একাশিতম অধ্যায়
বৃহস্পতি বললেন–কাম্য, নৈমিত্তিক ও নিত্যশ্রাদ্ধের কথা এবার বলছি শুনুন। অষ্টকা তিন প্রকার। প্রথম চিত্রী, এই অষ্টকাই শ্রেষ্ঠ, দ্বিতীয় প্রজাপত্যা ও তৃতীয়া বিশ্বদেবিত্রী। এটি ধনপুত্র দায়ক। প্রথম অষ্টকা অপূপ, দিয়ে দ্বিতীয়া মাংস দিয়ে এবং তৃতীয়া অষ্টকা শাক দিয়ে করতে হয়। এই হল অষ্টকার দ্রব্য বিধি। বিদ্বান ব্যক্তি ঐসব অষ্টকা সর্বস্ব ব্যয় করেও শ্রাদ্ধ করবেন। এরকম করলে ইহলোক পরলোকে মানুষ সুখী হয়। এই সব কর্ম যারা করেন তাদের সবসময় ভালো হয়। পিপাসার্ত গরু যেমন জলের কাছে এসে থাকে, তেমনি পর্বকালে পিতৃগণ নির্দিষ্ট তিথিতে দেবতাগণ, পুরুষদের কাছে এসে থাকেন।
যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট দিনে পিতৃ ও দেবতাদের পূজা করে না, তার এই জীবলোক বৃথা ও ধন লাভ বৃথা হয়ে যায়। দেবতা ও পিতাদের উদ্দেশ্যে যারা দান করেন, তারা দেবলোক পেয়ে থাকেন। পৌর্ণমাসীতে শ্রাদ্ধ করলে সবার আগে প্রজ্ঞাপুষ্টি, স্মৃতি, মেধা, পুত্র ও ঐশ্বর্য লাভ করে। এরকম প্রতিপদে করলে ধনলাভ হয় ও লব্ধ ধন নষ্ট হয় না। দ্বিতীয়াতে শ্রাদ্ধ করলে তার কোনো বিপদ হয় না। তৃতীয়াতে শত্রুহানি, চতুর্থীতে শত্রুর ছিদ্র দর্শন। পঞ্চমী স্ত্রী লাভ, ষষ্ঠীতে ব্রাহ্মণ থেকে পূজা লাভ, সপ্তমীতে মহাযজ্ঞ ও গণধিপত্য লাভ হয়, অষ্টমীতে ঐশ্বর্য প্রাপ্তি, নবমীতে ঐশ্বর্য ও স্ত্রী, দশমীতে ব্রাহ্মী, স্ত্রী, একাদশীতে চতুর্বেদ, পাপ প্রণাম ও ঐশ্বর্য দ্বাদশীতে রাজা, জয়শ্রী ও ধন, ত্রয়োদশীতে দীর্ঘায়ু এবং চতুর্দশীতে শ্রাদ্ধ করলে মৃত যুবক, মৃত যমজ সন্তান আর নিহত ব্যক্তির প্রাণ ফিরে আসে।
অমাবস্যায় সবসময় ভক্তিভরে শ্রাদ্ধ করবে, তাতে সমস্ত কামনা সিদ্ধ হবে ও অনন্তকাল স্বর্গ লাভ হবে। অমাবস্যায় সোমদেবকে আপ্যায়ন করবে। এভাবে আপ্যায়িত হয়ে সোমদেব ত্রিলোক পালন করেন। সিদ্ধচারণ গন্ধর্বরা তাকে সবসময় স্তব করবেন। সমানক্ষেত্রে পিতৃকর্ম করলে শ্রাদ্ধ অক্ষয় হয়। যারা পিতৃ ও দেবভক্ত, তারা পরম গতি লাভ করে।
.
বিরাশিতম অধ্যায়
বৃহস্পতি বললেন–যম যাশবিন্দুর কাছে যে নক্ষত্র বিশেষে শ্রাদ্ধের ফল বলেছিলেন, এবার তা বলছি শুনুন। যে অহিতাগি নর মৃত্তিকা যোগে শ্রাদ্ধ করেন, তিনি অপত্য লাভ করেন। অপত্যকামী ব্যক্তি রোহিণী নক্ষত্রে শ্রাদ্ধ করবে মৃগশিরা নক্ষত্রে শ্রাদ্ধ করেন তেজস্বিতা লাভ হয়। আদ্রা নক্ষত্রে কাজ করলে ক্ৰবকর্ম হতে হয়। পুণর্বস্ট্রতে কাজ করলে পুত্র ও ক্ষেত্র লাভ হয়। তিষ্য নক্ষত্র শ্রাদ্ধ করলে যশস্বী ও ধন-ধান্যবান হয়। অশ্লেষা নক্ষত্রে শ্রাদ্ধ করলে বীরপুত্র লাভ হয়।
মঘায় শ্রাদ্ধ করলে জ্ঞাতিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়। এভাবে পূর্ব ফাল্গুনীতে সৌভাগ্য, উত্তরফাল্গুনী শীল, চিত্রায় রূপবান পুত্র লাভ করে। পুত্রের জন্য বিশাখায় শ্রাদ্ধ করবে। অনুরাধা নক্ষত্র শ্রাদ্ধ করলে নররাজ্য বিস্তার করে। জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রে আধিপত্য লাভ হয়, মূলা নক্ষত্রে আরোগ্য, উত্তর আষাঢ়ায় শোক কমে যায়, শ্রবণায় পরমগতি, ধনিষ্ঠায় বিপুল ধন, অভিজিৎ নক্ষত্রে সাঙ্গবেদ, রেবতীতে বহু দ্রব্য, পূর্বভাদ্রপদে অজাবিক, উত্তরভাদ্র পদে গরু– এই ভাবে বিভিন্ন ফললাভ হয়।
.
তিরাশিতম অধ্যায়।
শংযু বৃহস্পতিকে জিজ্ঞাসা করলেনপিতৃগণকে দেওয়া কোন্ বস্তু তাদের তৃপ্তি সাধন করে বা কোন্ বস্তু তাদের কাছে অক্ষয় হয়ে থাকে? বৃহস্পতি বললেন–শ্রাদ্ধবিরা, শ্রাদ্ধে যাদেরকে হরি বলে নির্দেশ করেছেন, তা হল–তিল, ধান, যব, মাস, জল, মুগ ও ফল। এগুলিতে পিতামহগণ একমাস তৃপ্তি লাভ করেন।
এভাবে মাছ দান করবে দুমাস, হরিণ মাংসে তিনমাস, যাশমাংসে চারমাস, পাখির মাংসে পাঁচমাস, বরাহ মাংসে সাতমাস, পৃষত মাংসে আটমাস, সরৌরব মাংসে ন’মাস, করু মাংসে দশমাস, কুর্মমাংসে এগারো মাস, গব্য, মধু, ঘি মিশিয়ে শ্রাদ্ধ করলে এক বৎসর এবং কালো ছাগল ও গাধা দ্বারা শ্রাদ্ধ করলে পিতৃগণ অনন্তকাল তৃপ্তি লাভ করেন। পিতৃগণরা বলে–এমন কি কেউ আমাদের বংশে জন্ম নেয়নি, যে আমাদেরকে ত্রয়োদশী তিথিতে অন্ন, বর্ষা ও মঘাতে অজ ও সর্ব লোহের মাংস দান করবে। তোমরা বহু পুত্র কামনা করবে।
কেন না তাহলে বহু পুত্রদের মধ্যে কোনও একজন গয়াতে যাবে, কেউ গৌরী কন্যা বিয়ে করবে, কেউ নীল বৃষ উৎসর্গ করবে। শংযু বললেন–আপনি গয়ায় শ্রাদ্ধ করলে কেমন ফল লাভ হয়? পিতৃগণের কেমন পুণ্য হয়, তা বলুন। বৃহস্পতি বললেন–সং বৎসরের মধ্যে যে ব্যক্তি গয়ায় শ্রাদ্ধ করে, সে সর্বকামনা লাভ করে, ও স্বর্গলোকে পূজিত হয়। পুত্র গয়াতে গিয়ে শ্রাদ্ধ করে, দিব্য কাম ও মোক্ষলাভ করে। গয়াতে যেতে গেলে প্রথমতঃ যথাবিধি শ্রাদ্ধ করে কটিবেশে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে, গ্রামান্তরে গিয়ে সেখানে শ্রাদ্ধ শেষ করে, খেয়ে, ঐ গ্রাম প্রদক্ষিণ করে চলে যাবে। গয়াতে চুল, দাড়ি, নখ, বপন করতে হয় না।
গয়াযাত্রী ব্যক্তি ব্রাহ্মকুণ্ডু, প্রভাস, ব্রহ্মবেদী ও প্রেত পর্বতে বিধিনিয়মের শ্রাদ্ধ করবে। গয়ার উত্তরে মানসে মৈনাক সংজ্ঞক পর্বত আছে। উত্তরে কনখল ও দক্ষিণে মানস এইসব জায়গাতে স্নান করে, শ্রাদ্ধ করলে পিতৃলোক উদ্ধার পায়। স্বর্গ, পাতাল ও মতে গয়ার মতো তীর্থ আর নেই। যদি কারো পরম গতি লাভে ইচ্ছা হয়, তবে সে ঐ সব জায়গাতে শ্রাদ্ধ করবে। এর ফলে মানুষের কোটিকুল উদ্ধার হয়, পুত্র যদি কখনও গয়াতে যায় তাহলে শ্রাদ্ধে কল্পিত ব্রাহ্মণ গণকে সেখানেই ভোজন করাবে, তারা তুষ্ট হলেই দেবতাগণও তুষ্টি লাভ করে থাকেন।
