১২৩. প্ৰভাতে দর্শকসমাগম-ভীষ্মের পানীয় প্রার্থনা

১২৩তম অধ্যায়

প্ৰভাতে দর্শকসমাগম-ভীষ্মের পানীয় প্রার্থনা

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! রজনী প্রভাত হইলে পাণ্ডব, কৌরব ও অন্যান্য পার্থিবগণ বীরশয্যায় শয়ান ক্ষত্রিয়োত্তম ভীষ্মের নিকট গমনপূর্ব্বক অভিবাদন করিলেন। সহস্ৰ সহস্ৰ কন্যাগণ তথায় আগমন করিয়া ভীষ্মের উপর চন্দনচুর্ণ, লাজ ও মাল্যসমূহ বিকীর্ণ করিলেন। যেমন প্ৰাণীসকল সূৰ্য্যের উপাসনা করিতে উপস্থিত হয়, সেইরূপ স্ত্রী, বালক, বৃদ্ধ ও অন্যান্য দর্শকগণ পিতামহের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। বাদক, গণিকা, বারাঙ্গনা, নট, নর্ত্তক এবং শিল্পীগণও ভীষ্মের নিকট গমন করিলেন। কৌরব ও পাণ্ডবগণ যুদ্ধ, কবচ ও আয়ুধসকল পরিত্যাগ করিয়া পূর্ব্বের ন্যায় বয়ঃক্রম অনুসারে পরস্পরের প্রতি প্রীতিমান হইয়া দুরাধর্ষ ভীষ্মের নিকট উপবেশন করিলেন। পার্থিবগণে আকীর্ণ, ভীষ্মশোভিত সেই ভারতী সভা নভোমণ্ডলস্থ আদিত্যমণ্ডলের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। যেমন দেবগণ দেবরাজকে উপাসনা করেন, তদ্রূপ রাজগণ ভীষ্মকে উপাসনা করিতে লাগিলেন। ভীষ্ম শস্ত্রসন্তাপে সন্তাপিত হইয়াও ধৈৰ্য্যগুণে সমুদয় বেদনা সংবরণপূর্ব্বক ভুজঙ্গের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক ভূপতিগণকে নয়নগোচর করিয়া পানীয় প্রার্থনা করিলেন। ক্ষত্ৰিয়গণ চতুর্দ্দিক হইতে নানাবিধ খাদ্যসামগ্ৰী ও শীতল জলপূৰ্ণ কুম্ভসকল আহরণ করিলেন। ভীষ্ম সেই উপনীত [সমীপে আনীত] পানীয় নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “হে ভূপালগণ! আমি শরশয্যায় শয়ান হইয়া মনুষ্যলোক হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছি কেবল চন্দ্ৰসূৰ্য্যের পরিবর্ত্তনকাল [চন্দ্রের কৃষ্ণপক্ষগতিত্যাগপূর্ব্বক শুক্লপক্ষগতি; সূৰ্য্যের দক্ষিণায়নগতিত্যাগপূর্ব্বক উত্তরায়ণগতি] প্রতীক্ষায় জীবিত আছিঃ অদ্য মনুষোচিত ভোগসকল গ্রহণ করিতে পারি না।” ভীষ্ম এই কহিয়া ভূপালগণকে নিন্দা করিয়া কহিলেন, ভূপালগণ! আমি অর্জ্জুনকে অবলোকন করিতে ইচ্ছা করি।”

বাণপ্ৰভাবে অর্জ্জুনের পবিত্রবারি প্রদান

“ভীষ্ম এই কথা কহিবামাত্ৰ মহাবাহু ধনঞ্জয় নিকটবর্ত্তী হইয়া ভীষ্মকে অভিবাদনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে বিনীতভাবে কহিলেন, “পিতামহ! কি করিতে হইবে?”

“ধর্ম্মাত্মা ভীষ্ম অর্জ্জুনকে প্ৰণতভাবে সম্মুখে দণ্ডায়মান দেখিয়া প্রীতিপূর্ব্বক কহিলেন, ‘ধনঞ্জয়! তোমার শরজালে আবৃত হইয়া আমার শরীর দগ্ধ হইতেছে; মর্ম্মস্থানসকল ব্যথিত হইতেছে; মুখ পরিশুষ্ক হইতেছে; আমি নিতান্ত আকুল হইয়াছি, তুমিই সমর্থ; অতএব আমাকে পানীয় প্ৰদান কর।”

