১০৬. কৌরবকর্ত্তৃক ভীষ্মের পার্শ্বরক্ষা

১০৬তম অধ্যায়

কৌরবকর্ত্তৃক ভীষ্মের পার্শ্বরক্ষা

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! দুৰ্য্যোধন ক্ৰোধপরায়ণ শান্তনুতনয়কে বর্ষাকালীন জলধরপটলে সংবৃত সূৰ্য্যের ন্যায় পাণ্ডবগণে পরিবৃত দেখিয়া দুঃশাসনকে কহিলেন, ‘ভ্ৰাতঃ। ঐ দেখ, অরিনিসূদন পিতামহ মহাবীর পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক সমন্তাৎ পরিবৃত হইয়াছেন। উহাকে রক্ষা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। পিতামহ আমাদের রক্ষক; তিনি রক্ষিত হইলে নিশ্চয়ই সমরে সমুদয় পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণকে সংহার করিবেন। ঐ মহাবীর সংগ্রামে লোকদুষ্কর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতেছেন; অতএব তুমি অবিলম্বে সমুদয় সৈন্যগণসমভিব্যাহারে পিতামহকে পরিবেষ্টন করিয়া রক্ষা কর।

“হে রাজন। আপনার তনয় দুঃশাসন দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া অসংখ্য সৈন্য লইয়া ভীষ্মকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক অবস্থান করিলেন। তখন সুবলনন্দন শকুনি বিমল, প্রাস, ঋষ্টি ও তোমরধারী, সুশিক্ষিত, যুদ্ধকুশল বীরগণকর্ত্তৃক সমারূঢ়, বেগসম্পন্ন, পতাকাসুশোভিত শতসহস্ৰ অশ্ব লইয়া নকুল, সহদেব ও ধর্ম্মরাজের চতুর্দ্দিক পরিবেষ্টনপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধন পাণ্ডবগণের নিবারণার্থ অযুত আশ্বারোহী সৈন্য প্রেরণ করিলেন। অশ্বগণ গরুড়ের ন্যায় মহাবেগে রণস্থলে প্রবেশ করিবামাত্র ধরাতল তাহাদের খুরে আহত হইয়া কম্পিত ও ধ্বনিত হইতে লাগিল। অশ্বগণের খুরশব্দ পর্ব্বতন্থ দহ্যমান বংশবনের ধ্বনির ন্যায় শ্ৰবণগোচর হইল। তাহাদের খুরসমুদ্ভুত ধূলিপটল গগনতলে সমুত্থিত হইয়া সূৰ্য্যমণ্ডল সমাচ্ছাদিত করিল। যেমন মহাবেগশালী হংসকুল পতিত হইলে মহাসরোবর ক্ষোভিত হয়, তদ্রূপ সেই অশ্বগণ পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিলে সেনাগণ ক্ষোভিত হইয়া উঠিল। তুরঙ্গমগণের হ্রেষারবে আর কোন শব্দই শ্রুতিগোচর হইল না।

কৌরবপরাজয়ে শল্যের সক্ৰোধ সমর

“বেলা যেমন বর্ষাকালীন পৌর্ণমাসীতে অতি পরিপূরিত সমুদ্ধত [উচ্ছলিত] সাগরের বেগ রোধ করে, তদ্রূপ মহারাজ যুধিষ্ঠির ও মাদ্রীতনয়দ্বয় সেই অশ্বারোহিগণের বেগ নিবারণ করিয়া সন্নতপর্ব্ব শরনিকর ও প্রাসসমূহ নিক্ষেপপূর্ব্বক তাহাদের মস্তকচ্ছেদন করিতে লাগিলেন। অশ্বারোহিগণ পাণ্ডবদিগের শরে নিহত হইয়া গিরিগহ্বরস্থিত নাগনিহত মহানাগের ন্যায় নিপতিত হইল; তাহাদের মস্তক বৃক্ষ হইতে তালফলের ন্যায় ধরাতালে নিপতিত হইতে লাগিল। অনেক অশ্ব আরোহিসমভিব্যাহারে নিহত হইয়া চতুর্দ্দিকে পতিত হইতেছে দৃষ্ট হইল। অশ্বগণ পাণ্ডবগণের শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া সিংহাসমাক্রান্ত মৃগযুথের ন্যায় প্রাণভয়ে পলায়ন করিতে লাগিল। এইরূপে পাণ্ডবগণ সমরে শত্ৰুগণকে পরাজয় করিয়া ভেরীধবনি ও শঙ্খনিনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন।

“মহারাজ দুৰ্য্যোধন সৈন্যগণকে পরাজিত দেখিয়া দীনচিত্তে মদ্ররাজ শল্যকে কহিলেন, “হে মহাবাহো! পাণ্ডুতনয় যুধিষ্ঠির নকুল ও সহদেবসমভিব্যাহারে আমাদের সমক্ষে সৈন্যগণকে বিদ্রাবিত করিতেছে। আপনি স্বীয় অসাধারণ বলবিক্রম প্রকাশপূর্ব্বক তাহাকে নিবারণ করুন।” প্রতাপশালী শল্য দুৰ্য্যোধনের বাক্যশ্রবণ করিয়া সত্বর অসংখ্য রথসমভিব্যাহারে যুধিষ্ঠিরাভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির সেই সমাগত মদ্ররাজের সৈন্যগণকে অনায়াসে নিবারণ করিয়া তাঁহার বক্ষঃস্থলে দশবাণ নিক্ষেপ করিলেন; মাদ্রীনন্দনদ্বয়ও শল্যাকে সাতবাণে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর শল্য তাঁহাদের প্রত্যেকের প্রতি তিন-তিন বাণ নিক্ষেপ করিয়া পুনরায় যুধিষ্ঠিরকে ষষ্টি ও মাদ্রীতনয়দ্বয়ের প্রত্যেককে দুইশরে বিদ্ধ করিলেন।

“হে মহারাজ! অরাতিকুলনিসূদন মহাবাহু ভীমসেন যুধিষ্ঠিরকে মদ্রাধিপতির রথের সমীপবর্ত্তী দেখিয়া তাঁহাকে কৃতান্তের করালকবলস্থ জ্ঞান করিয়া সত্বর তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। ঐ সময় ভগবান ভাস্কর পশ্চিমদিক অবলম্বন করিয়া তাপপ্রদান করিতে লাগিলেন; কৌরব এবং পাণ্ডবগণেরও তুমুল সংগ্ৰাম হইতে লাগিল।”