২৮৩. রাবণকর্ত্তৃক পরিখাদিদ্বারা লঙ্কারক্ষা-বিধান

২৮৩তম অধ্যায়

রাবণকর্ত্তৃক পরিখাদিদ্বারা লঙ্কারক্ষা-বিধান

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে রাজন! এদিকে রাবণ যুদ্ধশাস্ত্রানুসারে লঙ্কাপুরীমধ্যে বিবিধ যুদ্ধোপকরণসামগ্ৰীসকল আহরণ করিতে লাগিলেন। সেই পুরী স্বভাবতঃই দুরাক্রমণীয়; তাহাতে আবার দৃঢ়তর প্রাকার ও তোরণে পরিরক্ষিত এবং মীনকুম্ভীরসমাকীর্ণ অগাধজলপরিপূর্ণ সাতটি পরিখায় পরিবেষ্টিত। প্রথম পরিখা সুদৃঢ় খতিরকাষ্ঠবিনির্ম্মিত শঙ্কসমূহদ্বারা পরিব্যাপ্ত; দ্বিতীয় পরিখা কপাট-যন্ত্রে দৃঢ়ীকৃত; তৃতীয় পরিখা লগুড় ও প্রস্তরগোলকে ব্যাপ্ত; চতুর্থ পরিখা আশীবিষসমূহ ও যোদ্ধৃগণে নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ, পঞ্চম পরিখা সর্জ্জরস ও ধূলিপটলে পরিপূর্ণ; ষষ্ঠ পরিখা মুষল, আলাত, নারাচ, তোমর, খড়্গ, পরশু ও শতয়ী সমাকীর্ণ, সপ্তম পরিখা মধুচ্ছষ্ট [মোম] ও মুদগরসমূহে সমাকীর্ণ। সমুদয় পুরদ্বারে স্থাবর ও জঙ্গম বরুজ [গম্বুজ]-সকল গজবাজিনিবহে পরিপূর্ণ ও পদাতিসমূহে পরিরক্ষিত হইতে লাগিল।

অঙ্গদের দৌত্যকাৰ্য্য

“অনন্তর রামচন্দ্রপ্রেরিত বীরবর অঙ্গদ রাক্ষসরাজের জ্ঞাতসারে পুরীমধ্যে প্রবিষ্ট ও কোটি কোটি রাক্ষসগণের মধ্যবর্ত্তী হইয়া উপবেশনপূর্ব্বক মেঘমালার অভ্যস্তরস্থিত আদিত্যের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল এবং অমাত্যগণবেষ্টিত রাক্ষসাধিপতি রাবণের সমীপবর্ত্তী হইয়া বাগ্মিতা প্রদর্শনপূর্ব্বক রামচন্দ্রের আদেশসকল কহিতে আরম্ভ করিল, “হে রাজন! মহাযশাঃ অযোধ্যানাথ কহিয়াছেন যে, দেশ ও নগর সকল দুরাত্মা অন্যায়কারী শাসনপরতন্ত্র হইলে দুর্নীতিনিবন্ধন উচ্ছেদদশা প্রাপ্ত হয়, তাহাতে সন্দেহ নাই। তুমি বলপূর্ব্বক আমার সীতাকে অপহরণ করিয়া কেবল একাকী অপরাধী হইয়াছ, কিন্তু সেই একের অপরাধে কত শত নিরপরাধ প্ৰজার প্রাণদণ্ড হইবে, তাহা বলিতে পারি না। তুমি যে বলদৰ্পে দর্পিত হইয়া বনবাসী ঋষিগণের হিংসা ও দেবনিবহের অবমাননা করিয়াছ, তুমি রাজর্ষিদিগকে নিহত করিয়াছ এবং অবলাগণের নেত্ৰজল উপেক্ষা করিয়া তাহাদিগের প্রাণসংহার করিয়াছ, এক্ষণে তোমাকে সেই সকল দুর্নীতের ফলভোগ করিতে হইবে, সন্দেহ নাই। তুমি যুদ্ধই কর, আর আপনার পৌরুষই প্ৰকাশ কর, আমি তোমাকে অমাত্যসহ শমনসদনে প্রেরণ করিব। হে নিশাচর! তুমি আমার এই মানব-ধনুর বীৰ্য্য প্রত্যক্ষ কর। তুমি জানকীকে মুক্ত করিলেও আমার নিকট মুক্তি পাইবে না, আমি নিশিত শরসমূহে এই ভূমণ্ডল রাক্ষস শুন্য করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

“তখন ক্ৰোধমূর্চ্ছিত রাবণ দূতের পরুষবাক্য সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া চারিজন রজনীচরকে[রাক্ষস] ইঙ্গিত করিলেন। যেমন পক্ষিগণ শার্দূলকে আক্রমণ করে, সেইরূপ ঐ চারিজন রজনীচর অঙ্গদের চারি অঙ্গ ধারণ করিল। অঙ্গদ অঙ্গসংলগ্ন চারিজন নিশাচরকে গ্ৰহণ করিয়া আকাশে উৎপতিত হইয়া প্ৰাসাদতলে আরোহণ করিল। উৎপতনকালে ঐ চারি নিশাচর আর্ত্তনাদ করিয়া ভূমিতলে নিপতিত ও চূর্ণহৃদয় হইয়া গেল।

