১০৪. ভীষণ সন্ধুলযুদ্ধ

১০৪তম অধ্যায়

ভীষণ সন্ধুলযুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মধ্যাহ্নকালে সোমকদিগের সহিত ভীষ্মের লোকক্ষয়কর ভয়ঙ্কর সংগ্ৰাম আরম্ভ হইল। ভীষ্ম শতসহস্ৰ নিশিতশরে পাণ্ডবসৈন্যগণকে তাড়িত করিলেন এবং যেমন গোগণ ছিন্ন ধান্যসমূহ বিমদিত করিয়া থাকে, তদ্রূপ তাহাদিগকে বিমর্দ্দিত করিতে লাগিলেন। পরে শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট ও দ্রুপদ শরনিকরে ভীষ্মকে প্রহার করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ভীষ্ম ধৃষ্টদ্যুম্নকে বাণবিদ্ধ করিয়া তিনশরে বিরাটকে প্রহার করিয়া দ্রুপদের প্রতি নারাচ পরিত্যাগ করিলেন। তখন তাঁহারা পাদপৃষ্ট [পাদদ্বারা মর্দ্দিত] ভুজঙ্গের ন্যায় ক্ৰোধে একান্ত অধীর হইয়া উঠিলেন। শিখণ্ডী ভীষ্মকে প্রহার করিলে ভীষ্ম তাঁহার স্ত্রীরূপ মনে করিয়া শরাঘাত করিলেন না। ধৃষ্টদ্যুম্ন হুতাশনের ন্যায় রোষানলে প্রজ্বলিত হইয়া ভীষ্মের বাহুদ্বয় ও বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলে দ্রুপদ পঞ্চবিংশতি, বিরাট দশ ও শিখণ্ডী পঞ্চবিংশতি সায়কে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর ভীষ্ম রুধিরধারায় অবলিপ্ত হইয়া বসন্তকালীন পুষ্পস্তবকমণ্ডিত রক্তাশোকের ন্যায় শোভাপ্রাপ্ত হইলেন। পরে তিনি তিনবাণে তাঁহাদিগকে বিদ্ধ করিয়া ভল্লাস্ত্রে দ্রুপদের কামুকচ্ছেদ করিয়া ফেলিলেন। দ্রুপদ অন্য শরাসন গ্ৰহণ করিয়া ভীষ্মকে বিদ্ধ করিয়া তিনবাণে তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। পরে ভীম, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্ৰ, কেকয়দেশীয় পঞ্চভ্রাতা ও সাত্যকি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে অগ্ৰে লইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নপুরঃসর পাঞ্চলসৈন্যদিগকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইলেন। এদিকে কৌরবগণ ভীষ্মরক্ষার্থ যত্নবান হইয়া সসৈন্যে পাণ্ডবসেনাগণের প্রতি গমন করিলে উভয়পক্ষীয় নর, অশ্ব, রথ ও মাতঙ্গগণের সঙ্কুলযুদ্ধ আরম্ভ হইল। রথী রথীদিগকে, গজারোহী গজারোহীদিগকে, অশ্বারোহী অশ্বারোহীদিগকে শমনসদনে প্রেরণ করিতে লাগিল। রথসকল রথী ও সারথিশূন্য হইয়া মনুষ্য ও অশ্বদিগকে বিমর্দ্দিত করিয়া বায়ুপ্রেরিত গন্ধর্ব্বনগরের ন্যায় চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। কুণ্ডলোষ্ণীষধারী, নিষ্কাঙ্গদসুশোভিত, শৌর্য্যে দেবকুমারসদৃশ, যুদ্ধে দেবরাজতুল্য, ধনে ধনপতিসদৃশ ও নীতিবিষয়ে বৃহস্পতিতুল্য, মহাবলপরাক্রান্ত রথিসকল সামান্য মনুষ্যের ন্যায় ধাবমান হইয়া বিনষ্ট হইতে লাগিলেন। করিকুল আরোহিশূন্য হইয়া স্বীয় সৈন্যগণকে বিমর্দ্দিত করিয়া নিপতিত হইল। কতকগুলি নবীন জলদের ন্যায় গভীরনিস্বন হস্তী চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। উহাদের চর্ম্ম বিচিত্ৰ হেমদণ্ডমণ্ডিত চামর, পতাকা ও শ্বেতচ্ছত্ৰসকল ইতস্ততঃ স্থলিত হইতে লাগিল। আরোহিসকলই গজপরিভ্রষ্ট হইয়া চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। নানাদেশসম্ভূত সুবর্ণালঙ্কৃত বায়ুগামী শতসহস্ৰ তুরঙ্গম ইতস্ততঃ গমন করিতে লাগিল। খড়্গহস্ত আরোহীসকল আহত অশ্বের সহিত তাড়িত ও পলায়িত হইল; করি সকল পলায়মান গজের সহিত মিলিত হইয়া বেগে অশ্ব ও পদাতিসকলকে বিমর্দ্দিত করিয়া গমন করিতে লাগিল। অবশিষ্ট করি সকল অশ্ব, রথ ও মানবসকলকে মর্দ্দিত করিল। এইরূপে উহারা পরস্পর বিমর্দ্দিত হইতে লাগিল।

