ভাগবত পুরাণ – ০১ম স্কন্ধ

ভাগবত পুরাণ (পৃথ্বীরাজ সেন)
প্রথম স্কন্ধ
প্রথম অধ্যায়

মহামুনি বেদব্যাস বিভিন্ন পুরাণ শাস্ত্র রচনা করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যেন তৃপ্ত হতে পারেননি। ঠিক সেইসময় মহান দেবর্ষি নারদের উপদেশ তিনি লাভ করলেন। যার দরুণ তিনি শ্রীমদ ভাগবত শাস্ত্র প্রণয়ন করতে চাইলেন। এই গ্রন্থে শ্রীভগবান-এর সমস্ত গুণ বর্ণনা করা হয়েছে।

এই শাস্ত্র তিনি যখন প্রণয়ন করতে চলেছেন, তখন তিনি এইরূপে মঙ্গলাচরণ করেছেন

যা থেকে এই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে, যাতে স্থিতি ও লয়, তেজ, বারি এবং মৃত্তিকার মতো পদার্থের বিনিময়, সেই ধরনের যে ভাগবত স্বরূপে তম, রজ এবং সত্ত্ব গুণের কার্যাদি সত্যের মতোই পতিত হয়, যিনি স্বয়ং অভিজ্ঞ এবং স্বরাট, যে বেদে দৈবগণ স্বয়ং বিমোহিত হয়ে যান, যে বেদ যিনি আদি কবি ব্রহ্মার হৃদয় পদ্মে প্রকাশ করেছিলেন, নিজের তেজের দ্বারা সবসময় যাতে কুহক নিরস্ত হয়ে রয়েছে, সেই সত্য স্বরূপ স্বয়ং পরমেশ্বরকে আমরা নিয়ত ধ্যান করে থাকি।

মহামুনি বেদব্যাস রচিত শ্রীমদভাগবত গ্রন্থে ঈর্ষাশূন্য সাধুদের ঈশ্বর আরাধনার সমস্ত ধর্ম নিরূপিত হয়েছে। এই বর্ণিত ঈশ্বর আরাধনা রূপ গ্রন্থে ধর্মের তিনটি দিক আছে। আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক এবং আধিভৌতিক। যা পরম মঙ্গল দান করে, সেই বাস্তব বস্তু এখান থেকে জানা যায়। শ্রীমদভাগবত যে গ্রন্থটি সেটি বেদরূপ কল্পবৃক্ষের গলিত ফল। সেই গলিত ফলই শুকদেবের মুখ থেকে পতিত হয়ে পড়েছে পৃথিবীতে। হে রসিক পাঠকগণ, আপনারা অমৃত দ্রব সংযুক্তা এই রসময় ফল রূপ বেদবারি শ্রবণের পরেও বারংবার পান করতে চাইবেন।

বিষ্ণুক্ষেত্র–যার নাম নৈমিষারণ্য, সেই অরণ্যে শৌণক প্রমুখ ঋষিরা সহস্র বছর যাবৎ একটি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে চলেছিলেন। এই রকমই যজ্ঞের অনুষ্ঠান চলাকালীন একদিন শৌণক প্রভৃতি ঋষিরা প্রাতঃকালে নিত্য নৈমিত্তিক হোম সমাপণ করেছেন। এমন সময় সেখানে রোমহর্ষণের পুত্র সূত এলে ঋষিগণ তাঁকে বসতে আসন দিলেন। সেই ঋষিরা সূতকে সাদরে আপ্যায়ণ করে জিজ্ঞাসাও করলেন–হে সূত, তুমি পবিত্র মহাভারত আদি ইত্যাদি ইতিহাস ধর্মশাস্ত্রগুলি অধ্যয়ন করেছ। যে সমস্ত বেদ বিদ্ৰা রয়েছে, তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভগবান বেদব্যাস এবং অন্যান্য সগুণ ও নিগুর্ণ সমস্ত তত্ত্ববিদ মুনিরা যা জানেন, হে সৌম্য তুমি স্বয়ং সেই তত্ত্ববিদ মুনিদের অনুগ্রহেই সব জানতে পেরেছ। কারণ হিসাবে বলা যায় সমস্ত গুরুরাই তাঁদের প্রিয় শিষ্যের কাছে সমস্ত গোপনীয় তত্ত্ব অনায়াসে ব্যক্ত করেন। হে আয়ুষ্মন, যে সমস্ত অর্থবোধক রাজ্য রয়েছে তাদের মধ্যে কলি ভাবাপন্ন মানুষের যে সমস্ত মঙ্গলময় বলে তুমি মনে করছ তার সব কিছুই আমাদের কাছে বল,

হে সভ্য তুমিতো জানোই বর্তমান এই কলিযুগে মানুষের আয়ু তো ক্রমশ কমেই আসছে। দিনে দিনে মানুষ ক্রমশ অলস এবং অল্প বুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে উঠেছে। ফল স্বরূপ নানা রোগ তাদেরকে দিনে দিনে আক্রমণ করে চলেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন শাস্ত্র, বিভিন্ন কর্ম এবং তাদের শ্রবণের বিষয়েও বিবিধ কথা বলা হয়েছে। হে সুজন, আগে উল্লিখিত বিষয়গুলির মধ্যে যা সার বস্তু, সমস্ত মানুষদের কাছে যা কাঙ্খিত, তুমি তার সমস্ত কিছুই ব্যক্ত কর। হে সূত, ভগবান তোমার সদাই মঙ্গল করুক। সমস্ত ভক্তগণদের পালক পিতা স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু যে কাজ করবার জন্য বসুদেবের পত্নী এবং কংসের প্রিয় ভগিনী দেবকীর গর্ভে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়।

এই মায়াময় ঘোর সংসার প্রবাহে পতিত সমস্ত মানুষ বিবশের বশীভূত হয়েও যার নাম উচ্চারণ করলে সমস্ত ভয় থেকে মুক্তি লাভ করে, যে ভগবানের পাদরূপ পদ্মশ্রিত প্রসন্নচেতা মুনিরা তাদের চরণ প্রান্তে উপনীত সমস্ত জনগণকে দর্শনমাত্র পবিত্র করেন, সঙ্গাদি পুণ্যবারিযুক্ত নদী তীর্থ বারবার স্নানের দ্বারা তাদের পবিত্র করে থাকেন, উচ্চারিত যত পুণ্য শ্লোকসমূহ, প্রশংসিত কর্ম সেই ভগবানের কলুষতা বিনাশক, যশ, শুদ্ধি, কাম সমূহ কোন্ ব্যক্তি না শ্রবণ, করতে ইচ্ছুক?

মানব সমাজের কল্যাণার্থে স্বেচ্ছায় যে ভগবান নারায়ণ অবতার মূর্তি ধারণ করেন, সেই শ্রীকৃষ্ণের লীলাকাহিনি নারদ প্রভৃতি ঋষিগণ কর্তৃক পরিগীত উদার কর্মসমূহ শুনতে শ্রদ্ধাশীল আমরা, আমাদের কাছে তুমি কর্মসমূহের বর্ণনা কর। হে ধীমান, যিনি নিজ মায়ারূপ লীলার দ্বারা নিজের ইচ্ছায় সৃষ্টাদি কর্ম এবং ভূ-ভার হরণরূপ লীলা করে থাকেন, সেই ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মঙ্গলময় মৎস্যাদি দশটি অবতার সকলের কথাও আমাদের কাছে বর্ণনা কর। আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ লীলা শ্রবণে কখনই উদাসীন হই না। এই শ্রীকৃষ্ণ লীলা শ্রবণে রসিককুলের অন্তরে ক্ষণে ক্ষণে মধুর থেকে মধুরতর অনুভূতির আবির্ভাব ঘটতে থাকে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার বিভিন্ন অবতার লীলায় নিজেকে আত্মগোপন করে মানুষের দেহ ধারণ করেছেন। তিনি তার ভ্রাতা রূপে আবির্ভূত বলরামের সাথে অলৌকিক কার্য সমূহও সম্পাদন করেছেন। তুমি তা আমাদের কাছে ব্যক্ত কর। কলিকাল আগত প্রায় জেনে তার ভয়ে দীর্ঘকাল সাধ্য যজ্ঞের ছলে ঐ বৈষ্ণব ক্ষেত্র যাতে আমরা কলির কথা শ্রবণ করার অবসর পেয়েছি। যারা মহাসমুদ্র পার করবার জন্য ইচ্ছুক বা প্রস্তুত সেই সব মানুষের কাছে এই শাস্ত্র মাঝির মতো, যা জীবদের বিচার করার বুদ্ধি বিনষ্ট করে সেই বিনষ্টকারী কলিরূপ দুস্তর সমুদ্র পার হতে আমরা ইচ্ছুক। তাই তো বোধ হয় তোমাকে কর্ণের ন্যায় বীর করে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। সমস্ত ব্রাহ্মণগণের পরিপালক, পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের রক্ষক, সমস্ত যজ্ঞের ঈশ্বর স্বরূপ শ্রীবিষ্ণু এক্ষণে স্বধামে গমন করেছেন। তাহলে এক্ষণে ধর্ম কাকে আশ্রয় করে আবর্তিত হচ্ছে? হে মহাত্মা, তুমি তা আমাদের সবার নিকট বর্ণনা কর।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়
ভগবানদের কথন ও ভক্তির যে মাহাত্ম তার

সমস্ত ঋষিদের প্রশ্নে পরিতুষ্ট হয়ে রোমহর্ষণ পুত্র সূত তাদের সুবাক্যে অভিনন্দিত করে ঋষিগণকে বলতে শুরু করলেন–

এই পৃথিবীতে যার কোনও কর্ম নেই, যিনি পুত্রের বিরহে একাকী সন্ন্যাসী হয়ে অনবরত গমনরত, সেই ঋষি বিরহ কাতর কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস ‘হা পুত্র’ বলে যে মুনির অনবরত অনুগমন করে চলেছেন, যিনি পৃথিবীর সমস্ত প্রাণের হৃদয়ে অবস্থিতির জন্য বৃক্ষরূপ ধারণ করে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, যিনি সেই বক্তা মুনি শুকদেবকে আমি প্রণাম করছি। যে সমস্ত মানুষ গাঢ় অন্ধকারময় সংসার রূপ ভবসাগর পার হতে চায়, সেই সমস্ত উগ্রশ্রবা সংসারী জনগণের প্রতি কৃপা দেখিয়ে যে অতি গোপনীয় শ্রী ভগবত পুরাণ বলেছেন। মুনিদের মধ্যে মহামুনি, সমস্ত গুণীদের মধ্যে যিনি মহাগুণী, সেই শুকদেবকে আমি সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাচ্ছি। যে পবিত্র অমূল্য গ্রন্থ যা প্রভাব অতুলনীয়, অসাধারণ প্রভাবে যা পরিপূর্ণ, যা সমস্ত শ্রুতির সারবস্তু, যার তুলনীয় গ্রন্থ আর কিছু নাই, বলা যায় যা এক এবং অদ্বিতীয়, যা অধ্যাত্ম তত্ত্ব মূলক সমস্ত বিষয়ের প্রকাশক, সেই অমূল্য পবিত্র গ্রন্থ যিনি বর্তমানে আমি উচ্চারণ করব। হে নারায়ণ নর, সমস্ত নরদের মধ্যে উত্তম, দেবী, সরস্বতী মহর্ষি বেদব্যাসকে নমস্কার জানিয়ে এই মায়াময় সমস্ত বিশ্বসংসার জয় করতে পারা যায় এবং অন্ধকারত্বের মূল কারণ স্বরূপ সংসারের মায়াময় দুঃখ, সমস্ত কষ্ট হরণ করতে পারা যায় এমন পবিত্র অমূল্য বিশ্বজগতের এমন গ্রন্থ পাঠ করবেন।

হে মুনিগণ, আপনাদের এই সুন্দর শান্তিদায়ক পূর্ণ প্রশ্নে আমার চিত্ত সত্যিই বিমোহিত হয়েছে। আপনি আমাকে শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক প্রশ্ন করেছেন। কোনো ইন্দ্রিয় দ্বারাই স্পর্শ যোগ্য নয় সেই অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব শ্রীভগবানের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করাই সংসারের জীবমাত্রের সবার বা সমস্ত জীবের পরম ধর্ম, এই ভক্তিকে প্রতিহত করা যায় না, এরূপ ভগবানের প্রতি ভক্তির দ্বারাই আত্মার সম্যকভাবে প্রসন্নতা লাভ হয়। ভগবান বাসুদেবের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করলে জীব সমাজের বৈরাগ্য এবং অহেতুক জ্ঞানের সঞ্চার ঘটে। সমস্ত ধর্ম প্রথম থেকে সুষ্ঠরূপে অনুষ্ঠিত হলেও যদি কৃষ্ণের কথা শুনে ভক্তগণের ভক্তি উৎপন্ন না হয়ে থাকে, তাহলে সেটাকে বলা চলে পন্ডশ্রম। কোন কিছুর প্রতি প্রবৃত্তি এবং কোন কিছু থেকে নিবৃত্তিকে বলা যায় ধর্মের ফল। ভোগের ফল বলতে শুধু ইন্দ্রিয় সমূহকে চরিতার্থ করা বোঝায় না বা, সমস্ত ইন্দ্রিয় উপভূক্ত নয়। এক্ষেত্রে বলা যায়, যে বা যতটুকু ছাড়া জীবন ধারণ করা সম্ভব নয় ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করতে হবে এর অতিরিক্ত অগ্রহণযোগ্য।

সমস্ত তত্ত্ববিদরা তাকেই তত্ত্ব বলে থাকেন, যা অদ্বিতীয় যা একক জ্ঞান। এই অদ্বয় জ্ঞানের স্বরূপকে ব্রহ্ম পরমাত্মা বলা হয়ে থাকে। জগতের সমস্ত শ্রদ্ধাশীল মুনিরা বেদ সমূহের শেষভাগ যা বেদান্ত নামে পরিচিত তারা তা শ্রবণের দ্বারা পরম আনন্দরূপ জ্ঞান প্রাপ্ত হন। সেই পরমব্রহ্মরূপ আনন্দরূপ জ্ঞান লাভ করে মুনিরা বৈরাগ্যযুক্ত প্রেমলক্ষণ রূপ ভক্তি দ্বারা তাদের পবিত্র বা বিশুদ্ধ হৃদয় দ্বারা পরম শুদ্ধ পরম আত্মাকে স্বয়ং প্রত্যক্ষ করে থাকেন।

সমস্ত শ্রদ্ধেয় দ্বিজদের মধ্যে পরম শ্রদ্ধেয় শ্রেষ্ঠ দ্বিজগণ, বিভিন্ন বর্ণ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন যে ধর্ম বিভিন্ন আশ্রম অনুসারে অনুষ্ঠিত ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের যে প্রয়োগ করেন তা হল কিন্তু আসলে কলির আরাধনা করা। পরম সংযমের দ্বারা মনকে একত্র করে সমস্ত জগত সংসারের ভক্তগণের প্রতিপালক ভগবানের কথাই শুধু শ্রবণ করুন। ভগবানের রূপ কীর্তন গানে সমস্ত জগতের বাতাস মুখরিত হোক। যে পরমদেব যার অনুধ্যান অর্থাৎ চিন্তামাত্র বিবেকীগণ অহংকারের দরুন উত্থিত কর্ম গ্রন্থি করে থাকেন, তাঁর কথা শুনতে কে না আগ্রহী, বলা বাহুল্য তার গুণ কীর্তন শুনতে সবাহ-ই আগ্রহী হন।

হে মহান আত্মারা, হে বিপ্রগণ, পুণ্য তীর্থে গমন করলে মহতের সেবা করার পরম সৌভাগ্য হয়, কিন্তু আবার মহৎ সেবার দ্বারা ভগবানের উপাসনায় শ্রদ্ধার জন্ম মানুষের শরীরে হয়ে থাকে। এই শ্রদ্ধার থেকে জন্ম নেয় ভাগবত কথা শ্রবণের ইচ্ছা এইভাবেই মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ যা সীমাহীন। সুতরাং ভগবানের গুণ কীর্তন ও তাঁর কথা শ্রবণ করাই হল আমাদের ন্যায় অজ্ঞানের কাছে পুণ্যের কাজ। সমস্ত জগতের সৎ যে মানুষজন তাদের সুহৃদ শ্রীকৃষ্ণ। তার আত্মকথা যারা শ্রবণ করে, তিনি সেই জনগণের হৃদয়ে প্রবিষ্ট হন। তিনি অকৃত বা কৃত সব অমঙ্গল বিধৌত করেন, নিত্য ভাগবত সেবার দ্বারা হৃদয়ের অদৃষ্ট পাপসমূহকে বিনষ্ট করা যায়। শ্রীকৃষ্ণের বর্ণনা মূলক বা স্তবমূলক উত্তম শ্লোকগুলির উচ্চারণ মাত্র শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্তির উদয় করে। সত্ত্ব, রজ, তম প্রভৃতি গুণ সমূহ থেকে যে কামের উদ্বুদ্ধিকরণ ঘটে তার দ্বারা লোভে আবিষ্ট চিত্তকে আর আকড়ে ধরে রাখতে পারে না। চিত্ত স্বত্তগুণে স্থিত থেকে প্রসন্নিত হয়, এইরকমভাবে ভগবানের প্রতি ভক্তি করতে করতে মন চিরকালীন আহ্লাদিত হয়। মানসিক সংযমের আবেশ ঘটে ফলস্বরূপ সকল বিষয়ের প্রতি সমস্ত রকম আসক্তি চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। সংযমের ফলে ত্যাগের ফলে পবিত্র সেই মানুষের ভগবত স্বরূপের সাক্ষাৎকার হয়ে থাকে। সেই পরমাত্মা ঈশ্বর যখন দৃষ্টি গোচর হয়ে যান তখন মানুষের হৃদয়ের সমস্ত গ্রন্থিসমূহের বিনাশ সাধন ঘটে। পরম আস্থা বা বিশ্বাসের আগমন ঘটার দরুন পাপ জনিত সকল সংশয়ের অবসান ঘটে। এতদিন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া জীবের সকল কর্মসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সুতরাং হে মনীষীগণ, ভগবান বাসুদেবের পরম পবিত্র শ্লোক উচ্চারণ করুন।

প্রকৃতিতে মোট তিনটি গুণ রয়েছে, সেগুলি হল, সত্ত্ব, তম এবং রজঃ। এই তিনটি গুণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরম পুরুষ এই বিশ্বের সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মাকে, স্থিতি রক্ষার জন্য বিষ্ণুর এবং প্রলয়ের জন্য মহেশ্বর-এর নাম ধারণ করেছেন। এই গুণ তিনটির মধ্যে সত্ত্ব গুণ শ্রী বাসুদেবের হাতেই সমর্পিত হয়েছে। শ্রীবিষ্ণু সকল জীবের মঙ্গল সাধন করে থাকেন। এই রূপ দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের জ্ঞান হয় যে, প্রবৃত্তিরূপ প্রকাশ যদি রহিত হয়, পার্থিব কার্যের থেকে ধূম শ্রেষ্ঠ হয়, ধূম থেকে প্রকাশ স্বভাব যে শ্রীময়, অগ্নি সে শ্রেষ্ঠ! কাঠের কিন্তু চলন শক্তিও নেই আবার তার প্রকাশ শক্তিও নেই। তাইতো গমনশীল ধর্মকে কাঠের থেকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। কিন্তু আবার ধূম অপেক্ষা অগ্নি শ্রেষ্ঠ কেননা অগ্নি স্বভাবতই ঊর্ধ্বে গতিশীল ও প্রকাশ করা তার বৈশিষ্ট। সেই অগ্নির দ্বারাই আমরা বেদে উক্ত যজ্ঞাদি সমস্ত কার্যসমূহ সম্পাদন করে থাকি। প্রথমে উল্লিখিত দৃষ্টান্তের ন্যায় জয়শীল তমঃগুণের থেকে ক্রিয়াশীল রজঃগুণ শ্রেষ্ঠ। আবার এদের থেকেও শ্রেষ্ঠ হচ্ছে সত্ত্বগুণ। সব থেকে শ্রেষ্ঠ সত্ত্বগুণের দ্বারাই ব্রহ্মদর্শন মানুষের হয়ে থাকে।

অতীতে বিভিন্ন পুণ্যাত্মা মুনিরা বিশুদ্ধ যে সত্ত্ব মূর্তি অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব ভগবান বাসুদেবকেই ভজন করতেন। বর্তমান যুগে যে সমস্ত মানুষ সেই পুণ্যাত্মা মুনিদের পথকে অনুসরণ করে ভগবান বাসুদেবের ভজন করে থাকেন। যাঁরা মোক্ষ লাভ করতে চান। তারা নারায়ণের অবতার মূর্তিকেই চিরন্তন সেবা করবেন। তার মানে এই নয় যে বিষ্ণু বাদে অন্যান্য দেবতাদের আপনারা নিন্দা করবেন। মানুষের মধ্যে যারা রজঃ এবং তমঃ প্রকৃতির তারা স্ত্রী ও পুত্র কামনায় এমনকি ঐশ্বর্যের কামনায় রজঃ ও তমঃ গুণের স্বভাব যুক্ত পিতৃলোক, ভূত ও প্রজাপতির সেবা করে থাকেন। সমস্ত বেদের উপর বাসুদেব প্রত্যক্ষ ভাবে এবং পরম্পরাগত ভাবে বাসুদেবকেই বোঝানো হয়েছে। এই সমস্ত যে যজ্ঞ যোগ নিত্য নৈমিত্তিক আদি ক্রিয়া রূপ যে জ্ঞান, যে সব তপস্যারূপ ধর্ম এবং তারপর কর্ম ফল এই সব কিছুর তাৎপর্য হলেন ভগবান বাসুদেব।

বাসুদেব স্বয়ং সমস্ত গুণের অতীত অর্থাৎ নিগুণ হয়েও এই বাসুদেব ভগবান সদ্ এবং অসদরূপ ত্রিগুণময়ী, নিজ মায়ার দ্বারা আগেই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন। ভগবান, তার নিজ মায়ার দ্বারা উদ্ভূত আকাশাদি কার্যে অন্তর্যামী রূপে প্রবিষ্ট হয়ে রয়েছেন। তাইত তাকে সত্ত্ব প্রভৃতি গুণ যুক্ত বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে তিনি কোনরকমভাবেই গুণযুক্তা নন, কারণ, তিনি স্বীয় চিৎশক্তির দ্বারা সদাই সমস্ত বিশ্বে পরিপূর্ণ। একবার আগুন ধরানো হলে তা বিভিন্ন কাঠে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পেলে তাকে আমরা বহু বলে মনেও করতে পারি, এক বিষাত্মা সকলের অন্তর্যামী পরমেশ্বর সকল প্রাণীতে অবস্থিত বলে তাকে বহু বলে মনে করে থাকি আমরা।

সে পরমাত্মা পবিত্র, সমস্ত বিশ্বের আধার রূপ সে ভগবান সূক্ষ্ম এবং স্থূল কারণাত্মক গুণময়। অর্থাৎ নিজে মায়ার দ্বারা রচিত ভাবের দ্বারা নিজের ইচ্ছায় সৃষ্ট চতুর্বিধ প্রাণীতে নিবিষ্ট হয়ে বৈষয়িক সুখ ও দুঃখ ইত্যাদি তিনি ভাগ করে থাকেন। সেই ভগবান দেব, তির্যক এবং নরাদিদের লীলাবশত সেই সকল অপরূপ অদ্ভুত সব অবতার মূর্তি ধারণ করেন। সেই পরমাত্মা ভগবান সে সকল অবতার মূর্তিতে অনুরক্ত হয়ে সত্ত্বগুণের দ্বারা সমস্ত লোককে পালন করে থাকেন। কারণ তিনিই হলেন সমস্ত সংসার জগতের মূল। তথা তিনিই সমস্ত লোকের সৃষ্টিকর্তা।

.

