মন্দিরে দীপদানের মাহাত্ম দণ্ডকেতুর উপাখ্যান
রাজা যজ্ঞধ্বজ একটি সুন্দর মন্দির নির্মাণ করে, তাতে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। বীতহোত্র নামে হরিভক্ত নিষ্ঠাবান একজন ব্রাহ্মণের হাতে পূজার ভার দিলেন।
পূজার ভার ব্রাহ্মণের উপর থাকলেও রাজা প্রতিদিন নিজের হাতে মন্দির পরিষ্কার করে, মন্দিরের চাতালের সামনে একটি প্রদীপ জ্বেলে দেন। তারপর ঠাকুরের পূজার কাজ করেন পুরোহিত বীতহোত্র।
একদিন পুরোহিত কৌতূহলী হয়ে রাজাকে জিজ্ঞাসা করলেন –যে কেন তিনি নিত্য এই দুটি কাজ করেন।
উত্তরে রাজা বললেন–এতে এক অপূর্ব রহস্য আছে। আপনাকে আমি বলবো। বহুদিন আগেকার কাহিনী।
রৈবত নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর পত্নীর নাম বন্ধুমতী। পাণ্ডিত্যের জন্য খুব খ্যাতি ছিল ব্রাহ্মণের কিন্তু তার লোভ ছিল খুব বেশি। লোভ বেশি থাকায় তিনি শাস্ত্র বিরোধী কাজ করতে বাধ্য হলেন। ধর্মাধর্মের কথা ভুলে তিনি মাদক দ্রব্যও বিক্রী করতে আরম্ভ করলেন।
এমন স্বামীর স্ত্রীও সঙ্গদোষে দুশ্চরিত্রা হয়ে গেলেন। রৈবতের বন্ধু-বান্ধবদের বহু চেষ্টাতেও তাদের স্বভাব পাল্টানো গেল না। রৈবতের পুত্রের নাম দণ্ডকেতু। সেও হল তার বাবা-মায়ের মত অসৎ স্বভাবের। বাবা লোভী এবং কৃপণ। দণ্ডকেতু বাবার কাছ থেকে নেশার খরচ না পেয়ে চুরি করতে আরম্ভ করল।– তারপর দণ্ডকেতু যখন যুবক হল তখন সে যুবতী মেয়েদের আকর্ষণ করতে লাগল। পাড়ার মেয়েরা তার ভয়ে আর ঘরের বার হতে পারত না। গ্রামের মানুষরা আর এইসব সহ্য করতে না পেরে ব্রাহ্মণ এবং তার ছেলে ও বউ-কেও গ্রামের বাইরে দূর করে দিল। তাদের এই অপকর্মের জন্য তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরাও বাড়িতে আশ্রয় দিল না।
তাঁরা নর্মদা নদীর তীরে এসে একটা কুঁড়েঘর তৈরি করে সেখানে বাস করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীর বয়েস হয়েছে। তার ওপর রৈবতকে ক্ষয় রোগে ধরেছে। বৈদ্যের পরামর্শেও কোন ফল হল না। একদিন তার মৃত্যু হল। ব্রাহ্মণীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল।
দণ্ডকেতুর কোন পরোয়া নেই। বাবার গচ্ছিত ধন অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এখন সংসার চালানোর জন্য সে চুরি করা শুরু করল।
একদিন দণ্ডকেতু একটি বিষ্ণুমন্দির দেখতে পেল। সে দেখল কয়েকজন নারী সেখানে নদীতে স্নান করে মন্দিরে পূজা করে চলে যাচ্ছে। তার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। যখন মেয়েরা ফিরে যাচ্ছে, দণ্ডকেতু তখন তাদের সঙ্গে ভালোমানুষ সেজে আলাপ করতে গেল। নিজের পরিচয় দিল ব্রাহ্মণের ছেলে হিসাবে। সে এই মন্দিরে আসে কারণ সে বিষ্ণু দেবতাকে খুব ভালোবাসে বলে।