“তখন যমরাজ্যবিবৰ্দ্ধন, মর্ত্যকুলবিনাশন [১], কঙ্কালসঙ্কুলসম্বাধ [২], শরাবর্ত্তসম্পন্ন [৩], নিতান্ত দূরবগাহ শোণিতান্ত্রতরঙ্গিণী [৪] প্রবাহিত হইতে লাগিল। ইহা শীর্ষোপল[৫]সমাকীর্ণ হস্তিগ্রাহ[৬]সঙ্কুল, কেশ, শৈবাল ও শাদ্বলবহুল [৭], রথহ্রদ[৮]পরিশোভিত, অশ্বমীনপরিপ্লুত [৮], কবচোষ্ণীষ-ফেন [১০] সমাচ্ছন্ন, কার্ম্মুকস্রোতোবিশিষ্ট [১১], অসি-কচ্ছপ [১২]-ভূয়িষ্ঠ, পতাকাধ্বজ-বৃক্ষ [১৬]-সন্ধীর্ণ ও ক্ৰব্যাদহংস[১৪]সমলঙ্কৃত। ক্ষত্রিয়গণ নির্ভীক হইয়া রথ, অশ্ব ও মাতঙ্গরূপ ভেলা অবলম্বনপূর্ব্বক সেই ভয়ানক শোণিতনদী উত্তীর্ণ হইতে লাগিলেন। যেমন বৈতরণী মৃত ব্যক্তিদিগকে যমালয়ে নীত করে, তদ্রূপ ঐ শোণিত নদী নিতান্ত ভীত ও বিমোহিত ব্যক্তিদিগকে বহন করিতে লাগিল। ক্ষত্ৰিয়গণ এই ভয়ানক বদব্যাপার নিরীক্ষণ করিয়া মুক্তকণ্ঠে কহিতে লাগিলেন, “হে বীরগণ! ক্ষত্ৰিয়গণ রাজা দুৰ্য্যোধনের অপরাধেই বিনাশপ্ৰাপ্ত হইতেছেন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র লোভপরতন্ত্র হইয়া গুণবান পাণ্ডবদিগের প্রতি কি নিমিত্ত বিদ্বেষ প্রকাশ করিয়াছেন?

হে মহারাজ! এইরূপ পাণ্ডবগণের প্রশংসাসহকৃত, আপনার পুত্রদিগের পক্ষে নিদারুণ, বহুবিধ বাক্য শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন ভীষ্ম, দ্রোণ ও শল্যকে কহিলেন, “হে বীরগণ! আপনারা কি নিমিত্ত বিলম্ব করিতেছেন? অহঙ্কারশূন্য হইয়া সংগ্রামে প্রবৃত্ত হউন।” তখন উভয়পক্ষই অক্ষদ্যূতিজনিত অতি ভয়ঙ্কর নরবিনাশসহকৃত ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। হে মহারাজ! মহাত্মাগণ আপনাকে বারংবার নিবারণ করিয়াছিলেন, কিন্তু আপনি তাহাতে কৰ্ণপাত করেন নাই, এক্ষণে তাহারই নিদারুণ ফলভোগ করিতেছেন। সসৈন্য পাণ্ডবগণ ও কৌরবেরা কেহই কাহারও প্রাণরক্ষা করিতেছেন না। এই নিমিত্ত এবং আপনার দুর্নীতি ও দৈবের প্রতিকূলতাবশতঃ এক্ষণে এই ঘোরতর স্বজনক্ষয় উপস্থিত হইয়াছে।”

[১-১৪। নিহত লোকগণের স্তুপাকার অস্থি সৈন্যরাপ মহানদীর বেলাভূমি, বাণিনিবাহ আবর্ত্ত, রক্ত ও নাড়ীনিচয় তরঙ্গ, মস্তকসমস্ত পাথরের নুড়ি, করিনিকর কুন্তীর, কেশসমূহ শেওলা ও ঘাস, রথসমূহ হ্রদ, অশ্বসকল মৎস্য, কবচ ও উষ্ণৱীষ্যসমূহ ফেন, ধনুকসকল স্রোত, অস্ত্ৰসমস্ত কচ্ছপ, ধ্বজ-পতাকাসমূহ তীরস্থ বৃক্ষ, মাংসাশী শৃগালগণ হংস]