তৃতীয় অধ্যায়
ভগবানের চতুর্বিংশতি অবতারের বর্ণনা

এর সঙ্গে সূত বিশ্বসৃষ্টির কারণ হিসাবে আরও বলে চললেন,– ভগবান প্রথমে বিশ্ব সৃষ্টি করতে গিয়ে প্রথম পুরুষরূপে বিরাট বিগ্রহ রূপ ধারণ করেছিলেন। এই বিরাট বিগ্রহ মূর্তি মহত্ব অহংকার দ্বারা গঠিত। এই বিরাট মূর্তির একাদশটি ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চ মহাভূতের ষোলোটি অংশ ছিল। প্রলয়ের সময় সমুদ্রের গভীরে শয়ন করে যোগ নিদ্রায় সেই একাদশ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট বিরাট পুরুষ নিদ্রিত অবস্থায় ছিলেন। সেই বিরাট পুরুষের নাভিরূপ হ্রদে উৎপন্ন পদ্ম থেকে ব্রহ্মদেব আবির্ভূত হন। যিনি সমস্ত বিশ্বের সৃষ্টিকর্তাদের অধিপতি। এই বিরাট পুরুষরূপ বিষ্ণুর চরণাদি সন্নিবেশের দ্বারা বিশ্ব প্রপঞ্চ নির্মিত হয়েছে। তার এই শায়িত বিরাট একাদশ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট মূর্তি বিশুদ্ধ সত্ত্ব গুণ বিশিষ্ট। অর্থাৎ তম এবং রজঃ গুণ থেকে সম্পর্ক শুন্য। এই পরম আশ্চর্য বিরাট পুরুষরূপ মূর্তিটিই হল ভগবানের আসল রূপ।

এই ভগবানের বিরাট পুরুষ রূপ দর্শন করা সাধারণ দৃষ্টি দিয়ে সম্ভব নয়। এরজন্য জ্ঞান দৃষ্টি প্রয়োজন। আর মুনিগণ সেই জ্ঞান দৃষ্টি দ্বারা ভগবানের সেই বিরাট পুরুষ রূপ দর্শন করে থাকেন। এই মূর্তির অসংখ্য চরণ রয়েছে, উরু, আনন, মশুক, কর্ণ, চক্ষু ও নাসিকা রয়েছে। এর সাথে মুকুট বস্ত্র ও কুন্ডলের সম্পর্ক আছে। ভগবানের এই বিরাট পুরুষ রূপ হল নারায়ণ ভগবানের আদিরূপ, এই একাদশ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট বিরাট পুরুষ বিষ্ণুর নানা অবতারের আশ্রয় স্থান এবং অক্ষয় বীজ স্বরূপ। এই নারায়ণের বিরাট রূপী পুরুষ থেকেই বা তার অংশ থেকে সমস্ত দেবতা, তির্যক জাতি এবং মানুষের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রথম পুরুষ অবতারে কৌমার নামক সৃষ্টিতে ভগবান ব্রহ্মারূপ ধারণ পূর্বক অত্যন্ত দুষ্কর ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন।

দ্বিতীয় অবতার হল তার বরাহ অবতার। প্রলয় উপস্থিত হলে তিনি বরাহরূপ ধারণ করে পৃথিবীকে তার দন্তে স্থাপন করে রক্ষা করেছিলেন। তৃতীয় অবতার হয়ে ঋষিসর্গে দেবর্ষি নারদ হয়ে বৈষ্ণব তন্ত্রের বর্ণনা দেন। বৈষ্ণব তন্ত্র হল এমন একটি শাস্ত্র, যা পাঠ করলে সমস্ত মানুষ এই লোকের সমস্ত রকম কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। চতুর্থ অবতারে তিনি ধর্মপত্নীর গর্ভে নর ও নারায়ণ নামে দুজন ঋষি হয়ে জন্মান এবং অত্যন্ত কঠোর তপস্যা করেন যা সবার পক্ষে দুষ্কর। সিদ্ধ পুরুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কপিল রূপ হল ভগবান বিষ্ণুর পঞ্চম অবতার। এই অবতারে তিনি আসুরি নামক ব্রাহ্মণকে সাংখ্য শাস্ত্র বলেছিলেন। অত্রি পত্নী অনসূয়ার গর্ভে জন্ম হয় ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। তিনি অনসূয়ার প্রার্থনার হেতু তাঁর গর্ভজাত হন। এই অবতারে তিনি অলক ও প্রহ্লাদ প্রভৃতিকে আত্মবিদ্যা উপদেশ করেন। সপ্তম অবতারে তার নাম হয় যজ্ঞ। তিনি রুচির পত্নী আকুতির গর্ভ থেকে জন্ম নেন। তার পুত্র যম প্রভৃতি দেবগণের সাথে এই অবতারে তিনি মন্বন্তর পালন করেছিলেন অর্থাৎ তিনি নিজে ইন্দ্র হয়েছিলেন। অষ্টম অবতারে তার নাম হয় ভগবান ঋষভদেব। নাভির পত্নী মেরুদেবীর গর্ভে ঋষভদেব রূপে অবতীর্ণ হন। তিনি সমস্ত আশ্রম বাসীদের মধ্যে শ্রেষ্ট পরমহংসের পথ দেখান। এটি সকলের দ্বারা সেবিত। ভগবান শ্রীবিষ্ণু তার নবম অবতারে মহারাজ পৃথুরূপে অবতীর্ণ হন। মহারাজ পৃথু পৃথিবী থেকে সমস্ত ঔষধি সমূহ দোহন করেছিলেন। তার জন্য তিনি সবার কাছে পরম শ্রদ্ধেয়। তার দশম অবতার হল মৎস্য অবতার। সেই সময় চাক্ষুষ ভাবে মন্বন্তর যে ঘটেছিল তাতে সমস্ত সমুদ্র প্লাবিত হয়ে পড়ে, তিনি তখন জীব জগৎকে রক্ষার্থে পার্থিব নৌকাতে রৈবস্বত মনুকে স্থাপন করে রক্ষা করেন।

দেবতা ও অসুরেরা যখন সমুদ্র মন্থন করেছিলেন তখন ভগবান একাদশ অবতার রূপ গ্রহণ করেন। সেই অবতারের নাম হল কূর্ম অবতার। মন্থনের দরুণ মন্দার পর্বত যখন সমুদ্রতলে প্রায় নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি কূর্ম রূপ ধারণ করে মন্দার পাহাড়কে পিঠে ধারণ করেন। দ্বাদশ অবতারের নাম ধন্বন্তরি। এই ধন্বন্তরি অবতারে তিনি সমুদ্র থেকে অমৃত ভাণ্ড তুলে নিয়ে আসেন। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর ত্রয়োদশ অবতারের নাম মোহিনী, অমৃত পান করা নিয়ে যখন অসুর ও দেবতাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের উপক্রম উপস্থিত হয়, তখন তিনি মোহিনী রূপ ধারণ করে অসুরদের বিমোহিত করে দেবতাদের অমৃত পান করান। চতুর্দশ অবতারের নাম হল নৃসিংহ অবতার। অদ্ভুত সেই রূপ সিংহের ন্যায় মুখ কিন্তু মানুষের ন্যায় শরীর। এই অবতারে ভক্ত প্রহ্লাদের বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে হিরণ্যকশিপুকে ঊর্ধ্বে স্থাপন করে নখের দ্বারা তার বক্ষস্থল বিদীর্ণ করেন। ভগবান শ্রীবিষ্ণু তাঁর পঞ্চদশ অবতারে বামন রূপ ধারণ করে ত্রিপাদ বিশিষ্ট ভূমি প্রার্থনার ছলে স্বর্গরাজ্য কেড়ে নেবার জন্য বলির যজ্ঞে যান।

তার ষোড়শ অবতারটির নাম পরশুরাম। এই অবতারে তার অস্ত্র হল পরশু। এই অবতারে তিনি একবিংশতিবার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয় শূন্য করেন। ক্ষত্রিয়দের নিধনের অন্তরালে ছিল রাজন্য বর্গের ব্রাহ্মণদ্বেষী মনোভাব। সপ্তদশ অবতারটি হলেন মহর্ষি ব্যাসদেব। মৎস কন্যা সত্যবতীর গর্ভে ঋষি পরাশরের ঔরসজাত ছিলেন এই বেদব্যাস। এই ব্যাসদেব বেদরূপ বৃক্ষের বহু শাখার উদ্ভাবন করেন। বলা বাহুল্য তিনি বেদকে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত করেন। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অষ্টাদশ অবতারের নাম হল ভগবান রামচন্দ্র। তিনি ইক্ষাকু বংশীয় রাজা দশরথের পুত্র রূপে দেবতাদের কার্য সাধনের ইচ্ছায় রামচন্দ্র হিসাবে মর্তে আবির্ভূত হন।

একবিংশতি অবতারে ভগবান শ্রীবিষ্ণু যাদবকুলে বলরাম ও কৃষ্ণ নামে জন্ম গ্রহণ করেন। এর পরই উপস্থিত হয় কলিকাল। কলিযুগে সমস্ত দেবতা বিদ্বেষীদের দেবতার প্রতি বিশ্বাস আনার জন্য গয়া প্রদেশে অঞ্জন পুত্র বুদ্ধ নামে আবির্ভূত হন। কলিযুগের শেষাশেষি রাজন্যবর্গ একেবারে ভালোবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে দস্যুবৃত্তিতে নেমে আসতে থাকে। সেই জন্য বিষ্ণু যশা নাম ব্রাহ্মণ থেকে ভগবান কল্কি নামে জন্ম গ্রহণ করেন জগৎকে পুনরায় রক্ষার জন্য।

ভগবান হরির অবতার অসংখ্য, যার কোন ক্ষয়ও নেই, পূর্ণ সরোবর থেকে যেমন-হাজার হাজার ক্ষুদ্র প্রবাহ, নির্গত হতে থাকে, তেমনই এই বিষ্ণু ভগবানের বিরাট রূপী মূর্তি থেকে অন্যান্য অবতারের আবির্ভাব ঘটে জগৎ-এর বিভিন্ন কারণ ও উদ্দেশ্যকে সফল করবার জন্য। ঋষি মনুদেব, মনুপুত্র দিকপাল লোকপাল এরা সকলেই হলেন ভগবান হরির অংশ। পূর্বোক্ত সব অবতাররা এবং যা এখনও উক্ত হয়নি সেই অবতাররা এই ভগবান শ্রীহরির বিরাট রূপী পুরুষের অংশ বা কলা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান অর্থাৎ তিনি কারও অবতার নন। তিনি ত অবতারী। তিনি বিভিন্ন অবতারে অসুরগণ কর্তৃক পীড়িত এই লোককে যুগে যুগে রক্ষা করে সুখী করে থাকেন। যে সকল ব্যক্তিরা শুদ্ধচিত্ত পবিত্র হয়ে এই সকল অবতারের অতি রহস্য জনক জন্মবৃত্তান্ত সন্ধান করে থাকে, তারা দুঃখ ও মায়াময় জগৎ সংসার থেকে মুক্তি পায়।

নিরাকার চৈতন্যময় ভগবানের এই স্কুল ও সূক্ষ্ম কারণাত্মক এ জগৎ রূপ এবং মায়া গুণের দ্বারাই আত্মাকে রচিত করেছে। সমস্ত নির্বোধ মানুষ মেঘকে আকাশের এবং পার্থিব ধূলিকণাকে বাতাসের বর্ণ বলে মনে করে। দ্রষ্টা আত্মাকে দৃশ্য স্নেহ বলে মনে করে। দৃষ্ট এই স্থূল দেহ ছাড়া অন্য সূক্ষ্ম দেহে আছে, যেটা এখনও পরিণত হয় নি এবং মায়ার গুণের দ্বারা রচিত। এটি নিরাকার অর্থাৎ কোন আকারই এর নেই। প্রত্যক্ষের ন্যায় বা দৃষ্টি দ্বারা তাকে উপলব্ধি করা যায় না বা দেখাও যায় না। ইন্দ্রাদি দেবতাদের মতো তা শোনাও যায় না। এই সমস্ত কারণের জন্য জীবাত্মার নাম দেওয়া হয়েছে লিঙ্গশরীর। এই লিঙ্গশরীর, নিয়েই বার বার জীবের জন্ম হয়। স্থূল শরীর এবং সূক্ষ্ম শরীর অবিদ্যার দ্বারা আত্মাতেই কল্পিত রয়েছে। জীবের যে আত্মা পরম ব্রহ্ম জ্ঞান লাভ করে, তার ফলে তার দুটি দেহ সূক্ষ্ম ও স্কুল শরীর বিনষ্ট হলে, সেই জীব ব্রহ্মস্বরূপ লাভ করে। সংসার চক্রে ভগবানের মায়া বিদ্যা রূপিণী হয়ে যদি ক্রিয়া থেকে নিবৃত্ত হয়, তাহলেই জীব পরমব্রহ্মকে লাভ করে। যে সমস্ত পণ্ডিতেরা তত্ত্বদর্শন করে থাকেন, ভগবান অবতার রূপে জন্ম লাভ করলেও তাঁর জন্ম ও কর্ম সবই দিব্য জীবদের ন্যায় প্রকৃত জন্ম কর্ম রহিত হয়ে থাকে। ভগবানের জন্ম ইত্যাদি, অবশ্যই মায়াচিত হয়ে থাকে। তত্ত্বজ্ঞানীরা একথা সব বলে থাকেন।

ঈশ্বর পরিদৃশ্যমান ঠিকই। তিনি সমস্ত বিশ্বের সৃষ্টি পরিচালনা করছেন, তিনি সমস্ত বিশ্বের স্থিতি বজায় রাখছেন এবং সমস্ত দুষ্ট আত্মাদের সংহার করে তিনি বিশ্বজগতকে রক্ষাও করছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যে, ঈশ্বর কিন্তু তাতে কোন ভাবেই আসক্ত হন না। ভগবান স্বাধীন তিনি কারও বশবর্তী নন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সমুহের তিনি হলেন নিয়ন্ত্ৰা, তিনি প্রতিটি জীবে অন্তর্যামী রূপে অবস্থিত রয়েছেন। এই ভাবে প্রতিটি জীবে অবস্থিত থেকে তিনি দৃষ্টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়রূপ রস প্রভৃতিকে গন্ধের ন্যায় অনুভব করে চলেছেন। জীবজগৎ–এ যে সমস্ত মানুষেরা নির্বোধ তারা যেমন ভগবানের এই সমস্ত কার্যকলাপ বুঝতে পারে না, ঠিক তেমন ভাবেই দুষ্টবুদ্ধি বা কুবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা যাদের মধ্যে ভক্তির অভাব রয়েছে, তারা নিপুণ ভাবে যুক্তিতর্কের দ্বারা ভগবানের লীলা রূপ রহস্য ও অনুধাবন করতে পারে না। সম্পূর্ণ জগতের আধার এই ভগবান মনের দ্বারা বহুরূপ প্রকাশ করে থাকেন, এবং বাক্যের দ্বারা বহু নাম প্রকাশ করে থাকেন। যিনি বা যে সমস্ত নির্বোধ মানুষেরা এই দুরন্ত বীর্য চক্রধারী মহা ভগবানের লীলা রহস্য সব জানতে পারেন, তিনি আপ্লুত ভক্তির দ্বারা তার চরণ রূপ কমলে সৌরভের ন্যায় সেবা করেন। হে মুনিগণ, আপনার এই দুশ্চর সাধনায় সমবেত, এই আপনাদের প্রতি ঈশ্বরের অনুরাগ যদি বর্ধিত হয় তাহলে এই সংসারের মোহ, যাতনা, দুঃখ প্রভৃতি থেকে মোক্ষ লাভ করবেন। বলা বাহুল্য যে, আর সংসার রূপ যাতনার পুনরাবর্তন ঘটবে না।

মোক্ষ লাভের আশায় সর্বজ্ঞ ঋষি বেদব্যাস ভাগবত পুরাণ রচনা করেন। মহর্ষি ব্যাসদেব রচিত ভাগবত পুরাণ গ্রন্থ বেদতুল্যই বটে, তার সঙ্গে মঙ্গলবহ এবং সব থেকে সেরা। যিনি আত্মবীর গণের শ্রেষ্ঠ তিনি নিজ পুত্রকে ভাগবত পুরাণ অধ্যয়ন করিয়েছেন। বেদব্যাস রচিত সম্পূর্ণ ভাগবত পুরাণে সমস্ত বেদ এবং ইতিহাসের সারবস্তু সংকলিত রয়েছে। সূত শুকদেব মহারাজ পরীক্ষিতকে ভগবত পুরাণ শ্রবণ করান। রাজা পরীক্ষিত তখন গঙ্গাতীরে অনশন করছিলেন এবং অনশন কৃত ঋষিগণের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। হে মুনিগণ গঙ্গাতীরের সেই সভায় মহা তেজস্বী মহর্ষি শুকদেব ভাগবত কীর্তন করেছিলেন। আমি কিন্তু তাঁরই অনুগ্রহে ভাগবত পুরাণ শ্রবণ করেছি। সেই আমিই তেজস্বী শুকদেব থেকে যা যা অধ্যয়ন করেছি তা আপনাদের শোনাব। কৃষ্ণ তার বিভিন্ন অবতারে ধর্ম, জ্ঞান এবং ঐশ্বর্যের সাথে মিলিত হয়ে নিজের নিত্য লীলায় প্রবিষ্ট হয়েছেন, কিন্তু এই ধর্মের প্রত্যক্ষ জ্ঞান যাদের নেই, যারা বিবেক ও জ্ঞান রহিত, কলিযুগের সেই সব জনগণের জন্য ভাগবত পুরাণ রূপ সূর্যের উদয় প্রত্যক্ষ হচ্ছে।

.

চতুর্থ অধ্যায়
মহামুনি বেদবাস অপরিতুষ্টর কাছে দেবর্ষি নারদের আগমন

যে সমস্ত মুনিরা যজ্ঞকর্মাদি করেন, তাঁদের মধ্যে বয়ঃবৃদ্ধ কুলপতি শৌণক বললেন– হে সূত, তুমি তো ভাগ্যবান এবং বাগ্মী শ্রেষ্ঠ ভগবান শুকদেব যে তোমার কাছে ভাগবতের কথা ব্যক্ত করেছেন, তুমি সেই ভাগবত মূলক কথনগুলির আমাদের নিকট বর্ণনা কর। কোন্ যুগে কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হেতু এবং কীভাবে তা প্রবৃত্ত হয়েছিল? কার দ্বারা প্রেরিত হয়ে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস এই বিশাল এবং পবিত্র সমস্ত বেদের মূল স্বরূপ ভাগবত পুরাণ সংহিতা রচনায় নিবিষ্ট হন। তার পুত্র ছিলেন শুকদেব, যিনি মহাযোগী ব্রহ্মজ্ঞ ভেদ বুদ্ধির হিত স্থিত প্রাজ্ঞ এবং মায়া শয্যা থেকে উখিত হয়ে মড়ার মতো পতিত হলেন। একদিন ব্যাসদেবের নগ্নপুত্র শুকদেবের পিছনে গমনকারী ব্যাসদেব কিন্তু বসন পরিহিত ছিলেন, কিন্তু তবুও তাকে দেখে জলক্রিয়ায় ব্যস্ত অপ্সরারা লজ্জায় বস্ত্র পরিধান করল, কিন্তু আশ্চর্য এই যে তার আগেই উলঙ্গ হয়ে পুত্র গমনকালে কিন্তু অপ্সরার ওরূপ কাজ করেনি। এইরূপ অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আশ্চর্য চকিত হয়ে বেদব্যাস জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমরা এরূপ করলে, এর অর্থ কি হয়, উত্তরে অপ্সরারা বলেছিল– হে মুনি, তুমি বৃদ্ধ জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন ঋষি, সব থেকে বড় কথা এই যে, তোমার শ্রীপুরুষ, সেই ভেদ বুদ্ধি, বিচার ক্ষমতা তোমার মধ্যে আছে। কিন্তু তোমার পুত্ৰ এতে শিশু তার ভেদবুদ্ধি হয় নি।

শুকদেব একদিন কুরু ও জঙ্গল প্রদেশ ভ্রমণ করতে উন্মত্ত গোবাহ জলের মতো বিচরণ করতে করতে হস্তিনাপুরে এসে প্রবেশ করলেন। পুরবাসীরা কি শুকদেবকে চিনতে পেরেছিল। হে বৎস্য আমাদেরকে তুমি বল যে এই শুকদেব মুনির সাথে কীভাবে পাণ্ডববংশীয় রাজর্ষি পরীক্ষিতের আলোচনা হয়েছিল, এবং যার দরুন ভাগবত সংহিতা পবিত্র হয়েছে। মহাভাগ্যবান শুকদেব গৃহস্থের গৃহ পবিত্র করার হেতু কিছুক্ষণ অপেক্ষায় রত থাকতেন। সূত, অভিমন্যু পুত্র পরীক্ষিতকে কেন ভক্তদের মধ্যে উত্তম ভক্ত বলা হয়, তার সমস্ত আশ্চর্য জন্ম এবং কর্মসমূহ আমাদের কাছে বিবৃত কর। পান্ডুবংশের রাজাধিরাজ মানবধর্ম পরীক্ষিতের কী এমন সময় উপস্থিত হয়েছিল যে তিনি তাঁর রাজ্যের উৎকৃষ্ট রাজ্য সম্পদ সমস্ত অনাদর করে গঙ্গাতীরে আমরণ অনশন ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। যে রাজলক্ষ্মীর চরণরূপ পদ্মে শত্রুরা পর্যন্ত নিজেদের মঙ্গলের আশায় নিজেদের সমস্ত ধনসম্পদ সমর্পণ করে প্রণাম করতেন, হে প্রিয়, সেই বীর রাজা পরীক্ষিত কী কারণে রাজলক্ষ্মী ত্যাগ করতে ইচ্ছা করেছিলেন, ভাগবত ভক্তগণ পর্যন্ত ও সমস্ত জনগণের মনোবল সমৃদ্ধির হেতু এবং ঐশ্বর্যের জন্য জীবিত থাকেন, শুধু নিজের জন্য বাঁচেন না, তাহলে সেই মহরাজ কেন পরহিতে নিজের দেহ পরিত্যাগ করলেন। একথাও শুনতে আমরা উদগ্রীব। এছাড়া আরও নানা জ্ঞানমূলক আলোচনা তোমার কাছ থেকে জানতে আমরা আগ্রহী। তুমি শুধু বেদই নয়, সমস্ত শাস্ত্র পারদর্শী।

এই কথা শুনে সূত বলতে শুরু করলেন, তৃতীয়তম যুগ যার নাম দ্বাপর যুগ, এই যুগ উপস্থিত হলে পরাশর মুনির ঔরসে পশুকন্যা সত্যবতীর গর্ভে হরির সপ্তদশ অবতার রূপে ব্যাসদেবের জন্মলাভ ঘটে। কোন একদিন সূর্যোদয়ের পরবর্তী সময়ে সরস্বতী নদীর পবিত্র জলে স্নান করে বদরিকাশ্রমে বসেছিলেন এই সর্বজ্ঞ ব্যাসদেব মুনি, এবং ভাবতে থাকলেন, কালের প্রভাবের দরুণ পৃথিবীতে যুগে যুগে ধর্মের বিপর্যয় ঘটে যায়। পঞ্চভূত দিয়ে এই যে শরীর গঠিত, সেই শরীরের শক্তি ক্রমশ ক্ষয় হয়ে থাকে। গুরুবাক্যে যাদের বিশ্বাস নেই প্রায়, এমনকি শাস্ত্রাদিতেও পর্যন্ত যাদের বিশ্বাস রহিত সেই সমস্ত অল্প আয় বিশিষ্ট জনগণকে দেখে সর্বজ্ঞান সম্পন্ন এই ঋষি ব্যাসদেব বিভিন্ন বর্ণ ও আশ্রমের কথা, তাদের হিতের কথা চিন্তা করছিলেন। বৈদিক কর্ম ইত্যাদি সমস্ত প্রজাগণের শুদ্ধিকরণ করে বিচার করে তিনি বেদকে চারভাগে বিভক্ত করলেন। চারটি বেদ হল–ঋক্, যজুঃ, সাম ও অথর্ব। এই চার নামে বেদ উদৃত হল। ইতিহাস মূলক পুরাণকে পঞ্চম বেদ বলা হয়ে থাকে। ঋগ্বেদে যে সমস্ত মুনিরা রয়েছেন তাদের মধ্যে নিপুণ হলেন হৈম মুনি, সামবেদের মুনিদের মধ্যে প্রধান হলেন জৈমিনি, এবং বৈশুসম্পায়ন একাই ছিলেন যজুঃবেদের নিপুণ মুনি। এবং অথর্ব বেদের মুনি দিগের মধ্যে সুমন্ত মুনি প্রধান। তিনি আবার অঙ্গিরসেরও জ্ঞাতা ছিলেন। এই সমস্ত বেদের ঋষিরা নিজ নিজ বেদকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেন। এই সমস্ত বেদের মুনিদের শিষ্য, প্রশিয্য এমনকি তাদেরও শিষ্যদের দ্বারা বেদের বহুশাখা উৎপন্ন হয়।

জীবজগতের অল্প বুদ্ধি সম্পন্ন পাঠকেরা যাতে বেদ অধ্যয়ন করার পর তার অর্থ অনুধাবন করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্য লাভ করার জন্যই দয়ালু ভগবান ব্যাসদেব বেদকে বিভক্ত করেন। স্ত্রী শুদ্ধ জাতি কিন্তু অধম, তাই ত স্ত্রী জাতিদের বেদ অধ্যয়ন করতে বা শ্রবণ করতে নেই। কিন্তু স্ত্রী জাতিদের বেদ শ্রবণ না করলে মঙ্গল হবে কি করে, তাই ত বেদব্যাস ভগবান কৃপাপূর্বক মহাভারত রচনা করেন স্ত্রীদের মঙ্গলের জন্য। হে ব্রাহ্মণরা এই রূপ ভাবে ভগবান ব্যাসদেব সর্ব সময় সর্বতোভাবে জীবনের কল্যাণ সাধন করার হেতু নিজেকে নিবৃত্ত রেখে তিনি সরস্বতী নদীর পবিত্র তটে নির্জনে বসে ভাবতে থাকলেন। ভগবান ব্যাসদেব চিরকাল ব্রহ্মচর্য পালন করে বেদ, গুরু, অগ্নি, যজ্ঞাদির পূজো করেছেন। এমনকি এই সমস্ত বিষয় সমূহের মধ্যে যে অনুশাসন রয়েছে তাও তিনি গ্রহণ করেছেন। মহাভারত রচনার দ্বারা বেদেরই অর্থ আসলে প্রকাশ পেয়েছে। ব্যাসদেবের দ্বারা লিখিত এই মহাভারতে স্ত্রী এবং শুদ্রের আসল ধর্মের কথা বলা হয়েছে। তার দেহে স্থিত যে জীব সে পরিপূর্ণ হলেও কিন্তু সে সম্পূর্ণ নয়। বেদের অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনার দ্বারা তেজস্বী হলেও নিজেকে কিন্তু অসম্পূর্ণের মতোই মনে হচ্ছে। হে পরমহংস ভক্তদের প্রিয় ভাগবতে ধর্মের বিশেষ রূপের কথা বলা হয় নি এই ধর্ম ভগবানের অতি প্রিয়। বেদব্যাস তখন নিজেকে অত্যন্ত হীন মনে করে অত্যন্তভাবে দুঃখিত হয়েছিলেন। ঠিক তখন মহর্ষি বেদব্যাসের আশ্রমে দেবর্ষি নারদের আগমন ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে মহর্ষি বেদব্যাস দেবপুরীতে নারদকে অভ্যর্থনা করেন।

.