শ্রাদ্ধের বিপ্রগণের কুলশীল, বিদ্যা বা তপস্যা–বিচার করা কর্তব্য নয়, তারা পূজিত হলেই মানুষ মুক্তিলাভ করে। সেখানে যথাযথ শ্রাদ্ধ করলে মুক্তি লাভ হয়। নিজের জ্ঞাতি, বন্ধু, মিত্র, সুহৃত এদেরও পিণ্ডদান করা যায়। এই পিণ্ডদানেপিণ্ডগ্রহীতা ও পিণ্ডদাতা দুজনেই স্বর্গে যেতে পারে। অজ্ঞাত নাম গোত্র ব্যক্তিদেরকে পিণ্ড দেবার মন্ত্র বলছি যথা–যারা পিতৃবংশে বা মাতৃবংশে জন্মায়, গুরু স্বজর, বন্ধু-বান্ধব, পুত্ৰদার বিবর্জিত, জ্ঞাতাজ্ঞাত এবং যারা গর্ভসংস্থিত আমি তাদেরকে এই পিণ্ড দিতে বলছি এই অক্ষয় হোক। গয়া ক্ষেত্রে তিলছাড়া পিণ্ডদান করতে হয়। অন্য বংশেরও পুত্র, দুহিতা, ইষ্ট ব্যক্তিদেরকে যত্নের সাথে বুদ্ধিমান ব্যক্তি সমাহিত হয়ে পিণ্ডদান করবে।
কৃতঘ্ন, মহাপাতকী প্রভৃতি সকলেই গয়াতে পিণ্ড দিলে নিষ্কৃতি লাভ করে। ব্রাহ্মঘু, সুরাপায়ী, গুরুদ্ৰোহী ব্যক্তিগণও যদি গয়াতে যান তবে তাদের পাপ নাশ হয়। গয়া তীর্থের মতো দুর্লভ তীর্থ ত্রিভুবনে আর নেই, এখানে পিণ্ড দান করলে নরকের ব্যক্তি স্বর্গে এবং স্বর্গস্থ ব্যক্তি মোক্ষ লাভ করে। আমাদের বংশে সেই রকম সৎকর্মশালী পুত্র জন্মাক যারা গয়াতে গিয়ে পিণ্ড দান করবে। মকর, চন্দ্র সূর্যের গ্রহণ, প্রেতপক্ষ চৈত্রমাসে গয়ায় পিণ্ডদান অতীব দুর্লভ। মলমাস, গুরু শুক্রের উদয় ও অস্ত এবং সিংহস্থ বৃহস্পতিতে গয়া শ্রাদ্ধ একান্ত কর্তব্য। বিচক্ষণ ব্যক্তি নিত্যই গয়া শ্রাদ্ধ করবেন।
গয়াতীর্থে শ্রাদ্ধ, জপ, হোম ও তপ অক্ষয় হয়। এজন্য পিতৃক্ষয় দিনে গয়াশ্রাদ্ধ অক্ষয় হয়। এরপর বৃষোৎসর্গের ফল বলছি, শুনুন। যে ব্যক্তি বৃষ উৎসর্গ করে, সে কুলের অতীত দশ পুরুষ ও অনাগত দশপুরুষ উদ্ধার করে। বৃষলাঙ্গুলের গলিত জল দিয়ে বৃষোৎসর্গে যে যে বস্তু স্পৃষ্ট হবে, সেই বস্তু পিতৃগণের পক্ষে অক্ষয় হবে। বৃষ যদি শিং বা খুর দিয়ে সবসময় মাটি খোড়ে, তার তা পিতৃকুলের মধুকুল্যা স্বরূপ অক্ষয়ত্ব লাভ করে। যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধ গুড়মিশ্রিত তিল অথবা মধুমন্ত্রে মধুমিশ্রিত তিল দান করে, তার এই দান অক্ষয় হয়।
বৃহস্পতি বললেন–দানের ব্যাপারে ব্রাহ্মণ পরীক্ষা করা উচিত নয়, তবে শ্রাদ্ধ দেব বা পিতৃ কর্মে পরীক্ষা করতে হয়। সর্ববেদবিদ, খ্যভাষ্যবিদ, বৈয়াকরণ, পুরাণধ্যায়ী, ধর্মশাস্ত্রধ্যায়ী ইত্যাদি জ্ঞানী, পণ্ডিতকে শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ করা উচিত। এইসব ব্রাহ্মণকে দান করলে তা অক্ষয় হয়। যারা যোগধর্মকারী তারা ধর্মাশ্রয়ীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। যিনি এই ব্রাহ্মণকে পূজা করেন, তাঁর পিতৃলোকের সাথে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের পূজা করা হয়। যোগধর্ম পবিত্রের পবিত্র, মঙ্গলের মঙ্গল, সর্ব ধর্মের প্রথম বলে ধরা হয়।
এবার অপাংক্তেয় ব্রাহ্মণের বিষয় বলছি। মদ্যপায়ী যক্ষ্মারোগ গ্রস্থ, পশুপাল, বণিক, গায়ন, পিতার সাথে বিবাদকারী, যার গৃহে উপজাতি বাস করে, অভিশপ্ত শিল্পোপজীবি, মিত্রদোহী, নাস্তিক, উন্মত্ত, পাঠ, পরস্ত্রী গামী, ব্রহ্মবিক্রয়ী এসব ব্যক্তিকে দান করলে ইহকাল পরকাল কোনও কালেই তা ফলদায়ক হয় না। কুকুর ও রাক্ষসরা শ্ৰাদ্ধীয় দ্রব্য যেন দেখতে না পায়। এজন্যই তিল ছড়িয়ে দান করতে হয়। রম্য নদীতীরে, সবিৎ সরোবরে ও নির্জন স্থানে শ্রাদ্ধ দান করলে পিতামহেরা খুশি হন। শ্রাদ্ধ দানে, অশ্রুপাত করতে নেই, মন্ত্র ছাড়া কোনও কথা হবে না। খেয়ে শ্রাদ্ধ করবে না।
কীভাবে শ্রাদ্ধ করলে মহাফল লাভ হয়, সেসব তোমাদের বললাম। বৃহস্পতি বললেন–শ্রাদ্ধকল্প শুনে যে মানুষ হিংসে করে, ঐ নাস্তিক ব্যক্তির নরক প্রাপ্তি হয়। কখনও যোগীদের নিন্দা কুৎসা করবে না, যারা যোগীদের নিন্দা, অপবাদ দেয় তারা কৃমি হয়ে জন্মায়। যিনি যোগ ও চব্বিশ তত্ত্বের পারদর্শী তিনিই জন্ম মরনের পরবর্তী হয়ে থাকেন। যে যোগবিদ বেদ অধ্যয়ন করে, তিনি বেদবেদ্য পরমপুরুষকে লাভ করেছেন। তিনিই যথার্থ বেদবিদ তাকেই বেদ পরায়ণ বলা হয়। পিতৃভক্ত জন। যজ্ঞ, বেদ, কাম, আয়ু ও ধন পেয়ে থাকেন। যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধ করার সময় শ্রাদ্ধ কল্প পাঠ করে, সে পূর্বোক্ত সমস্ত তীর্থ শ্রাদ্ধের ফল পায়।
শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করলে ইহকালের পরম তুষ্টি লাভ করে। এই বিধি যিনি প্রণয়ন করেছেন। সেই স্বয়ম্ভুকে ও মহাযোগেশ্বরকে আমি প্রণাম করি। বান্ধবগণ নামগোত্র উল্লেখ করে দেবতাদের সাথে পিতৃগণকে কুশবিছানো ভূমিতে পিণ্ডদান করবে। মানুষেরা যা খায়, পিতৃগণও তাই ভোজন করে থাকেন। মন্ত্রের প্রভাবে পিতৃগণের কাছে পিণ্ড উপস্থিত হয়। নাম, গোত্র, মন্ত্র পিতৃগণের অন্ন বহন করে, পিতৃগণের শতশত জন্ম হলেও তারা। তৃপ্তি পান। ব্রহ্মা কর্তৃক এই ব্যবস্থা নির্দিষ্ট আছে। এই পিতৃগণ দেবতা স্বরূপ, দেবগণ পিতৃগণ স্বরূপ। পিতৃগণের দৌহিত্রেরাই তাদের যজমান।
এই লোক সকল তাদের পুত্র, কন্যা, দান, শৌচ, তীর্থফল, দ্বিজত্ব প্রভৃতি নিয়ে ব্রহ্ম আগে যা যা বলেছেন তাই বললাম। আগে সহস্র বর্ষব্যাপী এক যজ্ঞ হয়। ঐ যজ্ঞের ভগবান ব্ৰহ্ম গৃহপতি হয়ে পাঁচশো বছর দেবতাদের ওপর প্রভুত্ব করেন, এরকম প্রসিদ্ধ আছে। সূত্র বললেন, ভগবান বৃহস্পতিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি যেভাবে পিতৃবংশের বর্ণনা করেছিলেন। আমি তেমনই বললাম। এরপর বরুণের বংশের কথা বলছি।
.
