১০২. অলম্বুষপরাজয়-পলায়ন

১০২তম অধ্যায়

অলম্বুষপরাজয়-পলায়ন

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়। মহাবীর অভিমন্যু মহারথীসকলকে বিনষ্ট করিতেছেন দেখিয়া অলম্বুষ কিরূপ যুদ্ধ করিল? অভিমন্যু অলম্বুষের সহিত কি প্রকারে যুদ্ধ করিলেন? ভীম, রাক্ষস ঘটোৎকচ, নকুল, সহদেব ও সাত্যকি কি প্রকারে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন এবং অর্জ্জুনই বা আমার সৈন্যগণের কি করিলেন? তুমি তাহা আনুপূর্বিক কীর্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অলম্বুষ ও অভিমন্যুর যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, অর্জ্জুন, ভীমসেন, নকুল ও সহদেব যেরূপ বিক্রম প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং ভীষ্ম ও দ্রোণপ্রভৃতি আপনার পক্ষীয় মহাবীরগণ নির্ভীকের ন্যায় যেরূপ অদ্ভুত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তাহা শ্রবণ করুন। মহাবলপরাক্রান্ত অলম্বুষ সিংহনাদ পরিত্যাগ ও বারংবার তর্জ্জনগর্জ্জনপূর্ব্বক ‘থাক থাক’ বলিয়া মহাবেগে অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হইল; অভিমন্যুও সিংহনাদ পরিত্যাগ করিয়া পিতৃবৈরী রাক্ষস অলম্বুষের প্রতি মহাবেগে গমন করিতে লাগিলেন। পরে দিব্যাস্ত্রবেত্তা রথিশ্রেষ্ঠ অভিমন্যু ও মায়াবী রথিপ্ৰধান রাক্ষস উভয়ে দেবদানবের ন্যায় সত্বর সমাগত হইলেন। অনন্তর অভিমন্যু শাণিত তিনসায়কে রাক্ষসকে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় পাঁচশরে বিদ্ধ করিলেন। যেমন তোদনদণ্ডে মাতঙ্গকে প্রহার করে, তদ্রূপ ক্ষিপ্রকারী অলম্বুষও ক্রোধাবিষ্ট হইয়া নয়শরে অভিমন্যুর হৃদয়দেশ বিদ্ধ করিয়া সহস্রশরে তাহাকে নিপীড়িত করিল। অভিমন্যু রোষপরবশ হইয়া শাণিত নয়শরে রাক্ষসের হৃদয় বিদ্ধ করিলে ঐ সমস্ত শর মর্ম্মভেদ করিয়া

কুসুমসুশোভিত কিংশুকবৃক্ষসংস্তীর্ণ পর্ব্বতের ন্যায় অধিকতর শোভাপ্রাপ্ত হইতে লাগিল এবং সেই সুবর্ণপুঙ্খ শরসমুদয় ধারণ করিয়া জ্বালাসনাথ [কিরণযুক্ত], শৈলের ন্যায় অপূর্ব্ব শ্ৰী ধারণ করিল।

“অনন্তর অলম্বুষ রোষাবিষ্ট হইয়া মহেন্দ্রপ্রতিম অভিমন্যুকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিল। রাক্ষসনিক্ষিপ্ত যমদণ্ডসদৃশ বাণসকল অভিমন্যুর দেহ ভেদ করিয়া ধরাতলে প্রবিষ্ট হইল এবং অভিমন্যুবিনির্ম্মুক্ত কনকভূষিত শরনিকরও অলম্বুষের শরীর ভেদ করিয়া ভূগর্ভে প্রবেশ করিল। যেমন দেবরাজ ময়দানবকে রণে পরাঙ্মুখ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ অভিমন্যু শরজালে রাক্ষসকে বিমুখ করিলেন। অনন্তর রাক্ষস মহীয়সী তামসী মায়া আবিষ্কৃত করিলে সকলেই ঘোরতর অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হইলেন; কি অভিমন্যু, কি আত্মীয়, কি পর, কেহই কাহাকেও নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইলেন না। মহাবীর অভিমন্যু সেই ঘোরতর অন্ধকার অবলোকন করিয়া অতিভাস্বর সৌর-অস্ত্র প্রয়োগ করিলেন। তখন রাক্ষসের মায়া তিরোহিত ও সমুদয় জগৎ পুনরায় প্রকাশিত হইল। পরে অভিমন্যু ক্ৰোধপরবশ হইয়া শরনিকরে রাক্ষসকে সমাচ্ছন্ন করিয়া তৎপ্রযুক্ত বহুবিধ মায়া নিবারণ করিলেন। রাক্ষস অলম্বুষ মায়াশূন্য ও শরজালে একান্ত আহত হইয়া ভয়ে রথ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিল। এইরূপে সেই কূটযোধী অলম্বুষ পরাজিত হইলে অভিমন্যু কৌরবসেনাগিগকে বিমর্দ্দিত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন বোধ হইল যেন, মদান্ধ বন্য মাতঙ্গ কমলদল মর্দ্দন করিতেছে।