পঞ্চম অধ্যায়
নারদ এবং মহর্ষি বেদব্যাসের মধ্যে বিভিন্ন আলাপচারিতা

দেবর্ষি নারদ বেদব্যাসের আশ্রমে প্রবেশ করে মহর্ষি বেদব্যাসকে প্রশ্ন করলেন– হে পরাশর মুনি পুত্র মহাভাগ্যবান ব্যাস, তোমার শুদ্ধ আত্মা, পবিত্র শরীর ও মন প্রসন্ন তো? তুমি সমস্ত ধর্মসমূহ জ্ঞাত হয়েছ, আবার তুমিই পরিপূর্ণ সুবিস্তীর্ণ মহাভারতও রচনা করেছ। সবার কাছে যেটা সনাতন ধর্ম, তা তুমি বিচার করেছ। এত কিছু করার পর নিজেকে কেন তুমি অকৃতার্থ মনে করে দুঃখ পাচ্ছো? এর কারণ আমাকে বল।

দেবর্ষি নারদের প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি বেদব্যাস বললেন– হে দেবর্ষি, তুমি আমার সম্পর্কে যা যা বললে তা যথার্থই। কিন্তু আমার আত্মা কিছুতেই পরিতুষ্ট হতে পারছে না। আমার এই অসন্তুষ্টির কারণ যে কী তা আমি কিছুতেই অনুধাবন করে উঠতে পারছি না। হে দেবর্ষি নারদ তুমি তো ব্রহ্মার পুত্র এবং তাঁর সঙ্গে অসীম জ্ঞান সম্পন্ন। তাই তো আমার অপরিতুষ্টতার কারণ হিসেবে যে প্রশ্ন তা তোমার কাছে উত্থাপন করছি। হে মুনি নারদ তোমার কাছ থেকে গোপনীয় তথ্য লুকানো নেই। তুমি পুরাণ পুরুষ উপাসনা করেছো। তুমি তো সূর্য যেমন ভ্রমণ করে চলেছে সর্বদা, ঠিক তেমনই তুমিও ত্রিভুবন ভ্রমণ করে সব কিছু দেখেছ, সেই তুমি বায়ুর মতন সবার অন্তরে প্রবেশ করে সবার অন্তরের ভাবগুলিকে দেখতে পাও। আমি যোগ রূপ বলের দ্বারা পরমব্রহ্ম লাভ করেছি এবং অধ্যায়নাদির দ্বারা বেদ বিষয়ে আমি নিপুণতাও পর্যন্ত লাভ করেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার অন্তরভাগ কেন দুঃখে পরিপূর্ণ তার কারণ আমি বুঝতে পারছি না, তাই তার কারণ আমায় বল।

বেদব্যাসের প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি নারদ বললেন– তুমি তো ভগবানের নির্মল যশ বলোনি, আর সেই যশ প্রকাশ করা ব্যতীত ব্রহ্মজ্ঞানের যে ভগবান তিনি পরিতুষ্ট হন না। হে মুনি শ্রেষ্ঠ বেদব্যাস, তুমি সমস্ত ধর্মের বর্ণনা এমন কি পুরুষার্থও বর্ণনা করেছ। কিন্তু বাসুদেবের মহিমা বর্ণনা করোনি। যে সমস্ত গ্রন্থে রস, অলঙ্কার সমূহ উপস্থিত রয়েছে, কিন্তু সমস্ত জগতের দেবতা, সমস্ত জগতকে পবিত্রকারী হরি যশকীর্তন না করা হয়ে থাকে, তা কিন্তু কাকতীর্থ তুল্য অর্থাৎ কোন ফলই লাভ হয় না সেই গ্রন্থ থেকে। মানস নামক সরোবর হংসতুল্য ভাগবত কিন্তু পরমহংসরা তাতে রমণ করবেন না উদাহরণস্বরূপ এই বলা চলে। অপার শব্দাদি যুক্ত হলেও যে বাক্যের প্রতি শ্লোক সমূহে ভগবানের মহিমান্বিত নাম যশ কীর্তিত হয়, তা কিন্তু সাধুরা শ্রবণও করে থাকেন, এবং তার সাথে কীর্তনও করে থাকেন। যে সমস্ত বাক্যে ভগবানের যশ ও নাম কীর্তন মূলক শ্লোকসমূহ রয়েছে সেই সব বাক্যের উচ্চারণে সবার পাপ বিনাশ করে। মোক্ষ লব্ধ যে সাধক অবিদ্যারূপ নিবর্তক জ্ঞান সমূহ ও যদি অচ্যুত, ভাবোথিত হয় তবে কিন্তু তা তার মতন সাধকের শোভা পায় না। নিরন্তর যা দুঃখ দিয়ে যাচ্ছে সেই কাম্য ধর্ম অথবা নিষ্কাম কর্ম যদি ভগবানকে অর্পণ না করা হয়, তা হলে কী সেই সাধকের তা শোভা পায়। হে পরাশর পুত্র মহাভাগ্যবান বেদব্যাস, তুমি অব্যর্থ জ্ঞান লাভ করেছো, সুতরাং তুমি শ্রীকৃষ্ণের অদ্ভুত অপূর্ব লীলাবলী স্মরণ করে তার বর্ণনা কর।

এই বিশ্বজনীন জগতের ভগবান রূপ ভাগবত লীলা ব্যতীত অন্য বিষয়ে যদি তোমার লক্ষ্য হয় তাহলে সেই পৃথক দর্শন জনিত রূপ ও নামের দ্বারা তোমার মতি কিন্তু অস্থির হবে। বায়ুর দ্বারা তাড়িত নৌকার যেমন কোন স্থিরতা নেই, তেমনই তোমারও মন কখনও কোথাও স্থির হবে না। হে মহাভাগ্যবান ব্যাসদেব তুমি যে সমস্ত বিষয়ে আসক্ত, জনগণের কল্যাণের জন্য নিন্দিত কাম্য কর্মকে ধর্ম বলে উপদেশ করায় তোমার কিন্তু মহা অন্যায় হয়েছে। তোমার কথা মত সমস্ত অধর্ম রূপ কাম্য, কর্মকেই তারা মানে। সাধারণ মানুষ ধর্ম বলে স্থির করেছে। ফল স্বরূপ এখন তাদের নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা তা মানছে না। যে সমস্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি যারা নিয়তির দ্বারা পরমেশ্বর ভগবানের বিশ্বস্বরূপ আনন্দময় রূপ অনুভব করতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা আপ্ততত্ত্বে অনভিজ্ঞ দেহাত্মবাদী মায়া দ্বারা এমন সত্ত্ব, রজ ইত্যাদি গুণের দ্বারা পরিচালিত সেই সমস্ত মানুষদের জন্য তুমি ভগবানের আনন্দময় লীলা বর্ণনা কর। অধর্মসমূহ পরিত্যাগ করে ধর্ম সঙ্গে হরির চরণরূপ কমল ভজনা করতে করতে অপরিপক্ক অবস্থায় যদি সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, অথবা তার সাধন পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়, তাহলে কী তার মঙ্গল হবে না। ভাগবতের ভজনা করতে করতে কোন মানুষ যদি স্বধর্ম আচরণ করে, তা হলে তার কী লাভ বা ক্ষতি হবে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা বিবেকীজন তারা ভাগবত রূপ যে ভক্তি সুখ, তার জন্য যত্ন করবে, আর এই আনন্দময় সুখ কিন্তু ওপরে অবস্থিত সত্যলোক থেকে নীচে নরক পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। দুঃখ যেমন অনায়াসেই আসে ঠিক তেমনই কর্মফল রূপ যে সুখ তা সর্বতোভাবে পাওয়া যায়। হে মহাভাগ্যবান প্রিয় মুকুন্দসেবী যে সব মানুষ, তারা নিম্ন জাতিতে জন্ম নিলেও কর্মী সমস্ত জনের মত বিষয় সমূহে আকৃষ্ট চিত্ত হয়ে কখনই সংসারে আবিষ্ট হয় না।

এই বিশ্বচরাচর, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কিন্তু ভগবানের থেকে পৃথক কিছু নয়, সব একই। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, ভগবান জগৎ থেকে পৃথক। এই ভগবানের শক্তিতেই সৃষ্টি, স্থিতি, এবং লয় হয়ে থাকে। এ সমস্ত বিষয়ে তুমি ত অবজ্ঞাত, হে মহাভাগ্যবান অব্যর্থ দ্রষ্টা বেদব্যাস, তুমি স্বয়ং পরমাত্মা

পুরুষের অংশে জগতের কল্যাণের হেতু জন্মগ্রহণ করেছ। বিরাট রূপী পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরমাশ্চর্য লীলা অধিকরূপে কীর্তন করে। এই আশ্চর্য লীলা বর্ণনাকারী উত্তম শ্লোক সমূহ ভগবানের গুণবর্ধনকারী। মানুষের তপস্যা শাস্ত্র শ্রবণ, আর সেই সমস্ত লোকসমূহের শোভনসমূহের শোভনযোগ্য অধ্যয়ন করা হলে জ্ঞানদানের অক্ষয় ফল লাভ হয়।

আমি পূর্বকল্প পূর্ব জন্মে এক ব্রাহ্মণের দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। বর্ষাকাল সমাগত হলে যে ব্রাহ্মণগৃহে আমি একত্র বাস করছিলাম, সেখানে সমস্ত গুণী জন সব মুনিদের সমাগম ঘটলে বাল্যকালে আমি সেই মুনিদের সেবার নিমিত্ত নিযুক্ত ছিলাম। সেই ব্রাহ্মণের গৃহে সমাগত সব মুনিরা ছিলেন সমদর্শী। কিন্তু সেই সময় আমি যে সব ক্রীড়া শান্তর আগমন ঘটায় তা পরিত্যাগ করে সেই মুনিদের আজ্ঞানুবর্তী হয়ে থাকি। সমাগত সেই সব সমদর্শী মুনিদের উচ্ছিষ্ট পাত্রের অবশিষ্ট অংশে একবার মাত্র ভোজন করতে পারতাম। যার দরুণ আমার সমস্ত পাপ বিদূরিত হয়ে যায়। এবং তাদের ধর্ম হরি ভক্তিতেই আমার রুচি উৎপাদিত হতে থাকে ক্রমশ।

সেই সব ব্রাহ্মণরা প্রতিদিন কৃষ্ণ কথা গান করতেন, আর আমি অনুগ্রহ হয়ে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিটি কথা শ্রদ্ধা পূর্বক শুনতাম। ঐ ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে শ্রীকৃষ্ণ লীলা মূলক গানসমূহ শোনার ফলে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আমার রতি জন্ম হয়। হে পরাশর পুত্র মহামতি বেদব্যাস সেই মধুর কীর্তিশালী ভগবানে আমার অবিহচ্যতিতে মতি হয়েছিল। সেই মতি দ্বারা আমি দর্শন করলাম, এই পরিদৃশ্যমান পৃথিবী জগৎ সংসার, স এবং অসদরূপ যোগমায়ার দ্বারা কল্পিত হয়েছে। সেই রূপ আমাদের সূক্ষ্ম ও স্থূল শরীর নিজের অবিদ্যার দ্বারাই নিত্য মুক্তস্বরূপ তার আত্মাতে কল্পিত হচ্ছে। বর্ষাকাল শরৎকালের প্রতি সন্ধ্যায় মহাত্মাগণেরা যে হরির অমল যশমূলক গান সংকীর্তন করতেন, তা আমি শ্রবণ করতাম। এই রকমভাবে হরির অমল অদ্ভুত সব যশমূলক সংকীর্তন শ্রবণ করার হেতু আমার রজঃ ও তমগুণের বিনাশ সাধন ঘটে এবং শ্রী হরির প্রতি ভক্তির উদয় হয়েছিল। সেই শ্রীহরির যশকীর্তন শুনতে শুনতে আমি শ্রীভগবানের অত্যন্ত অনুরক্ত বিনীত, শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠি এবং সমস্ত পাপেরও বিনাশ সাধন আমার ঘটেছিল। তার সঙ্গে আমি অত্যন্ত সংযত এবং সেই মুনিদের অনুগত হয়েছিলাম সেই জন্য সেই মুনিরা প্রত্যাগমনের সময় অত্যন্ত প্রীতির সঙ্গে কৃপাপূর্বক আমাকে গোপন জ্ঞান উপদেশ করেন। যা আমি ভগবান ব্রহ্মাকে বলেছিলাম। মুনিদের দ্বারা সৃষ্ট সেই জ্ঞানের দ্বারা আমি সমস্ত জগতের মায়া প্রবর্তক ভগবান বাসুদেবের প্রভাব জেনেছিলাম। আর এরই দ্বারা কিন্তু ভক্ত ভগবান ধর্মে গমন করে থাকেন। হে ব্রাহ্মণ, সবকিছুর নিয়ামক এই ভগবান যে সমস্ত কর্ম সমর্পণ বা যার দ্বারা কর্মসমূহ সম্পন্ন করা হয়, তা আধিভৌতিক, আধিদৈবিক এবং আধ্যাত্মিক তাপত্রয় বিনাশক।

হে সুব্রত, যে দ্রব্যসমূহের দ্বারা বা ব্যবহারের হেতু প্রাণীদের দেহে রোগ জন্ম নেয়, সেই দ্রব্য দ্বারাই কিন্তু কখনও রোগের নিরাময় করা যায় না। কিন্তু দ্রব্যান্তরের দ্বারা মিশ্রিত হলে তা রোগ নিরাময়ের কারণ হয়। যে সমস্ত কর্ম সমূহ করলে মানুষের বন্ধনের উৎপত্তির কারণ হয়, অর্থাৎ সেসব কর্ম যদি পরমেশ্বরকে অর্পণ করা যায়, তাহলে কিন্তু তা তাদের মোক্ষের কারণ হয়ে থাকে। ভগবানকে প্রীতি দেওয়ার জন্য যে কর্মসমূহ করা হয় তা ভক্তিযোগে নিষ্কাম কর্মযোগে জ্ঞান দান করে থাকে যা ভক্তিযুক্ত ভগবানের শিক্ষা অনুসারে বারংবার কোন কাম ছাড়া কর্ম করতে করতে শ্রীকৃষ্ণের গুণ স্মরণ হয়ে থাকে। যদি কোন মানুষ পূজা করার সময় তুমি ভগবান বাসুদেব, তোমাকে প্রণাম করি এই ভাবে যিনি মন্ত্রে নির্দিষ্ট মূর্তির নাম উল্লেখ করে যজ্ঞ করে থাকেন তিনি অবশ্যই ব্ৰহ্মতত্ত্ব দর্শন করেন। তার দেওয়া নিজের সেই উপদেশ আমি পালন করছি। সেই ভগবান বাসুদেব আমাকে জ্ঞান, ঐশ্বর্য এবং প্রেম দান করেছেন। তুমি মহাভাগ্যবান যে পরাশর পুত্র ও যশস্বী, তুমি ভগবানের বিশ্ব রূপ যশ বর্ণনা করো।

এই যশকীর্তিমূলক গ্রন্থ পাঠ করলে জ্ঞানী গণেরও জানার ইচ্ছার নিবৃত্তি হবে, নিরন্তর দুঃখের দ্বারা সৃষ্ট জনগণের লেশ নিবারণের আর অন্য কোনো উপায় নেই এই জগতে বলে বিবেকীগণ মনে করে থাকেন।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়
নারদের দ্বারা পূর্বজন্মে তাঁর শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তন ও সৌভাগ্যের বর্ণনা

সূত বললেন– হে সমগ্র সন্ন্যাসী বৃন্দ, ব্রহ্মপুত্র দেবর্ষির এই জন্ম এবং কর্ম সমূহের বৃত্তান্ত শুনে ভগবান ব্যাসদেব আরও কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। মহাভাগ্যবান ব্যাসদেব জানতে চাইলেন সেই মুনিরা যখন বিদেশে গেলেন সেই বাল্যবয়সে তুমি কী করলে পরবর্তীকালে তোমার জীবন কীভাবে অতিবাহিত করলে।

একদিন রাতে গাভী দোহনের জন্য আমার মা পথে বেরিয়েছিলেন। তার পদপিষ্ট একটি সর্প কাল প্রেরিত হয়ে তাকে দংশন করে। মায়ের মৃত্যুকে ভগবানের অনুগ্রহ মনে করে আমি ওর দিকে গমন করলাম। সেখানে অনেক সমৃদ্ধ দেশের অবস্থান ছিল। নগর, গ্রাম, গোষ্ট বিভিন্ন রত্নের খনি ছিল। বন পর্বতে নানা ধাতুর দ্বারা শোভিত পর্বতশ্রেণী এবং তার গায়ের বৃক্ষসকল। যেতে যেতে আমি স্বচ্ছ জলপূর্ণ সরোবরের এবং নদীর সান্নিধ্যে এসেছিলাম। এই সরোবরের তীরে পক্ষীদের কলকাকলি ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ভ্রমররা গুঞ্জন করছে। আমি শেষপর্যন্ত একটা বিরাট অরণ্যের সামনে পৌঁছে গেলাম। সেই বনে নলবেণু গাছের ঝাড়, কুশ এবং বাঁশঝাড়ের অবস্থান। সেখানে বাঘের মতো হিংস্র জন্তুদের বসবাস। আমার ইন্দ্রিয় এবং দেহ অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়েছিল। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় আমি কাতর হয়েছিলাম। সেই নদীতে স্নান করলাম। সেই নদীর জল পান করে আমার ক্লান্তির অপনোদন ঘটে গেল।

নির্জন বনভূমিতে একটি অশ্বত্থ গাছের নীচে বসে পরমাত্মাকে চিন্তা করতে থাকলাম। আমার দুটি চোখ জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। হরি আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হলেন। আমার সর্ব অঙ্গে জাগল আলৌকিক শিহরণ একটু বাদে গভীর আনন্দে লীন হলাম। নিজেকে এবং পরমাত্মাকে আর দেখতে পেলাম না। ভগবানের রূপ দেখতে না পেয়ে আমি উন্মত্তের মত হয়ে উঠলাম। আবার তাঁকে দর্শন করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। এই ইচ্ছা ফলপ্রসূ হল না। অতৃপ্ত আত্মা আতুরের মতো ক্রন্দন করতে লাগল।

তখনই আকাশবাণী শুনতে পেলাম। –ওহে, এ জন্মে তুমি আমাকে আর দেখতে পাবে না। যাদের চিত্তের মালিন্য দূরীভূত হয়নি, এই কুযোগীরা আমাকে কখনও দেখতে পায় না। একবার সেই রূপ আমি তোমাকে দেখালাম কারণ আমার প্রতি তোমার অনুরাগের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। আমার হৃদয়ের সমস্ত বাসনা পরিত্যাগ করে তুমি আমার পার্ষদত্ব লাভ করবে। আমাকে নিবদ্ধ তোমার এই শ্রদ্ধা কখনই বিনষ্ট হবে না। আমার অনুগ্রহে প্রাণীদের সৃষ্টি এবং প্রলয় হলেও তোমার স্মৃতি থাকবে।

এই কথা বলে পরমেশ্বরের কণ্ঠস্তব্ধ হয়ে গেল। তখনও তার মূর্তি আকাশে ছিল। অথচ অমূর্তি বলে আমি তাকে দেখতে পাই নি। আমি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করলাম।

লজ্জা ত্যাগ করে আমি ভগবানের নাম কীর্তন করতে করতে পৃথিবী পর্যটন করতে থাকলাম। শুরু হল আমার সীমাহীন প্রতীক্ষা। হে ব্রাহ্মণ, এইরূপে আমি উন্মাদ প্রায় হয়ে কৃষ্ণভক্তে পরিণত হলাম। মালাভর্তি বিদ্যুতের মতো আমার মৃত্যুর সময় এসে উপস্থিত হল। ভগবান পার্ষদরূপ শুদ্ধ স্বত্ত্বময় দেহের জন্য আমার ভৌতিক দেহের পতন হল। প্রলয় কাল উপস্থিত হল। ভগবান সমস্ত জগতকে প্রলয় করলেন। ব্রহ্মার নিশ্বাসের সঙ্গে আমি তাঁর দেহের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সহস্র যুগ চলে গেল। নিদ্রা থেকে জেগে উঠে ব্রহ্মা সৃষ্টি করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তার ইন্দ্রিয় সকল থেকে মরীচি প্রভৃতি ঋষিগণের আবির্ভাব ঘটল এবং আমি জন্মগ্রহণ করলাম।

মহাবিষ্ণুর অনুরোধে ত্রিলোকের অন্তর ও বাইরে কোথাও বাধা না পেয়ে ভ্রমণ করতে করতে আমি হরিকথা গান করে বিচরণ করে থাকি। আমি যখন ভগবানের লীলা গান করে থাকি, তখন ভগবান যেন আমার হৃদয়ে প্রবেশ করেন। যখন যেখানে তিনি গমন করেন, তাঁর পবিত্র চরণ স্পর্শে সেই স্থান তীর্থস্থানে পরিণত হয়ে যায়। বারবার বিষয় ভোগের বাসনায় আসক্ত সংসারীদের পক্ষে হোলিলীলা কীর্তন করা অবশ্য কর্তব্য। এটি আমার প্রত্যক্ষ অনুভব।

সূত বললেন– ভগবান নারদমুনি বেদব্যাসকে একথা বলে এবং তার অনুমতি নিয়ে বীণা বাজাতে বাজাতে অন্য কোথাও গমন করলেন।

.

সপ্তম অধ্যায়
অশ্বত্থামা দ্রৌপদী পুত্রদের বিনাশ এবং অর্জুনের জন্য প্রদান

শৌনক বললেন– হে সূত, নারদ বনে গেলে ভগবান তার অভিপ্রায় জেনে কি করেছিলেন?