চুরাশিতম অধ্যায়
ঋষিরা এই প্রস্তাব শুনে খুশি হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন- হে সূত। রাজাদের বংশ, স্থিতি ও প্রভাব কীর্তন করুন, আমরা তাও শুনব। লোমহর্ষণ সূত মুনিদের একথা শুনে তাদের কৌতূহল নিবারণের জন্য বললেন– হে মুনিগণ। মহর্ষি ব্যাসদেব আমাকে যেমন উপদেশ দিয়েছেন, আমি তেমন করে রাজাদের বংশ, স্থিতি ও প্রভাব বর্ণনা করছি।
বরুণের স্ত্রী সামুদ্রী দেবী, সুনাদেবী নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর কলি ও বৈদ্য নামে দুই ছেলে ও সুরসুন্দরী নামে এক কন্যা জন্মে। কলির জয় ও বিজয় নামে দুই পুত্র ও বৈদ্যের ঘৃণি ও মুনি নামে দুই পুত্র জন্মে। প্রজা ভক্ষণ করার ইচ্ছেতে তারা পরস্পর পরস্পরকে খেয়ে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। সুনা দেবীর সন্তান কলির কনিষ্ঠা স্ত্রী, বিশ্বকর্মার কন্যা হিংসা থেকে মদ নামে পুত্র জন্মে।
কলির প্রথমা স্ত্রী নিকৃতি– নাক, বিঘ্ন, সঙ্কট, বিধর্মক নামক রাক্ষস প্রভৃতির জন্ম দেন। এদের মধে বিঘ্ন মস্তকহীন, নাক শরীর শূন্য, সঙ্কট একহস্ত, বিধর্মক এক পাদবিশিষ্ট। সঙ্কটের পত্নী তামসী পূতনা এবং বিধর্মকের পত্নী রেবতী, এদের সহস্র সহস্র পুত্র উৎপন্ন হয়। নাকের পত্নী শকুনি, বিঘ্নের পত্নী আয়ামুখী। সন্ধ্যায়ে বিচরণকারী মহাবীর্য নৈম্মত নামে প্রসিদ্ধ রাক্ষসের পত্নী তামসী, পূতনাও রেবতীর সন্তান। ব্রহ্মার অনুমতিতে স্কন্দ এদের অধিপতি।
বর রমণী বৃহস্পতি ভগিনী প্রভাসখ্য অষ্টম বসুর পত্নী। শিল্পী বিশ্বকর্মা তাঁরই পুত্র, ইনি দেবতাদের বাস্তু নির্মাণ ও শিল্প উদ্ভাবন করেন। তিনিই দেবতাদের বিমানগুলি নির্মাণ করেছেন। সেই মহাত্মার শিল্পগুলি মানুষদেরও উপজীব্য। ত্বষ্টার পত্নী বিরোচনা। ত্রিশিরা অসুর তাঁর পুত্র। ধীমান মহাত্মা বিশ্বকর্মা, দেবতাদের শিল্পাচার্য ছিলেন। তাঁর পুত্র ময় বিশ্বকর্মা বলে প্রখ্যাত হন। ময়ের কনিষ্ঠা ভগিনী সুরেন সবিতার স্ত্রী সংজ্ঞা নামে বিখ্যাত হন। তিনি তপ প্রভাবে সবিতা থেকে মনুকে ও যমজ যম ও যুমনাকে প্রসব করেন। পরে তিনি অশ্বরূপে উত্তর কুরুদেশে গিয়ে তপস্যায় নিযুক্ত হন।
ঋষিরা বললেন–বুধগণ বিবস্বানকে মাতণ্ড বলেন কেন? সংজ্ঞাই যা অশ্বরূপে কেন নাসিকা দ্বারা প্রসব করলেন? আমরা তাই জানতে চাইছি। সূত বললেন– সূর্য প্রথমে একটি অণ্ডাকারে প্রসূত হন। দীর্ঘকাল সেই অণ্ড ছোট হয়ে গেল না দেখে ত্বষ্টা তাকে ভেঙে দিলেন। কশ্যপ অণ্ডের মধ্যে মার্তণ্ডকে স্নেহবশে বললেন– বংস, তুমি অণ্ড, নও, তুমি মার্তণ্ড হলে। অণ্ডটি দুভাগ হলে বিবস্বান মার্তণ্ড নামে পুরাণ সমাজে খ্যাতি লাভ করে। পুরাকালে বিবস্বানের স্ত্রী সংজ্ঞার তিন পুত্র জন্মে। রূপযৌবন শালিনী সংজ্ঞা দেবী মার্তণ্ডের রূপে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। মার্তণ্ডর তেজ তিনি সহ্য করতে কষ্ট পাচ্ছিলেন।
সংজ্ঞার গর্ভে মার্তণ্ডের দুই মহাবল পুত্র ও এক কন্যা উৎপাদন করেন। সংজ্ঞা দেবী বিবস্বানের তেজ সহ্য করতে না পেরে ঠিক নিজের প্রতিমূর্তির মতো ছায়ামূর্তি নির্মাণ করলেন। সেই মূর্তি হাতজোড় করে সংজ্ঞাকে বলল আমি কি করব? আদেশ করুন। সংজ্ঞা বললেন–তোমার মঙ্গল হোক। আমি বাপের বাড়ি যাব। তুমি নিশ্চিন্তে এই বাড়িতে বাস কর। আর আমার এই দুই বালক সন্তান ও কন্যাকে যত্ন করে প্রতিপালন করো। এই সব কথা আমার স্বামীর কাছে প্রকাশ করো না, ছায়া দেবী একথা শুনে বললেন–আপনি নিশ্চিন্তে আপনার বাবার কাছে যেতে পারেন।
এদিকে সংজ্ঞা কাছে গেলে তার বাবা রেগে গিয়ে বললেন– তুমি পতিকে অবজ্ঞা করো না, তার কাছেই ফিরে যাও। এভাবে পিতা বারবার অনুরোধ করলেও তিনি হাজার বছর ধরে বাবার কাছেই থেকে গেলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত পিতা আদেশ করলে সংজ্ঞাদেবী অশ্বীরূপ ধারণ করে উত্তর কুরুদেশে গিয়ে তৃণ খেয়ে রইলেন। এদিকে দিবাকর সেই ছায়া মূর্তিকে সংজ্ঞা মনে করে তার গর্ভে তেজস্বী, ধর্মজ্ঞ শ্রুতশ্ৰবা, শ্রুতকর্মা নামে দুই পুত্র উৎপাদন করলেন। তশবা সাবণী মনু নামে এবং শ্রুতকর্মা শনৈশ্চরী গ্রহরূপে প্রখ্যাত।