“অর্জ্জুন ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া রথে আরোহণ ও জ্যারোপণপূর্ব্বক গাণ্ডীব আকর্ষণ করিলেন। সমুদয় সৈন্য ও পার্থিবগণ বজ্রের ন্যায় তাঁহার জ্যাতিলনির্ঘোষ শ্রবণ করিয়া চকিত হইয়া উঠিলেন। ধনঞ্জয় ভীষ্মকে প্ৰদক্ষিণ করিয়া প্ৰদীপ্ত শরসন্ধান আমন্ত্রণ ও পার্জ্জন্যাস্ত্ৰ [বারি আকর্ষণক্ষম শর—অর্জ্জুনের এই অস্ত্রটির নাম পার্জ্জন্য অন্ত্র। পার্জ্জন্য অর্থ মেঘবারি। ইহা আকাশের মেঘবারি পর্য্যন্ত আকর্ষণ করিতে পারে। আজকাল নলকূপের জলে যাঁহাদের আশ্চৰ্য্যবোধ হয় তাঁহাদের এই পাতালজলের আকর্ষণে আরও অধিক আশ্চৰ্য্যমন্বিত হওয়া উচিত।] সংযোজনপূর্ব্বক সকল লোকের সমক্ষে ভীষ্মের দক্ষিণপাৰ্থে পৃথিবীকে বিদ্ধ করিলেন। অনন্তর সেই স্থান হইতে অমৃততুল্য, দিব্যগন্ধ ও দিব্যস্বাদু, অতিশীতল বিমল বারিধারা সমুত্থিত হইল। ধনঞ্জয় তদ্দ্বারা দিব্যকর্ম্মা [পবিত্র কাৰ্য্যের অনুষ্ঠাতা] ও দিব্যপরাক্রম [দেবতুল্য শ্রৌৰ্য্যশালী] ভীষ্মকে পরিতৃপ্ত করিলেন। ভূপতিগণ অর্জ্জুনকে ইন্দ্রের ন্যায় কর্ম্ম করিতে অবলোকন করিয়া যারপরনাই বিস্ময়প্রাপ্ত হইলেন এবং এরূপ উদভ্ৰান্ত হইয়াছিলেন যে, তাঁহাদিগের উত্তরীয়-বসন সকল স্রস্ত হইয়া পড়িল। কৌরবগণ অর্জ্জুনের সেই অলৌকিক কর্ম্ম নিরীক্ষণ করিয়া শীতার্ত্ত [শীতকাতর] গোসমূহের ন্যায় কম্পিত হইতে লাগিলেন। চতুর্দ্দিকে শঙ্খদুন্দুভির বাদ্য হইতে লাগিল।

“ভীষ্ম পরিতৃপ্ত হইয়া পার্থিবগণের সমক্ষে যেন অর্জ্জুনকে পূজাপূর্ব্বক কহিলেন, “হে মহাবাহো! এ কাৰ্য্য তোমার পক্ষে বিচিত্র নহে; নারদ তোমাকে পূর্ব্বতন ঋষি বলিয়া কীর্ত্তন করিয়াছেন। দেবরাজ ইন্দ্ৰ দেবগণের সহিত একত্ৰ হইয়া যে কর্ম্ম করিতে সমর্থ হয়েন না, তুমি বাসুদেবের সাহায্যে তাহাও সম্পাদন করিবে। ধনুর্বিদ্যাবিশারদগণ তোমাকে সকল ধনুৰ্দ্ধর ক্ষত্রিয়ের শ্রেষ্ঠ বলিয়া জানেন। যেমন জগতের মধ্যে মনুষ্য, পক্ষীর মধ্যে গরুড়, জলের মধ্যে সাগর, চতুস্পদের মধ্যে গো, তেজের মধ্যে আদিত্য, গিরির মধ্যে হিমালয়, জাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, সেইরূপ ধনুৰ্দ্ধরের মধ্যে তুমিই প্রধান। আমি দুৰ্য্যোধনকে বারংবার কহিতেছি এবং বিদুর, দ্রোণ, বলদেব, বাসুদেব ও সঞ্জয়ও পুনঃ পুনঃ কহিয়াছিলেন, কিন্তু বিপরীতবুদ্ধি, অজ্ঞান, শাস্ত্রত্যাগী দুৰ্য্যোধন তাহা শ্রবণ করেন নাই এবং তাঁহাতে শ্রদ্ধাও করেন নাই; অতএব তিনি অচিরকালমধ্যে ভীমসেনের বলে অভিভূত ও নিহত হইয়া শয়ন করিবেন।