সূত বললেন– ব্রহ্মনদী সরস্বতীর পশ্চিম তীরে শ্যামাপ্রস নামে একটি আশ্রম আছে। সেখানে ব্যাসদেব উপস্থিত হলেন। জলস্পর্শ করে সমাধির দ্বারা মন স্থির হল। ভগবান এবং তাঁর মায়াকে দেখলেন। এই মায়ার দ্বারা সম্মোহিত হয়ে জীব গুণাতীত হয়েও ত্রিগুণাত্ম মনে করে ভগবানে, ভক্তিযোগেই সাক্ষাৎ অনর্থপশম– এটা দেখে অজ্ঞ লোকের হিতের জন্য তিনি শ্রীমদ ভাগবত প্রস্তুত করলেন।

শৌণক বললেন– হে সূত। শুকদেব সংসারের প্রতি নিস্পৃহ ছিলেন। কোনো বস্তুর প্রতি তার বিন্দুমাত্র আসক্তি ছিল না। তিনি আত্মারাম হয়েও এই বৃহৎ সংহিতা কী ভাবে অভ্যাস করলেন।

সূত জবাব দিলেন– আত্মারাম বন্ধনরহিত মুনিরাও অহেতুক ভক্তি করে থাকেন। হরি এইজাতীয় গুণবিশিষ্ট, হরির গুণে ভগবান শুকদেব মহৎ ভাগবত অধ্যয়ন করেছিলেন। হে শৌণক, এবার আমি রাজর্ষি জন্ম, কর্ম, মুক্তি এবং মহাপ্রস্থানের কথা বলব। এইভাবে কৃষ্ণ-কথার উদয় হবে।

কুরু-পাণ্ডবের ভয়ংকর যুদ্ধের অবসান ঘটে গেল। নিহত বীররা স্বর্গে গমন করলেন। ভীমের গদার আঘাতে দুর্যোধনের উরু’ভঙ্গ হল। দুর্যোধনের প্রিয় কার্য হয় মনে করে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা নিদ্রিত দ্রৌপদীর শিশু পুত্রদের শিরচ্ছেদ করে দুর্যোধনকে উপহার দিলেন। এই নিন্দিত কর্মে সকলেই নিন্দা করে থাকেন। মাতা দ্রৌপদী শিশুদের নিকট বার্তা শুনে অশ্রু পরিপূর্ণ লোচনে কাঁদছিলেন। অর্জুন তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন–হে ভদ্রে, যখন আততায়ী ব্রাহ্মণ্যধর্ম অশ্বত্থামার মস্তক গাণ্ডীব থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের দ্বারা তোমাকে উপহার দেব তখন তোমার মনে আনন্দের উদ্রেক হবে। এই মিষ্ট বাক্যে দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিয়ে অর্জুন গুরু পুত্র অশ্বত্থামার পেছনে ধাবিত হলেন। অশ্বত্থামা অর্জুনকে দূর থেকে আসতে দেখে রথে করে পালাতে লাগলেন।

যখন অশ্বত্থামা নিজেকে নিরাশ্রয় এবং অশ্বরা ক্লান্ত হয়েছে বুঝতে পারলেন তখন ব্রহ্মাস্ত্রকেই প্রাণরক্ষার উপায় বলে মনে করেন। সেই অস্ত্র থেকে প্রচণ্ড তেজ আবির্ভূত হল। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন– হে কৃষ্ণ, ভক্তদের অভয়পদ মহাবাহ, তুমি একমাত্র মুক্তি দাতা তুমি প্রকৃতির অতীত পুরুষ, তুমি কারণ, তুমি সাক্ষাৎ ঈশ্বর, তুমি নিজ প্রভাবে মায়ার দ্বারা বিমোহিত চিত্ত জীবগণের ধর্মাদিরূপ মঙ্গল বিধান করো। এই তোমার অবতার রূপ পৃথিবীর ভার অপনোদনের জন্য। এটা কী বা কোথা থেকে আসছে তা আমি বুঝতে পারছি না। এই তেজ সবদিক থেকে ধেয়ে আসছে।

শ্রী ভগবান বললেন–হে অর্জুন, এটা ব্রহ্মাস্ত্র। প্রাণ সংকট উপস্থিত হয়েছে বলে অশ্বত্থামা এটা প্রয়োগ করেছে। কিন্তু এই অস্ত্রের উপসংহার কৌশল সে জানে না। এই অস্ত্রের প্রতিস্পর্ধী অপর কোনো অস্ত্র নেই। তুমি অস্ত্রবিদ্যায় অভিজ্ঞ, নিজের প্রযুক্ত ব্রহ্মাস্ত্র তেজের দ্বারা এই অস্ত্রের তেজ বিনাশ করো।

শত্রু নিহন্তা অৰ্জুন ভগবানের কথা শুনলেন। তিনি কৃষ্ণকে পরিক্রমা করে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। দুটি অস্ত্রের তেজ পরস্পরকে আক্রমণ করল। দ্যুলোক, ভূর্লোক, অন্তরীক্ষে তা ছড়িয়ে পড়ল। মনে হল প্রলয়কালে উপস্থিত হয়েছে। সূর্য এবং অগ্নি যেন আকাশে বর্ধিত হচ্ছে।

অর্জুন গৌতমীপুত্ৰ অশ্বত্থামাকে ধরে রঞ্জুর দ্বারা পশুর মতো বন্ধন করে শত্রুকে শিবিরে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন–হে পার্থ, একে রক্ষা করা উচিত নয়। এই হত্যাকারীদের বধ করো। যে রাত্রিবেলায় গুপ্তভাবে নিরপরাধ বালকদের বধ করেছে, সে যে নির্দয় খলব্যক্তি। পরপ্রাণের দ্বারা নিজের প্রাণ পরিপুষ্ট করে তাকে বধ করা মঙ্গলজনক এটাই তার প্রায়শ্চিত্ত, না হলে তাকে নরকে গমন করতে হবে। দ্রৌপদীর কাছে তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে যে তোমার পুত্রহন্তারককে ছিন্ন মস্তক তাকে উপহার দেবে। এই আততায়ী আত্মীয় বন্ধুগণের পাপ স্বরূপ। এ কুলাঙ্গার শুধু তোমাদের নয়, নিজ প্রভু দুর্যোধনেরও অপ্রিয় আচরণ করেছে।

কৃষ্ণের দ্বারা উৎসাহিত হয়েও অর্জুন কিন্তু পুত্রহস্তা গুরুপুত্রকে বধ করতে চাইলেন না। তারপর দ্রৌপদীর কাছে অশ্বত্থামাকে সমর্পণ করলেন। পাঞ্চালী রজ্জবদ্ধ পশুর মতো আনীত গুরুপুত্রকে দেখে কৃপা পূর্বক প্রণাম করলেন। তারপর বললেন– হে ব্রাহ্মণ পূজণীয়, একে ছেড়ে দাও, তুমি যার অনুগ্রহে বিভিন্ন অস্ত্রের উপসংহার শিখেছো, সেই ভগবান দ্রোণাচার্য পুত্ররূপে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁর পত্নী কৃপীও আছেন। বীর প্রসবিণীর জন্য পতি সহমরণ করেননি। হে ধর্মজ্ঞ, তুমি গুরুর বংশকে দুঃখিত করো না। মৃতবৎসা আমি যেমন অশ্রু মুখে রোদন করছি, পতিব্রতা এ জননী, গৌতমী যাতে ক্রন্দন না করেন, সেই ব্যবস্থা করো।

ধর্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর যুক্তি পক্ষপাত শূন্য বাক্যের অনুমোদন করলেন। নকুল, সহদেব, সাত্যকি, অর্জুন, দেবকীপুত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তথায় উপস্থিত অসংখ্য পুরুষ ও রমণীরাও এই বাক্যের অনুমোদন করলেন। ভীম এই বাক্যের বিরুদ্ধে গিয়ে বললেন– যে ব্যক্তি প্রভুর স্বার্থ দেখে না, সে যে শিশুদের বিনাশ করেছে, তাঁর বধই উত্তম। ভীম এবং দ্রৌপদীর কথা শুনে সখা অর্জুনের মুখের দিকে চেয়ে শ্রীকৃষ্ণ বললেন– হে অর্জুন ব্রাহ্মণ অধম হলেও বধের যোগ্য নয়, আততায়ী বধের যোগ্য। আমি এই দুজনকেই বলেছি, আমার এই উপায় অনুশাসন তুমি পালন করো। দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিতে তুমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, তা যেন সত্যে পরিণত হয়। ভীমসেন, দ্রৌপদী এবং আমার যাতে ভীতি সঞ্চরন ঘটে তার ব্যবস্থা করো।

সূত বললেন– অর্জুন হঠাৎ শ্রীকৃষ্ণের অভিপ্রায় বুঝতে পারলেন। তিনি অশ্বত্থামার কেশের সঙ্গে যুক্ত শিরভুষণ মণি অসির দ্বারা ছেদন করলেন। শিশু হত্যার জন্য অশ্বত্থামা তখন বিষণ্ণ। এখন মণিহীন হওয়ায় নিস্তেজ অশ্বত্থামাকে আরো ভয় পাবার কোনো কারণ থাকলো না। তাকে রঞ্জুর বন্ধন মুক্ত করে শিবির থেকে বাইরে বের করে দেওয়া হল। মস্তক মুন্ডন, ধনু গ্রহণ, এবং বাসস্থান থেকে নির্বাসন– এই তিনটি হল ব্রাহ্মণদের কাছে বধতুল্য। এছাড়া তাদের কোন দন্ড নেই।

শোকাকুল পাণ্ডবরা মৃত জ্ঞাতিদের জন্য পরলৌকিক কার্য সম্পাদন করলেন।

.

অষ্টম অধ্যায়
শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক উত্তরার গর্ভস্থ পরীক্ষিতের রক্ষা, কুন্তিদেবীর স্তব এবং যুধিষ্ঠিরের অনুতাপ

পাণ্ডবরা মৃত ও জ্ঞাতিদের তর্পণ করার জন্য গঙ্গায় গেলেন। সেখানে তারা স্নান করে, তর্পণ করলেন। হরির পাদপদ্মে পরাগের পবিত্র গঙ্গাজলে অবগাহন করলেন। যুধিষ্ঠির, ধৃতরাষ্ট্র পুত্রশোকে কাতর গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী সকলে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মাধব বোঝালেন, প্রাণীগণের প্রতি কালের প্রভাব অনিবার্য, এর কোনো প্রতিকার নেই। ভগবান ধূর্ত দুর্যোধনাদির দ্বারা অপহৃত যুধিষ্ঠিরের পৌত্রিক রাজ্য তাকে প্রাপ্ত করালেন। দ্রৌপদীর কেশ আকর্ষণ জনিত পাপে নৃপতিদের বিনাশ করলেন। উত্তম কল্পে তিনটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করালেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের যশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি যখন রথে আরোহণ করতে যাবেন, তখন উত্তরা তার সামনে ছুটে এলেন।

উত্তরা বললেন– হে মহাযোগী জগৎপতি আমাকে রক্ষা করো, যে জগতে পরস্পরের থেকে পরস্পরের মৃত্যু হয়, যেখানে একমাত্র তুমি অন্যকে নির্ভরতা প্রদান করতে পারো, হে বিভু, হে ঈশ, এই শর আমার দিকে ছুটে আসছে। এই শর আমাকে দগ্ধ করুক, তাতে আমার বিন্দু মাত্র অনুশোচনা নেই, কিন্তু আমার গর্ভস্থ পুত্রকে তা যেন বিনষ্ট করতে না পারে।

ভক্ত বৎসল ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উত্তরার কথা শ্রবণ করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, পৃথিবীকে পাণ্ডবশূন্য করার জন্য ব্রহ্মাস্ত্র এখন শর রূপ ধারণ করেছে। হে মুনিশ্রেষ্ঠ, পাণ্ডবরা নিজেদের দিকে দীপ্ত পাঁচটি শরকে আসতে দেখলেন। তারা সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র ধারণ করলেন। ভগবান পাণ্ডবদের বিপদ দেখে সুদর্শনের দ্বারা তাদের রক্ষা করলেন। তিনি উত্তরার গর্ভ রক্ষাও করলেন। মহাস্ত্রকে প্রতিহত করলেন। হে শৌণক, যদিও ব্রহ্মাস্ত্র অব্যর্থ এবং প্রতিকারহীন, বৈষ্ণব তেজে তা শান্ত হয়েছিল। যে কৃষ্ণ মায়ার দ্বারা ঐ জগতের সৃষ্টি, পালন এবং প্রলয় বিধান করে থাকেন, তিনি এই ব্রহ্মাস্ত্রের উপশম করে ছিলেন।

ব্ৰহ্মতেজ থেকে মুক্তি পেয়ে পুত্রগণ এবং দ্রৌপদীর সাথে কুন্তীদেবী দ্বারকায় গমনোদ্যত শ্রীকৃষ্ণকে বললেন– ভগবান তুমি সমস্ত প্রাণীর অন্তর জুড়ে অবস্থান করছ অথচ তোমাকে কেউ দেখতে পায় না। যেহেতু তুমি ঈশ্বর এবং সকল কিছুর নিয়ামক, তুমি আদি সনাতন পুরুষ, প্রকৃতির থেকে শ্রেষ্ঠ তুমি প্রকৃতির পরিচালক, তোমাকে আমি নমস্কার করি। নৃত্যগীত কলাবিশিষ্ট অভিনেতাকে দেখলেও সঙ্গীত শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ লোক যেমন তাকে বুঝতে পারে না, তেমনই মায়ার পর্দায় আচ্ছন্ন অতীন্দ্রিয় অব্যয় তোমাকে দেহাভিমানী পুরুষ দেখলেও জানতে পারে না। আমি অজ্ঞ, আমি তোমাকে প্রণাম করছি। তুমি কৃষ্ণ বাসুদেব, দেবকীপুত্র নন্দন। গোবিন্দ তোমাকে নমস্কার করছি। তোমার নাভিতে পদ্ম উৎপন্ন হয়েছে। তোমার গলদেশে পদ্মের মালা বিরাজমান। তোমার নেত্র এবং চরণ পদ্মতুল্য, তোমার উদ্দেশ্যে আমি প্রণিপাত জ্ঞাপন করছি।

হে হৃষিকেশ, কংসের দ্বারা কারারুদ্ধ এবং পুত্রশোকে আহত দেবকীকে তুমি মুক্ত করেছ। পুত্রদের সাথে আমি অনেক বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছি। হে হরি, বিষদান, জতুগৃহ দাহ, রাক্ষসের পীড়ন, অসৎ সভা, বনবাসের কষ্ট, মহারথীদের অস্ত্র, সম্প্রতি অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র থেকে তুমি আমাদের রক্ষা করেছ। হে জগৎগুরু, আমাদের সেই বিপদ নিরন্তর হোক তোমার দর্শন প্রাপ্তির কারণ, তোমাকে দেখলে আর জন্মগ্রহণ করতে হয় না। জন্ম, ঐশ্বর্য, বিদ্যা ও সম্পদের দ্বারা যে সব ব্যক্তি গঠিত, তারা তোমার নাম উচ্চারণ করার অধিকারী নয়। তুমি অকিঞ্চনের প্রাপ্য। যারা অকিঞ্চন অর্থাৎ যাদের কিছু নেই, তারাই তোমার নাম গান করতে পারে। তুমি আত্মারাম শান্ত মুক্তি প্রদাতা, তোমাকে বারবার নমস্কার করি। তুমি প্রাণীদের পরস্পর বিদ্বেষ মুক্ত বিষয় সমদর্শী, তুমি নিয়ন্ত্রক এবং কালস্বরূপ অন্তর্যামী। হে ভগবান, তুমি মানুষের অনুকরণ মাত্র করে থাকো। তোমার অভিপ্রায় কেউ বুঝতে পারে না। প্রিয় বা বিদ্বেষের কোন পাত্র তোমার মধ্যে নেই। হে বিশ্বাত্মা, তোমার জন্ম নেই, তোমার মধ্যে কোনো কর্ম নেই, কারণ তুমি নিজেই আত্মা। তুমি বরাহদি তির্যক, রামচন্দ্ৰাধি মানুষ, নর-নারায়ণাদি ঋষি এবং মৎস্যের মতো জলচর প্রাণীতে তোমার জন্ম ও কর্ম কেবল বিড়ম্বনা অর্থাৎ অনুকর মাত্র। ভয় তোমার ভয়ে ভীত হয়, তুমি দধির ভাণ্ড ভঙ্গ করে অপরাধ করেছিলে। যশোদা রঞ্জু এনেছিলেন। তখন তোমার কী অবস্থা হয়েছিল তা আমাকে বিমোহিত করেছে। তখন তোমার চোখের কাজল জলে ভিজে গিয়েছিল, তুমি ভয়ে ব্যাকুল মুখ নীচু করেছিলে।

কেউ কেউ বলে থাকেন তুমি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের কীর্তি বর্ধনের জন্য প্রিয় যদুবংশে জন্ম গ্রহণ করেছ। আবার কেউ বলে থাকেন, সুতপা ও কৃষ্টিরূপে প্রার্থিত হয়ে বিশ্বের মঙ্গল এবং অসুরদের বিনাশ করার জন্য বসুদেব ও দেবকীর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছ। আবার কেউ বলেন, সমুদ্রে নৌকার মতো পৃথিবী পাপের ভারে অবসন্ন। পৃথিবীর ভার তুলে নেবার জন্য ব্রহ্মার প্রার্থনায় তোমার আবির্ভাব। কেউ বলেন এই সংসারে অবিদ্যা অর্থাৎ আত্মস্বরূপের অজ্ঞানবশত অবিদ্যা নিবৃত্তির নিমিত্ত শ্রবণ এবং স্মরণযোগ্য কাজের জন্য তোমার আগমন। যে সব মানুষেরা তোমার চরিত্র নিরন্তর শ্রবণ। কীর্তন পাঠ স্মরণ ও অভিনন্দন জানায় তারা তোমার চরণ কমল দেখতে পায়। হে প্রভু, নিজ ভক্তদের জন্য তোমার সকল কাজ। আমার পুত্ররা যুদ্ধে অনেক রাজন্যকে দুঃখ দিয়েছে। তোমার চরণকমল ব্যতীত তাদের আর কোনো আশ্রয় নেই। তুমি আমাদের ত্যাগ করে কেন চলে যেতে চাও।

তোমার অদর্শনে খ্যাতি এবং সমৃদ্ধিযুক্ত যদুদের গঠন সম্ববান্বিত পাণ্ডবরা আমার কে? জীবাত্মার অদর্শনে ইন্দ্রিয়গণ অকিঞ্চিৎকর। তোমার অদর্শন হলো। হে গদাধর তুমি এখানে আছো, বলে এই স্থানটি শোভা যুক্ত, ধ্বজ তজাদি চিহ্নিত তোমার চরণ কমল এখানে অঙ্কিত হচ্ছে। তুমি চলে গেলে এই স্থান তার সকল শোভা হারাবে। তোমার দর্শনে চারপাশ পবিত্র হয়ে উঠেছে। হে বিশ্বের ঈশ্বর, বিশ্বাত্মা বিশ্বমুখী, তুমি কেন আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছ? হে মধুপতি, গঙ্গা যেমন সমস্ত পথ অতিক্রান্ত করে সমুদ্রের প্রতি ধাবিত হয়, তেমনই আমার একনিষ্ঠ মতি যেন অবিচ্ছিন্ন ভাবে তোমাতেই প্রীতিলাভ করে। তুমি অর্জুনের সখা, বিষ্ণু বংশের শ্রেষ্ঠ, বাতাস যেমন বনস্থ বংশের পরস্পর সংঘর্ষের দ্বারা অগ্নি উৎপাদন করে তার বিনাশ করে, তুমিও অত্যাচারী রাজন্যবর্গের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ঘটিয়ে তাদের বিনাশ করেছ। হে গোবিন্দ, গো ব্রাহ্মণ এবং দেবতাদিগের জন্য তুমি বিগ্রহ প্রকট করেছ। হে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ তোমাকে নমস্কার।

সূত বললেন– কুন্তি ভগবানের সমস্ত মহিমার স্তব করলেন, কৃষ্ণ তখন মৃদু মৃদু হাসছেন। কুন্তী দেবীর প্রার্থনা অঙ্গীকার করে হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলেন। সুভদ্রা প্রমুখ সমস্ত স্ত্রীদের সম্মতি নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় যাবার উপক্রম করলেন। এবার যুধিষ্ঠির প্রেমপূর্বক তাঁকে নিষেধ করলেন। ভগবানের অভিপ্রায় না জানার জন্য ব্যাস প্রভৃতি মুনি গণের দ্বারা এবং অদ্যুত কৰ্মা শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা ইতিহাস উল্লেখ পূর্বক উপদেশ দিলেও শোকাকুল যুধিষ্ঠির তা বুঝতে পারলেন না।

তিনি আত্মীয় স্বজনের বধ চিন্তা করে বললেন– ওহে দুরাত্মা আমার হৃদয়ে আবির্ভূত অজ্ঞানতা দেখো। এই দেহের জন্য আমি বহু অক্ষোয়িণী সৈন্য হত্যা করেছি। বালক, বাহ্মণ, আত্মীয়, বন্ধু, পিতৃব্য ভ্রাতা ও গুরুজনদের বধ করেছি। বহু কাল নরকে থাকলেও আমার পাপ স্খলন হবে না। ধর্মযুদ্ধে অর্থাৎ অন্য রাজা রাজ্য আক্রমণ করলে প্রজাদের রক্ষার জন্য শত্রুদের বধ করা প্রজারক্ষক রাজার পক্ষে পাপকার্য নয়। এই শাস্ত্রের অনুশাসন আমি বুঝতে পারছি না। আমার দ্বারা নিহত আত্মীয়দের রমণীগণের যে বিদ্বেষ উত্থিত হয়েছে তা আমি নিবারণে করতে সক্ষম নয়। পঙ্কমিশ্রিত জল পঙ্কের দ্বারা শুদ্ধ করা যায় না। অল্প মদ্যপান জনিত অপরাধ প্রচুর মদ্যের দ্বারা শোধন করা যায় না, দৈবাৎ একটি প্রাণী হত্যা হয়ে গেলে ইচ্ছাকৃত হিংসা বহুল যজ্ঞের দ্বারা তা স্খলন হয় কি?

.