একবার যম রেগে গিয়ে ছায়াদেবীর গায়ে পাদঘাত করেন, এতে তিনি রেগে গিয়ে অভিশাপ দেন। ধর্মাত্মা যম ছায়া সংজ্ঞার অভিশাপে দুঃখিত পিতার কাছে সমস্ত কথা বললেন। আমি মোহবশে অপরাধ করেছি, জননী আমাকে পাপ দিয়েছেন, আমাকে মহাভয় থেকে পরিত্রাণ করুন, প্রভু বিবস্বান বললেন– পুত্র আমার মনে হয় এর কোনও বিশেষ কারণ আছে নিশ্চয়ই।
তুমি সত্যবাদী, ধর্মজ্ঞ হলেও তোমার রাগ হলো কেন? মায়ের কথা অন্যথা করা অসাধ্য। কৃমিরা তোমার পা নিয়ে নিলেও তুমি নতুন পা অনায়াসে পাবে। এরফলে তোমার মায়ের কথা সত্য হবে, শাপমুক্ত হয়ে, তোমারও রক্ষা হবে। আদিত্য একথা বললে পরে ছায়া সংজ্ঞাকে বললেন, তুমি একজন সন্তান কে এত বেশি স্নেহ কর কেন। তোমার কাছে তো সব সন্তানই সমান। ছায়াদেবী রহস্য প্রকাশের ভয়ে চুপ করে থাকলেও আদিত্য ধ্যানে সব জানতে পারলেন।
তিনি ছায়াদেবীতে শাপ দিতে উদ্যত হলে, ছায়াদেবী তখন সমস্ত কথা ব্যক্ত করলেন। বিবস্বান রেগে গিয়ে ত্বষ্টার কাছে গেলেন। ত্বষ্টা তাকে অৰ্চনা করে বললেন– তোমার এক তেজযুক্ত এইরূপ শোভা পায়না। সংজ্ঞা সহ্য করতে না পেরেই বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি তোমার যোগিনী ভার্যাকে দেখতে পারে, যদি আমার কথা শোন। আমি তোমার রূপের পরিবর্তন করে তোমাকে মনোহারী আকার দেব। এই ভাবে ত্বষ্টা দিবাকরের অনুমতি নিয়ে তাকে কিছুটা তেজহীন, মনোরম করলেন।
তখন আদিত্য দেব অশ্বরূপিণী নিজের স্ত্রীকে দেখতে পেলেন। মার্তণ্ডদেব অশ্বরূপ নিয়ে তার কাছে। মিলনেচ্ছায় গেলেন। সংজ্ঞাদেবী পরপুরুষ ভেবে তাকে প্রত্যাখান করলেন। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হল না। সংজ্ঞাদেবীর নাক থেকে নাসত্য ও দস্ত্র নামে অশ্বিনী কুমার দ্বয়ের জন্ম হয়। এরা অষ্টম প্রজাপতি মার্তণ্ডের সন্তান। পরে আদিত্য সংজ্ঞাদেবীকে নিজের মনোহর মূর্তি দেখালেন এবং দেবীও খুশি হলেন।
এদিকে যম মাতৃশাপে দুঃখিত মনে ধর্ম অনুসারে প্রজাপালন করতে লাগলেন এবং শুভকাজের ফলে লোকপালত্ব পেলেন। এঁর অন্য ভাই শনৈশ্চর গ্রহত্ব লাভ করেছেন। তষ্টা সূর্যদেবের তেজ সমূহ দিয়ে বিষ্ণুর সেই সুদর্শন চক্র দিয়ে কদানব হত্যা করা হয়। যমভগিনী যমুনাদেবী লোকহিতার্থ যমুনা নামে শ্রেষ্ঠ নদীরূপে পরিণত হন। আর এদের সকলের বড়, যার অধিকার চলেছে, সেই বৈবস্বত মনুর বিবরণ এবার বলব।
.
পঁচাশিতম অধ্যায়
সূত বললেন–দেবতাদের সঙ্গে চাক্ষুষ মন্বন্তর শেষ হলে, পৃথিবী রাজ্য বৈবস্বত মনুর অধিকারে এল। বিবস্বানের জ্যেষ্ঠ ছেলে মনুর আত্মতুল্য নজর পুত্র জন্মে ইন্ড্রাকু, নহুশ, ধৃষ্ট, শর্যাতি, গরিষ্যন্ত, প্রংশু ও নাভাগরিষ্ট, করুষ ও পৃষব্র, এই নজন বৈবস্বতক মনুর ছেলে। হে মুনিগণ। এরকম শ্রুতি আছে ব্রহ্মার আদেশে প্রজাপতি মনু প্রজাসৃষ্টি করে যজ্ঞ আরম্ভ করে মিত্র বরুণের উদ্দেশ্যে আহুতি দিলে এক দিব্য আভরণ ভূষিতা নারী প্রাদুর্ভূত হন।
ইনিই ইড়া, মনু তাকে ইলা বলে সম্বোধন করলেন। ইলা বললেন–আমি মিত্রা বরুণের অংশে জন্মেছি, তাদের কাছে যাব। একথা বলে ইলা মিত্রবরুণের কাছে গিয়ে হাতজোড় করে বললেন– হে দেবদ্বয়! আপনাদের কোনও আদেশ আমি পালন করব! দুই দেবতাকে বললেন–তোমাকে দেখে আমরা খুশি হলাম।
তুমি আমাদের কন্যা বলে খ্যাত হবে। ইলাদেবী মিত্রা বরুণের কাছে বরলাভ করে ফিরে আসার সময় সোম পুত্র বুধের সঙ্গে মিলিত হল তখন তার গর্ভে বুধের ওরসে পুরুরবার জন্ম হয়। এই ইলাদেবী মনুর বংশে সুদ্যুম্ন নামে খ্যাত হন। সুদ্যুম্নের উৎকল, পয় বনস্ম তিন পরম ধার্মিক পুত্র জন্মে।
উৎকলের রাজধানী উৎকল, যিনতাম্বের পশ্চিম দেশ, গয়ের গয়াপুরী, দিনকরনন্দন মনু সন্তান সৃষ্টি করে পৃথিবীকে দশভাগ করে সন্তানদের দান করেন। ইক্ষাকুর অন্য দশপুত্র জন্মে, কিন্তু সুদ্যুম্নোর স্ত্রীভাব রয়েছে বলে তিনি রাজ্য লাভ করতে পারলেন না। বশিষ্ঠের কথা অনুযায়ী, যশস্বী, ধার্মিক সুদ্যুম্বকে প্রতিষ্ঠানপুরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সুদ্যুম্নের স্ত্রীভাব আছে বলে তিনি লজ্জা বশে রাজ্য ত্যাগ করে সেই রাজ্য পুরুরবাকে দান করেন।
সূত বললেন–দেবী ভগবতী কেবার শিবের কাছে এই নিয়ম স্থাপন করলেন–আশ্রমে যে পুরুষ প্রবেশ করবে সে অবিলম্বে সুন্দরী নারীমূর্তি ধারণ করবে। এজন্য সেই উমাবনে পশুপিশাচ সবাই স্ত্রীরূপী। রাজা সুদ্যুম্ন সেই উমাবনে ঢুকে স্ত্রীভাব প্রাপ্ত হন।
.