কৌরব-পাণ্ডবের পরস্পর যুদ্ধ

“অনন্তর মহাবীর ভীষ্ম সৈন্যগণকে পলায়ন করিতে দেখিয়া শরনিকরে অভিমন্যুকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। মহারথ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ একমাত্র অভিমন্যুকে বেষ্টন করিয়া চারিদিক হইতে শর প্রহার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন। তখন পরাক্রমে অর্জ্জুনতুল্য, বীৰ্য্যে বাসুদেবসদৃশ, মহাবীর অভিমন্যু পিতা ও মাতুলের অনুরূপ বহুবিধ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীৰ্য্য অর্জ্জুন কৌরবসেনা বিনাশ করিতে অভিমন্যুর নিকট গমন করিলেন। তখন রাহু যেমন দিবাকরকে প্রাপ্ত হয়, তদ্রূপ ভীষ্ম অর্জ্জুনকে প্রাপ্ত হইলেন। হে মহারাজ! আপনার আত্মজগণ রথ, হস্তী ও অশ্বগণসমভিব্যাহারে ভীষ্মকে বেষ্টন করিয়া সাবধানে রক্ষা করিতে লাগিলেন; এদিকে পাণ্ডবেরাও ধনঞ্জয়কে পরিবৃত করিয়া ঘোরতর যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলেন।

“অনন্তর কৃপাচাৰ্য্য ভীষ্মের সম্মুখবর্ত্তী পার্থকে পঞ্চবিংশতি সায়কে সমাচ্ছন্ন করিলেন। যেমন শার্দুল কুঞ্জরের প্রতি গমন করে, তদ্রূপ সাত্যকি পাণ্ডবদিগের প্রিয়কাৰ্য্যসাধনাৰ্থ কৃপের প্রতি গমন করিয়া নিশিতশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। আচাৰ্য্য কোপপরতন্ত্র হইয়া সত্বর নয়শরে সত্যকির হৃদয়দেশ বিদ্ধ করিলে সাত্যকিও ক্রুদ্ধ হইয়া মহাবেগে শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক গৌতমান্তকর [কৃপাচাৰ্য্য-বিনাশকর] এক ভয়ঙ্কর শর নিক্ষেপ করিলেন। অশ্বত্থামা সেই শত্রুশনিসম শরকে মহাবেগে আগমন করিতে দেখিয়া ক্ৰোধাভরে দুই খণ্ডে ছেদন করিয়া ফেলিলেন।

“তখন যেমন নভোমণ্ডলের রাহু শশাঙ্কের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ সাত্যকি কৃপাচাৰ্য্যকে পরিত্যাগ করিয়া অশ্বত্থামার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা তাঁহার কামুকচ্ছেদন করিয়া শর প্রহার করিতে লাগিলেন। সাতকি শত্রুনিপাতন ভারসহ অন্য শরাসন গ্ৰহণ করিয়া ষষ্টিশরে অশ্বত্থামার বাহুদ্বয় ও বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। অশ্বত্থামা গাঢ়তর শরবিদ্ধ, নিতান্ত ব্যথিত ও মুহুর্ত্তকাল বিমোহিত হইয়া গজদণ্ড অবলম্বনপূর্ব্বক রথোপস্থে উপবিষ্ট হইলেন, পরে সংজ্ঞালাভ করিয়া ক্ৰোধাভরে পুনরায় সাত্যকিকে শরদ্বারা বিদ্ধ করিলেন। যেমন বসন্তকালে বলবান সর্পশিশু বিলমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ ঐ শর সাত্যকিকে বিদ্ধ করিয়া ধরণীতলে প্রবেশ করিল। পরে তিনি ভল্লাস্ত্রে ধ্বজদণ্ড ছেদন করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন এবং যেমন বর্ষাকালে জলদাবলি দিবাকরকে সমাচ্ছন্ন করে, তদ্রূপ শরনিকরে সাত্যকিকে সমাচ্ছন্ন করিলেন; সাত্যকিও শরজাল নিরাকরণ করিয়া শরনিকরদ্বারা অশ্বত্থামাকে সমাচ্ছন্ন করিযা মেঘমণ্ডলীবিনির্ম্মুক্ত মার্ত্তণ্ডের ন্যায় তাঁহাকে সন্তপ্ত করিতে লাগিলেন। পরে পুনরায় উদ্যত হইয়া শরসহস্ৰে অশ্বত্থামাকে সমাচ্ছন্ন করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন।

“দ্রোণাচাৰ্য্য পুত্রকে রাহুগ্ৰস্ত নিশাকরের ন্যায় নিরীক্ষণ করিয়া সাত্যকির প্রতি মহাবেগে গমন করিলেন এবং শরনিপীড়িত আত্মজ অশ্বত্থামাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত সুতীক্ষ্নসায়কে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন; সাত্যকিও গুরুপুত্ৰ অশ্বত্থামাকে পরিত্যাগ করিয়া লৌহময় শরজালে দ্রোণকে বিদ্ধ করিলেন; অনন্তর শক্ৰতাপন অর্জ্জুন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া দ্রোণাচাৰ্য্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। এইরূপে তাঁহারা উভয়ে মিলিত হইয়া নভোমণ্ডলস্থ বুধ ও শুক্র গ্রহের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।”