নবম অধ্যায়
ভীষ্মের কাছে যুধিষ্ঠির এবং অন্যান্যদের গমন, বিবিধ ধর্মের উপদেশ, শ্রীকৃষ্ণের স্তব করতে করতে ভীষ্মের মহানির্বাণ

সূত বললেন– প্রাণী হত্যার ভয়ে ভীত যুধিষ্ঠির ভীষ্মের শরশয্যার অঞ্চলে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তখন অন্যান্য ভ্রাতারা তাকে অনুসরণ করলেন। ব্যাসদেব ধৌম্য প্রভৃতি ব্রাহ্মণেরা অশ্বযুক্ত স্বর্ণভূষিত রথে অনুগমন করলেন। ভগবান অর্জুনের সাথে রথে চড়ে বসলেন। রাজা যুধিষ্ঠির তাদের পরিবেষ্টিত হয়ে কুবেরের মতো শোভিত হলেন। স্বর্গভ্রষ্ট দেবতার মতো ভূমিতে পতিত ভীষ্মকে দেখে তারা সকলে প্রণাম করলেন। মহর্ষি, দেবর্ষি রাজর্ষিরা ভরত বংশ প্রধান ভীষ্মকে দেখার জন্য সেখানে সমাগত হলেন। এলেন পর্বত, নারদ, ধৌম্য, ভগবান ব্যাসদেব, বৃহস্মন ভরদ্বাজ এবং সশিব্য পরশুরাম, এলেন বশিষ্ঠ, ইন্দ্র, প্রমদ, ক্রীত, গৃৎসবাদ, অসিত, কাক্ষীবান, গৌতম, অত্রি, ঐবিশ্বামিত্র এবং সুদর্শন। এলেন কাশ্যপ, বৃহস্পতি প্রভৃতি ঋষিগণ।

বসুশ্রেষ্ঠ ভীষ্মদেব সকলকে দেখে সম্মান করলেন। শ্রীকৃষ্ণকেও ভীষ্মদেব পূজো করলেন, বিনয় এবং অনুরাগে পরিপূর্ণ পাণ্ডবেরা তার কাছে বসেছিলেন। ভীষ্মদেব স্নেহাশ্রুতে আকুল নয়নে বললেন–হে ধর্মনন্দনগণ, তোমরা কষ্ট করে জীবিত থাকার যোগ্য নও। ব্রাহ্মণধর্ম এবং অচ্যুতের আশ্রয়ে থেকেও যে ক্লেশে তোমাদের কালাতিবাহিত করতে হল এটি খুবই কষ্টের বিষয়। বীর পাণ্ডুর মৃত্যুর পর কুন্তী বধু ছিলেন এবং তোমরাও ছিলে বালক, তোমাদের জন্য তিনি অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন বারবার। মেঘসকল, যেমন বাসুর অধীন, তেমনই লোকপালদের সাথে সমস্ত লোকই কালের অধীন। ধর্মপুত্ররাজ যুধিষ্টির, গদাধারী ভীম, ধনুন্বীর অর্জুন, গাণ্ডীব যার ধনু, যাদের বন্ধু স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ সেখানেও বিপদ উপস্থিত হয়েছে। এই কৃষ্ণের অভিপ্রায় কী তা কি আমরা জানতে পারি। হে ভরতশ্রেষ্ঠ, হে নাথ, হে প্রভু এই সব দুঃখ দৈবের অধীন। এই দেহ সেই কৃষ্ণ। তাঁর অনুবর্তী অনাথ প্রজাদের পালন করে।

এই যে কৃষ্ণকে দেখছ, ইনি স্বয়ং ভগবান আদি পুরুষ মহশ্রেষ্ঠ নারায়ণ, ইনি মায়ার দ্বারা লোককে বিমোহিত করেন। ইনি যদুবংশে বিচরণ করছেন। হে নৃপ, এই কৃষ্ণের গোষ্ঠনীয় প্রভাব ভগবান শিব দেবর্ষি নারদ সাক্ষাৎ ভগবান কপিল জানেন। যাঁকে তোমরা তোমাদের নতুন পুত্র আন্তরিক বন্ধু বলে মনে করছ তাকে তোমরা প্রীতিবশত মন্ত্রী, দূত আর রথের সারথি করেছ। হে মহারাজ, একান্ত ভক্তের প্রতি তার অনুকল্প দেখো। সাক্ষাৎ ব্রহ্মস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ মরণকালে নিজে এসেই উপস্থিত হয়েছেন। যতক্ষণ আমি এই দেহ ত্যাগ না করছি, ততক্ষণ চতুর্বাহু আমার ধ্যান পথের পথিক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমার সম্মুখে অপেক্ষা করবেন।

সূত বললেন– যুধিষ্ঠির তা শুনে মুনিদের সমক্ষে শর শয্যায় শায়িত ভীষ্মকে ধর্মের কথা জিজ্ঞাসা করলেন –মানুষ মাত্র স্বভাবজনিত যে ধর্ম, বর্ণ এবং আশ্রম বিহিত যে ধর্ম সংসারে বিরহ এবং অনুরঞ্জনের বিদগ্ধ, নিবৃত্তি এ প্রবৃত্তি ধর্ম বদ্যধর্ম, দানধর্ম, মোক্ষধর্ম সংক্ষেপে এবং বিস্তার পূর্বক বললেন। ভীষ্মদেব নানা আখ্যানে ইতিহাসে বর্ণিত ধর্ম, কাম, মোক্ষ এবং তাদের প্রাপ্তির উপায়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করলেন। ধর্মের কথা বলতে বলতে ইচ্ছামৃত্যু যোগী ভীষ্মের বাঞ্ছিত উত্তরায়ণ কাল উপস্থিত হল। যুদ্ধে যিনি সহস্র রথীদের রক্ষা করতেন, সেই ভীষ্ম কথা বলা বন্ধ করলেন। শূন্য পীতবসন পরিহিত আদিপুরুষ চতুর্ভুজ শ্রীকৃষ্ণের আসক্তি শূন্য মন নিযুক্ত করলেন। তাঁর অশুভগুলি বিনষ্ট হল ভগবানের কৃপা অবলোকনে। অস্ত্রাষ্টতের শতনা চলে গেলে ইন্দ্রিয়ের চাঞ্চল্য দূরীভূত হল। তিনি শ্রীকৃষ্ণের স্তব করতে লাগলেন। যার প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি প্রবাহ হয় এবং যিনি লীলা খেলার জন্য কখনও নিজ প্রকৃতিকে স্বীকার করে থাকেন, সেই কৃষ্ণকে প্রণাম করি। ত্রিভুবনের মধ্যে কমনণীয় তমালের মতো কৃষ্ণবর্ণ সূর্যকিরণের মতো উজ্জ্বল বসন পরিহিত কেশদামে আবৃত নয়নকমল যার বিগ্রহ সেই অর্জুনের প্রিয়সখা শ্রীকৃষ্ণে আমার নির্মল মতি হোক।

আমার শরের দ্বারা যার দেহ ক্ষত বিক্ষত হয়ে গাত্রাবরণ ছিন্ন বিছিন্ন হয়েছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে অশ্বখুরস্থিত ধুলির দ্বারা ধূসরবর্ণ এবং বিক্ষিপ্ত তেজ সমুহের সাথে সংলগ্ন কর্মে সুশোভিত আসন বিশিষ্ট শ্রীকৃষ্ণে আমার মন যুক্ত হোক।

অর্জুনের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ কুরু এবং পাণ্ডব রথ স্থাপন করে বললেন, যিনি কাল দৃষ্টির দ্বারা বিপক্ষ সৈন্যদের আয়ু হরণ করেছিলেন সেই অর্জুনসখা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আমার ব্রতী হোক, দূরস্থিত বিপক্ষ সৈন্যের প্রধানদের দোষ ও বুদ্ধিতে স্বজন বধ থেকে নিবৃত্ত অর্জুনের অজ্ঞানতা যিনি আত্মবিদ্যায় দূরীভূত করেছিলেন, সেই সর্বোত্তম কৃষ্ণের প্রতি আমার মন স্থাপিত হোক। যিনি নিজের প্রতিষ্ঠা বিসর্জন দিয়ে আমার প্রতিজ্ঞা সত্যে পরিণত করার জন্য রথ থেকে নেমে এসে রথচক্র ধারণ করেছিলেন, তার প্রতি আমার সমস্ত শ্রদ্ধা আপ্লুত হোক। যিনি স্বলিত উত্তরীয় হয়ে আমার দিকে ছুটে এসেছিলেন এবং আততায়ী আমার তীক্ষ্ম বাণের দ্বারা বিধ্বস্ত কবচ রক্ষাপুত আমাকে বধের জন্য বলপূর্বক আমার দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। সেই ভগবান মুকুন্দ আমার গতি হোক। এই যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিগণ যাকে দেখে মুক্তিলাভ করেছিলেন, অর্জুনের রথকে যিনি কুটুম্বের মতো রক্ষা করে জল হাতে অশ্বতাড়নের জন্য চাবুক এবং ডানহাতে অশ্বের রজ্জ্ব ধারণ করে শোওমান হলে সেই ভগবানের। প্রতি আমার মতি হোক।

যাঁর সুন্দর গমন, মধুর হাবভাব, মৃদুমন্দ হাসি এবং প্রণয়পূর্বক অবলোকনের দ্বারা সম্মানিত গোপনাঙ্গ প্রেমে উন্মত্ত হয়ে গোবর্ধন ধারণাদি কর্মের অনুকরণ করে কৃষ্ণের স্বরূপ লাভ করেছিলেন, সেই কৃষ্ণে আমার গতি হোক।

যিনি নিজ কল্পিত প্রাণীদের প্রতি হৃদয়ের অন্তর্যামী রূপে অধিষ্ঠিত, এক সূর্য যেমন প্রত্যেকের চক্ষুতে বহু বলে মনে হয়, এক অদ্বিতীয় এই আমার সামনে উপস্থিত সেই কৃষ্ণকে আমি লাভ করেছি।

সূত বললেন– ভীষ্ম মন, বাক্য এবং চক্ষু ক্রিয়ার দ্বারা ভগবান পরমাত্মা কৃষ্ণর সন্নিবিষ্ট হয়ে অন্তরের প্রাণের বায়ু বিলীন করে নিবৃত্ত হলেন। তার প্রাণবায়ু বহির্গত না হয়ে অন্তর আত্মা শ্রীকৃষ্ণে লীন হয়ে গেল।

দিবাবসানে পক্ষীগণের মতো সকলে নীরব হলেন। দেবতা এবং মানবের দ্বারা বাদিত হয়ে দুন্দুভি বেজে উঠল। রাজাদের মধ্যে যাঁরা অসূয়া শূন্য সাধু। তারা ভীষ্মের প্রশংসা করলেন। আকাশ থেকে পুষ্প বৃষ্টি হতে থাকলো। হে শৌণক, মোক্ষ প্রাপ্ত হলেও ভীষ্মের দেহাদি সংস্কার করায় যুধিষ্ঠির ক্ষণকাল দুঃখিত হলেন। মুনিরা আনন্দিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে গোপনীয় নামের দ্বারা স্তব করতে থাকলেন। তারপর নিজ নিজ আশ্রমে ফিরে গেলেন। কৃষ্ণের সাথে যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্র এবং তপস্বিনী গান্ধারীকে সান্ত্বনা দিলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি ক্রমে এবং কৃষ্ণের অনুমোদন প্রাপ্ত হয়ে পিতৃ পিতামহের রাজ্য ধর্মানুসারে শাসন করতে থাকলেন।

.

দশম অধ্যায়
শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা অভিমুখে যাত্রা

শৌণক প্রশ্ন করলেন– ধার্মিক শ্রেষ্ঠ মহারাজ যুধিষ্ঠির কিভাবে রাজ্য শাসনে প্রবৃত্ত হলেন?

সূত জবাব দিলেন বিশ্বপালক এবং সর্বনিয়ামক শ্রীকৃষ্ণ কুরু বংশকে সঞ্জীবিত করে এবং যুধিষ্ঠিরকে নিজ রাজ্যে স্থাপন করে আনন্দিত হয়েছিলেন। ভীষ্ম এবং কৃষ্ণের জ্ঞানে ধর্ম-নন্দন যুধিষ্ঠিরের জ্ঞান উদয় ঘটে। তার ভ্রম বিলোপিত হয়। তিনি ইন্দ্রের মতো আসমুদ্র পৃথিবী শাসন করতে লাগলেন। তার শাসনকালে মানুষেরা ইচ্ছানুসারে বৃষ্টি দান করত। পৃথিবীর সমস্ত অভীষ্ট বস্তু অনায়াসে উৎপাদিত হত। দুগ্ধবতী গাভীরা আনন্দে দুগ্ধের দ্বারা এক একটি গোষ্ঠকে পরিপ্লাবিত করত। যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছানুসারে নদী, সমুদ্র এবং পর্বত অনুকূল হয়েছিল। বৃক্ষলতা সর্বকালে ফল দিতে থাকে। যুধিষ্ঠিরের কোনো শত্রু ছিল না। তার অধীনস্থ প্রজাগণের আধিদৈবিক আধিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক ক্লেশ ছিল না। তারা মানবিক এবং শারীরিক যন্ত্রণাকে জয় করতে পেরেছিল।

শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের অনুমতি নিয়ে দ্বারকা যাবার জন্য রথে আরোহন করলেন। এর আগে তিনি হস্তিনাপুরে কয়েকমাস অতিবাহিত করেছিলেন। সুভদ্রা, দ্রৌপদী, কুন্তী, বিরাট তনয়া উত্তরা, গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্র, যুযুৎসু, নকুল, সহদেব, ভীম এবং সত্যবতী প্রমুখেরা কৃষ্ণের বিরহ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেন না। পাণ্ডবরা কৃষ্ণের সাথে একত্রে উপবেশন, ভোজন, দর্শন স্পর্শ করেছেন, কৃষ্ণের প্রতি তাদের চিত্ত সমর্পণ করেছেন, তারা কী করে কৃষ্ণবিরহ সহ্য করবেন।

ব্যাকুল চিত্ত পাণ্ডবরা অনিমিখ নয়নে কৃষ্ণকে দেখতে দেখতে তাকে অনুসরণ করলেন। কৃষ্ণ তাদের গৃহ থেকে নির্গত হলেন। বন্ধু স্ত্রীরা নয়নের অশ্রু নয়নেই নিরুদ্ধ রাখলেন। যাতে কৃষ্ণের অমঙ্গল না হয়। মৃদঙ্গের আওয়াজ শোনা গেল, বেজে উঠল শঙ্খ, ভেরী, বীণা, গোমুখী, দুন্দুভি। অট্টালিকার ওপর আরোহণ করে কুলনারীরা কৃষ্ণকে দেখে পুষ্প বর্ষণ করেছিলেন। তাদের হৃদয়ে প্রেম এবং লজ্জার জাগরণ ঘটে গিয়েছিল। তাদের মুখমণ্ডলে ঈষৎ হাস্যের প্রতিচ্ছবি। জিতেন্দ্রিয় অর্জুন, বাসুদেবের মস্তকের ওপর শুভ্রছত্র ধারণ করলেন। সাতকী রমণীয় চাদর গ্রহণ করলেন। পথে কুসুম বর্ষিত হতে থাকল। ব্রাহ্মণগণ সত্য আশীষ বাণী উচ্চারণ করলেন। তার মধ্যে নিষ্ঠুন ব্রহ্মের অনুরূপ আশীষ ছিল। কোনো কোনো স্তোত্রের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের বর্ণনা করা হল।

পুররমণীদের পরস্পর আলাপ সকজনের শ্রুতিমধুর হয়েছিল। তারা কৃষ্ণকে সকল গুণের কার্যসৃষ্টির স্রষ্টা হিসাবে গ্রহণ করলেন। কৃষ্ণ প্রপঞ্চতীত, তিনি নিজ স্বরূপে একই বিদ্যমান। নাম এবং রূপবিহীন জীবন্মাতে দেবতা মানুষ ইত্যাদি নাম এবং রূপ সৃষ্টি করার জন্য তিনি বেদশাস্ত্র প্রণয়ন করেন। প্রাণবায়ু জয় করে জিতেন্দ্রিয় সূক্ষ্মদর্শী ঋষিরা বিশুদ্ধ বুদ্ধিতে যাঁর স্বরূপ দেখতে পান, তিনি হলেন পরম পুরুষ বাসুদেব।

হে সখী, যে ঈশ্বর স্বেচ্ছায় একাকী বিশ্বের সৃজন, পালন এবং সংহার করে থাকেন, অথচ বিশ্বের প্রতি বিন্দুমাত্র আসক্ত হন না, তিনিই হলেন শ্রীকৃষ্ণ। শাস্ত্রে তার এই গোপনীয় তত্ত্ব বিশ্লেষিত হয়েছে ও জ্ঞানীরা তার পবিত্র কথা সদা সর্বদা কীর্তন করেন। অবিশুদ্ধ বুদ্ধির নৃপতিরা পর পীড়নের দ্বারা নিজেদের প্রাণ পোষণ করেন, তখন জগতের কল্যাণের জন্য বাসুদেব ছত্ররূপ ধারণ করেন। যুগে যুগে তিনি তম, সত্ত্ব, দয়া এবং যশ প্রকটিত করেন। যদুবংশ অত্যন্ত প্রশংসনীয় মধুবন অর্থাৎ মথুরা ক্ষেত্র অত্যন্ত পুণ্যতম, পুরুষশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ নিজের জন্ম এবং গমনের দ্বারা এই মৈত্রকে সন্মানিত করেছেন।

দ্বারকা স্বর্গের যশকে তিরস্কার করে পৃথিবীকে পূণ্যবতী এবং যশবতী করেছেন। সেখানকার প্রজারা শ্রীকৃষ্ণের প্রফুল্ল বদন দেখে থাকেন। হে সখি, যাঁকে লাভ করার জন্য ব্রজরমণীরা সন্মোহিত, শ্রীকৃষ্ণ যাঁদের পানি গ্রহণ করেছেন, তারা বহু ব্রত স্নান এবং হোমাগ্নির দ্বারা ঈশ্বররের অর্চনা করেছেন। তিনি শিশুপাল প্রমুখ রাজন্যবর্গকে পরাভূত করেছেন। যাঁরা প্রত্যুম্ন প্রভৃতি জননী এবং নরকাসুর বধে অপর সহস্র রমণীগণও যার দ্বারা আসীন হয়েছিলেন তিনিই কৃষ্ণ। স্ত্রী জাতির স্বাধীনতা এবং পবিত্রতা না থাকলেও এই সকল স্ত্রীরা স্ত্রীত্বকে শোভিত করেছিলেন।

সূত আরও বললেন– পুর রমণীগণের এইসব বিচিত্র কথা শোনা গেল। তাদের অভিনন্দিত করে শ্রীকৃষ্ণ গমন করলেন। শ্রীকৃষ্ণের রক্ষার জন্য চতুরঙ্গিণী সৈন্যবাহিনীকে যুধিষ্ঠির প্রেরণ করেছিলেন। ভগবানের বীরত্বে কাতর পাণ্ডবগণকে তিনি নিবৃত্ত করেন। শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধব প্রমুখ যাদবদের সাথে। দ্বারকায় গমন করলেন। হে ভার্গব, শ্রীকৃষ্ণ কুরু, জাঙ্গল, পাতাল সুরলোক, দেশ। যমুনার নিকটবর্তী দেশ ব্ৰহ্মাবর্ত, কুরুক্ষেত্র, মৎস্য সরস্বতী নদীর নিকটবর্তী দেশ, মরুভূমি, অল্প জলযুক্ত দেখা অতিক্রম করে গৌরীর ও অবীর দেশের পরবর্তী দ্বার প্রদেশে পৌঁছলেন।

সেই দেশে সেখানকার জনগণের দ্বারা নিবেদিত উপহারে পূজিত হলেন। তখন অস্তমিত হয়েছে।

.

একাদশ অধ্যায়
দ্বারকাবাসীগণ কর্তৃক শ্রীকৃষ্ণের সংবর্ধনা এবং নগরে প্রবেশ

সূত বললেন–ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় উপনীত হলেন। প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করার জন্য পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজালেন। তার করকমলে বর্তমান শুভ্র শঙ্খ শব্দ করতে করতে রক্তবর্ণ কমলসমূহের মধ্যে কলহংসের মতো শোভা পেতে লাগলো। প্রভুর দর্শন ইচ্ছায় প্রজা সকল তার নিকট এসে উপস্থিত হল। সুর্যের কোন আলোকের অপেক্ষা না থাকলেও লোকেরা যেমন দিকদান করে থাকে তেমন ভাবেই শ্রীকৃষ্ণকে প্রজারা নানাবিধ উপহার প্রদান করল। বালকেরা যেমন গৃহস্থ পিতার কছে আবদার করে বসে তেমনই গন্ধ এবং রক্ষক শ্রীকৃষ্ণকে তারা গদগদ বাক্যে বলতে লাগল- হে নাথ, এ জগতের মঙ্গলকামী জনগণের একমাত্র আশ্রয় হলে তুমি। ব্রহ্মা, সনকাদি ঋষি এবং দেবতাদের দ্বারা তুমি পূজিত। তোমার চরণ কমলে আমরা প্রণত হই। ব্রহ্মাদির ওপর প্রভুত্ব কারী কালও তোমার চরণে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তুমি আমাদের মঙ্গলের জন্য বিশ্বপালক হও, তুমি আমাদের মাতা, পিতা, সুহৃদ এবং পতি অর্থাৎ রক্ষক। তোমার অনুগমনের দ্বারা আমরা কৃতার্থ হয়েছি। তুমি আমাদের পরম দেবতা তোমার দ্বারা আমরা উপযুক্ত রক্ষকযুক্ত হয়েছি। তুমি স্নিগ্ধ দৃষ্টিপূর্ণ বদন কমলে বিরাজমান। হে পদ্মপলাশ লোচন, আমাদের ছেড়ে তুমি যখন হস্তিনাপুর অথবা মথুরা মণ্ডলে যাও, যখন সূর্য ব্যতীত চক্ষুর মতো চারপাশে অন্ধকার নেমে আসে, তোমার বিরহে হে অচ্যুত, ক্ষণকালকেও কোটি বছর বলে মনে হয়। হে নাথ, তুমি দীর্ঘকাল প্রবাসে থাকলে আমরা কী করে জীবিত থাকব।

ভক্তবৎসল বাসুদেব প্রজাদের উচ্চারিত এইসকল শব্দ শ্রবণ করতে করতে দ্বারকাপুরে প্রবেশ করলেন। নাগরা যেভাবে ভোগবতী পরীকে রক্ষা করে, যেভাবে নিজের মতো বলশালী মধুপ বোঝ দশাট, কুকুর, অন্ধক, এবং বৃক্ষরা সে নগরী রক্ষা করত। সেই নগরীতে সমস্ত ঋতুর ফল এবং পুষ্পদি শোভা বিদ্যমানই, যেখানে পদ্ম উৎপাদনে সরোবর শোভা আছে। নগরীর প্রধান দ্বার, গৃহদ্বার এবং পথে পথে উৎসব জনিত তোড়ন নির্মাণ করা হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণের ধবজা উড়ছে। নগরীর প্রধান পথ, ছোট পথ, হাটবাজার পরিষ্কার করা হয়েছে। সুগন্ধ জলের দ্বারা নগরীকে সিক্ত করা হয়েছে। ফল, পুষ্প এবং যবের অঙ্কুর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি গৃহদ্বার দধি, আতপ চাল, ফল, ইক্ষুদণ্ড পূর্ণ কুম্ভ এবং পূজার উপকরণ রাখা হয়েছে।

এই সুশোভিত নগরীতে প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণ এসেছেন, শুনে উদারচিত্ত বসুদেব অত্রুর, উগ্রসেন, অদ্ভুত বিক্রম, বলরাম, প্রদ্যুম্ন, চারুদেষ্ণ এবং জাম্ববতী পুত্র শাম্ব হস্তীকে সামনে রেখে কাছে চলে এলেন। তারা মঙ্গলজয় পুষ্পহস্ত ব্রাহ্মণদের সাথে শঙ্খ, তুর্য এবং বেদধ্বনির দ্বারা উৎসাহিত হয়ে ভগবানের কাছে গেলেন। শত শত শ্রেষ্ঠ বারঙ্গণারা কৃষ্ণদর্শনের লালসায়? মানে আরোহণপূর্বক তার কাছে গেলেন। নট, নর্তক, গায়ক, সুত, মগধ এবং বন্দীনিরা ভগবানের কার্যসকল গান করতে থাকল, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিকটে এসে পৌঁছলেন। তিনি সেখানে পৌঁছে কাউকে হস্তধারণ দ্বারা সম্মানিত করলেন। আচন্ডাল সকলকে অভয় এবং অভিলষিত বস্তু দিয়ে বন্দিত করলেন। পিতা মহাদি গুরুবর্গ এবং সপত্নীক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদ গ্রহণ করলেন। অন্যান্য বন্দিদের সন্মান লাভ করে নগরে প্রবেশ করলেন।

কৃষ্ণ রাজপথে এলে দ্বাররক্ষক কুলরমণীরা তার দর্শনে আহ্লাদিত হলেন। দ্বারকাবাসীরা নিত্য ভগবানকে দেখলেন, তাদের নয়নের তৃপ্তি সাধন হয়নি। কারণ শ্রী বিগ্রহ সকল শোভার আশ্রয় ছিল। যাঁর বক্ষস্থল মহালক্ষ্মীর নিবাসস্থল, সৌন্দর্য এবং অমৃত পূর্ণ মুখমণ্ডল সমস্ত প্রাণীর নয়নের পানপাত্র, যাঁর বাহু লোকপালদের আশ্রয়স্থল, যার চরণকমল ভক্তগণের বাসস্থান, তিনি হলেন কৃষ্ণ। সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, ইন্দ্রধনু এবং বিদ্যুতের দ্বারা মেঘ যেমন শোভা পায়, শ্বেতবর্ণ ছত্র এবং চামরের দ্বারা মুণ্ডিত, চারদিকে থেকে পুষ্প বর্ষণে অভিবর্ষিত শ্রীকৃষ্ণ পীতবসন এবং বনমালার দ্বারা পথে পথে শোভিত হয়ে ছিলেন। তিনি মাতা পিতার গৃহে প্রবেশ করলেন। মাতৃগণের দ্বারা আলিঙ্গিত হলেন। দেবকী প্রমুখ ষাটজন মাতাকে মস্তকের দ্বারা প্রণাম করলেন। তারা পুত্রকে কোলে করে আনন্দে বিহ্বল হয়ে চোখের জল বিসর্জন করলেন। পুত্র স্নেহে তাদের স্তন থেকে দুগ্ধ ক্ষরিত হচ্ছিল।

তারপর সমস্ত কাম্য দ্রব্যে পরিপূর্ণ উত্তম নিজ ভবনে প্রবেশ করলেন। ষোলো হাজার পত্নী ও অট্টালিকা সেখানে ছিল। প্রিয়াগত পতিকে দূর থেকে দেখে পত্নীদের মনে মহান আনন্দ উপস্থিত হল। তারা লজ্জায় অবনতমুখী হয়ে আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর অভিপ্রায় যুক্ত রমণীদের প্রথমে মনে মনে, তারপর দৃষ্টির দ্বারা, পরবর্তীকালে পুত্রের দ্বারা এবং পরিশেষে নিজেরা পতিকে আলিঙ্গন করলেন। লজ্জাশীলা সেই রমণীদের নেত্র থেকে নিরুদ্ধ হলেও কিছু অশ্রু বহির্গত হতে থাকল।

বাতাস যেমন বৃক্ষের সংঘর্ষের দ্বারা অগ্নি উৎপাদন করে যাদের ভস্ম করে দেয়, কৃষ্ণ সেইভাবে উদ্ধত প্রভাবশালী নৃপতিদের মধ্যে পরস্পর কলহ বাঁধিয়ে যুদ্ধ সংঘর্ষ করলেন। নিজে যোগমায়ার দ্বারা নরলোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্ত্রী রত্ন সমুহে অবস্থিত থেকে প্রাকৃত জনের মতো বিহার করতেন। যাদের উদ্দাম ভাব, নির্মলহাসি এবং লজ্জাযুক্ত চাউনির দ্বারা বিস্ময়ে বশীভূত প্রাকৃত মদন চাপ নিক্ষেপ করত, মোট সর্বোত্তম প্রমদাগণ কপট বিলাশের ভান করেও শ্রীকৃষ্ণের চিত্তে চাঞ্চল্য ঘটাতে পারেনি।

ভগবান প্রাকৃত গুণে অনাসক্ত থেকে নাশ কার্যে ব্যাপৃত থাকতেন। তত্ত্বজ্ঞ প্রকৃত সাধারণ লোক তাকেই নিজেদের মতো কামাসক্ত লোক বলে মনে করত। এটাই ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব। তিনি প্রকৃতিতে থেকেও তার গুণের দ্বারা লিপ্ত হন না, বুদ্ধি যেভাবে আত্মাকে আশ্রয় করে থাকলে ও আত্মার আনন্দ প্রভৃতি গুণের দ্বারাও যুক্ত হয় না, সেইভাবে ভগবান আচরণ করে থাকতেন।

.

