১২০. সমবেত পাণ্ডবাক্রমণে ভীষ্মের ভীষণ যুদ্ধ

১২০তম অধ্যায়

সমবেত পাণ্ডবাক্রমণে ভীষ্মের ভীষণ যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে নরনাথ! এইরূপে সমুদয় পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ একত্র হইয়া শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া ভীষ্মকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক শতঘ্নী, পরিঘ, পরশু, মুদ্গর, মুষল, প্রাস, ক্ষেপণীয় [যাহা ক্ষেপণ করা যায়-ছুড়িয়া মারা যায়], শর, শক্তি, তোমর, কম্পন, নারাচ, বৎসদন্ত ও ভুশুণ্ডী [বাহুদ্বয় পরিমাণ দীর্ঘ বড় বড় গ্রস্থিযুক্ত মোটা লাঠি]সমূহ তাঁহাকে তাড়না করিতে লাগিলেন। তদ্দ্বারা তাঁহার তনুত্ৰাণ বিশীর্ণ হইলে তিনি মৰ্মে আহত হইয়াও অধীর হইলেন না; প্রত্যুত বীরক্ষয় রূপ ইন্ধনে উদ্দীপিত, বিচিত্র শরাসনরূপ মহাশিখাশালী, নেমিনির্ঘোষিরূপ সন্তাপসনাথ [অতি তাপযুক্ত], তাঁহার প্রদীপ্ত মহাস্ত্র-পাবক [ভীষণ অস্ত্ররূপ অনল] অরাতিগণের পক্ষে প্রলয়কালীন অনলের ন্যায় হইয়া উঠিল। পিতামহ ভীষ্ম সেই রথমণ্ডল হইতে বিনিঃসৃত হইয়া শত্ৰুগণমধ্যে বিচরণ করিতে লাগিলেন এবং দ্রুপদ ও ধৃষ্টকেতুকে গণনা না করিয়া পাণ্ডব-সেনার অভ্যন্তরে উপস্থিত হইলেন, পরিশেষে সাত্যকি, ভীম, ধনঞ্জয়, দ্রুপদ, বিরাট ও ধৃষ্ট্যদুম্নের প্রতি ভীমঘোষ [ভয়ঙ্কর শব্দযুক্ত] মহাবেগগামী, বর্ম্মাবরণভেদী [বর্ম্মরূপ আবরণভেদকারী], নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। সাত্যকি প্রভৃতি ছয়জন মহারথ ভীষ্মের সমুদয় শর নিরাকৃত করিয়া দশ-দশ বাণে তাঁহাকে বিমর্দ্দিত করিলেন। শিখণ্ডী যেসকল স্বর্ণপুঙ্খ শিলাসিত সায়ক নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, তাহা অতি শীঘ্র ভীষ্মের শরীরমধ্যে প্রবিষ্ট হইল। অনন্তর অর্জ্জুন কুপিতচিত্তে শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া ভীষ্মের অভিমুখে উপস্থিত হইয়া তাঁহার শরাসন ছেদন করিলেন। দ্রোণ, কৃতবর্ম্মা, জয়দ্ৰথ, ভূরিশ্রবা, শল, শল্য ও ভগদত্ত, এই সাত মহারথ ভীষ্মের শরাসনচ্ছেদন সহ্য করিতে না পারিয়া দিব্যঅস্ত্রসমূহে অর্জ্জুনকে আচ্ছাদনপূর্ব্বক অতি দ্রুতবেগে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। সাত্যকি, ভীমসেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, দ্রুপদ, রাক্ষস ঘটোৎকচ ও অভিমন্যু, এই সাত মহাবীর দ্রোণ প্রভৃতির দ্রুতগমনজনিত তুমুল শব্দ শ্রবণ করিয়া অর্জ্জুনের সহিত মিলিত হইবার নিমিত্ত ক্রোধমূর্চ্ছিতচিত্তে [অত্যন্ত ক্ৰোধসহকারে] বিচিত্ৰ কামুক-হস্তে সত্বর ভ্রমণ করিলেন। দানবগণের সহিত দেবগণের যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, কৌরবপক্ষীয় সাত বীরের সহিত পাণ্ডবপক্ষের সাত বীরের সেইরূপ লোমহর্ষণ সংগ্রাম হইতে লাগিল।