ছিয়াশিতম অধ্যায়
সূত বললেন–হে মুনিগণ! এবার মনু পুত্রদের চরিত্রের কথা শুনুন। মনুপুত্ৰ পৃষ গুরুর একটি গাভীকে হত্যা করে খেয়ে ফেলেন, তাই মহাত্মা চ্যবনের শাপে সে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হন। করুষের অতি পরাক্রমশালী কারুশ নামে একশো সন্তান জন্মে। নাগরিষ্টর ছেলে বিদ্বান ভগনন্দন। ভগনন্দনের ছেলে প্রাংশু। প্রাংশুর ছেলে প্ৰজানি। প্রজাতির ছেলে বীর্যবান ক্ষনিত্ৰ। ক্ষনিত্রের ছেলে শ্রীমান ক্ষুপ। ক্ষুপের ছেলে বিবিংশর বিবিংশের ছেলে প্রতাপবান খনিনেত্র। ত্রেতাযুগে তাঁর করন্ধম নামে এক ছেলে জন্মে।
করন্ধমের ছেলে অবিক্ষিত। তাঁর পুত্র ধর্মাত্মা চক্রবর্তী সংবর্তমুনির সাহায্যে স্বর্গ্যোন। তখন বৃহস্পতি সঙ্গে সংবর্তের ভীষণ ঝগড়া হয়। মরও চক্রবর্তী হয়েছিলেন। তাঁর ছেলে নরিষ্যন্ত, নরিষ্যন্তের ছেলে দম, দমের ছেলের রাষ্ট্রবর্ধন, তার ছেলে সুধৃতি, তার ছেলে নর, তার ছেলে চোখ, চোখের পুত্র কছুমান, তার ছেলে বেগবান, বেগবানের ছেলে বুধ তাঁর ছেলে তৃণবিন্দু ইনিই ত্রেতাযুগে (তৃতীয়) রাজা হন। তৃণবিন্দুর মেয়ে দ্রবিড়া, দ্রবিড়ার ছেলে বিশ্রবা, তাঁর ছেলের নাম বিশাল।
এই বিশাল রাজা ধার্মিক ছিলেন। ইনিই বিশালপুরী নির্মাণ করেন। বিশালের ছেলে মহাবল হেমচন্দ্র, তাঁর ছেলে সুচন্দ্র, তাঁর পুত্র ধুম্রাম্ব। তাঁর ছেলে বিদ্বান সৃজ্ঞয় তাঁর পুত্র সংদেব, তাঁর ছেলে পরমধার্মিক কৃশাম্ব। তাঁর পুত্র মহাতেজস্বী সোমদত্ত। সোমদত্তের পুত্র জনমেজয়, তার ছেলে প্রমতি। তৃণবিন্দুর প্রসাদ বিশাল, রমণীয় রাজারা সকলেই দীর্ঘায়ু, মহাত্মা, ধার্মিক ছিলেন। শয্যতি রাজার আর্নত নামে এক ছেলে ও সুকন্যা নামে এক মেয়ে জন্মায়, সুকন্যা চ্যবনের স্ত্রী।
আনর্ত্তের ছেলে রেব। রেবের ছেলে বৈবত এঁরই অন্য নাম কুকুষ্মী। ইনি একশো ভাই-এর মধ্যে বড়। ইনি কুশস্থলীতে রাজত্ব করতেন। একসময় ইনি নিজের মেয়ের সাথে ব্ৰহ্ম সভায় গিয়ে গান শুনেছিলেন। ব্রহ্মার মুহূর্ত কাল পালে মানুষের বহুযুগ পার হয়ে যায়। কুকুৰ্মী গান শুনে নিজের গৃহে ফিরে এসে দেখলেন সেখানে বসুদেবরা অন্ধক, ভোজ ও বৃষ্ণি বংশীয় অনেকে পরিশ্রম করে একটা সুন্দর পুরী নির্মাণ করেছে। এই ঘটনা শুনে তিনি নিজের রেবতী নামের কন্যাকে বলরামের হাতে সম্প্রদান করে তপস্যার জন্য মেরু পর্বতে চলে গেলেন।
এই কাহিনি শুনে ঋষিরা সূতকে জিজ্ঞাসা করলেন –এতকাল পার হয়ে গেলেও কী জন্য রেবতী তখনও বৃদ্ধা হন নি? এই কুকুৰ্ম্মী কিভাবে মেরু পর্বতে চলে গেলেও তার বংশ পৃথিবীতে রেখে গেলেন?
যে গানকে রেবতী দীর্ঘকালকে মুহূর্তকাল ভেবেছিলেন সেই গান কিরকম? সেই ব্রহ্মসভায় কোন কোন্ দেবতাই বা ছিলেন? সূত বললেন– ব্রহ্মলোকে গেলে মানুষের খিদে, তৃষ্ণা, জরা, মৃত্যু, ভয় বা রোগ হয় না। গানের বিষয় যে প্রশ্ন করলেন– সে বিষয়ে বলছি। স্বর সাতটি, গ্রাম তিনটে, তাল উনপঞ্চাশ রকমের। এই সব মিলে স্বরসড়প।
ষড়জ ঋষভ, গান্ধার মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ, এই সাতটি স্বর। সৌরীরী, হরিচাম্বা, কলোপবালা, যুদ্ধ মধ্যমা, যাঙ্গী, পাবনা, দৃষ্টাশ রো মধ্যম গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। ষড়জ গ্রামের কথা শুনুন–উত্তর মন্ত্রা, রজনী, উত্তরা, আয়তা, শুদ্ধ ষড়দা, প্রভৃতি। ষড়জ গ্রামের অন্তর্গত গান্ধার গ্রামের বর্ণনা বলছি–অগ্নিষ্টোমিক, রাজপেরিক, পৌন্ড্রক, অশ্বমধিক, রাজসূয়, চক্রমবর্মক, মহারবৃষ্টিক, ব্রহ্মদান, প্রজাপত্য, নাগপক্ষাশ্রয়, হয়ক্রান্ত, মৃগকান্ত, বিষ্ণুক্রান্ত, কোকিলের গলার মতো মনোরম সূর্যক্রান্ত সাবিত্র, অর্ধসাবিত্র, সবতো ভদ্র, সুবর্ণ, সুতন্ত্র, বিষ্ণু, ভূতি, বিফল, উপনীত, বিনত, ভগবিপ্রিয়, শ্রী, অবিরম্য, শুক্র ও পুণ্যপদ, পুণ্যারক–এরা গান্ধার গ্রামের অন্তর্ভুক্ত।
ভগবান ব্ৰহ্ম মোবীরার সাথে গান্ধারী গান করে থাকেন। উত্তরাদি স্বরের অধিদেবতা ব্রহ্মা। হরিনাম মূচ্ছনার অধিদেবতা ইন্দ্র, শুদ্ধ মধ্যমা মূচ্ছনা মরুদেশে অন্তর্গত। উত্তর মন্ত্রখ্য তালের অধিদেবতা ষড়জ। উত্তর ও প্রথম তাল অনুযায়ী উত্তমন্ত্র নাম হয়েছে। দ্রুব, অধিদেবতা, ধৈর্যতের মূৰ্ছনার নাম উত্তরায়ণ। অগ্নির উপাসনার ষড়ের নাম শুদ্ধ ষড়ষিক, পাঁচটি স্বরের মূচ্ছনা দিয়ে সাধুগণের মোহ সৃষ্টি করেছিল যক্ষীগণ, তাই মূৰ্ছনার নাম যাক্ষিকা। ওই মূচ্ছনা শুনে বিষধর সাপেরা মুগ্ধ হয়ে পড়ে। এর দেবতা বরুণ, শকুন্তক মূচ্ছনা দিয়ে কিন্নর গণ গান শোনান। গান্ধার গানে অনুরাগ বিশুদ্ধ গান্ধারীর অধিদেবতা গন্ধর্ব। ষড়ভুজ নামে প্রধান মূচ্ছনা প্রথমে পিতামহের কাছে উপস্থিত হয়। এর অধিদেবতা অনল।
.