“অঙ্গদ তখন হর্ম্যশিখর হইতে লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক লঙ্কাপুরী উল্লঙ্ঘন করিয়া স্ববলাসমীপে উপনীত হইল এবং রামচন্দ্ৰকে আনুপূর্ব্বিক সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদনপূর্ব্বক তৎকর্ত্তৃক অভিনন্দিত হইয়া বিশ্রাম করিল।

বানরসৈন্যের লঙ্কা আক্রমণ-রাক্ষসসহ যুদ্ধ

“অনন্তর শ্রীরামচন্দ্র মহাবেগবান্‌ বানরগণের সম্যক্‌ সাহায্যে লঙ্কার প্রাকার ভগ্ন করিলেন। লক্ষ্মণ বিভীষণ ও জাম্বুবানসমভিব্যাহারে দূরতিক্রম্য দক্ষিণদ্বার আক্রমণ করিলেন। তখন করভাকায় [হস্তিতুল্য দেহ] ও অরুণবর্ণ অতিমাত্ৰ যোদ্ধা শতসহস্ৰকোটি বানর তাঁহার সহিত লঙ্কায় প্রবেশ করিল এবং লম্ববাহু, দীর্ঘকর, আয়তউরু ও মহাজঙ্ঘশালী ধূম্রবর্ণ তিন কোটি ভল্লুক সেই নগর নিপীড়ন করিতে লাগিল। বানারগণের উৎপতন ও নিপতনে ধূলিপটল উৎক্ষিপ্ত হইয়া প্রভাকরের প্রভা তিরোহিত করিল। কোন বানর শালিপ্রসূনসদৃশ [ধাম্যকণিশসম—ধানের ফুলতুল্য], কেহ কেহ বা শিরীষ কুসুমতুল্য, কেহ কেহ বা তরুণ-অরুণসন্নিভ এবং কেহ বা শণের ন্যায় গৌরবর্ণ, ঈদৃশ বিচিত্ৰবৰ্ণ-বানরগণাধিষ্ঠিত পুরপ্রাচীর কপিলবর্ণ হইয়া উঠিল, আবালবৃদ্ধবনিতা রাক্ষসগণ বিস্মযয়োৎফুল্ললোচনে দর্শন করিতে লাগিল।

“বানরগণ নগরের মণিাস্তম্ভ ও কর্ণাটশিখরসকল ভগ্ন করিল; পরে শতঘ্নী, চক্ৰ, লগুড় ও প্রস্তর গ্রহণ করিয়া মহাশব্দে মহাবেগে ভগ্ন ও উৎপাটিত করিয়া শৃঙ্গ এবং যন্ত্ৰসকল লঙ্কামধ্যে নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিল। যে-সকল নিশাচর প্রাকারোপরি উপবিষ্ট ছিল, তাহারা কপিগণের উপদ্রবে তৎক্ষণাৎ পলায়ন করিল।

“অনন্তর বিকৃতাকার কৃষ্ণকায় কামরূপী শতসহস্র বিক্রমশালী নিশাচর রাবণের আদেশানুসারে প্রাকারপৃষ্ঠে আরোহণ ও বানরগণকে আক্রমণপূর্ব্বক শস্ত্ৰজালবর্ষণে অপসারিত করিয়া সেই প্রাকার কপিশুন্য করিল। একদিকে বানরগণ শূলাঘাতে, অন্যদিকে রাক্ষসগণ স্তম্ভতোরণাঘাতে নিপতিত হইতে লাগিল। তখন কোন স্থানে কেশাকেশি, কোন স্থানে নখানখি ও কোন স্থানে দন্তদন্তি যুদ্ধ আরম্ভ হইল। উভয় দলই তর্জ্জনগর্জ্জনপূর্ব্বক এরূপ উন্মত্ত হইয়া উঠিল যে, ভূতলে নিপতিত ও নিহত না হইলে কেহ কাহাকেও পরিত্যাগ করে না।

“এদিকে রামচন্দ্ৰ পয়োধরের ধারা-বর্ষণের ন্যায় শরজাল বর্ষণ করিয়া অনেক-সংখ্যক নিশাচরকে ধরাশায়ী করিলেন। দৃঢ়ধন্বা শ্রমশূন্য সৌমিত্ৰও নারাচসমূহদ্বারা একে একে দুৰ্গস্থ অরাতিগণকে নিপতিত করিতে লাগিলেন। এইরূপে লঙ্কাপুরী বিমর্দ্দিত হইলে সেদিন সৈন্যগণ চরিতার্থ ও জয়প্রাপ্ত হইয়া রাঘবের আজ্ঞাক্ৰমে প্রত্যাবৃত্ত হইল।”