“এদিকে শিখণ্ডী ছিন্নকার্ম্মুক ভীষ্মকে দশবাণে ও তাঁহার সারথিকে সাতবাণে বিদ্ধ করিয়া একবাণে রথের ধবজচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ভীষ্ম অন্য কার্ম্মুক গ্রহণ করিলে ধনঞ্জয় ক্রুদ্ধ হইয়া তীক্ষ্ন তিনশরে তাহাও ছেদন করিলেন। অনন্তর ভীষ্ম যতবার শরাসন গ্রহণ করেন, অর্জ্জুন ততবারই তাহা ছেদন করিয়া ফেলেন। পরিশেষে তিনি ধনঞ্জয়ের প্রতি জুলন্ত বজ্রের ন্যায় পর্ব্বতবিদারণ শক্তি নিক্ষেপ করিলে মহাবীর ধনঞ্জয় ক্রুদ্ধ হইয়া অতি তীক্ষ্ন পাঁচভল্পে তাহা পাঁচ খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। যখন সেই ছিন্ন শক্তি রথ হইতে নিপতিত হইল, তখন বোধ হইল যেন বিদ্যুৎ খণ্ড খণ্ড হইয়া মেঘবৃন্দ হইতে পতিত হইতেছে।

ঋষিবাক্যানুসারে ভীষ্মের সমরাবসানে ইচ্ছা!

“শক্তি ছেদিত হইল দেখিয়া জাতক্ৰোধ ভীষ্ম মনে মনে চিন্তা করিলেন, “যদি মহাবল মধুসূদন পাণ্ডবগণের রক্ষক না হইতেন, তাহা হইলে আমি উহাদিগকে একমাত্র শরাসনেই নিহত করিতে পরিতাম; কিন্তু পাণ্ডবগণ অবধ্য ও শিখণ্ডী স্ত্রীলোক; এই দুই কারণে উহাদিগের সহিত যুদ্ধে ক্ষান্ত হইলাম; পিতা কালীর [সত্যবতীর] পাণিগ্রহণসময়ে সন্তুষ্ট হইয়া আমাকে স্বেচ্ছামরণ ও রণে অবধ্যত্ব বর প্রদান করিয়াছিলেন; এক্ষণে মৃত্যুর এই প্রকৃত সময় বোধ হইতেছে।” তখন আকাশস্থ ঋষি ও বসুগণ অমিততেজঃ ভীষ্মের এইরূপ অধ্যবসায় অবগত হইয়া কহিলেন, “হে ভীষ্ম! তোমার যেরূপ অধ্যবসায় হইয়াছে, তাহা আমাদিগেরও প্রীতিকর; অতএব রণবুদ্ধি নিবৃত্ত করিয়া অভিলষিত বিষয়ের অনুষ্ঠান কর।” ঋষিগণের বাক্যাবসানে শুভসূচক সুগন্ধ অনুকুল সমীরণ প্রবাহিত, মহাস্বন দেবদুন্দুভিসকল নিনাদিত ও ভীষ্মের উপর পুষ্পবৃষ্টি নিপতিত হইতে লাগিল। সেই সকল ঋষি ও বসুগণের বাক্য ভীষ্ম ব্যতীত আর কাহারও শ্রবণগোচর হয় নাই, মহর্ষি ব্যাসদেবের তেজঃপ্রভাবে আমিও শ্রবণ করিয়াছিলাম। মহারাজ! সর্ব্বলোকপ্রিয় ভীষ্ম রথ হইতে পতিত হইবেন বলিয়া দেবগণের মহাসম্ভ্রম [মনের চাঞ্চল্য] সমুপস্থিত হইল।

