৬৯তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের প্রতি যুধিষ্ঠিরপ্রযুক্ত ধিক্কার
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির মহাবলপরাক্রান্ত সূতপুত্রের শরজালে একান্ত সন্তপ্ত হইয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহাকে জীবিত শ্রবণ করিয়া ক্রোধভরে ধনঞ্জয়কে কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! তোমার সৈন্যগণ নিপীড়িত ও পলায়িত হইয়াছে এবং তুমিও কর্ণকে সংহার করিতে একান্ত অসমর্থ হইয়া ভীতমনে ভীমকে পরিত্যাগপূর্ব্বক আমার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছ। এখন বুঝিলাম, আৰ্য্যা কুন্তীর গর্ভে জন্ম পরিগ্রহ করা তোমার নিতান্ত অনুচিত হইয়াছে। তুমি দ্বৈতবনে আমার নিকট সত্য করিয়াছিলে যে, আমি একাকীই কর্ণকে বিনাশ করিব, সন্দেহ নাই। এখন তোমার সে প্রতিজ্ঞা কোথায় রহিল? আজ তুমি কর্ণের ভয়ে ভীত হইয়া ভীমসেনকে পরিত্যাগপূর্ব্বক কিরূপে আগমন করিলে? তুমি যদি পুর্ব্বে দ্বৈতবনে আমাকে কহিতে যে, আমি সূতপুত্রকে বিনাশ করিতে সমর্থ হইব না, তাহা হইলে আমি ইতিকৰ্ত্তব্যতা অবধারণ করিতাম। হে ধনঞ্জয়! তুমি তৎকালে আমার নিকট সূতপুত্রের বধসাধন বিষয়ে অঙ্গীকার করিয়া এক্ষণে কি নিমিত্ত তাহার অনুষ্ঠানে অসমর্থ হইলে? কি নিমিত্ত আমাদিগকে শত্রুমধ্যে আনয়ন করিয়া কঠিন ভূভাগে নিক্ষেপপূর্ব্বক চূর্ণ করিলে? হে অর্জ্জুন! আমরা সততই তোমাকে বহুতর আশীর্ব্বাদ করিয়া থাকি; কিন্তু তুমি ফললাভার্থী ব্যক্তিদিগের বহুকুসুম সুশোভিত নিষ্ফল পাদপের ন্যায় আমাদিগের তৎসমুদয়ই বিফল করিলে। আমি রাজ্যলাভে একান্ত লোলুপ; কিন্তু এক্ষণে তোমা হইতে আমার আমিষখণ্ডসমাচ্ছাদিত বড়িশের [মাংসখণ্ডে জড়িত বঁড়শী] ন্যায়, ভক্ষ্যদ্রব্যসমাচ্ছন্ন গরলের ন্যায় রাজ্যব্যাপদেশে বিনাশলাভ হইল। হে ধনঞ্জয়! যোগ্য অবসরে প্রত্যুপ্ত বীজ যেমন মেঘের উপর নির্ভর করে, তদ্রূপ আমরা কেবল রাজ্যলাভের আশায় এই এয়োদশ বৎসর তোমার উপর নির্ভর করিয়াছিলাম, কিন্তু এক্ষণে তুমি আমাদিগকে ঘোরতর দুঃখে নিপাতিত করিলে। হে নির্ব্বোধ! তোমার বয়ঃক্রম সাত দিন হইলে আৰ্য্যা কুন্তীর প্রতি এই দৈববাণী হইয়াছিল যে,—এই দেবরাজসদৃশ বিক্রমশালী পুত্র রণস্থলে সমস্ত শত্ৰুদিগকে পরাজিত করিবে। ইহার বাহুবলেই খাণ্ডবপ্রস্থে দেবতা ও অন্যান্য প্রাণীগণ পরাজিত হইবেন। এই বীর মদ্র, কলিঙ্গ, কেকয় ও কৌরবগণকে নিহত করিবেন। ইহার তুল্য ধনুর্দ্ধর আর প্রাদুর্ভূত হইবে