এইভাবে সে প্রায়দিনই মেয়েদের সাথে নানা কথা বলত। একদিন একটি মেয়েকে ডেকে সে বলল–প্রতিদিন দিনের বেলায় এসে তোমরা পূজা করে যাও। কিন্তু কোনোদিন কি দেখেছ যে, বিষ্ণু কিছু খেয়েছেন? নিশ্চয় দেখ নি। কিন্তু আমি পূজা করি রাতের বেলায়। তুমি রাতে এসে দেখবে ভগবান আমার পূজার উপকরণ গ্রহণ করেছেন। তুমি একাই আসবে কারণ বেশি লোক জানাজানি হয়ে গেল তিনি আসবেন না।
মেয়েটি দণ্ডকেতুর কথা শুনে মনে মনে ভাবল–এই যুবক যা বলছে নিশ্চয় তা সত্যি হতে পারে। রাত্রিবেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটি একাই চলে এল মন্দিরে।
এদিকে সেই মেয়েটির আসার অপেক্ষায় দণ্ডকেতু নির্জন মন্দিরে বসে আছে। মেয়েটিকে দেখে দণ্ডকেতু আনন্দিত হয়ে বলল–এস, এস, ভিতরে এস।
এই কথা বলে দণ্ডকেতু তার হাত ধরে মন্দিরের মধ্যে নিয়ে গেল। একটা প্রদীপ মিটমিট করে জ্বলছিল। দণ্ডকেতু তার নিজের কাপড়ের এক টুকরো দিয়ে বাতিটি বড় করে জ্বালাল। এখন বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মূর্তির সামনে পড়ে থাকা শুকনো পাতা নিজের কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করল। তারপর মেয়েটির সঙ্গে সে কুকর্ম করল। মেয়েটি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে চিৎকার করলেও কেউ তা । শুনতে পায় নি। তারপর শেষরাতে তারা দুজনে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকাল হয়ে গেলেও তাদের ঘুম ভাঙ্গে না। নিত্যদিনকার মত অন্যান্য মেয়েরা বিষ্ণুপূজা করতে এসে তাদের দেখতে পেল। গত রাত্রে এই মন্দিরের মধ্যে কি ঘটেছে, তা কারো বুঝতে বাকি রইল না।
তখন সেই মেয়েরা ফিরে গিয়ে গ্রামের লোকজনদের এই ঘটনার কথা বলল। ক্রোধে ফেটে পড়ল সবাই। মন্দিরের মধ্যে এমন অনাচার! লাঠি সোটা নিয়ে এসে তারা তাদের দুজনকে পেটাতে লাগল। লাঠির ঘায়ে প্রাণ বেরুল দুজনার।
যজ্ঞধ্বজের মুখে এমন কথা শুনে ব্রাহ্মণ বীতহোত্র আশ্চর্য হয়ে বললেন–ছি, ছি, মন্দিরের মধ্যে এমন অপকর্ম যে করে সে মানুষ না পাষণ্ড। উপযুক্ত শাস্তি হল তাদের। কিন্তু নরকে হবে তাদের আসল শাস্তি, সেখানে বহুকল্প কঠোর শাস্তি নিশ্চয় পাবে।
রাজা বললেন–যেভাবে মহাদোষে দোষী সে, তাতে নরকেই তার গতি হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু আসল কথা কি জানেন, সে তো বিষ্ণুলোকে।
ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে বললেন–সে কি কথা? এমন মহাপাপী বিষ্ণুলোকে গেল?
রাজা আবার বললেন–তাদের মৃত্যুর সময়ে যমদূতেরা তাদের যমপুরীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এল, কিন্তু বিষ্ণুর দূতেরা বাধা দিয়ে বলল–এরা গত রাতে বিষ্ণুমন্দিরে প্রদীপ জ্বালিয়েছে, মন্দির মার্জনা করেছে। তার ফলে সারা জীবনের পাপ রাশি পুড়ে ছাই হয়েছে। সেই মার্জনা ও প্রদীপ দানের প্রভাবে তারা বিষ্ণুলোকে গেল। তারপর তারা রাজা-রানি হয়ে পৃথিবীতে এল।
রাজার মুখে এমন কথা শুনে ব্রাহ্মণ চমকে উঠলেন। বুঝলেন যে দণ্ডকেতুই বর্তমানে রাজা যজ্ঞধ্বজ।