“মহাতপঃ ভীষ্ম দেবর্ষিগণের বাক্য শ্রবণ করিয়া সর্ব্ববরণভেদী নিশিত শরনিক্ষেপে ক্ষত-বিক্ষত হইয়াও অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিলেন না। শিখণ্ডী ক্রুদ্ধ হইয়া ভীষ্মের বক্ষঃস্থলে অতি তীক্ষ্ন নয় বাণ নিক্ষেপ করিলেন। যেমন ভূমিকম্প উপস্থিত হইলেও পর্ব্বত কম্পিত হয় না, সেইরূপ ভীষ্ম শিখণ্ডীর শরে কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না। তখন মহাবীর অর্জ্জুন হাস্য করিয়া গান্তীব-শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক ক্রোধাভরে প্রথমে পঞ্চবিংশতি ক্ষুদ্রকে, তৎপরে একশত শরে ভীষ্মের গাত্র ও সমুদয় মর্ম্মস্থান আহত করিলেন। মহারথ ভীষ্ম অন্যান্য যেসকল বীরগণের শরনিকরে নির্ভর-নিপীড়িত হইতেছিলেন, এক্ষণে সন্নতপর্ব্ব শরজাল বিস্তার করিয়া সেই সকল বীরকে বিদ্ধ ও তাঁহাদের শর সমুদয় নিবারিত করিতে লাগিলেন। মহারথ শিখণ্ডী যেসকল স্বর্ণপুঙ্খ শিলাশিত শর পরিত্যাগ করিলেন, ভীষ্ম তদ্মারা কিছুমাত্র পীড়িত হইলেন না।

অর্জ্জুন যুদ্ধে ভীষ্মের উত্তেজনা—পুনঃ যুদ্ধ

“অনন্তর ধনঞ্জয় ক্রুদ্ধ হইয়া শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া ভীষ্মের অভিমুখীন হইতে লাগিলেন এবং তাহার শরাসন ছেদন, দশবাণে তাঁহাকে বিদ্ধ, একবাণে ধ্বজচ্ছেদ ও দশবাণে তাঁহার সারথিকে বিকম্পিত করিলেন। ভীষ্ম কামুকান্তর পরিগ্ৰহ করিলে ধনঞ্জয় তাহাও তিনভল্লে খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর ভীষ্ম যত ধনু গ্ৰহণ করিলেন, ধনঞ্জয় এক-এক নিমিষে তৎসমুদয়ই ছেদন করিলেন। পিতামহ ভীষ্ম অতঃপর আর অর্জ্জুনকে আক্রমণ করিলেন না, কিন্তু অর্জ্জুন পুনরায় তাঁহাকে পঞ্চবিংশতি ক্ষুদ্রকদ্বারা আঘাত করিলেন।

“মহাধনুৰ্দ্ধর ভীষ্ম অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া দুঃশাসনকে কহিলেন, “হে দুঃশাসন! বজ্রপাণি পুরন্দর যাহাকে পরাজয় করিতে সমর্থ নহে, সেই মহারথ অর্জ্জুন ক্রুদ্ধ হইয়া আমার উপর অনেক সহস্ৰ শর নিক্ষেপ করিতেছে, সন্দেহ নাই; নতুবা মহারথ মনুষ্যগণের কথা দূরে থাকুক, বীৰ্য্যশালী দেব, দানব ও রাক্ষসগণও একত্র হইয়া আমাকে পরাজয় করিতে পারে না।” ভীষ্ম ও দুঃশাসন এইরূপে কথোপকথন করিতেছেন, এমন সময় ধনঞ্জয় শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া ভীষ্মকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ভীষ্ম অর্জ্জুন-শরের নির্ভর-নিপীড়নে অধিকতর বিস্মিত হইয়া পুনরায় কহিলেন, “হে দুঃশাসন! এই যে বজ্রসমস্পর্শ অবিচ্ছিন্ন শরধারা নিক্ষিপ্ত হইতেছে, ইহা কখনো শিখণ্ডীর বাণ নহে; এই যে মুষলসদৃশ বাণসকল দৃঢ় আবরণ ভেদ করিয়া আমার মর্ম্মস্থান ভেদ করিতেছে, ইহা কখনো শিখণ্ডীর বাণ নহে; এই যে ব্ৰহ্মদণ্ডসমস্পর্শ বজ্রবেগের ন্যায় দুর্বিষহ শরনিকর আমার জীবনকে রুগ্ন করিতেছে, ইহা কখন শিখণ্ডীর বাণ নহে; এই যে গদা ও পরিঘসদৃশ কঠোর তর সায়কসমুদয় যমদূতের ন্যায় নিক্ষিপ্ত হইয়া আমার প্রাণ বিনাশ করিতেছে, ইহা কখনো শিখণ্ডীর বাণ নহে; এই যে জাতক্ৰোধ লেলিহান বিষবিষম আশীবিষের ন্যায় বিশিখজাল আমার মর্ম্মস্থানে প্রবেশিত হইতেছে, ইহা কখনো শিখণ্ডীর বাণ নহে; এই যে বাণসকল আমার সমুদয় গাত্র ভেদ করিতেছে, ইহা কখনো শিখণ্ডীর বাণ নহে, অর্জ্জনেরই বাণ, তাহার সন্দেহ নাই। গাণ্ডীবধন্বা ধনঞ্জয় ব্যতিরেকে আর কোনো রাজা আমাকে ক্লেশিত করিতে পারে না।”