দ্বাদশ অধ্যায়
পরীক্ষিতের জন্মোৎসব

শৌণক বললেন– হে সূত, অশ্বত্থামা কর্তৃক নিক্ষিপ্ত ব্রহ্মসেনা নামক অস্ত্রে উত্তরার গর্ভ পীড়িত হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ আবার তাঁকে পঞ্জীপূত করলেন। ভাগবত শ্রবণে শ্রদ্ধারূপ যার মহতী বৃদ্ধি এবং মহান ধৈর্যশীল সেই পরীক্ষিতের জন্ম, কর্ম এবং নিধন কীভাবে হয়েছিল, আমি এখন তা শুনতে ইচ্ছা করি। যদি তা বলার যোগ্য বলে মনে করো, আমাদের কাছে তা বিরত করো।

সূত বললেন– সংসাদিত বস্তু থেকে নিস্পৃহ হয়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পিতার মতো প্রজাদের পালন করতে থাকলেন। সুস্পষ্ট যজ্ঞসমূহ থেকে অর্জিত স্বর্গলোকে মহিষী ভ্রাতৃগণ জম্বুদ্বীপে আধিপত্য স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তৃত ফনা যুধিষ্ঠিরকে আনন্দ দিতে পেরেছে। ক্ষুধিত ব্যক্তির খাদ্যবস্তু ছাড়া অন্য কিছুতে যেমন প্রীতি হয় না। কৃষ্ণনিষ্ঠ যুধিষ্ঠির কৃষ্ণভক্তি ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে সুখলাভ করে নি।

হে ভৃগুনন্দন, মাতা উত্তরার গর্ভস্থ এবং ব্রাহ্মস্ত্রের তেজে বাহ্যমান পরীক্ষিত তখন সেই পুরুষকে দেখেছিলেন। সে পুরুষের মাথায় উজ্জ্বল সুবর্ণের কিরীট, মনোহর রূপ তার শ্যাম বর্ণ সম্পন্ন, বিদ্যুতের মতো বস্ত্র পরিহিত এবং তিনি নির্মল ও নির্বিকার। তার সুন্দর দীর্ঘ চারটি বাহু, তপ্ত কাঞ্চনের মতো উজ্জ্বল দুটি কুণ্ডল, চক্ষুদুটি রক্ত বর্ণের এবং হাতে গদা ছিল। তিনি উল্কার মতো গদা ঘোরাতে ঘোরাতে চারিদিকে ভ্রমণ করছিলেন। সূর্য যেমন নীহারকে বিনাশ করে, তেমনই তিনি নিজের গদার দ্বারা অস্ত্রের তেজ নিবারণ করে ছিলেন। পরীক্ষিত নিকট অবস্থিত, সেই পুরুষকে দেখে ভাবলেন, ইনি কে? এরূপ বিচার করেছিলেন মানুষের যুক্তি তর্ক বিচারের অতীত ধর্মের পালক সর্বময় সর্বেশ্বর্যময় পাপাদি অর্থাৎ সকল দুঃখের প্রশমনকারী হরি সেই অস্ত্র বিনাশ করেন। দশমহলের গর্ভস্থ শিশুর সামনে সেখানে অন্তর্হিত হয়ে যান।

দ্বিতীয় পাণ্ডবের মতো পাণ্ডুর বংশের পরীক্ষিতের জন্ম হল। সন্তুষ্ট চিত্ত মহারাজ যুধিষ্ঠির সৌম্য, ধৌম্য, কৃপাচার্য প্রভৃতি ব্রাহ্মণ গণের দ্বারা শ্রোতৃবাচন পূর্বক পৌত্রের জাত কর্ম করালেন। দানযজ্ঞ কালে রাজা যুধিষ্ঠির পৌত্র জন্মের জন্য ব্রাহ্মণদের সুবর্ণ গাভী, ভূমি, গ্রহ, অশ্ব, হস্তি এবং মিষ্টান্ন দান করলেন; তারপর পরিতুষ্ট ব্রাহ্মণ গণ মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে বললেন– হে কুরু বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি, কুরু বংশীয় এই সূর্যবংশে দুর্বার দৈবকর্তৃক বিনাশ উপস্থিত হলে তোমাদের অনুগ্রহের নিমিত্ত বিষ্ণু একে দিয়েছেন। হে মহা ভগবান, এজন্য এই বালক বিষ্ণুরাত অর্থাৎ কর্তৃক নামে খ্যাত হবে। বংশ গুণে কথাভাগবতেও শ্রেষ্ঠ হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।

যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেনহে ব্রাহ্মণগণ যশ এবং কীর্তির দ্বারা এ বংশের মহাত্মা পূণ্য যশস্বী, রাজর্ষিদের অনুবর্তন করতে হবে।

ব্রাহ্মণগণ বললেন– হে যুধিষ্টির এ বিষয়ে তুমি বিন্দুমাত্র সংশয় প্রকাশ করো না। এ বালক মনুপুত্র ইক্ষাকুর মতো প্রজা রক্ষক হবে। দশরথ পুত্র রামচন্দ্রের মতো ব্রাহ্মণদের হিতৈষী এবং সত্য প্রতিজ্ঞা হবেন। কুশিনর দেশের রাজা শিবির মতো দাতা এবং শরণাগত পালক হবে। দুষ্মন্তের পুত্র রাজা ভরতের মতো জ্ঞাতিগণ এবং যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণদের মধ্যে যশ বিস্তার করবে। ধনুর্ধারী বীরদের অগ্রণী এ বালক পাই এবং কার্তবীর্য অর্জুনের মতো হবে। সে হবে সমুদ্রের মতো গম্ভীর ও অগ্নির মতো দুর্ধর্ষ। ধরিত্রীর মতো ক্ষমাশীল, মাতা-পিতার মতো সহিষ্ণু, হিমালয়ের মতো সতত সিংহের বিক্রান্ত, সমদর্শিতায় পিতামহ ব্রহ্মার সমান হবে সে। প্রসন্নতায় শিবের সাথে তার তুলনা করা হবে। শ্রীপতি বিষ্ণুর মতো সে হবে সকল প্রাণীর আশ্রয়। এই বালকের মধ্যে সমস্ত সদগুণ কৃষ্ণের মতো মহিমান্বিত হবে। উদারতায় সে হবে রন্তিদেবের তুল্য। হবে যযাতির মতো ধার্মিক। ধৈর্যে মহারাজ বলির সমান। এবং প্রহ্লাদের মতো শ্রীকৃষ্ণের মতিযুক্ত। এই বালক বহু অশ্বমেধ যজ্ঞ করবে। বৃদ্ধাদের নিরন্তর সেবা করবে। অনেক রাজর্ষির পিতা হবে। হবে সে উৎপাদগামীদের শাসক। পৃথিবীর ধর্মরক্ষার জন্য কলিকে নিগৃহীত করবে। মুনি বালক শৃঙ্গী তাকে নিধনের জন্য তক্ষক সৰ্পকে প্রেরণ করবে। সব আসক্তি পরিত্যাগ করে সে শ্রী হরির চরণ কমল আশ্রয় করবে। হে মহারাজ, ব্যাসপুত্র শুকদেবের কাছে সে। আত্মজ্ঞান লাভ করবে। পরীক্ষিত পার্থিব দেহ গঙ্গা তীরে পরিত্যাগ করে শ্রীহরির চরণে আশ্রয় নেবে।

এই কথা বলে ব্রাহ্মণেরা যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে সন্মানিত হয়ে নিজ নিজ গৃহে গমন করলেন।

পরবর্তীকালে এই বালক পরীক্ষিত নামে খ্যাত হয়ে ছিলেন। জন্মগ্রহণের পর গর্ভে দৃষ্ট পুরুষকে ধারণ করে জনগণের মধ্যে পরীক্ষা করতেন। যুধিষ্ঠির প্রভৃতির দ্বারা লালিত হয়ে রাজপুত্র শুক্লপক্ষের চন্দ্রের মতো বৃদ্ধি পেতে থাকলেন। বাল্যকালেই তিনি ধর্মাত্মা কৃষ্ণভক্ত সকল প্রাণীর প্রতি প্রীতিযুক্ত হয়েছিলেন।

জ্ঞাতি দ্রোহ জনিত অধর্ম থেকে মুক্তি পাবার জন্যে রাজা যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে বাসনা করলেন। তিনি প্রজাদের কাছ থেকে কর এবং দণ্ড ছাড়া অন্য কোন অর্থ গ্রহণ করতেন না। রাজকোষে প্রচুর অর্থ না থাকায় চিন্তান্বিত হলেন। তার অভিপ্রায় জেনে কৃষ্ণপ্রাণিত ভাইরা উত্তর দিকে মরু ও রজ্যের যজ্ঞে পড়ে থাকা সুবর্ণ পাত্রাদি অপহরণ করলেন। যুধিষ্ঠির তিনটি অশ্বমেধ যজ্ঞের দ্বারা যজ্ঞেশ্বর হরির অর্চনা করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের আহ্বান পেয়ে হস্তিনাপুরে এলেন, কয়েকমাস সেখানে থাকলেন। দ্রৌপদী এবং বন্ধুজনের সাথে রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে অর্জুনের সঙ্গে যদুগণের দ্বারা পরিবৃত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় গেলেন।

.

ত্রয়োদশ অধ্যায়
বিদুরের উপদেশ অনুসারে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর বনগমন

সূত বললেন– তীর্থ ভ্রমণে গিয়ে বিদুর ঋষি মৈত্রেয়ের কাছ থেকে নিজের গতি জেনে হস্তিনাপুরে গেলেন। বিদুর মৈত্রেয়মুনির কাছে কতকগুলি প্রশ্ন করেছিলেন। তার কয়েকটি উত্তর শুনেই অন্য প্রশ্ন করা থেকে বিরত হলেন। আত্মীয় বিদুরকে কাছে আসতে দেখে যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্র যুযুৎসু সঞ্জয়, কৃপাচার্য, কুন্তী, গান্ধারী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা, উত্তরা, কৃপাচার্যের ভগিণীরা তার কাছে এলেন। মুছাগত ব্যক্তির প্রাণ অবসন্ন হলে ইন্দ্রিয়গুলি নিস্পৃহ হয়ে পড়ে। প্রাণ ফিরে এলে ইন্দ্রিয়গুলি ক্রিয়াশীল হয়। বিদুরের বিরহে আত্মীয়গণ তাকে পেয়ে আনন্দে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন। আত্মীয়রা যথারীতি আলিঙ্গন অভিবাদন প্রভৃতির দ্বারা মিলিত হয়ে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করলেন। বিদুর আসনে উপবিষ্ট হলেন। যুধিষ্টির তাকে সম্মানিত করলেন।

যুধিষ্ঠির বললেন– পক্ষীগণ যেমন শাবকদের পক্ষছায়ায় রক্ষা করে তেমনই আপনার পক্ষপাত ছায়া বর্জিত আমাদের কথা কি আপনার মনে পড়ে। আপনার আশীর্বাদে আমরা বিষ, অগ্নি প্রভৃতি বিপদ থেকে রক্ষিত হয়েছি। এই পৃথিবীর তীর্থযাত্রার ভ্রমণ করতে করতে বৃত্তির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। মোক্ষ কোন্ তীর্থে পৌঁছে গেছেন। হে বিভু, আপনাদের মতো পরম ভাগবতগণ নিজেরাই তীর্থস্বরূপ শুদ্ধ। কারণ ভগবান আপনাদের হৃদয় থেকে গরল ধারণ করে তীর্থগুলি পবিত্র করে থাকেন। হে তাত, কৃষ্ণ যাদের দেবতা সেই যদুবংশের বন্ধুদের ও সুহৃদদের আপনি কী দেখেছেন? তাঁরা সুখে আছেন তো?

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রশ্ন শুনে বিদুর যদুকুলের বিনাশ ছাড়া আর যা জানতেন সব বললেন। মানুষের দুর্দিন স্বগৃহে উপস্থিত হলে পাণ্ডব দ্বারা দেবতাদের মতো সন্মানিত হয়ে বিদুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দেবার জন্য কিছুকাল সেখানে বাস করলেন। মান্ডব ঋষির অভিশাপে যম একশো বছর যাবৎ শুদ্র হয়েছিলেন। তখন সূর্য যমলোকে পাতকিদের যথাবিধি দণ্ড দিতেন। যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভ করে বংশধর পৌত্র পরীক্ষিৎকে দেখে ইন্দ্রাদি লোকপাল তুল্য ভাইদের সাথে পরম আনন্দিত হলেন।

গৃহে আসক্ত এবং গৃহকার্যে প্রমত্ত পাণ্ডবদের আয়ুর কাল অজ্ঞাতসারে আক্রমণ করল। বিদুর তা বুঝতে পেরে ধৃতরাষ্ট্রকে অনতিবিলম্বে বললেন– ভয় অর্থাৎ কালে এসে উপস্থিত হয়েছে। হে প্রভু, এ জগতে কোনো স্থানে কোনো সময়ে যার প্রতিকার নেই, আমাদের সেই অন্তিমকাল উপস্থিত হয়েছে। যে মৃত্যুরূপ কালগ্রস্ত হয়ে মানুষ প্রিয়তম প্রাণ থেকেও বিযুক্ত হয় আর অন্য ধন প্রভৃতির কথা কী বলব? মহারাজ, আপনার পিতা, ভ্রাতা, সুহৃদ এবং পুত্রগণ সকলেই নিহত হয়েছেন। আপনার বয়সও হয়েছে। দেহ জরাগ্রস্ত। আর এখন পরের গৃহে বাস করছেন কেন? আপনি জন্ম থেকে অন্ধ এখন আবার বুধির এবং বুদ্ধিহীন হয়েছেন। আপনার দন্তগুলি শিথিল হয়েছে। অজীর্ণজনিত মন্দাগ্নি আপনাকে আক্রমণ করেছে। এখনও সানুরাগে কেন এখানে বাস করছেন। হায় জীবের জীবিত থাকার আশা কী ফলবতী? যে আশায় আপনি আপনার পুত্রহন্তা ভীমের প্রদত্ত অন্ন গৃহপাশ কুকুরের মত ভোজন করছেন। হে মহারাজ যাদের বিনাশ কামনায় অগ্নি নিক্ষেপ করেছেন, বিষ দিয়েছেন, পত্নীদের অপমানিত করেছেন, যাদের রাজ্য ও সম্পত্তি অপহরণ করেছেন, তাদের প্রদত্ত অন্নাদির দ্বারা প্রাণ ধারণের কী প্রয়োজন? এই রূপ দৈন্য অনুভব করেও জীবিত থাকতে ইচ্ছা করছেন। পুরাতন বস্ত্রের মতো আপনার অনিচ্ছাও এই দেহ জরায় জীর্ণ হয়ে ক্ষয় পাচ্ছে।

যিনি অসমর্থ হয়ে ধন পুত্রাদি এবং দেহাভিমানে পরিত্যাগ করে সকলের অগোচরে গৃহত্যাগ করেন, তিনি বীর বলে কথিত হন। যার দ্বারা যশ বা ধর্ম কোনো স্বার্থপুরণ হবে না, সেই মোহ জরাদি ব্যাকুল এই দেহকে যিনি ত্যাগ করেন, তিনিই বীর। নিজে থেকে অথবা পরের উপদেশে যিনি এ জন্মের নির্বেদ প্রাপ্ত হয়ে মনকে বশীভূত হয়ে শ্রীহরিতে ধারণ করেন, তিনি শ্রেষ্ঠ মানব। আপনি আত্মীয়দের অগোচরে উত্তর দিক অর্থাৎ হিমালয় অভিমুখে চলে যান। এর পরেই গরমকাল এসে উপস্থিত হবে।

অনুজ বিদুর কর্তৃক প্রবোধিত হয়ে জন্মান্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র চিত্তের দৃঢ়তা বশত আত্মীয় স্বজনের স্নেহ পাশ ছিন্ন করে গৃহ থেকে বহির্গত হলেন। সুবলরাজের কন্যা পতিব্রতা সুশীলা গান্ধারী পতির অনুগমন করলেন। হিমালয় দুর্গম হলেও তা তাদের কাছে আনন্দদায়ক হয়েছিল।

অজাতশত্রু মহারাজ যুধিষ্ঠির সন্ধ্যা বন্দনাদি করে ব্রাহ্মণদের তিল, গাভী, ভূমি, অন্ন দান করে গৃহে প্রবেশ করলেন। তিনি বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধরীকে দেখতে পেলেন না। সেখানে উপবিষ্ট সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করলেন –হে সঞ্জয়, বৃদ্ধ অন্ধ আমাদের পিতা কোথায় গেলেন? পুত্রশোকে কাতর মাতা গান্ধারী এবং আমাদের হিতাকাঙ্খী পিতৃব্য বিদুরই বা কোথায় গেলেন? আমার কোনো পাপ কল্পনা করে দুঃখিত হয়ে ভার্যার সাথে ধৃতরাষ্ট্র গঙ্গায় পতিত হলেন? আমাদের পিতা পাণ্ডুর মৃত্যুর পর ভ্রাতুস্পুত্র আমাদের বিপদ থেকে যারা রক্ষা করেছিলেন সেই দুজন পিতৃব্য বিদুর ও ধৃতরাষ্ট্র এখন কোথায় গেলেন।

সূত বললেন– নিজ গৃহে ধৃতরাষ্ট্রকে না দেখে সূত সঞ্জয় কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। তিনি দুহাত দিয়ে চোখের জল মুছে বুদ্ধির দ্বারা মনকে ঠিক করলেন। তিনি বললেন, হে কুল নন্দন তোমাদের পিতৃব্যদ্বয় এবং গান্ধারি কোনো কথাই জানি না। হে মহাবাহ, সেই মহাত্মাদের দ্বারা আমি বঞ্চিত হয়েছি।

এমন সময় খঞ্জনি হাতে ভগবান নারদ সেখানে নেমে এলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির অভিবাদন পূর্বক তাকে অর্চনা করলেন। যুধিষ্ঠির জানতে চাইলেন, হে ভগবান, আমি পিতৃব্যদ্বয়ের কোনো সংবাদ জানি না। এখান থেকে তারা কোথায় গেলেন? নিহত পুত্রের শোকে কাতর ও পস্বিনী মতো কোথায় গেলেন? আপনি আমাকে শোক সাগর থেকে উদ্ধার করুন।

মুনিশ্রেষ্ঠ ভগবান নারদ বললেন– হে মহারাজ, কারও জন্য শোক করো না। যেহেতু এ জগত ঈশ্বরের বশীভুত। দিকপাল গণের সাথে সমস্ত লোক তো ঈশ্বরে পূজা উপহার বহন করছে। সেই পরমেশ্বরই কর্মানুসারে প্রাণীদের সংযুক্ত করছেন। আবার তিনি তাদের বিযুক্ত করছেন। যেমন দড়ি দিয়ে নাসিকায় বদ্ধ পাখিরা দীর্ঘ রঞ্জু দিয়ে বন্ধ থাকে তেমনই বেদরূপ দড়িতে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় প্রভৃতি নামরূপ রঞ্জুতে বদ্ধ জীব সকল শাসন পালন করছে। ক্রীড়াকারীর ইচ্ছায় কাষ্ঠময় পশুপক্ষীর একত্র মিলন ও বিচ্ছেদ হয়। ঈশ্বরের ইচ্ছায় জীবগণের সংযোগ ও বিয়োগ হয়ে থাকে।

সন্ত্রস্ত ব্যক্তি যেমন পরকে রক্ষা করতে পারে না, কাম গুণের অধীনে পাঞ্চ ভৌতিক দেহ অন্যকে রক্ষা করবে কী করে? হে মহারাজ, এ জগৎ ভগবানই, তিনি এক সৎপ্রকাশক জীবগণের অন্তর্যামী আত্মা। যিনি ভোক্তা রূপে দেহের অন্তরে এবং ভোগ্য রূপে বাইরে অবস্থান করেন। এটি মায়ার খেলা।

ধৃতরাষ্ট্র, ভ্রাতা বিদুর ও ভার্য্যা গান্ধারীর সাথে হিমালয়ের দক্ষিণ দিকে ঋষিদের আশ্রমে গিয়েছেন।

সেখানে স্বধুনী গঙ্গার সাতজন ঋষির প্রতিনিমিত্ত পৃথক পৃথক সাতটি স্রোতে নিজেকে বিভক্ত করেছেন, তাই সেই তীর্থকে সপ্তস্রোত বলা হয়। সেই তীর্থে ত্রিকাল স্নান করে যথা বিধি অগ্নির হোম করে তিনি অবস্থান করছেন। এখন তার মনে কোনো বিষয় বাসনা নেই। তিনি আসন এবং শ্বাস জয় করে ছয়টি ইন্দ্রিয় প্রত্যাহার করেছেন, হরির ভাবনার দ্বারা স্বত্ত্ব রজঃ ও তমোগুণের মালিন্য দূর করেছেন। অহংকারে অস্পদ মনকে বিজ্ঞানাত্মা সংঘবদ্ধ বুদ্ধিতে সংযুক্ত করেছেন। বুদ্ধি অঙ্ক থেকে বিচ্ছেদ করে এক্ষেত্র পাঁচকে এক করেছেন। ঘর ভেঙে গেলে তার উপস্থিত আকাশ যে মন মহাকাশে পরিণত হয়, তেমনই তিনি আত্মাকে পরমাত্মাকে এক করে দিয়েছেন।

হে মহারাজ, যিনি অখিল কর্মসন্ন্যাস করে কৃত্য হয়েছেন, সে ধৃতরাষ্ট্র শ্রেয় প্রতিবন্ধক বিঘ্ন তুমি করো না। আজ থেকে পরবর্তী পঞ্চম দিনে তিনি দেহ ত্যাগ করবেন। সেই দেহ আপনা থেকেই ভস্মীভূত হবে। পর্ণশালার সাথে পতির দেহ দগ্ধ হতে থাকলে পতিব্রতা গান্ধারী পতির উদ্দেশ্যে অগ্নিতে প্রবেশ করবেন। হে করুণানন্দন, বিদুর সেই আশ্চর্য ঘটনা দেখে একাধারে আনন্দিত এবং শোক সঞ্চাত হয়ে তীর্থসেবার জন্য সেখান থেকে চলে যাবেন।

এই কথা বলে নারদ স্বর্গে চলে গেলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর কথা শুনে শোক ত্যাগ করলেন।

.