না। ইহাকে কেহই কখন পরাজয় করিতে পারিবে না। এই বীর সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী হইবে এবং ইচ্ছা করিলেই যাবতীয় প্রাণীগণকে বশীভূত করিতে পারিবে। হে কুন্তি! সুরজননী অদিতির পুত্র অরিনিসূদন মধুসূদনের ন্যায় এই পুত্র তোমার গর্ব্বে প্রাদুর্ভূত হইয়াছে। এই মহাবীর সৌন্দর্য্যে শশাঙ্ক, বেগে বায়ু, ধীরতায় সুমেরু, ক্ষমাগুণে পৃথিবী, তেজে দিবাকর, ঐশ্বর্য্যে কুবের, শৌর্য্যে শক্র ও বলবীর্য্যে বিষ্ণুর অনুরূপ হইবে। ইহা হইতেই কৌরবদিগের বংশরক্ষা হইবে। এই বীর আপনাদিগের জয় ও শত্রুগণের পরাজয়ের নিমিত্ত খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করিবে।
‘হে ধনঞ্জয়! তৎকালে অন্তরীক্ষে এইরূপ দৈববাণী হইয়াছিল; শতশৃঙ্গপৰ্বতশিখরে অবস্থিত মহর্ষিগণও ইহা শ্রবণ করিয়াছিলেন। কিন্তু এক্ষণে সেই দৈববাণী নিষ্ফল হইল। অতএব বোধ হইতেছে, দেবগণও মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিয়া থাকেন। হে বীর! আমি মহর্ষিগণের মুখে নিরন্তর তোমার প্রশংসাবাদ শ্রবণ করিয়া দুর্য্যোধনের উন্নতিবিষয়ে অণুমাত্র প্রত্যাশা করিতাম না এবং তুমি যে সূতপুত্র হইতে ভীত হইবে, আমার মনেও কখনও এরূপ বিশ্বাস হয় নাই। দেখ, তুমি বিশ্বকর্ম্মা কর্ত্তৃক নির্ম্মিত অশব্দ-চক্ৰসম্পন্ন কপিধ্বজ রথে আরোহণ এবং হেমপট্টসমলঙ্কৃত খড়্গ ও তালপ্রমাণ গাণ্ডীব ধারণ করিতেছ; বিশেষতঃ বাসুদেব তোমার সারথি হইয়াছেন; তথাচ তুমি সূতপুত্র হইতে ভীত হইয়া রণস্থল হইতে প্রত্যাগমন করিলে। এক্ষণে তুমি বাসুদেবকে গাণ্ডীবশরাসন প্রদান কর। তুমি যদি কৃষ্ণের সারথি হইতে, তাহা হইলে উনি, পুরন্দর যেমন বজ্ৰ গ্ৰহণপূর্ব্বক বৃত্রাসুরকে সংহার করিয়াছিলেন তদ্রূপ প্রবল পরাক্রম সূতপুত্রকে বিনাশ করিতেন, সন্দেহ নাই। হে অর্জ্জুন! যদি অদ্য তুমি সমরচারী সূতপুত্রকে নিবারণ করিতে সমর্থ না হও, তাহা হইলে তোমা অপেক্ষা অস্ত্রশস্ত্রে সুনিপুণ অন্য এক ভূপালকে এই গাণ্ডীব প্রদান কর। তাহা হইলে লোকে আমাদিগকে পাপপুরুষপরিসেবিত অগাধ নরকে নিপতিত, পুত্রকলত্রবিহীন এবং সুখ ও রাজ্যপরিভ্রষ্ট নিরীক্ষণ করিবে না। তোমার সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করা অপেক্ষা পঞ্চম মাসে গর্ভস্রাবে বিনষ্ট হওয়া বা কুন্তীর গর্ভে জন্ম পরিগ্রহ না করাই শ্রেয়ঃকল্প ছিল। হে দুরাত্ম! এক্ষণে তোমার গাণ্ডীবে ধি, বাহুবীর্য্যে ও অসংখ্য শরনিকরে ধিক্ এবং বানরধ্বজ ও পাবকপ্রদত্ত রথেও ধিক্।’ ”