিনি অভিষেকানন্তর সুগ্ৰীব, বিভীষণ ও তাঁহাদিগের সুহৃদগণকে বিবিধ ভোগদ্বারা অৰ্চনা ও তৎকালোচিত শিষ্টাচারদ্বারা সৎকার করিয়া অতিদুঃখে গৃহগমনে অনুমতি করিলেন। তাঁহারা বিদায় হইলে পুষ্পকরথে পূজা করিয়া প্রীতিপূর্ব্বক যক্ষরাজকে প্রদান করিয়া দেবগণ-সমভিব্যাহারে গোমতী নদী-সমীপে নির্ব্বিঘ্নে ত্ৰিগুণদক্ষিণ দশ-অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলেন।”