চতুর্দশ অধ্যায়
অর্জুনের মুখ থেকে যুধিষ্ঠিরের শ্রীকৃষ্ণের তিরোধান বাক্যশ্রবণ

সূত বললেন– অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের আচরণ এবং অভিপ্রায় জানার জন্য দ্বারকাতে গেলেন। ইতিমধ্যে সাত মাস কেটে গেল অর্জুন দ্বারকা থেকে ফিরে এলেন না। যুধিষ্ঠির ভয়ানক দুর্লক্ষণ দেখতে পেলেন। কালের ভয়াবহ গতি এবং ঋতু ধর্মের বিপর্যয় ঘটে গেল। মানুষেরা ক্রোধ, লোভ এবং মিথ্যাযুক্ত হল, পাপ পথে তারাই জীবিকা নির্বাহ করতে থাকল। পিতা মাতা বন্ধু ভাই পতি এবং পত্নীর মধ্যে নিরন্তর কলহ দেখা দিল। রাজা যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন– বন্ধুদের দেখার জন্য এবং পুণ্যশ্লোক শ্রীকৃষ্ণের মনের বাসনা জানার জন্য অর্জুন দ্বারকাতে গিয়েছে। ভীম, সাত মাস বলে গেল। এখনও পর্যন্ত কেন অর্জুন ফিরে এল না, আমি তা বুঝতে পারছি না। দেবর্ষি নারদ যা বলেছিলেন, সেই সময় কি এখন উপস্থিত হল? ভগবান তাঁর লীলাসাধন করে দেহ পরিত্যাগ করার ইচ্ছা করবেন। তাঁর আনুকূল্যে আম্মদ আমাদের সম্পদ রাজ্য, পত্নী, প্রাণপজ এবং বংশ রক্ষা সম্ভব হয়েছে। হে ভীম, এই দৈহিক দৈবী এবং পার্থিব বিপর্যয় গুলি দেখো। আমার বাম উরু, চোখ এবং বাহু বারবার স্পন্দিত হচ্ছে। হৃদয় কম্পিত হচ্ছে, শৃগাল অগ্নি উদগীরণ করতে করতে সূর্যের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে। কুকুর আমাকে লক্ষ্য করে নির্ভয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে। শুভ পশু গাভী আমাকে বামদিকে রেখে চলেছে। অশুভ গদর্ভ আমার ডানদিকে প্রদক্ষিণ করছে। অশ্বগুলিকে ক্রন্দন করতে দেখছি। কপোত মৃত্যুদূতের মতো আমার মনকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। পেঁচা আর কাকের কুৎসিত শব্দ বিশ্বকে শূন্য করতে চাইছে।

হে ভীম, সুর্যের চারিদিকের বেষ্টন ধূম্রবর্ণ হয়েছে। পর্বতের সাথে সাথে পৃথিবীতে কম্পন দেখা দিয়েছে, বিনা মেঘে বজ্রপাতের শব্দ তুমি শুনতে পাচ্ছ না? সূর্য নিস্তেজ হচ্ছে, গ্রহগণের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেছে। প্রাণী আর ভূতের দ্বারা আকাশ ও পৃথিবী যেন বলছে। মানুষের মনও আলোড়িত৷ এগুলি কী মঙ্গল বিধান করবে, এটা আমরা জানি না। বৎসগণ স্তন পান করছে না। গাভীগণ দুগ্ধ দিচ্ছে না, গোষ্ঠে গাভীগণ অশ্রুমুখে কান্না করছে। বৃষরা আনন্দিত হচ্ছে না। দেবপ্রতিমাগুলিও ক্রন্দন করছে। জনপদ গ্রাম নগর উদ্যান আকর এবং আশ্রমগুলি হতশ্রী হয়ে পড়েছে। তারা কী দুঃখ বহন করছে। আমি জানি না। আমার মনে হচ্ছে, শ্রী কৃষ্ণের ধ্বজ অঙ্কুশ বজ্ৰাদি চিহ্ন বিশিষ্ট বরণের সম্পর্কহীন হয়ে পৃথিবী আজ সৌভাগ্যহীনা হয়েছে।

অমঙ্গল চিহ্ন দেখে যুধিষ্ঠির অনিষ্ট চিন্তা করছিলেন। এমন সময় দ্বারকা থেকে অর্জুন এসে উপস্থিত হলেন। অর্জুন যুধিষ্ঠিরের চরণে প্রণাম করে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাঁর দুটি চোখ থেকে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল। তাকে মলিন দেখে নারদের কথা মনে করে যুধিষ্ঠির সুহৃদদের মধ্যে বলতে শুরু করলেন।

তিনি বললেন– দ্বারকায় আমাদের আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব সবাই সুখে আছে তো? মাননীয় মাতামহ কুশলে আছেন তো? ভাইয়ের সাথে মাতুল বসুদেবের খবর কী? পরস্পর ভগিনী এবং আমাদের মাতুলানী দেবকী প্রভৃতি বসুদেবের পত্নীগণ পুত্রবধূদের সাথে সুখে আছেন তো? সুষেণ, চারুদেষ্ণ এবং জাম্ববতী নন্দন শাম্ব কুশলে আছেন তো? অপর কৃষ্ণ পুত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ঋষভ প্রভৃতিদের পুত্রদের সাথে কুশলে আছেন তো? শ্রীকৃষ্ণের অনুচরগণ শ্রুতদেব, উদ্ধব প্রভৃতি অন্যান্য শ্রেষ্ঠ পুরুষগণ সুখে আছেন তো?

ব্রাহ্মণদের হিতকারী এবং ভক্তবৎসল গোবিন্দ দ্বারকায় সুধর্ম সভায় সুখে আছেন তো? বলরামের সাথে সনাতন পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ জনগণের মঙ্গলরক্ষা এবং সৃষ্টির জন্য বিরাজমান তো? সত্যভামা প্রভৃতি ষোলো হাজার মহিষীগণ যাঁর চরণকমল শুশ্রূষায় মোক্ষ ও কর্মবলে মনে করতেন, তিনি কেমন আছেন? যদুবংশের বীরগণ যার বাহুবলে অকুতোভয়ে হয়ে বলপূর্বক স্বর্গ থেকে আনীত দেবতাদের ব্যাবহারযোগ্য সুধর্মা সভাতে বারবার পায়ের দ্বারা স্পর্শ করেছেন, সেই গোবিন্দ কুশলে আছেন তো?

অর্জুন তোমার কোনো পীড়া হয়নি? তোমার শরীরের সেই তেজ কোথায় গেল? তুমি দীর্ঘকাল সেখানে ছিলে। কোনো কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা কি পূর্ণ করতে পারোনি? অন্তরঙ্গ বন্ধু শ্রীকৃষ্ণের বিরহে নিজেকে শূন্য বলে মনে করছ কি? এছাড়া তোমার এমন অবস্থা হতে পারে না।

.

পঞ্চদশ অধ্যায়
অর্জুনের মুখে যদুকুল সংহার শ্রবণ এবং শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান বার্তা শুনে পাণ্ডবদের হিমালয়ের দিকে মহাপ্রয়াণ

সূত বললেন– মহারাজ যুধিষ্ঠির নানা আশংকা করে অর্জুনের বিষয়ে কল্পনা করছিলেন। অর্জুন কৃষ্ণবিরহে তখন কাতর হয়ে ওঠেন। শোকে তার বাক রুদ্ধ হয়েছে। তিনি নিষ্প্রভ হয়ে ভগবানের চিন্তা করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে শোক সংবরণ করলেন। চোখের জল মুছে ফেললেন। কৃষ্ণের অদর্শনজনিত বিরহে কাতর হয়ে পড়লেন। বারবার কৃষ্ণের কথা অর্জুন বললেন– হে মহারাজ, বন্ধুরূপী হরির সঙ্গ দ্বারা আমি বঞ্চিত হয়েছি। দেবগণেরও আশ্চর্যকর আমার তেজ তিনি অপহরণ করেছেন। দেহ প্রাণহীন হলে তাকে মৃত বলা হয়। যার ক্ষণকাল বিয়োগে এই জগৎ অপ্রিয়দর্শন হয়, অর্থাৎ দেখতে আর ভালো লাগে না, যাঁর সম্যক আশ্রয়ে দ্রুপদ গিয়ে স্বয়ম্বর সভায় সমাগত কামোন্মত্ত নৃপতিদের প্রভাব অপহরণ করেছিলাম, এবং ধনুর দ্বারা মৎস্যকে নিপাতিত করে দ্রৌপদীকে লাভ করেছিলাম, যার সন্নিধানে দেবগণের সাথে দেবরাজ ইন্দ্রকে জয় করে খাণ্ডব বন অগ্নিকে দিয়েছিলাম, সেই খাণ্ডবদাহে ময়দানবকে রক্ষা করার অদ্ভুত শিল্পকলা মণ্ডিত সভা লাভ করেছিলাম, যাঁর কৃপায় আমরা পৃথিবীর রাজাদের পরাজিত করেছি, যাঁর তেজে অজাত অস্থিতুল্য বলবীর্য সম্পন্ন তোমার অনুজ ভীমসেন জরাসন্ধকে বধ করেছিলেন, দুঃশাসন প্রভৃতি দুর্বত্ত গণ রাজসভায় আপনার পত্নীর খোঁপা খুলে কেশ আকর্ষণ করেছিল, যে খোঁপা রাজসূয় যজ্ঞে মহাভিষেক করায় প্রশংসনীয় ও রম্য ছিল,সেই ঘটনা স্মরণ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সভায় এসে উপস্থিত হন। তাঁর চরণে প্রণাম করার সময় দ্রৌপদী নয়না কৃষ্ণের চরণে পড়েছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভীমের দ্বারা দুঃশাসন প্রভৃতির পত্নীদের বৈধব্য ঘটিয়েছেন, আমাদের বনবাসের সময় শত্রু দুর্যোধনের কৌশলে দশ হাজার শিষ্যের সাথে মুনি দুর্বাসা এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাদের পাক পাত্রে তখন অন্ন ছিল না। অভুক্ত ব্রাহ্মণদের অভিশাপের ভয়ে আমরা বিপন্ন হয়েছিলাম। এই সময় কৃষ্ণ এসে দ্রৌপদীর পাকপাত্র থেকে শাকান্ন ভক্ষণ করে আমাদের রক্ষা করেছিলেন। আহারের আগে স্নান করার সময় জলমগ্ন ঋষিরা পরিতৃপ্ত মনে করে বৃথা আহারের ব্যবস্থা করানো হল, ভেবে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

যাঁর তেজে দেবীর সাথে শূলপানি শিব যুদ্ধে বিস্মিত হয়ে আমাকে নিজের পাশুপৎ অস্ত্র দিয়েছিলেন। এই দেহেই স্বর্গলোকে দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে অর্ধাসন আমি লাভ করেছিলাম। সে স্বর্গে আমি যখন ক্রীড়া করছিলাম, ইন্দ্রের সাথে দেবগণ নিবাগ কবচ নামক অসুরদের বধের জন্য আমার গাণ্ডবী চিহ্নিত বাহু দণ্ড আশ্রয় করেছিলেন, কৃষ্ণের প্রভাবে তা অত্যন্ত শক্তিশালি হয়েছিল।

শ্রেষ্ঠ ভক্তগণ মোক্ষের নিমিত্ত যাঁর চরণ কমল ভজন করেন মন্দমতি সেই ঈশ্বরকে আমি আমার সারথি হিসেবে লাভ করেছিলাম। হে নরদেব, কৃষ্ণের গম্ভীর মৃদু-মন্দ হাসির সাথে মনোজ্ঞ পরিহাস বাক্যগুলি এখনও আমার মনে পড়ছে। তিনি আমাকে পার্থ, অর্জুন, সখে, কুরুনন্দন ইত্যাদি হৃদয়গ্রাহী সম্বোধনের দ্বারা সম্বোধিত করতেন। শয্যা, উপবেশন, ভ্রমণ, প্রশংসা এবং ভোজনাদি কর্মে একত্রে অবস্থান করেছি। এর ব্যতিক্রম হলে হে বয়স্যা তিনি অত্যন্ত সত্যবাদী, এরুপ বক্তব্য তিনি করতেন। পিতা যেমন পুত্রের অপরাধ ক্ষমা করে তেমনই কুমতি আমাদের সকল অপরাধ তিনি সহ্য করেছেন। হে মহারাজ, সেই কৃষ্ণের বিরহে এখন আমি শূন্য গৃহে অবস্থান করছি। শ্রীকৃষ্ণের ষোলো হাজার মহিষী রক্ষার ভার নিয়ে আমি দুর্বত্ত বহুগমের দ্বারা পরাজিত হয়েছি। আমার সেই গান্ডীব ধনুর শর, অশ্বরথ রক্ষার ভার নিয়ে আমি দুবৃত্ত বহুগমের দ্বারা পরাজিত হয়েছি।

আমার সেই গান্ডীব ধনু, শর, অশ্বরথি সবকিছু আজ শক্তিহীন।

মহারাজ, যাদের মঙ্গল চিন্তা করেছেন, তারা বিপ্রসাথে বিমূঢ় হয়ে অন্নময়ী মদিরা পান করে উন্মত্ত চিত্তে একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে চার পাঁচজন মাত্র অবশিষ্ট রয়েছে। প্রাণীগণ যে পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করে বা পালন করে এটি ভগবান পরমেশ্বরের কাজ। জলচর মৎস্যাদির মধ্যে যারা বড়ো মাছ, তারা ছোটো মাছদের খেয়ে ফেলে। বলবান দুর্বলদের এবং বলশালী ব্যক্তি পরস্পর বলশালীদের বিনাশ করে থাকে। বলিষ্ঠ যদু এবং মহৎ পাণ্ডবদের দ্বারা দুর্বলদের বিনাশ করিয়ে ভগবান যদুদের দ্বারা পরস্পরকে হত্যা করিয়ে পৃথিবীর ভার হরণ করলেন।

সূত বললেন– শ্রীকৃষ্ণের চরণ কমল গভীর প্রেমে ধ্যান করতে করতে অর্জুনের চিত্ত বিযুক্ত হয়েছিল। বাসুদেবের চরণ কমলে চিন্তা করে সঞ্জাত ভক্তির দ্বারা বিষয় বাসনা নষ্ট হয়েছিল। যুদ্ধের আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে উপদেশ দিয়েছিলেন, অর্জুন তা ভুলে গিয়েছিলেন। এখন আবার সেই জ্ঞান তিনি লাভ করলেন, ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা প্রকৃতির লয় হল। তিনি গুণাতীত হলেন, নাশ হল লিঙ্গ দেব। এবং সূক্ষ্ম দেহের অর্জুন সম্পূর্ণ শোক মুক্ত হলেন।

মহারাজ যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের গতি এবং যদুকুলের নাশ চিন্তা করে স্বর্গপথে যাওয়ার কথা ভাবলেন। কুন্তীদেবীও অর্জুনের কথায় জীবনমুক্তা হলেন। লোকে যেমন পায়ে কাঁটা ফুটলে অপর কাঁটা দিয়ে তা তুলে উভয় কাঁটাকে পরিত্যাগ করে, ঠিক সেই ভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে দেহে পৃথিবীর ভার হরণ করলেন সেই দেহ পরিত্যাগ করলেন।

ঈশ্বরের কাছে অবতার তনু ও ভূতার মুক্তি উভয়ই সমান। অভিনেতা যেমন নিজ রূপে থেকে নানারূপ ধারণ করে, এবং শেষ পর্যন্ত অন্তর্ধান করে, ভগবান নিজের স্বরূপে থেকে নানারূপ ধারণ করেন এবং ত্যাগ করেন।

যাঁর পবিত্র কথা সকলের শ্রবণ করা উচিত, সেই ভগবান মুকুন্দ নিজের দেহের সাথে পৃথিবী ত্যাগ করলেন। অজ্ঞান লোকের অমঙ্গলের জন্য কলি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করল। যুধিষ্ঠির সর্বত্র লোভ মিথ্যা হিংসা ছলনা ইত্যাদির প্রভাব দেখতে পেলেন। তিনি তাঁর সুসংযত পৌত্র পরীক্ষিতকে সসগরা ধরিত্রী অর্পিত করলেন। স্বরাজ্য হস্তিনাপুরে তাকে অভিষিক্ত করা হল। রাজা যুধিষ্ঠির অনিরুদ্ধের পুত্র বজ্রকে মুথরার সুরসেন বংশের অধিপতি করলেন। নিজে প্রজাপতি দেবতার যজ্ঞ করলেন। তিনটি অগ্নিতে আত্মাকে সমর্পণ করলেন। রাজোচিত বস্ত্র, অলঙ্কার সবকিছু ত্যাগ করলেন, ক্ষমতা শূন্য এবং অহঙ্কার শূন্য হয়ে বন্ধন ছিন্ন করলেন। এবার বাক্যকে মনে, মনকে প্রাণে, প্রাণকে আপনার কার্য উৎসর্গের সাথে আপনাকে মৃত্যুতে এবং মৃত্যুকে পঞ্চভূতের সমষ্টি দেহে লয় করলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি দেহকে স্বত্ত্ব, রজঃ এবং তম, এই গুণত্রয়ে লয় করেন এবং গুণত্রয়তে প্রভৃতিতে লয় করেন। এই সমস্ত কারণে প্রকৃতিতে জীবাত্মাতাতে এবং জীবাত্মাকে অব্যয় ব্রহ্মে লয় করেন। মলিন বসন পরিধান করলেন। নিরাহার ও মৌন হলেন। আলুয়ায়িত কেশে জড় উন্মত্ত পিচের মতো কারও অপেক্ষা না করে বধিরের মতো গৃহ থেকে বহির্গত হলেন। পরব্রহ্মকে ধ্যান করতে করতে উত্তর দিকে গমন করলেন। এই দিকে আগে যারা গেছেন, এবং সেখান থেকে আর কেউ ফিরে আসেন নি।

ভীম প্রভৃতি ভাইয়েরা অগ্রজের মতো গৃহ থেকে বহির্গত হলেন। যুধিষ্ঠির ধর্মাদি বারোটি পুরুষার্থক সম্যক রূপে নির্বাহ করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, শ্রী কৃষ্ণের পাদ পদ্মেই তাঁর আশ্রয়। সকল ভাই ভগবানের ধ্যানচ্যুত ভক্তিতে পবিত্র বুদ্ধি লাভ করলেন।

বিদুরও কৃষ্ণের প্রতি মন অভিনিবিষ্ট করলেন। প্রভাত সূর্যে দেহত্যাগ করলেন। পিতৃগণের সাথে স্বস্থানে গমন করলেন। তখন দ্রৌপদীও ভগবান বাসুদেবের একান্ত মতি হয়ে তাঁকে লাভ করলেন।

.

ষোড়শ অধ্যায়
পরীক্ষিতের রাজ্যলাভ, দিগ্বিজয় এবং ধর্ম ও ধরার সংবাদ শ্রবণ

সূত আরও বললেন–হে ব্রাহ্মণ, মহাভাগবত পরীক্ষিত শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের শিক্ষায় পৃথিবী পালন করতে থাকলেন। তাঁর জন্মের সময় জাতককে শাস্ত্রবিদ পণ্ডিতেরা যেসব ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন একে একে তা সবই ফলতে লাগল। তিনি উত্তরের কন্যা ইরাবতাঁকে বিয়ে করলেন। জন্মেজয় প্রভৃতি চারটি পুত্রের জন্ম হল। কৃপাচার্যকে গুরুপদে বরণ করলেন। গঙ্গাতীরে তিনটি অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। যজ্ঞে ব্রাহ্মণদের অনেক দক্ষিণা দিলেন। এবার বীর রাজা পরীক্ষিত দিগ্বিজয়ে বের হলেন। কোনো একটি জায়গাতে গোমিথুনকে পায়ের দ্বারা আঘাত করতে রাজচিহ্ন ধারী শুভ্রকে দেখলেন। শুভ্ররূপী কলিকে প্রতাপের দ্বারা নিগৃহীত করেছিলেন।

শৌণক জানতে চাইলেন–হে সুত, রাজা পরীক্ষিত রাজ চিহ্নধারী শুভ্রকে কেবল নিগ্রহ করলেন, কিন্তু বধ করলেন না কেন? সেই কালিন গৃহ যদি বিষ্ণু কথাপ্রিয় হয়, তাহলে বিষ্ণুর চরণ কমলের মধু পানকারী সাধুদের কথাকে আশ্রয় করে থাকলে তবে তা ব্যাখ্যা করুন। অন্য অসৎ কথার আর কী প্রয়োজন?

সুত বললেন– কুরুজঙ্গলে বাস করার সময় যুদ্ধিনিপুণ দেশে কলি প্রবেশ করছে, এই অপ্রিয় কথা শুনতে পেলেন। তিনি ধনুর্বাণ গ্রহণ করলেন। নীলবর্ণ চারটি অশ্বযুক্ত এবং বিজয় সিংহ চিহ্নিত রথে উঠে বসলেন। রথ, অশ্ব, হস্তী এবং পদাতিক, এই চতুরঙ্গ সেনা পরিবৃত হয়ে দিগ্বিজয়ের জন্য নির্গত হলেন।

তিনি পূর্ব, পশ্চিমে, দক্ষিণ এবং উত্তর দিকের বিভিন্ন দেশ জয় করলেন। জয় করলেন ভদ্রাশ্ব, কেতুমাল, ভারত, উত্তর কুড়ুল এবং দক্ষিণ কুড়ুল। মহাত্মা পরীক্ষিত জনপদের জনগণ শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য সূচক নিজ পূর্বপুরুষদের যশগান করছে তা শুনতে পেলেন। অশ্বত্থামার অস্ত্রের থেকে নিজ রক্ষার কথা যাদব ও পাণ্ডবদের পরস্পর বন্ধুত্বের কথা শুনলেন। তিনি পরম সন্তুষ্ট হয়ে তাদের ধন, বস্ত্র এবং আহার দান করলেন। প্রত্যহ তিনি পূর্বপুরুষদের কাজের অনুসরণ করে চলতেন। শীঘ্রই তাঁর জীবনে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল।

এই সময় বিশ্বরূপধারী ধর্ম নিঃস্ব, বৎসহীনা জলধির মতো রোদনরতা গাভীকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন –হে ভদ্রে, তোমার দেহের মঙ্গল তো? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, মনের পীড়ায় তুমি কষ্ট পাচ্ছো, তুমি নিস্তেজ, তোমার মুখে গ্লানিমা এসেছে। হে বৎস, তুমি কি দুরোচিত কোনো বস্তুর জন্য শোক করছ? এর পর শুদ্ধ উপায়ে রাজারা তোমাকে পালন করবে দেখে শোক করছ কি? অসুরগণ কর্তৃর্ক যজ্ঞীয় ভাগ অপহৃত করার জন্য দেবতাদের জন্য শোক করছ। ইন্দ্র বর্ষণ না করায় প্রজাদের কষ্ট হচ্ছে ভেবে শোক প্রকাশ করছ।

হে পৃথিবী, অতীতের দ্বারা অরক্ষমান স্ত্রীদের জন্য শোক করছ? রাক্ষসকুল পিতৃগণ কর্তৃক অরক্ষিত বালকদের জন্য শোক প্রকাশ করছ?

হে বসুন্ধরা যে জন্য তুমি কৃশ হয়েছ, সেই মানসিক দুঃখের কারণ বলো, পৃথিবী বললেন– ধর্ম, আমাকে যা জিজ্ঞাসা করছ, তা তুমি নিজেই জানো। যে কারণে লোকের শোকাবহ চারটি পাদের দ্বারা তুমি অবস্থান করছিলে, এখন তা আছে কি? শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক পরিত্যাক্ত জনগণের জন্য আমি শোক প্রকাশ করছি। সত্য, শৌচ, দয়া, ক্ষমা, ত্যাগ, সন্তোষ, সরলতা, মনের ধৈৰ্য্য, বহিরিন্দ্রের চিরতা, তপস্যা, সাম্য, পরের অপরাধ সহ্য করা, প্রাপ্তিতে উদাসীন্য, শাস্ত্র বিচার, জ্ঞান, বিরক্ত, ঐশ্বর্য, শৌর্য, তেজ, বল, স্মৃতি, স্বাতন্ত্র, কৌশল, সৌন্দর্য, ধৈর্য, সফলতা, প্রতিভার আতিশয্য, বিনয়, সৎ স্বভাব, মনের শক্তি, জ্ঞানেন্দ্রিয়ের শক্তি, কর্মের শক্তি। ভোগের আম্পাদন-এর স্থৈর্য। শাস্ত্রের বিশ্বাস, যশ, সন্মান এবং গর্বেপর অভাব– এই একচল্লিশটি এবং মহত্ত্বের ইচ্ছাকারী জনগণের প্রার্থনীয় অন্যান্য গুণগুলি শ্রীকৃষ্ণের মহাপ্রলয়েও নষ্ট হয় না। সকল গুণের আধার এবং লক্ষ্মীর বাসস্থান সেই শ্রীকৃষ্ণ এই লোক পরিত্যাগ করেছেন। পাপ কলি পৃথিবীর ওপর দৃষ্টিপাত করছে। তাই আমি শোক প্রকাশ করছি।

— হে দেবশ্রেষ্ঠ নিজের জন্য, আপনার জন্য, দেবতা, ঋষি, পিতৃগণ, সাধু সমস্ত বর্ণ এবং আশ্রমের জন্য আমি শোক প্রকাশ করছি।

–যে স্বতন্ত্র যে হরি অসুর বংশের শত শত অক্ষয়িণী সৈন্য বিনাশ করেছেন, তিনটি চরণে হীন দুঃস্থ করিয়ে যদুদের রমণীয় মূর্তি ধারণ করেছেন, প্রেম পূর্বক অবলোকন, মধুর হাসি, এবং সুমিষ্ট বাক্যের দ্বারা সত্যভামা প্রমুখ মহিষীদের গর্বের সাথে পুরুষোত্তমের বিরহ সহ্য করে? পৃথিবী এবং ধর্ম যখন এই ধরনের কথা বলছিলেন, তখন রাজর্ষি পরীক্ষিত সরস্বতীর কাছে তাঁদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন।

.