“প্ৰতাপবান ভীষ্ম এই কথা কহিতে কহিতে যেন পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করিবার অভিলাষে ধনঞ্জয়ের প্রতি শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। ধনঞ্জয় তৎক্ষণাৎ কুরুবীরগণের সমক্ষে তিনশরে তাহা তিন খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর শান্তনুতনয় জয় বা মৃত্যুর অন্যতম প্রাপ্ত হইবার বাসনায় সুবর্ণ-বিচিত্র চর্ম্ম ও খড়্গ ধারণ করিলেন। কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য! ভীষ্ম রথ হইতে অবতীর্ণ হইতে না হইতেই ধনঞ্জয় শরনিকরে সেই চর্ম্ম শতধা ছিন্ন করিয়া ফেলিলেন।

“অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির, কহিলেন, “হে সৈন্যগণ! তোমরা ভীষ্মকে আক্রমণ কর। তোমাদিগের অণুমাত্ৰও ভয় নাই।” ইহা কহিয়া তিনি তাঁহাদিগকে প্রেরণ করিলেন। সৈন্যগণ যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণ করিয়া তোমর, প্রাস, বাণ, পট্টিশ, খড়্গ, নারাচ, বৎসদন্ত ও ভল্লসমূহ লইয়া চতুর্দ্দিক হইতে একমাত্র ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইল এবং পাণ্ডবগণ ঘোরতর সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। এদিকে ধাৰ্তরাষ্ট্রগণ ভীষ্মকে জয়ী করিবার অভিলাষে একমাত্র ধনঞ্জয়ের অভিমুখীন হইয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিলেন।

“অনন্তর তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল। উভয়পক্ষ পরস্পর সংহারে প্রবৃত্ত হইলে যুদ্ধক্ষেত্র মুহূর্ত্তকালমধ্যে গঙ্গাপাতজনিত সাগরাবর্তের [গঙ্গাসাগর-সঙ্গমস্থ জলঘূর্ণীর] ন্যায় হইয়া উঠিল। পৃথিবী শোণিতলিপ্ত হইয়া অতিভীষণ রূপ ধারণ করিল এবং সম ও বিষম স্থল কিছুই লক্ষিত হইল না। ভীষ্ম মর্ম্মাহত হইয়াও দশসহস্ৰ যোদ্ধাকে নিহত করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। মহাধনুৰ্দ্ধর ধনঞ্জয় সেনামুখে অবস্থান করিয়া কৌরবসৈন্যগণকে বিদ্রাবিত করিতে লাগিলেন। আমরা তাঁহার ভয়ে খীত ও তাঁহার শরে নিপীড়িত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিলাম। সৌবীর, কিতব, প্রাচ্য, প্রতীচ্য, উদীচ্য, মালব, অভিষাহ, শূরসেন, শিবি, বসতি, শাল্য, শল, ত্রিগর্ত্ত, অম্বষ্ঠ ও কেকয়দেশীয় মহাত্মগণ শরার্ত্ত ও ব্ৰণপীড়িত [বাণাঘাতে বেদনাযুক্ত] হইয়াও অর্জ্জুনসহ যুধ্যমান ভীষ্মকে পরিত্যাগ করিলেন না।

