১০৩. দ্রোণ-অর্জ্জনযুদ্ধ

১০৩তম অধ্যায়

দ্রোণ-অর্জ্জনযুদ্ধ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য ও অর্জ্জুন কি প্রকারে যত্নসহকারে রণস্থলে সমাগত হইলেন? অর্জ্জুন ধীমান দ্রোণের একান্ত প্রিয়পাত্র এবং দ্রোণও অর্জ্জুনের নিতান্ত প্রীতিভাজন; অতএব মদোৎকট [ক্ৰোধমত্ত] সিংহদ্বয়ের ন্যায় ঐ দুই মহাবীর কি প্রকারে পরস্পর সমাগত হইলেন?”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! দ্রোণাচাৰ্য্য রণস্থলে অর্জ্জুনকে প্রীতিভাজন বলিয়া বিবেচনা করেন না এবং অর্জ্জুনও ক্ষত্রিয়ধর্ম্মানুসারে তাঁহাকে গুরু বলিয়া সম্মান করেন না; ক্ষত্ৰিয়গণ কেহই কাহাকে পরিত্যাগ করেন না; প্রত্যুত মৰ্য্যাদাশূন্য [সম্বন্ধবন্ধন বিবেচনায় উদাসীন] হইয়া পিতা ও ভ্রাতাদিগের সমভিব্যাহারে যুদ্ধ করিয়া থাকেন। মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য অর্জ্জুনের তিনশরে বিদ্ধ হইলেন; কিন্তু তাহা অর্জ্জুন-শরাসনবিনির্ম্মুক্ত বলিয়া পরিগণিত না করিয়া গহনবনে অতিপ্রবৃদ্ধ হুতাশনের ন্যায় রোষে প্রজ্বলিত হইয়া অর্জ্জুনকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহারাজ দুৰ্য্যোধন দ্রোণাচাৰ্য্যের পার্ষ্ণি গ্ৰহণ করিবার নিমিত্ত সুশর্ম্মাকে প্রেরণ করিলেন। সপুত্ৰ ত্ৰিগৰ্তরাজ সুশর্ম্মা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক সায়কসমূহে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের শরনিকর শরৎকালে গগনচারী হংসনিচয়ের ন্যায় নভোমণ্ডলে শোভমান হইতে লাগিল। যেমন বিহঙ্গমগণ সুস্বাদু ফলভারাবনত পাদপে প্রবেশ করিয়া থাকে, তদ্রূপ সেই সকল শরজাল পার্থশরীরে প্রবেশ করিল। অর্জ্জুন সিংহনাদ পরিত্যাগ করিয়া সপুত্ৰ ত্ৰিগৰ্তরাজকে বাণে বিদ্ধ করিলেন। তাঁহারাও প্রলয়কালীন অন্তকসদৃশ অর্জ্জুনের শরনিকরে ক্ষতবিক্ষত হইয়া প্ৰাণপণে অর্জ্জুনের সহিত ঘোরতর যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইয়া তাঁহার প্রতি অনবরত শর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। যেমন আচলসকল সলিলবর্ষণ গ্রহণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ পার্থ শরসমূহদ্বারা শরবর্ষণ গ্ৰহণ [বাণে বাণে শত্রুনিক্ষিপ্ত শরনিরোধ] করিলেন। তখন আমরা তাঁহার হস্তলাঘব অবলোকন করিতে লাগিলাম। যেমন সমীরণ মেঘমণ্ডল অপসারিত করিয়া থাকে, তদ্রূপ তিনি একাকী হইয়াও বহুযোধ্যবিনির্ম্মুক্ত দুর্নিবার শরবৃষ্টি অনায়াসে নিবারণ করিলেন। তখন দেবদানবগণ তাঁহার এই অদ্ভূত কাৰ্য্য নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।

ভীম-সুশর্ম্মাদির যুদ্ধ-কৌরবপলায়ন

“অনন্তর অর্জ্জুন রোষপরবশ হইয়া সেনামুখে বায়ব্য-অস্ত্ৰ প্রয়োগ করিলে প্রবল সমীরণ প্রাদুর্ভূত হইয়া অন্তরীক্ষ ক্ষুভিত, পাদপদল নিপাতিত ও সৈন্যগণ বিনষ্ট করিতে লাগিল। দ্রোণাচাৰ্য্য নিদারুণ বায়ব্য-অস্ত্র নিরীক্ষণ করিয়া ভয়ঙ্কর শৈলাস্ত্র পরিত্যাগ করিলেন, তখন বায়ু প্রশান্ত ও দশদিক প্রসন্ন হইলে। পরে অর্জ্জুন ত্ৰিগৰ্তরাজের রথীদিগকে নিরুৎসাহ, সমরপরাঙ্মুখ ও হীনবীৰ্য্য করিতে লাগিলেন। অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন, কৃপ, অশ্বত্থামা, শল্য, কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ এবং বাহ্লীকদিগের সহিত মহারাজ বাহ্লীক রথসমূহে পার্থের চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিলেন। ভীমসেন ভগদত্ত ও শ্রুতায়ুকর্ত্তৃক গজসৈন্য দ্বারা চতুর্দ্দিকে আক্রান্ত হইলেন। ভূরিশ্রবা, শল ও সৌবল শরজালে নকুল ও সহদেবকে নিবারণ করিলেন। ভীষ্ম সসৈন্যে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের সমভিব্যাহারে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করিতে ধাবমান হইলেন।

“মহাবীর ভীমসেন গজসৈন্য আগমন করিতে দেখিয়া গদা গ্রহণ ও বনমধ্যস্থ মৃগরাজ সিংহের ন্যায় সৃক্কণী লেহনপূর্ব্বক সত্বর রথ হইতে অবতীর্ণ হইলে সেই সেনাদিগের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হইল। তখন গজারোহিসকল তাহাকে গদাহস্ত নিরীক্ষণ করিয়া সাবধানে চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিল। ভীমসেন মেঘমণ্ডল-মধ্যগত সূৰ্য্যের ন্যায়। সেই গজসৈন্যে শোভমান হইলেন। অনন্তর যেমন সমীরণ জলদজাল চালিত করিয়া থাকে, তদ্রূপ তিনি গদাদ্বারা গজসৈন্যদিগকে তাড়িত করিতে লাগিলেন। তখন করিকুল গজমান মেঘমণ্ডলের ন্যায় আর্ত্তনাদ করিতে লাগিল। মহাবীর ভীমসেন মাতঙ্গগণের দশনদ্বারা বিদারিত হইয়া পুষ্পিত অশোকবৃক্ষের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। পরে তিনি তাহাদিগকে ধারণপূর্ব্বক তাহাদিগের দশন ভগ্ন করিয়া সেই সমস্ত দশনদ্বারা দণ্ডধারী সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় করিকুলের কুম্ভমণ্ডলে প্রহারপূর্ব্বক ভূতলে নিপাতিত করিতে লাগিলেন এবং শোণিতচর্চিত ও মেদিমজ্জায় অবলিপ্তকলেবর হইয়া রুধিররঞ্জিত গদা ধারণপূর্ব্বক রুদ্রদেবের ন্যায় নিরীক্ষিত হইলেন। অনন্তর হতাবিশিষ্ট করিসৈন্যগণ স্বীয় বলসমুদয়কে বিমর্দ্দিত করিয়া চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইলে কৌরবসেনাসকল পরাঙ্মুখ হইল।”