সাতাশিতম অধ্যায়
এবার আমি পূর্বাচার্যদের মত অনুসারে যথাক্রমে সঙ্গীতের অলংকার-এর কথা বলছি। নিজ নিজ অনুসুবর্ণ পদ সমূহের যোগ বিশেষকেই অলংকার বলা হয়। পদ, বাক্য, যোগার্থ দিয়ে এর অভিব্যক্তি হয়ে থাকে। স্থান তিনটি বুক, গলা, মাথা। তিন জায়গায় প্রবৃত্ত স্বরই উত্তম। একভাবে যার সঞ্চারণ তা স্থায়ী, নানা আকারে যা সঞ্চরণ তা সঞ্চারী, যার নিম্নগতি তা অবরোহণ এবং যা উন্নতিশীল তা আরোহণ পদবাচ্য। বৰ্ণতত্ত্ব পণ্ডিতদের একমত। এইসব বর্ণের অলংকার শুনুন। অলংকার চারটি স্থাপনী, মরেজিনী, প্রমাদ ও অপ্রমাদ এদের লক্ষণ বলছি।
উষ্ট্রক লাঘ্য বিকৃতস্বর, একস্থান থেকে উৎপন্ন হয়ে অন্যস্থানে শেষ হয়ে থাকে। কুমার নামে স্বর আস্তে আস্তে বিস্তারলাভ করে। শ্যেনস্বর কান্ত সজ্ঞাত ও কলা নামমাত্র প্রতিষ্ঠিত। এই শ্যেনস্বর উত্তর অবরোহ, সবিন্দু, স্বর কলা কলা প্রমাণে আবির্ভাব হয়। বিন্দু এক কলা এই বর্ণস্থায়ী অসাবধান বশত স্বরগত বিপর্যয় ঘটে বটে, কিন্তু ইচ্ছে করেও স্বর বিপর্যয় করতে পারা যায়। ষড়জ থেকে আরব্ধ প্রধান স্বরে একান্তভাবে কখনও উচ্চ ও কখনও নীচ ক্রমে আক্ষেপ ও অবস্কন কর্তব্য। কলা স্থান একান্তভাবে বারো রকম। ত্রাসিত স্বরের উচ্চারণে দুটি স্বর পরিব্যক্ত হয়। এর উচ্চারণও আটরকম স্বরে বিহিত।
বর্ণস্থান ও প্রয়োগ বিশেষ অনুযায়ী কলামাত্রা প্রধানতঃ ত্রিশ রকম বলা যায়। সংস্থান, প্রমাণ, বিকার ও লক্ষণ অলংকারের প্রয়োজন এই চার রকম। জনগণের শরীর অলংকারের মতোই সাজানো। অলংকার গানের ঐশ্বর্য দান করে। কিন্তু অতিরিক্ত অলংকার যেমন জনগণের উৎসাহ কমে যায়, তেমনি গানে অযথা অলংকার বিন্যাস গানের ভাবকে ক্ষুণ্ণ করে। সুতরাং নারীর মতোই গানেরও অলংকারের যথাযথ বিন্যাস থাকা উচিত। ষড়জ স্বর তার মধ্য ও মন্ত্র এই তিনভাগে বিভক্ত। যড়জ ও মধ্যম গ্রামের রীতি প্রায় একরকম শব্দময় গানগুলির প্রথম, মধ্য ও শেষ ভাগে অলংকার ইত্যাদির কৌশলে নানারকম রীতি দেখা যায়।
সাত স্বর থেকে অন্য স্বরের উৎপত্তি হয়। গান্ধার স্বর অনুসারে চারটে মদ্রক গীত হয়। পদের ভেদ তিনরকম আর সঙ্গীতের ভেদ সাতরকম। গান্ধার রাগের অনুগত। ভেদ বিবরণ এরকম। মধ্যমস্বরের ভেদক্রম এই রকম। দ্বিতীয় তাল এর চরণ ও মাত্রা সব এর নাভিমণ্ডল স্বরূপ প্রভৃতি অনুসারে কখনো কখনো মাত্রাগুলি লীন অবস্থায় থাকে। সঙ্গীতের যে অংশে মাত্রা অনুসারে তাল বিন্যাস না থাকে সেই অপূর্ণ পাদ বিশিষ্ট অংশকে সাত মতিবীরনা বলা হয়।
যে অংশে নির্দিষ্ট মাত্রা সংখ্যায় ব্যাঘাত দেখা যায়, তাকে যান বলে। শুল্ল ও অপর অন্তিম গানের দ্বিতীয় পাদভাগে সঙ্গীত আরম্ভ হলে প্রকৃত অনুসারে পাদভাগ চার ভাগ থেকে বেড়ে পাঁচ পাদে সম্পূর্ণতা লাভ করে। অর্ধেক ভাগে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। দক্ষিণ ও উত্তর মদ্রকে চারপাদ অন্তেই শেষ হয়ে থাকে। দুই বা অনেক স্বরের একই বিধান পতাকারিন নামে বিখ্যাত।
.
অষ্টআশিতম অধ্যায়
সূত বললেন–বিকুক্ষির ছোট ভাই নিমির বংশ শুনুন। এই নিমিরাজা গৌতম ঋষির আশ্রমের কাছে দেবপুরের মত জয়ন্ত নামে এক বিখ্যাত নগর স্থাপন করেছিলেন। এরই বংশে ঋষি শ্রেষ্ঠ জনক থেকে নেমি নামে সর্বজন মান্য পুত্র জন্মে। ইক্ষাকুর এক পুত্র জন্মায়, ইনি বশিষ্ঠের পাপে বিদেহ হয়েছিলেন। এঁর ছেলের নাম মিথি। মিথির নাম থেকেই মিথিলা পুরির প্রখ্যাতি। মিথিলার অধিপতি রাজা জনক, জনক থেকেই উদাবসু। তাঁর পুত্র নন্দিবর্ধন, তাঁর পুত্র বীর ও ধার্মিক সুকেতু। তাঁর ছেলে মহাবল দেবরাত, তাঁর পুত্র বৃহদ্রথ। তাঁর পুত্র প্রতাপবান মহাবীর্য, তার ছেলে ধৃতিমান, তাঁর পুত্র সুধৃতি, সুধৃতি পুত্র ধর্মাত্মা রাজা ধৃষ্টকেতু তাঁর পুত্র বিখ্যাত হর্ষ। তার পুত্র মরু, তার পুত্র প্রতিত্বক। তাঁর পুত্র কীর্তিরথ। এই কীর্তিরথের পুত্র দেবমীর, তাঁর ছেলে বিবুধ, তাঁর পুত্র ধৃতি।
ধৃতির পুত্র কীৰ্তিরাজ। তার পুত্র রোমবান। তাঁর পুত্র স্বর্ণরোমা। স্বর্ণরোমার ছেলে নরপতি হ্রস্বরোমা। তার ছেলে বিদ্বান শিরধ্বজ। এই শিরধ্বজ কর্ষণ করার সময় সীতা দেবীকে ক্ষেত থেকে পান। সীতা রাম মহিষী সাধ্বী সতী পতিব্রতা, সূত বললেন– মহাত্মা রাজা শিরধ্বজ রাজা যখন অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, তখন নিয়ম অনুযায়ী অগ্নিক্ষেত্র কর্ষণে করেছিলেন, সেই সময়ই সীতার আবির্ভাব।
শিরধ্বজের, ভানুমান নামে এক পুত্র জন্মে। ঐ পুত্র মেথিল বলে পিরিচিত, শিরধ্বজেয় ভাই কুশধ্বজ। ইনি কাশীর নরেশ ছিলেন। ভানুমানের একটি ছেলে হয়, তার নাম প্রদ্যুম্ন। এর পুত্র মুনি, তার ছেলে উজ্জবহ, তাঁর পুত্র সুতধ্বজ, সুতধ্বজের ছেলে শকুনি। স্বাগত শকুনির ছেলে আর সুরক্ষা স্বাগতের ছেলে, এঁর ছেলে সুশ্রত, তার ছেলে জয়, জয়ের ছেলে বিজয়, বিজয়ের ছেলে ঋত।
ঋতের পুত্র সুনয়। সুনয়ের ছেলে বীতহব্য, বীতহব্যের ধৃতি নামে এক পুত্র জন্মে। ধৃতির ছেলে বহুনাস্ব, তার ছেলে কৃতি। এই কৃতি অবধি জনকদের বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
.