ভীষ্মের পার্থপ্রশংসায় কুপিত দুৰ্য্যোধনের সান্ত্বনা

“রাজা দুৰ্য্যোধন ভীষ্মের বাক্য শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন। ভীষ্ম তদ্দর্শনে তাহাকে কহিলেন, ‘দুৰ্য্যোধন! ক্ৰোধ পরিত্যাগ কর। ধনঞ্জয় এই শীতল অমৃতগন্ধী [অমৃততুল্য গন্ধযুক্ত] জলধারা সমুৎপাদন করিয়াছেন, অবলোকন করিলে। এই ধারামণ্ডলে আর কেহই এ কাৰ্য্যসাধনে সমর্থ নহেন। এই মনুষ্যলোকে অর্জ্জুন বা কৃষ্ণ ব্যতীত কেহই আগ্নেয় [অগ্নি], বারুণ [বরুণ], সৌম্য [চন্দ্ৰ], বায়ব্য [বায়ু], বৈষ্ণব [বিষ্ণু], ঐন্দ্ৰ [ইন্দ্র], পাশুপাত [শিব], পারমেষ্ঠ্য [ব্ৰহ্মা], প্রাজাপত্য [প্রজাপতি], ধাত্র [ধাতা], ত্বাষ্ট্র [বিশ্বকর্ম্মা], সাবিত্ৰ [সূৰ্য্য] ও বৈবস্বত [যম] অস্ত্র অবগত নহেন। অধিক কি, সুরাসুরগণও ধনঞ্জয়কে জয় করিতে পারেন না; অতএব অচিরাৎ এই অমানুষকর্ম্ম [অলৌকিক কাৰ্য্যকারী], সত্যবান, শৌৰ্য্যশালী সব্যসাচীর সহিত তোমার সন্ধি হউক। হে বৎস! মহাবাহু কৃষ্ণ স্বাধীন [শ্রদ্ধা-আয়ত্ত] থাকিতে থাকিতে ধনঞ্জয়ের সহিত তোমার সন্ধি করাই উপযুক্ত হইতেছে। তোমার হতাবিশিষ্ট সহোদর ও ভূপালগণ নিহত না হইতে হইতে এবং কোপোদ্দীপিতলোচন যুধিষ্ঠির তোমার সৈন্যগণকে দগ্ধ না করিতে করিতে ধনঞ্জয়ের সহিত তোমার সন্ধি করাই উপযুক্ত হইতেছে। আমার ইচ্ছা এই যে, তোমার সৈন্যগণ নকুল, সহদেব ও ভীমসেনের হস্তে বিনষ্ট না হইতে হইতে তুমি মহাবীর পাণ্ডবগণের সহিত সৌহার্দ্দ কর। আমার নিধনেই যুদ্ধের অবসান হউক; পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি কর। হে ধার্ম্মিক! আমার বাক্যে তোমার অভিরুচি হউক; আমি তোমার ও বংশের পক্ষে ইহাই ক্ষেমঙ্কর [শুভাপ্রদ] বোধ করিতেছি। ধনঞ্জয় যাহা করিয়াছেন, তাহাই যথেষ্ট হইয়াছে; অনন্তর ক্ৰোধ পরিত্যাগ করিয়া পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি কর। ভীষ্মের নিধনের পর তোমাদের মিত্ৰত হউক, অবশিষ্ট সুহৃদগণও জীবিত থাকুন; ইহাই উত্তম। হে রাজন! প্রসন্ন হও; পাণ্ডবগণকে রাজ্যার্দ্ধ প্ৰদান কর; যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রন্থে গমন করুন; তুমি মিত্রদ্রোহী ও পার্থিবগণের জঘন্য [হীন] হইয়া পাপীয়সী কীর্ত্তি ভোগ করিও না। আমার মৃত্যুর পর প্রজাগণের শান্তিস্থাপন হউক, পার্থিবগণ প্রীতিমান হইয়া পরস্পর মিলিত হউক; পিতা পুত্ৰকে, ভাগিনেয় মাতুলকে ও ভ্রাতা ভ্রাতাকে প্রাপ্ত হউন। যদি মোহাবেশ বা নির্বুদ্ধিতানিবন্ধন আমার এই সময়োচিত বাক্য গ্ৰহণ না কর, সত্য কহিতেছি, তুমি পরিণামে পরিতাপিত হইবে ও সকলেই বিনাশ প্রাপ্ত হইবে।”

“হে মহারাজ! শল্যসন্তপ্তমর্ম্মা [বেদনায় হৃদয়ের অন্তস্থলে তাপপ্রাপ্ত] ভীষ্ম ভূপালগণের সমক্ষে সৌহৃদ্য-সহকারে দুৰ্য্যোধনকে এই কথা কহিয়া বেদনা সংবরণপূর্ব্বক আত্মাকে যোগযুক্ত করিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন। যেমন মুমূর্ষ ব্যক্তির ঔষধে অভিরুচি হয় না, তদ্রূপ সেই ধর্ম্মাৰ্থযুক্ত, হিতকর ও অনাময় বাক্যে আপনার পুত্রের অভিরুচি হইল না।”