“এদিকে পাণ্ডবগণ একমাত্র ভীষ্মকে পরিবেষ্টন ও সমুদয় কৌরবসৈন্যকে পরাজিত করিয়া শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন এবং শত শত ও সহস্ৰ সহস্ৰ সৈন্যের প্রাণসংহার করিলেন। ‘নিপাতিত কর, গ্ৰহণ করা, যুদ্ধ কর, ছেদন কর’, ভীষ্মের রথের দিকে এইরূপে শব্দ সমুত্থিত হইল।

ভীষ্মের শরশয্যা

“হে মহারাজ! ভীষ্মের কলেবর ধনঞ্জয়ের নিশিত শরনিকরে এরূপ বিদ্ধ হইয়াছিল যে, দুই অঙ্গুলি স্থানও অবশিষ্ট ছিল না। এইরূপে ক্ষতবিক্ষত কলেবর ভীষ্ম সূৰ্য্যাস্তের কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে আপনার পুত্ৰগণের সমক্ষে পূর্ব্বশিরাঃ হইয়া, রথ হইতে নিপতিত হইলেন। স্বর্গে দেবগণ, মর্ত্যলোকে ভূপতিগণ উচ্চস্বরে হাহাকার করিতে লাগিলেন; ভীষ্ম নিপতিত হইতেছেন দেখিয়া আমাদের হৃদয়ও তাঁহার সহিত নিপতিত হইল। নিখিল ধনুৰ্দ্ধরগণের ধ্বজস্বরূপ [অতুলনীয় উচ্চ কীর্ত্তিতুল্য] ভীষ্ম সমুত্থিত ইন্দ্ৰধ্বজের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইলে বসুন্ধরা কম্পিত হইয়া উঠিল। তিনি এরূপ শরজালে আবৃত হইয়াছিলেন যে, পতিত হইয়াও ধরাতল স্পর্শ করিলেন না; শরশয্যায় শয়ন করিয়া রহিলেন। দিব্যভাবসকল তাহাতে প্রবেশ করিল, জলধর বর্ষণ করিতে লাগিল, মেদিনী কম্পিত হইয়া উঠিল।

ভীষ্মের প্রাণপরিত্যাগে উত্তরায়ণের প্রতীক্ষা

“মহাবীর ভীষ্ম পতনসময়ে দিবাকরের দক্ষিণদিকে অবলোকন করিয়াছিলেন; এই নিমিত্ত সমুচিত সময় প্রতীক্ষায় অবলোকন সংজ্ঞা লাভ করিলেন। ঐ সময় অন্তরীক্ষ হইতে এই দিব্য বাক্য তাঁহার শ্রবণগোচর হইল যে, ‘নিখিল ধনুৰ্দ্ধরগণের অগ্রগণ্য মহাত্মা ভীষ্ম কি নিমিত্ত দক্ষিণায়নে প্ৰাণ পরিত্যাগ করিবেন?” ভীষ্ম এই দিব্যাবাক্য শ্রবণ করিয়া “আমি জীবিত আছি বলিয়া প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন। এইরূপে কুরুপিতামহ ভীষ্ম ধরাতালে পতিত হইয়াও উত্তরায়ণ-প্রতীক্ষায় প্ৰাণ ধারণ করিয়া রহিলেন। “হিমালয়নন্দিনী গঙ্গা ভীষ্মের অভিপ্ৰায় অবগত হইয়া মহর্ষিগণকে হংস রূপে তাঁহার নিকট প্রেরণ করিলেন। মানসনিবাসী হংস রূপ ঋষিগণ সত্বর গমন করিয়া দেখিলেন, কুরুকুলতিলক মহাত্মা ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন। তখন তাঁহারা তাঁহাকে প্রদক্ষিণ করিয়া পরস্পর আমন্ত্রণপূর্ব্বক কহিলেন, “মহাত্মা ভীষ্ম কি নিমিত্ত দক্ষিণায়নে প্ৰাণ পরিত্যাগ করিবেন?” এই বলিয়া দক্ষিণদিকে প্রস্থান করিতে লাগিলেন। মহাবুদ্ধি ভীষ্ম তাঁহাদিগকে দর্শনপূর্ব্বক ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “হে হংসগণ! আমি মনে মনে স্থির করিয়াছি যে, দিবাকর যতদিন দক্ষিণায়নে অবস্থান করিবেন, ততদিন আমি গমন করিব না; সত্য কহিতেছি, আদিত্য উত্তরায়ণস্থ হইলে আমি সেই পুরাতন স্থানে [পূর্ব্বজন্মক্ষেত্ৰে-বসুলোকে] উপস্থিত হইব; এক্ষণে সেই উত্তরায়ণ প্রতীক্ষায় প্ৰাণ ধারণ করিতেছি। মহাত্মা পিতা আমাকে স্বেচ্ছামরণ বর দিয়াছিলেন, আজি তাহা সফল হউক; সেই বরপ্রভাবে মরণের উপর আমার কর্ত্তৃত্ব আছে, তন্নিমিত্ত আমি জীবিত রহিয়াছি, নিয়মিত কাল উপস্থিত হইলে জীবন বিসর্জ্জন করিব।”

ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্মের শরশয্যায় শয়ন

“ভীষ্ম হংসগণকে এই কথা বলিয়া শরশয্যাতেই শয়ান রহিলেন।

“হে মহারাজ! কুরুবংশাবতংস মহাতেজাঃ অবধ্য ভীষ্ম নিপতিত হইলে, পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ সিংহনাদ করিতে লাগিলেন; আপনার পুত্ৰগণ কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। কৌরবগণ নিতান্ত মোহাবিষ্ট হইয়া উঠিলেন, কৃপ ও দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি বীরগণ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া রোদন ও বিষাদে বহুক্ষণ স্তব্ধেন্দ্ৰিয় [সমস্ত চেষ্টারহিত] হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন; যুদ্ধাভিলাষ পরিত্যাগ করিলেন এবং নিতান্ত নিগৃহীত হইয়াও পাণ্ডবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন না। ফলতঃ কুরুগণ সহসা অবিতর্কিত ব্যসনে [অচিন্তিতপূর্ব্ব বিপদে] নিমগ্ন হইয়া চতুর্দ্দিক শূন্যপ্রায় দেখিতে লাগিলেন। তাহারা শরনিকরে ক্ষতবিক্ষত ও অর্জ্জুনের নিকট পরাজিত হইয়াছিল; আবার মহাবীর ভীষ্মও নিহত হইলেন; সুতরাং ইতিকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিল।

“পাণ্ডবগণ ইহলোকে জয়লাভ করিলেন ও পরলোকে পরম গতি লাভ করিবেন বলিয়া মহাশঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। সোমক ও পাঞ্চলগণ পুলকিত হইলেন। তুৰ্য্য সহস্ৰ [হাজার হাজার ঢাক] নিনাদিত হইলে মহাবল ভীমসেন বাহ্বাস্ফোটনপূর্ব্বক চীৎকার করিতে লাগিলেন। উভয় সেনার মধ্যেই কোন কোন বীর অস্ত্রপরিত্যাগপূর্ব্বক চিন্তা করিতে লাগিলেন, কেহ কেহ। চীৎকারপূর্ব্বক পলায়ন করিলেন, কেহ কেহ মোহাবিষ্ট হইলেন, কেহ কেহ ক্ষত্রধর্ম্মের নিন্দা করিতে লাগিলেন এবং কেহ কেহ ভীষ্মের প্রশংসা করিতে আরম্ভ করিলেন। ঋষিগণ, পিতৃগণ ও ভারতদিগের পূর্ব্বপুরুষেরা তাঁহার প্রশংসা করিতে আরম্ভ করিলেন। ভীষ্ম মহোপনিষদ বিহিত [মুক্তিবিধায়ক] যোগাশ্রয়পূর্ব্বক জপে প্রবৃত্ত হইয়া সময়-প্রতীক্ষায় অবস্থান-করিতে লাগিলেন।”