উননব্বইতম অধ্যায়।
সূত বললেন–সোমের পিতা ঋষি অত্রি, সমস্ত লোকের মঙ্গলের জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন। শোনা যায় পুরাকালে তিন হাজার বছর পর্যন্ত অবিচল ভাবে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যা করেছিলেন। তিনি মহাবুদ্ধিশালী দ্বিজন্মা ছিলেন। তার দেহ সোমত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল। সেই মহাত্মার সোমত্ব ঊর্ধ্বদেশ আক্রমণ করে। তাঁর দুচোখ থেকে সোমস্রাব হতে থাকে।
তখন বিধাতার ইচ্ছায় দশ দিক্দেবী সোমকে গর্ভে ধারণ করেন। কিন্তু তারা গর্ভধারণ করে রাখতে পারলেন না। হঠাৎ সেই গর্ভ চারদিক আলোয় উদ্ভাসিত করে ধরায় এসে পড়ল। লোক পিতামহ তখন তাকে ওপরে স্থাপন করলেন। ঐ দেবরূপী সীতাংশু ধর্মিষ্ঠ এবং সত্য প্রতিজ্ঞ। সাদা রঙের হাজার ঘোড়া এঁর বাহন। মানসপুত্ররা লাগলেন।
এরপর সোম আরও তেজস্বী ও দীপ্তিময় হয়ে উঠলেন। তিনি ব্রহ্মার দেওয়া রথে চড়ে একুশবার বসুন্ধরাকে প্রদক্ষিণ করেন। তার তেজ, কিরণ পৃথিবীতে এসে পড়ল। পৃথিবী শয্যাশ্যামতা, হল প্রজারাও রক্ষা পেল। একমাত্র ভগবান সোমই জগতের পালন কর্তা। সেই চাঁদ তেজ লাভ করে বিধি অনুযায়ী কর্ম করে দশশত বর্ষ যাবৎ তপস্যা করেন। সোমদেব নিজকর্মগুণে প্রভু রূপে খ্যাতি লাভ করেন। ব্রহ্মা করে তাকে রাজ্য দান করেন।
দক্ষ প্রজাপতি নিজের সাতাশজন কন্যাকে চাঁদের কাছে সম্প্রদান করেন। এরা নক্ষত্র নামে প্রসিদ্ধ। সোম তখন মহারাজ্য পেয়ে একবার মূয়র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। এই যজ্ঞে ব্রহ্মা ব্রহ্মকর্মে নিযুক্ত এবং ভগবান নারায়ণ সদস্য হয়েছিলেন। এছাড়া সনৎ কুমার প্রভৃতি ঋষিরাও এসেছিলেন। শোনা যায় ঐ যজ্ঞে সোম ব্রহ্মর্ষি দেবকে দক্ষিণা স্বরূপ ত্রৈলোক্যই দান করেন। তিনি যজ্ঞের শেষে স্নান করে সমস্ত দেবতা, ঋষিদের দ্বারা পূজিত হলেন। তিনি রাজাধিরাজ হয়ে দশদিক উজ্জ্বল করলেন।
সেই সময় তিনি ঐশ্বর্য সন্মান লাভ করে দুর্বিনীত হয়ে উঠলেন। বৃহস্পতির স্ত্রী তারা দেবীকে তিনি হঠাৎ-ই হরণ করলেন। দেব দেবর্ষিরা অনেক প্রার্থনা করলেও তিনি তারাদেবীকে ফিরিয়ে দিলেন না। তারা হরণ উপলক্ষ্যে দেব-দানবদের মধ্যে ভয়ঙ্কর একযুদ্ধ বাধে। পিতামহ ব্রহ্মার শরণ গ্রহণ করেন সকলে। তখন তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হল, কিন্তু গর্ভবতী তারাকে বৃহস্পতি গৰ্ভত্যাগ করতে বললেন। কিন্তু তখনই এক কুমার আবির্ভূত হলেন। আগুনের মত তিনি দীপ্ত।
সেই ভগবান কুমার জন্মের সাথে সাথেই দেবতাদের দেহশ্রী হরণ করলেন, দেবতারা চিন্তিত হয়ে পুত্রের জন্ম পরিচয় বিষয়ে তারাকে জিজ্ঞাসা করল। ঐ কুমারটি চন্দ্রের না বৃহস্পতির, তারা দেবতাদের হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললেন–না। ব্রহ্মা স্বয়ং এসে জানতে চাইলেন। তখন তারাদেবী বললেন– এই মহাত্মা পুত্রটি চন্দ্রের।
দানশীল প্রজাপতি চন্দ্র তখন এই পুত্রকে বুধ নামে ডাকলেন। তখন বুধ পূর্বদিকে রওনা দিলেন। এই বুধ রাজপুত্রী ইলার গর্ভে এক পুত্র উৎপাদন করেন, সেই পুত্রের নাম পুরুরবা উর্বশীর গর্ভে দুই পুত্র হয়। চন্দ্র জোর করে বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে হরণ করেছিলেন বলে যক্ষারোগে তাঁর দেহ ক্ষীণ হয়ে যায়। তখন তিনি পিতা অত্রির শরণাপন্ন হন। অত্রি তখন তাকে শাপমুক্ত করেন। রোগমুক্ত হয়ে তাঁর, শোভা জ্যোতি বৃদ্ধি হয়।
.
নব্বইতম অধ্যায়
সোমের পুত্র বুধ। বুধের পুত্র তেজস্বী, প্রবল পরাক্রমী, দানশীল পুরুরবা। তিনি সাদী রূপে গুণে ত্রিলোকের শ্রেষ্ঠ, সুন্দরী ঊর্বশী গন্ধর্ব লোক ছেড়ে, দেবতাদের ত্যাগ করে এই নরপতিকেই পতিত্বে বরণ করেছিলেন। চৌষট্টি বছর তারা একসাথে বাস করেন। এঁরা দুজন কখনও চৈত্ররথ বনে, কখনও মন্দাকিনীর তীরে কখনও অলকায়, বা সুন্দর সুন্দর কাননে মিলিত হতেন। ঋষিরা তখন সূতকে জিজ্ঞাসা করলেন –ঊর্বশী অপ্সরা হয়ে কেন দেবতাদের ত্যাগ করে পুরুরবাকে বরণ করে নিল? সূত বললেন–ঊর্বশী ব্রহ্মার শাপে মানুষ রাজা পুরুরবার সেবা করেছিলো।
ঊর্বশী নিজের শাপমোচনের জন্য স্থির করলেন তিনি সব সময়ে শুধু ঘি খেয়ে থাকবেন। তাদের শয্যার পাশে দুটি মেষ থাকবে আর রাজাকে কখনো তিনি নগ্ন দেখবেন না, মৈথুন কাল ছাড়া। এই তিনটি নিয়ম সম্পর্কে রাজাকে সচেতন করলেন এবং নিয়ম ক্ষুণ্ণ না হওয়া অবধি তিনি রাজার কাছেই থাকবেন, এই প্রতিশ্রুতি দিলেন। এভাবে তারা চৌষট্টি বছর অনুরাগের সঙ্গে একত্র বাস করেন। কিন্তু এদিকে গন্ধর্বরা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। স্বর্গবাসী ঊর্বশী আবার দেবতাদের কাছে কিভাবে আসবেন, চিন্তা করলেন।
তাঁরা জানতে পারলেন উর্বশী পুরুবার সঙ্গে কোনো প্রতিশ্রুতির নিয়মে যুক্ত হয়ে আছেন, তখন তারা কৌশলে ঊর্বশীর তিনটি শর্তের বিঘ্ন ঘটালেন। তখনই ঊর্বশী তিরোধান করলেন। রাজা মনের দুঃখে সমস্ত পৃথিবী উর্বশীর খোঁজে পরিভ্রমণ করতে লাগলেন। কত বন, নদীতীর, নানা উপনিবেশ, গিরিগুহা ও ঝর্ণা, নানা নগরে নগরে ঘুরে ঘুরে সকলের কাছে ঊর্বশীর খোঁজ করতে লাগলেন। দুঃখে কাতর হয়ে ঊর্বশীকে উদ্দেশ্য করে আপন মনে মনঃস্তাপ করে বলতে লাগলেন–আমি নির্বোধ, আমায় তুমি দেখছো না কেন? আমার এই অবস্থায় তুমি কোথায় রয়েছে বিরোধ করে? তোমার এরকম জীবনকে আমি ধিক্কার দিই।
