১২২. অর্জ্জুনশরে শরশয্যায় ভীমের উপাধান-বিধান

১২২তম অধ্যায়

অর্জ্জুনশরে শরশয্যায় ভীমের উপাধান-বিধান

সঞ্জয় কহিলেন, “ধনঞ্জয় গাণ্ডীব পরিত্যাগপূর্ব্বক ভীষ্মকে অভিবাদন করিয়া অশ্রুপূর্ণনয়নে কহিলেন, “হে পিতামহ! আমি আপনার ভৃত্য, কি করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন।”

“ভীষ্ম কহিলেন, ‘বৎস! আমার মস্তক লম্বমান হইতেছে; তুমি সমর্থ ধনুৰ্দ্ধরগণের শ্রেষ্ঠ, ক্ষত্রিধর্ম্মে অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান, অতএব উপযুক্ত উপাধান [শিয়রের বালিশ] প্ৰদান কর।”

“ধনঞ্জয় ‘তথাস্তু’ বলিয়া কৰ্তব্য অবধারণপূর্ব্বক গাণ্ডীবকে আমন্ত্রণ, সন্নতপর্ব্বশরসমুদয় গ্রহণ ও মহাত্মা ভীষ্মকে অভিবাদন করিয়া মহাবেগ সুতীক্ষ্ন তিন শর নিক্ষেপ করিলে শরত্ৰয় তাঁহার মস্তকে লগ্ন হইয়া উপধানস্বরূপ হইল। সুহৃদগণের প্রীতিবৰ্দ্ধন ধনঞ্জয় অভিপ্ৰায় অবগত হইয়াছেন দেখিয়া, তত্ত্ববিৎ ভীষ্ম পরিতুষ্টচিত্তে উপাধানদানের নিমিত্ত ধনঞ্জয়কে সভাজন [প্ৰশংসা] করিলেন এবং সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘ধনঞ্জয়! তুমিই শয্যার অনুরূপ উপাধান আহরণ করিয়াছ, যদি এরূপ না করিতে, ক্রুদ্ধ হইয়া আমি তোমাকে শাপ প্রদান করিতাম। যুদ্ধে এইরূপ শরশয্যাতে শয়ন করাই ধর্ম্মনিষ্ঠ ক্ষত্রিয়গণের কর্ত্তব্য।’ ভীষ্ম ধনঞ্জয়কে এইরূপ কহিয়া পার্শ্বস্থিত রাজা ও রাজপুত্ৰগণকে কহিলেন, “হে ভূপতিগণ! দেখ, ধনঞ্জয় আমার উপাধান আহরণ করিয়াছে; সূৰ্য্যের উত্তরায়ণ আবর্ত্তন [আগমন] পর্য্যন্ত আমি শয্যাতেই শয়ন করিয়া থাকিব। যখন দিবাকর সপ্ততুরঙ্গমযুক্ত [সপ্তাশ্ববাহনসমন্বিত] তেজঃপ্রদীপ্ত রথে আরোহণ করিয়া উত্তরায়ণে আবর্ত্তিত হইবেন, সেই সময়ে যাঁহারা আমার নিকট আগমন করিবেন, তাঁহারা দেখিবেন, আমি পরমসুহৃদ প্রিয়তম প্রাণকে বিসর্জ্জন করিব। এক্ষণে তোমরা আমার এই বাসস্থানে পরিখা খনন কর; আমি দিবাকরকে উপাসনা করিব। তোমরা বৈরভাব পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধ হইতে বিরত হও।”

“অনন্তর শিল্যোদ্ধারণকুশল [বেদনানিবারণনিপুণ] সুশিক্ষিত বৈদ্যগণ সর্ব্বপ্রকার উপকরণসমভিব্যাহারে তথায় উপস্থিত হইলেন। ভীষ্ম তাঁহাদিগকে দর্শন করিয়া দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, “দুৰ্য্যোধন! সৎকারপূর্ব্বক ধন প্ৰদান করিয়া চিকিৎসকগণকে বিদায় কর। আমি ক্ষত্রিয়ধর্ম্মের প্রশংসনীয় পরমগতি প্ৰাপ্ত হইয়াছি; চিকিৎসকের প্রয়োজন কি? হে ভূপালগণ! শরশয্যাগত ভীষ্মের এইরূপ ধর্ম্ম নয়, যথাকলে আমাকে এই সমুদয় শরের সহিত দগ্ধ করিতে হইবে।”

ভীষ্মসম্ভাষণান্তে সকলের স্বস্ব শিবিরে গমন

“দুৰ্য্যোধন ভীষ্মের বাক্য শ্রবণ করিয়া যথাযোগ্য সৎকারসহকারে বৈদ্যগণকে বিসর্জ্জন করিলেন। নানা জনপদের রাজগণ অমিততেজঃ ভীষ্মের ধর্ম্মানুগত অবস্থান অবলোকন করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন।

“অনন্তর সেই সমুদয় রাজা, পাণ্ডব ও কৌরবগণ ভীষ্মের সমীপবর্ত্তী হইয়া তাঁহাকে প্ৰণাম ও তিনবার প্রদক্ষিণ করিলেন এবং তাঁহার চতুর্দ্দিকে রক্ষক নিযুক্ত করিয়া স্বস্ব শিবিরগমন চিন্তা করিতে লাগিলেন। অনন্তর নির্ভর-নিপীড়িত রুধিরার্দ্রকলেবর বীরগণ সায়াহ্নসময়ে স্ব স্ব স্কন্ধাবারে সমুপস্থিত হইলেন।

“মহারথ পাণ্ডবগণ ভীষ্মের পতনে পুলকিত ও প্রীত হইয়া উপবেশন করিলে পর বাসুদেব যুধিষ্ঠিরের নিকটে গমন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! ইহা পরম সৌভাগ্যের বিষয় যে, আপনি ভীষ্মকে নিপাতিত করিয়া জয়যুক্ত হইয়াছেন। মহারথী, সত্যসন্ধ, সর্ব্বশস্ত্রপারদর্শী ভীষ্ম কি দেবগণ, কি মানবগণ, সকলেরই অবধ্য; কিন্তু হে রাজন! আপনি যাহার প্রতি কোপ-নয়নে দৃষ্টিপাত করেন, তাহার আর নিস্তার নাই; মহাবীর ভীষ্ম আপনার বিষম সাংঘাতিক দৃষ্টিতেই পতিত হইয়া দগ্ধ হইয়াছেন, সন্দেহ নাই।”

“যুধিষ্ঠির প্রত্যুত্তরে কহিলেন, “হে বাসুদেব! আমরা তোমারই প্ৰসাদে জয়লাভ করিয়াছি এবং কৌরবেরা তোমারই ক্ৰোধে পরাজিত হইয়াছে। তুমি আমাদিগের শরণ, ভক্তগণের অভয়দাতা; তুমি যাহাদিগের রক্ষক ও হিতকারী, তাহাদিগের জয় বিস্ময়কর নহে। আমার মতে তোমাকে প্রাপ্ত হইলে কিছুই বিস্ময়কর হয় না।”

জনার্দ্দন হাস্য করিতে করিতে কহিলেন, ‘মহারাজ! ঈদৃশ বাক্য আপনারই উপযুক্ত হইয়াছে।’ ”