২৫৮. রীহিদ্রোণিকপর্ব্বাধ্যায়

২৫৮তম অধ্যায়

রীহিদ্রোণিকপর্ব্বাধ্যায়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবেরা বহু ক্লেশে অরণ্যবাসে একাদশ বৎসর অতিবাহিত করিলেন এবং অনির্দ্দিষ্টকাল অল্পমাত্রই অবশিষ্ট আছে, এইরূপ অনুধ্যান করিয়া অনায়াসলভ্য বন্য ফলমূল ভক্ষণপূর্ব্বক দিনপাত করিতে লাগিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির স্বকর্ম্মদোষজনিত ভ্রাতৃগণের দুঃখ, দূতসদ্ভূত শক্রগণের দৌরাত্ম্য ও কর্ণের অতি পরুষবাচন স্মরণ করিয়া শল্যাহত-হৃদয়ের ন্যায় সুখে রজনীতে নিদ্রিত হইতেন না। প্ৰত্যুত রোষাবেশপ্রভাবে ঘন ঘন দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতেন। অর্জ্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব ও দ্রৌপদী ইহারা বনবাসের নির্দ্দিষ্ট কাল অল্পমাত্রই অবশিষ্ট আছে, এই ভাবিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে সেই দুর্ব্বিষহ দুঃখ সহ্য করিতে লাগিলেন। তৎকালে তাঁহাদিগের কলেবর উৎসাহ, চেষ্টা ও অমর্ষপ্ৰভাবে যেন অন্য প্রকার বোধ হইতে লাগিল।

এইরূপ কিয়ৎকাল অতীত হইলে একদা সত্যবতীসূত ভগবান ব্যাস পাণ্ডবগণকে অবলোকন করিবার নিমিত্ত তথায় উপস্থিত হইলেন। রাজা যুধিষ্ঠির প্রত্যুদগমনপূর্ব্বক বিধানানুসারে তাঁহার সংবৰ্দ্ধনা করিয়া আসন প্ৰদান করিলেন। মহাতপাঃ ব্যাস আসনে আসীন হইলে মহারাজ যুধিষ্ঠিরও প্ৰণাম করিয়া তাহার সন্নিধানে উপবিষ্ট হইলেন।

যুধিষ্ঠির সমীপে ব্যাসাগমন-বিবিধ উপদেশপ্ৰদান

অনন্তর সত্যবতীনন্দন ব্যাস স্বীয় পৌত্রগণকে বন্য ফলমূলাহারী ও নিতান্ত কৃশকায় নিরীক্ষণ করিয়া বাষ্পগদগদ বচনে কৃপাপ্রদর্শনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! তপানুষ্ঠান না করিলে কদাচি সুখলাভ হয় না। মনুষ্য পৰ্য্যায়ক্রমে সুখ-দুঃখ ভোগ করিয়া থাকে; কিন্তু অনন্ত সুখসম্ভোগে কেহই সমর্থ হয় না। বিশুদ্ধবুদ্ধি-সম্পন্ন প্রজ্ঞ লোক উন্নতিলাভে হৃষ্ট ও হীনদশায় কোনক্রমে বিষণ্ন হয়েন না; অতএব উপস্থিত সুখ দুঃখ সমভাবে বোধ করিবে। যাদৃশ কৃষক শস্যের সময়প্রতীক্ষা করিয়া থাকে, তদ্রূপ সকলেরই অবসর প্রতীক্ষা করা কর্ত্তব্য।

“হে যুধিষ্ঠির! তপস্যা অপেক্ষা সার পদার্থ আর নাই। তপস্যা হইতে পরম সুখলাভ হয়; তপস্যাপ্রভাবে সকল বস্তুই সিদ্ধ হইতে পারে। সত্য, সরলতা, অক্রোধ, সংবিভাগ, দম, শম, অনসূয়া, অহিংসা, শৌচ ও ইন্দ্ৰিয়সংযম এই কয়েকটি গুণ মনুষ্যের পবিত্ৰতা সম্পাদন করিয়া থাকে। সৎপথাবরোধী অধর্ম্মরুচি মনুষ্যেরা কদাচি সুখলাভ করিতে পারে না। ইহলোকে যে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করা যায়, পরলোকে তাহার ফলভোগ হইয়া থাকে; অতএব মনুষ্য তপস্যা ও নিয়মে নিরন্তর নিরত থাকিবে। প্রদানকাল উপস্থিত হইলে বিগত মৎসর হইয়া প্ৰফুল্ল-মনে অর্থীকে পূজা প্ৰণামপূর্ব্বক শক্ত্যনুসারে দান করিবে।

“সত্যবাদী ব্যক্তি অনায়াসে দীর্ঘায়ু ও সরল হইয়া থাকে; অক্রোধী ও অসূয়াশূন্য মনুষ্য পরমনির্ব্বাণ লাভ করে। দান্ত ও শান্তিপর হইলে নিরন্তর সুখস্বচ্ছন্দতালাভ হইয়া থাকে। ইন্দ্ৰিয়দমনশীল ব্যক্তি সংবিভাগকর্ত্তা, দাতা, অহিংসক ও ভোগসম্পন্ন, সে পরম আরোগ্য লাভ করে। অন্যের সম্পত্তি সন্দর্শন করিয়া সন্তপ্ত হন না। যে ব্যক্তি সম্মানার্হ মনুষ্যকে সম্মান করিয়া থাকে, মহৎকুলে তাহার জন্ম হয়। জিতেন্দ্ৰিয় পুরুষ কদাচ ব্যসনী হয়েন না। যিনি সর্ব্বদা শুভবিষয়ের পক্ষপাতী, তিনি কালকৃত দেহাবসানে কল্যাণমতি হইয়া প্রাদুর্ভূত হয়েন।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবান! পরলোকে দান, ধর্ম্ম ও তপস্যার কি কি গুণ লাভ হয় এবং দুষ্কর কর্ম্মই বা কি, আপনি তাহা কীর্ত্তন করুন।” ব্যাসদেব কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! পৃথিবীতে দান অপেক্ষা দুষ্কর আর কিছুই নাই। লোকের অর্থতৃষ্ণা অতি বলবতী, অর্থও অতিকষ্টে লাভ হইয়া থাকে। দেখ, মনুষ্য ধনলাভে লোলুপ হইয়া প্রিয়তর প্রাণের প্রত্যাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক সাগর ও অরণ্যে প্রবেশ করে; কেহ কেহ কৃষি ও গোরক্ষণে নিযুক্ত হয়, কেহ বা দাসত্ব পৰ্য্যন্ত স্বীকার করিয়া থাকে; সুতরাং এইরূপ দুঃখোপার্জ্জিত ধন পরিত্যাগ করা নিতান্ত দুষ্কর। বিশেষতঃ ন্যায়োপার্জ্জিত অর্থ দেশ, কাল ও পাত্ৰ বিবেচনা করিয়া প্ৰদান করা সাতিশয় সুকঠিন। যে ব্যক্তি অন্যায়তঃ অর্থ উপার্জ্জন করিয়া সম্পদান করে, সেই দান তাহাকে মহৎ পাপভয় হইতে পরিত্রাণ করিতে সমর্থ হয় না; কিন্তু যথার্থ অবসরে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে অর্থীকে ন্যায়োপার্জ্জিত অর্থ প্ৰদান করিলে তাহার অনন্ত ফললাভ হইয়া থাকে।”