তারপর একসময় রাজা দেখলেন প্লতীর্থের এক সরোবরে উর্বশী সখীদের সঙ্গে জলক্রীড়া করছেন। ঊর্বশী দূর থেকে রাজাকে দেখে সখীদের বললেন–ঐ যে পুরুষোত্তম রাজা, যার সঙ্গে আমি বাস করেছিলাম। রাজাও তখন কাতর হয়ে ঊর্বশীকে আহ্বান করতে লাগলেন। দুজনে লুকিয়ে দেখা করলেন। ঊর্বশী জানালেন–আমি আপনার দ্বারা গর্ভবতী হয়েছি, কিছুদিন পর আমার নিশ্চয়ই এক কুমার উৎপন্ন হবে। আপনি আমার জন্য শোক করবেন না। রাজা ঊর্বশীর সঙ্গে একটা দিন কাটিয়ে নিজ ভবনে চলে গেলেন।
কিন্তু এক বৎসর কেটে গেলে রাজা একদিন বললেন–তুমি আমার সঙ্গে সবসময়ই থাক। ঊর্বশী জানালেন, এ বিষয়ে গন্ধর্বদের জানাতে হবে আর তাদের কাছ থেকে এ জন্য সম্মতি লাভ করতে হবে। কারণ আমাকে চিরকাল গন্ধব লোকেই বাস করতে হবে। রাজা গন্ধর্বদের কাছে বর চাইলে তার, তথাস্তু বলে অনুমতি দিলেন। কাঠের মধ্যে আগুন ছুঁড়ে দিয়ে রাজা ঊর্বশীর গর্ভজাত কুমারকে নিয়ে নিজের নগরের দিকে চললেন, তখন দেখলেন সামনে একটি অশ্বত্থ গাছ জ্বলছে। একথা গন্ধর্বদের জানালে তার পুরুরবাকে অশ্বত্থ গাছের কাঠের আগুনে যজ্ঞ করতে বললেন, তাহলে রাজা গন্ধর্বলোকে প্রতিষ্ঠা পাবেন। তারপর পুরুরবা সেই অগ্নিকে তিনভাগ করলেন।
ইলানন্দন রাজা পুরুরবা যুমনার উত্তর তীরে প্রয়াগে রাজত্ব করতেন। তার তেজস্বী ছয় পুত্র জন্মে। এই পুত্রেরা সকলেই গন্ধর্বলোকে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এদের নাম আয়ু, কিম্বায়ু, অমাবসু, শতায়ু, ও গতায়ু ইত্যাদি এরা ঊর্বশীর গর্ভজাত। এদের মধ্যে অমাবসুর পুত্র রাজা ভীম। ইনি বিশ্ববিজয়ী। ভীমের পুত্র শ্রীমান কাঞ্চনপ্রভু, তাঁর পুত্র সুহোত্র। ইনি বিদ্বান ও মহাবল ছিলেন। সুহোত্র, থেকে কোশিকীয় গর্ভে জ জন্মগ্রহণ করেন।
এই জহ্নু একসময় যজ্ঞ করছিলেন, সেই সময় হঠাৎ গঙ্গা যজ্ঞভূমি প্লাবিত করে দেয়, জন্তু প্রচণ্ড রেগে গিয়ে গঙ্গাকে বলেন, তোমার সমস্ত জল ব্যর্থ হবে। তোমার এই গর্বিত ব্যবহারে ফল এখনই পাবে তুমি, তোমার সমস্ত জল আমি পান করব। গঙ্গাকে পান করছেন দেখে মহাভাগ দেবর্ষি গঙ্গাকে জাহ্নবী নামে তাঁর কন্যারূপে উপহার দিলেন। জহ্ন কাবেরীর পানি গ্রহণ করেন।
গঙ্গা আবার নিজরূপ ফিরে পায়। জহ্ন কাবেরীর গর্ভে সুহোত্র নামে এক ধার্মিক পুত্র উৎপাদন করেন। সুহোত্রের পুত্র অজপ, তার পুত্র মহাযোগ বলাকাম্ব। বলাকাম্বের তিন পুত্র গয়, শীল, কুশ। কুশের চার পুত্র। কুশাম্ব, কুশনাভ, অমূতাঁরয়া ও বসু। রাজশ্রেষ্ঠ কুশাম্ব পুত্রার্থী হয়ে বহুবর্ষ তপস্যা করেন। তপস্যায় শেষে শতক্রতু সাক্ষাৎ আবির্ভূত হন। আর নিজেকে কুশাম্বের পুত্র রূপে কল্পনা করেন।
সুহোত্রের পুত্র গাধি ও কৌশিক। গাধির কন্যা সুন্দরী সত্যবতাঁকে ঋচীকের হাতে সম্প্রদান করেন। এই সত্যবতীর গর্ভে ভৃগুনন্দন জমদগ্নি জন্ম গ্রহণ করেন। সত্যবতীর স্বামী ঋচীক চরু প্রস্তুত করে বললেন– তুমি, তোমার মা এই চরু খেয়ে ফেল। এর ফলে তোমার মার গর্ভে তেজস্বী ক্ষত্রিয় জন্মগ্রহণ করবেন। তোমারও এক ধৃতিমান, দ্বিজশ্রেষ্ঠ পুত্র জন্মাবে। এরপর গাধি রাজা সপরিবারে ঋচীকের আশ্রমে এলেন, তখন কন্যা সত্যবতী মাতাকে ঋচীকের কথা জানালে, দুজনে দৈবক্রমে পরস্পর পরস্পরের চরু খেয়ে ফেলেন।
ঋচিক সমস্ত কথা জানতে পেরে সত্যবতাঁকে বললেন–তোমার মার দ্বারা তুমি প্রতারিত হয়েছে। তোমার ক্রুর কর্ম। অতি দারুণ এক পুত্র জন্মাবে। তোমার মায়ের গর্ভে তপোধন, ঋষি জন্ম নেবেন। কারণ তোমার মায়ের ভক্ষিত চরুতে আমি তপোবলে সমস্ত ব্ৰহ্ম গুণ নিহিত করেছি।
সত্যবতী শুনে বললেন–হে মুনে! আপনি ইচ্ছে করলে সমস্ত লোকই সৃজন করতে পারেন, তাতে পুত্র উৎপাদন করবেন এই কথা আর বেশি কি? আপনি আমাকে সরল বুদ্ধি পুত্র দান করুন। পুত্র সম্বন্ধে আমার প্রতি আপনি অন্য ব্যবস্থা করবেন না। ঋচীক বললেন–তুমি যা বলছো, তাই হবে। অর্থাৎ পুত্র হবে তপোধন আর পৌত্র প্রচণ্ড কর্ম। এরপর সত্যবতী ভার্গব জমদগ্নিকে লাভ করলেন আর গাধিরাজার পুত্র হন বিশ্বামিত্র মুনি। পুণ্যবতী সত্যবতী মহানদী কৌশিকী নামে বিখ্যাত হয়ে
পুরাকালে ঈক্ষাকুবংশে সুবেনু নামে এক রাজা ছিলেন। তার কন্যার নাম কামলী রেণুকা, জমদগ্নি ঐ কামলী রেণুকার গর্ভে পরশুরামকে পুত্ররূপে উৎপাদন করে। ঐ পুত্র সমস্ত বিদ্যায় পারঙ্গম, ধনুর্বেদে পারদর্শী। ঋচীক ও সত্যবতীর প্রথম পুত্র জমদগ্নি। মধ্যম পুত্র শুনঃশেফ এবং কনিষ্ঠ পুত্র শুনঃপুচ্ছ। কৌশিক থেকে ভৃগুর প্রসাদে মহাত্মা বিশ্বমিত্রের জন্ম হয়। ইনি বিশ্বরথ নামেও বিখ্যাত। কৌশিক বংশের মহাত্মাদের বহু গোত্র বিখ্যাত। পার্থিব, দেবরাত, সমর্ধন, উদুম্বর, উদুম্নান, অরক, লৌহিণ্য, রেণু, কারীষু ইত্যাদি এইসব বিশ্বামিত্র গোত্র।
বিশ্বমিত্র থেকে দৃষদ্বতীর গর্ভে অষ্টক নামে এক পুত্র হয়। ঋষিরা জিজ্ঞাসা করলেন –বিশ্বামিত্র ইত্যাদি নরপতিরা কি কি লক্ষণ ধর্ম, তপস্যা বা শাস্ত্র জ্ঞানে ব্রাহ্মণত্ত্ব পেয়েছিলেন? সূত বললেন– ব্রাহ্মণদের অন্যায়ভাবে উপার্জিত দ্রব্য দান পেয়ে যে ধর্ম লাভের জন্য যজ্ঞ করে তার ধর্মফল লাভ হয় না। যে গর্ব করে ব্রাহ্মণদের দান করে, তার দান ও নিষ্ফল হয়। ধন ঐশ্বর্য লাভ করার জন্য যে জপ সাধনা করে, তার দেওয়া সমস্ত দানই নিষ্ফল হয়। হিংস্র প্রকৃতির লোকেরা ধর্ম, করার ইচ্ছাতে দান বা যজ্ঞ করেন, তাদেরও সাফল্য লাভ ঘটে না। কোন কামনা না করে সত্তাবে উপার্জিত অর্থ যে সৎপাত্রে দান করেই সুখ, স্পর্ধা লাভ হয়, বিশ্বামিত্র তপোবনেই ঋষিত্ব পান।