সপ্তদশ অধ্যায়
পরীক্ষিত এবং ধর্মের সংলাপ ও পরীক্ষিতের কলিনিগ্রহ

সূত বললেন–রাজা পরীক্ষিত সরস্বতীর তীরে একটি শূদ্রকে দেখতে পেলেন। ওই শূদ্র গোমিথুনকে প্রহার করতে লাগল। মৃণালের মতো শুভ্রবর্ণ বৃষটি শূদ্ৰতাড়িত হয়ে কাঁপতে থাকল। শূদ্রের পদাহত বৎসহীন অবদন, কৃশ, তৃণ ভক্ষণে ইচ্ছুক একটি গাভীকে দেখা গেল। রাজা রথে আরোহণ করলেন। মেঘের মতো গম্ভীর স্বরে স্বর্ণখচিত বেশধারী কলিকে জিজ্ঞাসা করলেন –আমার পালিত এই দেশে বলবান দুর্বলদের আঘাত কেন করছ? নটের মতো রাজবেশ পরিধান করেছ? অথচ কর্মে শূদ্রের মতো, তুমি কে? তুমি বধের যোগ্য। মৃণালের মতো শুভ্র বর্ম তিনটি চরণে হীন হয়ে এক চরণে বিচরণ করছ।

কুরুরাজদের বাহুদণ্ডে সুরক্ষিত এই ভূতল তোমার অশ্রুব্যতীত অন্য কোনো প্রাণীর চোখ থেকে জল পড়েনি। হে, বৃষ, তুমি এখানে শোক করো না, এই শুভ্র থেকে তোমার ভয় দুর করো। হে মা, আমি জীবিত থাকতে তোমার মঙ্গল হবে। হে সাধ্বী, যার রাজ্যে দুবৃত্তের ভয়ে প্রজারা ভীত হয়, সেই প্রমত্ত রাজার কীর্তি, আয়ু, সৌভাগ্য এবং পরলোক সব নষ্ট হয়ে যায়। আর্তদের আর্তি হরণ করা রাজার শ্রেষ্ঠ ধর্ম। অতএব এই দুবৃত্তকে আমি বধ করব। হে বৃষ, তোমার তিনটি পা কে ছেদন করেছে? হে বৃষ। নিরপরাধী, তোমার মঙ্গল হোক। পাণ্ডবদের কীর্তি বিনাশ হোক, কে তোমার অঙ্গ ছেদন করেছে তা নিঃসঙ্কোচে আমাকে বলো। নিরাপরাধকে যে দুঃখ দেয় তাকে আমি হত্যা করবই। অসাধুদের দমন করলে সাধুদের মঙ্গল হয়।

ধর্ম বললেন–পাণ্ডববংশোদ্ভূত তোমাদের এই আর্তদের অভয়প্ৰদবাক্য যুক্তি যাদের গুণসমুহে আকৃষ্ট হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দৈত্যাদিকর্ম স্বীকার করেছিলেন। হে পুরুষ শ্রেষ্ঠ, যে পুরুষ থেকে প্রাণীদের দেহ উৎপন্ন হয় সে পুরুষকে আমরা জানি না। বিকল্প অর্থাৎ ভেদকে যারা আচ্ছাদন করেন, যোগীগণ বলেন, আত্মাই আমার সুখ এবং দুঃখের কারণ। আধার দৈবজ্ঞ গণ্য বলে থাকেন, গ্রহাদিগমই সুখ দুঃখের কারণ বলে থাকেন। যারা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করেন, তাঁরা বলে থাকেন বাক্য ও মনের অতীত পরমেশ্বর থেকেই সুখ দুঃখের সৃষ্টি হয়ে থাকে। হে রাজর্ষি এর মধ্যে যেটা তোমার গ্রহণযোগ্য, তা তুমি বিচার করে নাও।

সম্রাট পরীক্ষিত মোহশুন্য হয়ে সমাহিত চিত্তে ধর্মকে বললেন– হে ধর্মজ্ঞ, তুমি ধর্মের কথাই বলেছ। কৃষ্ণরূপধারী তুমিই হলে সাক্ষাৎ ধর্ম। পাপী জনগণের জন্য নরকের স্থান নির্ধারিত হয়েছে। সূচকের অর্থাৎ না জেনে নির্ণয় করলেও সেই গতি হয়। তুমি যে পাপীর নাম করছ না, তার কারণ হল পাপ করলে যে নরক গতি হয়, পাপীর নাম উল্লেখধারীরও সেই পাপ হয়। ভগবানের মায়ার গতি প্রাণীদের বাক্য এবং মনের অগোচর এটা সুনিশ্চিত। সত্যযুগে ধর্মের চারটি চরণ ছিল– তপস্যা, পবিত্রতা, দয়া, এবং সত্য। তার মধ্যে অধর্মের অংশ গর্ব বিষয়ের প্রতি আসক্তি এবং মদ্য পানাদির জন্য মত্ততার দ্বারা ধর্মের তিনটি অংশ নষ্ট হয়ে গেছে, হে ধর্ম, এখন সত্যরূপ অংশটুকু আছে। তা তুমি নিজের দ্বারা রক্ষা করতে পারবে। মিথ্যার দ্বারা বর্ধিত এই অধর্মরুপ কলি তাকেও গ্রহণ করতে চাইছে। ইনি হলেন পৃথিবী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং গুরুভার নষ্ট করেছেন। একদা তিনি নিজের চরণের স্পর্শে সবদিক দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করেছিলেন। সাধ্বী এই অধর্মরূপ কলি তাকেও গ্রহণ করতে চাইছে।

ইনি হলেন পৃথিবী। সাধ্বী এই পৃথিবী কৃষ্ণ কর্তৃক পরিত্যক্তা। তিনি চোখের জল ফেলে শোক প্রকাশ করছেন। তিনি ভাবছেন, ভক্তিবিহীন রাজবেশধারী শূদ্ররা তাকে ভোগ করবে। ধর্ম এবং পৃথিবীকে সান্ত্বনা দিয়ে মহারথী পরীক্ষিত খড়গ গ্রহণ করলেন। কলি রাজচিহ্ন পরিত্যাগ করলেন। ভয়ে কাতর হয়ে মহারাজ পরীক্ষিতের চরণমূলে পতিত হলেন। কীর্তিমান দীনবৎসল বীর পরীক্ষিত শরণাগত কলিকে বধ করলেন না। তিনি হাসতে হাসতে বললেন– অর্জুনের যশরথনে ব্যগ্র আমাদের কাছে তুমি কৃতাঞ্জলি হয়েছ। তোমার কোনো ভয় নেই। কিন্তু আমার রাজ্যে তুমি থাকতে পারবে না।

কারণ তুমি অধর্মের বন্ধু। তুমি রাজার দেহে বর্তমান থাকলেও তোমার সাথে সাথে অধর্ম আসবে। আসবে লোভ, মিথ্যা, চুরি, দৌজন্য, স্বধর্মত্যাগ, অলক্ষ্মী, কপটতা, কলহ, এবং অহঙ্কার অর্থাৎ হে অধর্মের বন্ধু কলি ব্রহ্মবর্তে তুমি থাকতে পারবে না। কারণ এদেশে যজ্ঞের কাজে দক্ষ ব্রাহ্মণরা যজ্ঞের দ্বারা যজ্ঞশ্বর হরির বন্দনা করে থাকেন।

সূত বললেন– পরীক্ষিত এই আদেশ করে বললেন, হে সার্বভৌম, আপনার আদেশে আমি যেখানেই বাস করি সেখানেই ধনুর্বাণধারী আপনাকে আমি দেখতে পাব। কারণ আপনি সমস্ত পৃথিবীর সম্রাট। হে ধার্মিক শ্রেষ্ঠ, আপনি সেই স্থান নির্দিষ্ট করে দিন, আপনার আদেশ আমি পালন করতে পারব।

সূত বললেন– কলি এই ধরনের প্রার্থনা করলেন। মহারাজ পরীক্ষিত তাকে এই স্থান গুলি নির্দেশ করলেন–জুয়া খেলা, মদ্যপান, পরস্ত্রীর সখা এবং প্রাণী হিংসা। যে কাজে মিথ্যা, মত্ততা, সঙ্গ এবং শঠতা/ক্রুরতা এই বারো ধরনের অধর্ম থাকে। কলি আবার প্রার্থনা করলে, পরীক্ষিত স্বর্ণ রৌপ্যাদি তার বাসস্থান রূপে দিলেন। তার সাথে দিলেন মিথ্যা, মদ, কাম, রাজঃ, গুণব্যত হিংসা এবং শত্রুতা। অধর্মহেতু কলি পরীক্ষিতের আদেশে তার প্রদত্ত এই পাঁচটি স্থানে বাস করতে লাগলেন।

বৃষ রূপ ধর্মের তপস্যা, পবিত্রতা এবং দয়া, এই তিনটি ভগ্নপাদকে মহারাজ সংযুক্তা করালেন। পৃথিবীকে সান্ত্বনা দিলেন। এখন পরীক্ষিত রাজা উপযুক্ত আসনে আরোহণ করে প্রজাপালন করছেন।

.

অষ্টাদশ অধ্যায়
পরীক্ষিতের প্রতি মুনি বালকের শাপ প্রদান

সূত বললেন– পরীক্ষিত মাতৃ গর্ভে থাকাকালীন অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্রে দগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহে মৃত হননি। ব্যাসপুত্র শুকদেবের শিষ্য পরীক্ষিত আসক্তি ত্যাগ করে ভগবানের তত্ত্ব জ্ঞান লাভ করেন। গঙ্গাতীরে নিজের দেহ ত্যাগ করেছিলেন। মহান সম্রাট অভিমন্যু পুত্র পরীক্ষিত যতদিন পৃথিবী পালন করেছিলেন ততদিন পর্যন্ত কলি প্রবিষ্ট হয়েও তার প্রভাব বিস্তার করতে পারেন নি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবী পরিত্যাগ করলেন। অধর্মের হেতু কলি এই জগতে প্রবেশ করল। মহারাজ পরীক্ষিত কলিকে বধ করেন নি। কারণ কলিকালে পুণ্য কর্মগুলি সংকল্প মাত্র ফল দান করে থাকে পাপকর্মগুলি অনুষ্ঠিত হলেও তার ফল দেয়।

পরীক্ষিত বিবেচনা করেছিলেন, কলি ধীর ব্যক্তির কাছে অত্যন্ত ভীরু, নিজে সাবধান হয়ে অসাবধনী এবং বালকদের ওপর বাঘের মতো আক্রমণ করে। সাবধান হলে এই কলির দ্বারা কোনো ক্ষতি সাধন হতে পারে না। ঋষিরা বললেন– হে সূত, তুমি অনন্তকাল জীবিত থাক, শুকদেব পরীক্ষিতকে যে শ্রীমদ ভাগবত রূপ আখ্যান বর্ণনা করেছেন, তা স্পষ্ট করে বলো।

সূত বললেন– অহো, আমরা বর্ণকঙ্কর জাতি। কিন্তু জ্ঞানবৃদ্ধ ঋষিদের সমাদর পেয়ে আমাদের জন্ম সফল হয়েছে। যার অনন্ত শক্তি এবং যিনি নিজেও অনন্ত, মহতের মধ্যে তারই গুণ বিকশিত হয়। তাই যে, মহালক্ষ্মী প্রার্থনাকারী ব্ৰহ্মাদিক পরিত্যাগ করে অনভিলাষী হরির চরণধূলির সেবা করেন। ব্রহ্মা ভগবানের চরণে অর্ঘ্যজল প্রদান করেছিলেন। ভগবানের চরণের নখ থেকে পতিত হয়ে গঙ্গা জল রূপে শিবের সাথে তা জগৎকে পবিত্র করেছে। মুকুন্দ ছাড়া অন্য কে ভগবত পদের অর্থ হতে পারে। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান।

কোনো একদিন মহারাজ পরীক্ষিত বনে মৃগয়া করতে গিয়েছিলেন। তিনি ধনুর্বাণ নিয়ে একটি হরিণকে অনুসরণ করতে থাকেন। শ্রান্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত হয়ে একটি জলাশয়ের সামনে আসেন। তাঁর পাশে একটি পবিত্র আশ্রমে প্রবেশ করেন। সেখানে শমীক মুনিকে ধ্যান মুদ্রিত অবস্থায় দেখলেন। এই মুনি ইন্দিয় প্রাণ, মন এবং বুদ্ধির ক্রিয়াকে প্রতিরোধ করে ছিলেন। জগত স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি থেকে নিবৃত্ত হয়েছিলেন। মুনির ওপরে প্রক্ষিপ্ত জটা ছিল। পরিধানে মৃগবর্মের আচ্ছাদন। মহারাজ তৃষ্ণায় কাতর হয়ে মুনির কাছেই জল চাইলেন। মুনি সমাধিস্থ থাকায় তার কাছ থেকে কোনো কিছু পাওয়া গেল না। রাজা পরীক্ষিত নিজেকে অপমানিত মনে করলেন। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। –হে ব্রাহ্মণ, ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় কাতর মহারাজের প্রতি আপনার এরূপ আচরণের অর্থ কী?

শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন যে, এই মুনি ক্ষত্রিয়ের প্রতি অবজ্ঞাবশত কপট যোগস্থ হয়ে আছেন। ফিরে যাবার আগে ব্রহ্মশির স্কন্ধে ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে একটি মৃত সর্প অর্পণ করলেন।

ওই ঋষির অতি তেজস্বী একটি বালক পুত্র ছিল। সে মুনিবালকদের সঙ্গে খেলতে খেলতে দেখতে পেল, রাজা পরীক্ষিত তাঁর পিতার গলদেশে মৃত সর্প অর্পণ করেছেন। একথা শুনে বালক পুত্র বলল, রাজা প্রজাদের রক্ষক এবং ব্রাহ্মণদের দাস হয়ে প্রভুকে অপমানিত করছে। এটা কত বড়ো অধর্ম দেখো। দ্বাররক্ষক কুকুর বলিভূত কাকের মতো প্রভুর অন্নে পরিপুষ্ট হয়ে তারই অবমাননা করছে।

ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের তাদের গৃহরক্ষক নিযুক্ত করেছে। দ্বার পাল হয়ে গৃহ মধ্যে ভান্ডারস্থ খাদ্যবস্তু কী করে খাবার সাহস উৎপাদন করছে।

ক্রোধে রক্ত চক্ষু হয়ে ঋষিবালক শৃঙ্গি কৌশিক নদীর জলে আচমন করে বাক্য রূপ বজ্র নিক্ষেপ করলেন। অর্থাৎ অভিশাপ দিলেন। তিনি বললেন–যে কুলাঙ্গার আমার পিতাকে অপমান করে মর্যাদা লঙঘন করেছে, আজ থেকে সপ্তম দিবসে আমার আদেশ অনুসারে, তক্ষক নামে এক মহাসর্প তাকে দংশন করবে।

বালক আশ্রমে ফিরে এল। পিতার গলদেশে সর্পের দেহ দেখে বালক দুঃখিত হল। অঙ্গীরার বংশধর শমীক মুনি পুত্রের বিলাপ শুনে চক্ষু উন্মীলন করলেন। কাঁধে মৃত সর্প দেখে প্রশ্ন করলেন– এটা কে ফেলেছে? শৃঙ্গি সমস্ত ঘটনা বলল। শাপের অযোগ্য মহারাজ পরীক্ষিতকে শাপ দেওয়া হয়েছে তা শুনে শমীক মুনি পুত্রের প্রশংসা করলেন না।

তিনি বললেন– অহো, তুমি মহৎ পাপ করেছ। অল্প অপরাধে গুরুদণ্ড দিয়েছ। তোমার বুদ্ধি এখনও পরিপক্ক হয়নি। বিষ্ণুস্বরূপ নৃপতিদের সাথে সাধারণ মানুষকে সমানভাবে দেখা উচিত হয়নি। হে পুত্র, নারায়ণ রাজার মূর্তি ধরে থাকেন, তাঁর অবর্তমানে অনেক মানুষের দুর্দশা হবে। রাজার দ্বারা রক্ষিত না হয়ে অনেক মানুষের দুর্দশা হবে। রাজার দ্বারা রক্ষিত না হয়ে অনেক মানুষ মেষসমুহের মতো ধ্বংস প্রাপ্ত হবে।

রাজর্ষি পরীক্ষিত ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং পরিশ্রমে কাতর হয়ে আমাদের এখানে এসেছিলেন তিনি অভিশাপের যোগ্য নন। হে অপক্ক বুদ্ধির বালক, নিষ্পাপ সেবকের প্রতি যে পাপ করেছ, সর্বাত্মা ভগবান যেন তাকে ক্ষমা করেন।

.

ঊনবিংশ অধ্যায়
গঙ্গাতীরে মহারাজ পরীক্ষিতের প্রয়োবেশন, ঋষি গণের সমাগম

সুত বললেন– মহারাজ পরীক্ষিত নিন্দিত কর্মের কথা চিন্তা করতে থাকলেন। তিনি ভাবলেন, গুপ্ত তেজ সম্পন্ন নিরাপরাধ ব্রাহ্মণের প্রতি তার আচরণ মুখের মতো হয়েছে। ব্রাহ্মণকে অবমাননার দ্বারা তিনি ভগবানকে অবজ্ঞা করেছেন। শীঘ্রই তার বিপদ আসবে। সেটা পাপ গণের প্রতি তাঁর পাপীয়সী বুদ্ধি না হয়।

যখন রাজা পরীক্ষিত এই কথা চিন্তা করছিলেন, তখন তক্ষকের কাছ থেকে নিজের মৃত্যুর কথা শুনলেন। তক্ষকের বিষনলকে উত্তম মনে করলেন, বিষয়াসক্ত তাঁর পক্ষে বৈরাগ্যের কারণ হবে। ইহলোক এবং পরলোক যে হেয়, তা তিনি স্থির করলেন। এখন উভয়কেই পরিত্যাগ করবেন। তিনি গঙ্গা তীরে আমরণ অনশনব্রত গ্রহণ করলেন। মুনিদের মতো প্রশান্ত এবং আসক্তি শূন্য হয়ে একান্ত মনে শ্রীকৃষ্ণের চরণ কমল ধ্যান করতে থাকলেন।

মুনিরা সশিষ্যে সেখানে আসতে থাকলেন। সাধুরা তীর্থ যাত্রার ছলে মলিন তীর্থ গুলিকে নিজেরাই পবিত্র করে থাকেন। এলেন অত্রি, বশিষ্ঠ, চ্যবন, শারদ্বান, অরিষ্ট, নেমি, ভৃগু, অঙ্গীরা পরাশর, বিশ্বামিত্র, পরশুরাম, উতথ্য, ইন্দ্ৰপ্ৰমদ, সুবাহ, মেধা, তিথি, দেবল, অষ্টিষেণ, ভরদ্বাজ, গৌতম, মৈত্রেয় প্রমুখ। মহারাজ পরীক্ষিত তাঁদের পুজো করলেন। তারা সকলে সুখে উপবেশন করলেন। মহারাজ আবার তাদের প্রণাম করলেন।

তার এই কাজ শাস্ত্র সম্মত কিনা তা জিজ্ঞাসা করলেন, সন্ন্যাসীবৃন্দ তার কাজ অনুমোদন করলেন। রাজা বললেন, আমি রাজদের মধ্যে অতি ধন্য, যেহেতু আমার কাজ মহাপুরুষদের অনুমোদন যোগ্য হয়েছে। আপনারা মহত্তম, তাই আমাকে অনুগ্রহ করেছেন। আমি পাপ করেছি। ব্রাহ্মণগণ, আপনারা আমাকে শরণাগত বলে জানবেন। দেবতারূপ গঙ্গাদেবী আমাকে তার শরণাগত বলে জানুক। আমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণে আমার চিত্ত স্থাপন করলাম। ব্রাহ্মণদের প্রেরিত কুহক বা তক্ষক আমাকে দংশন করুক। আপনারা বিষ্ণুর কথা কীর্তন করুন। আমি যে জন্মই লাভ করি, সে জন্মই যেন ভগবান হরিতে আমার মতি অক্ষুণ্ণ থাকে। আমি ব্রাহ্মণদের প্রণাম করছি।

রাজা পরীক্ষিত সপুত্র জন্মেজয়ের ওপর রাজ্যের ভার অর্পণ করলেন। গঙ্গার দক্ষিণ তীরে উত্তর মুখ হয়ে কুশাসনে উপবেশন করলেন।

মহারাজ পরীক্ষিত এই ধরনের অনশন করলে স্বর্গের দেবতারা প্রশংসা করতে থাকলেন। পৃথিবীতে পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকল। দুন্দুভি গুলি বারবার বাজতে লাগল। লোকের অনুগ্রহ করা যাদের স্বভাব সেই জাতীয় শক্তিশালী সমাগত মহর্ষিরা রাজাকে সাধুবাদ দিলেন, শ্রীকৃষ্ণের গুমের কথা বলতে লাগলেন। তারা বললেন– হে রাজ্যশ্রী শ্রেষ্ঠ, কৃষ্ণের অনুগত আপনার পথে এই প্রায়োবেশন আশ্চর্যের বিষয় নয়। কারণ যুধিষ্ঠির রাজ মুকুট যুক্ত গৌরবান্বিত সিংহাসন পরিত্যাগ করেছিলেন। আমরা গঙ্গাতীরে অপেক্ষা করব। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার দেহ লীন না হবে। ততক্ষণ আমরা এখানে থাকব। এখানে রজঃগুণ নেই এবং কোনো শোক নেই।

মহারাজ পরীক্ষিত বললেন– সত্যলোকে মূর্তিধারী দেবগণের মতো আপনারা নানা স্থান থেকে এখানে এসেছেন। পরের প্রতি অনুগ্রহ করাই আপনাদের স্বভাব। এছাড়া লোকে বা পরলোকে, আপনাদের কোনো প্রয়োজন নেই। হে ব্রাহ্মণগণ, আমি আমার দ্রষ্টব্য বিষয় জিজ্ঞাসা করছি– মরণোন্মুখ ব্যক্তির কী বিশুদ্ধ কর্তব্য কর্ম করণীয় আপনারা তা বিচার করে বলুন।

ব্যাসপুত্র শুকদেব পৃথিবী পর্যটন করতে সেখানে এলেন। কোনো আশ্রমের চিহ্ন সেখানে দেখা যায়নি। তিনি আত্মস্বরূপের উপলব্ধিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। বালকরা চারদিক থেকে তাকে অবজ্ঞা সূচক বাক্য বলছিল। তার বেশ ছিল অবধূতের মতো। বয়স ষোলো বছর। হাত, পা উরু, বাহু, স্কন্ধ, কপোল এবং গাত্র মনোরম। চোখ দুটি সুন্দর এবং বিস্তৃত। নাসিকা, গুচ্ছ এবং কর্ণদ্বয় সমান। মুখমণ্ডল সুন্দর কণ্ঠে শঙ্খের মতো তিনটি রেখা, স্কন্ধলগ্ন অস্থিস্থল বিস্তীর্ণ ও উন্নতি নাভি। জলের ঘূর্ণির মতো গভীর তিনটি রেখার দ্বারা মনোরম উদর। তাঁর দিগম্বর কুণ্ঠিত কেশগুলি মাথায় বিক্ষিপ্ত, অজানুলম্বিত বাহু। শ্যাম বর্ণ তার দেহখানি। নবযৌবনবশত দেহের শোভা ঠিকরে চিত্ত আকর্ষণ করছে। তার তেজ গুপ্ত কিন্তু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। মুনিরা তাকে অভ্যর্থনা জানালেন।

মহারাজ পরীক্ষিত শুকদেবকে পূজা করলেন। যে সমস্ত স্ত্রী এবং অবোধ বালকরা তাঁকে ঘিরে এসেছিল, তারা নিবৃত্ত হয়ে চলে গেল। শুকদেব মহাসনে উপবেশন করলেন। শুকদেব সেই সভায় ব্রহ্মর্ষি এবং দেবর্ষিদের দ্বারা পরিবৃত হয়েছিলেন। মহারাজ পরীক্ষিত শান্ত চিত্ত এবং সর্বজ্ঞ মুনি শুকদেবের কাছে এলেন। পরীক্ষিত জিজ্ঞাসা করলেন –হে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ধর্ম আমি আজ মহর্ষি হবার অধিকারী হলাম, আমার কী সৌভাগ্য আপনি কৃপা করে অতিথি হিসেবে আমাকে পবিত্র করলেন।