বিত্থোৎপত্তি ও তার মাহাত্ম্য
বৈকুণ্ঠপুরীতে একদিন লক্ষ্মী নারায়ণ বসে আছেন সিংহাসনে। একসময় দেবী লক্ষ্মী নারায়ণকে জিজ্ঞাসা করলেন –তুমি আমাকে খুব ভালবাস, কিন্তু আমার চেয়েও কি তোমার কোনো প্রিয় ভক্ত আছে? এ জগতে তোমার সবচেয়ে প্রিয় কে?
দেবীর প্রশ্ন শুনে শ্রীহরি হাসলেন এবং বললেন, তুমি আমার প্রাণপ্রিয়া। কিন্তু যে জন ভক্তিভরে সর্বদাই আমার কথা চিন্তা করে সেই জনই আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয়। আমি তার হৃদয়ে সব সময় বিরাজ করি। যদি সে কখনো আমাকে ভুলে যায়, তবুও আমি তাকে ত্যাগ করি না। এমন ভক্তি একমাত্র শিবের আছে। তাই শিবই আমার সবচেয়ে প্রিয়।
আর যিনি শিবের পূজা করেন, তিনি আমার কাছে শিবের চেয়েও প্রিয়। যে শিবপূজা করে না তাকে আমি অতিশয় দুর্জন মনে করি। তার উপর সব সময় ক্রোধিত হয়ে থাকি। সে জপ, তপ, পূজা যাই করুক না কেন, সে কোনো কিছুতেই ফল পাবেনা। শিবকে পূজা করলে মঙ্গল হবে, তা না হলেই বিপদ আসবে।
হরির মুখে লক্ষ্মীদেবী সব কথা শুনলেন এবং তিনি নিজেকে অভাগিনী মনে করলেন। বললেন, আমার জীবন বিফলে গেল। আমি কখনই শিবকে পূজা করিনি। আমার বেঁচে থেকে লাভ কি?
শ্রীহরি দেবী লক্ষ্মীকে বললেন, দুঃখ করো না। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। আমি তোমার কাছে কখনও শিবের মাহাত্ম কীর্তন করিনি, তাহলে তুমি জানবে কি করে। এবার থেকে রোজ তুমি শিবের পূজা করো। যদি পদ্মফুল দিয়ে শিবের পূজা কর তাহলে শিব তুষ্ট হবেন। শিব তুষ্ট হলে অন্যান্য দেবতারাও তুষ্ট হবেন। শিবের অর্চনা করলে সবার অর্চনা করা হয়।
নারায়ণের কথামতো লক্ষ্মীদেবী প্রত্যেকদিন শিবের পূজা করলেন। তিনি একশো পদ্মফুল দিয়ে একবছর ধরে পূজা করবেন ঠিক করলেন। দেবী নিজে প্রত্যেকদিন শত পদ্ম গুণে আনেন এবং তা গঙ্গাজলে ধুয়ে নিয়ে তা দিয়ে ভক্তিভরে পূজা করেন। এইভাবে একদিন বছরের শেষ দিন এল। প্রত্যেকদিনের মত দেবী শত পদ্মফুল তিনবার ধরে গুণে নিয়ে গঙ্গাজলে ধুয়ে পূজায় বসলেন।
লক্ষ্মীদেবীকে পরীক্ষা করার জন্য ত্রিলোচন দুটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন।
এদিকে এক একটি করে পদ্মফুল লক্ষ্মীদেবী শিবলিঙ্গের উপরে স্থাপন করে পূজা করছেন।
হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন দুটি ফুল কম পড়ছে। তখন তিনি মনে মনে ভাবলেন, কে আমার পূজার পদ্ম চুরি করে নিল? তাহলে কি আমি গোণার সময় অন্যমনস্ক ছিলাম। আমার এই পূজা বিফল হবে। এখন দুটো পদ্ম কোথায় পাব? আর যদি পাওয়া যায় তাহলে অন্যের দ্বারা আনাতে হবে। প্রত্যেকদিন আমি নিজের হাতে ফুল তুলেছি, আমাকে ব্রতের শেষ দিন অন্যের দ্বারা চয়নিত ফুল পূজায় ব্যবহার করব? আর আমি যদি আসন ছেড়ে উঠি, তাতে পূজায় বিঘ্ন হবে। তাহলে এখন কি করা যায়।
তারপরে লক্ষ্মীদেবীর একটা কথা মনে পড়ে গেল। একদিন শ্রীহরি বলেছিলেন, লক্ষ্মীদেবী যেন একটি ফুল্লসরোবর। আর এই সরোবরে তোমার দুটি স্তন যেন দুটি কমল। শ্রীহরি কখনো মিথ্যা বলতে পারেন না। কাজেই এই দুই স্তনপদ্মে আমি শিবের পূজা করব।
এই কথা ভেবে দেবী ছুরিকা নিলেন। সেই দৃশ্য দেখে স্তনদ্বয় যেন বলছে তব অঙ্গে জন্মে আমাদের জীবন ধন্য হয়েছে, আবার যদি আমাদের দিয়ে শিব পূজা কর তাহলেও আমাদের জীবন সার্থক হবে।
দেবী স্তনদ্বয়ের অন্তরের কথা শুনে বললেন–হরি আর শঙ্করের যেমন কোনো ভেদ নেই, তেমনি পদ্মের সঙ্গে তোমাদেরও কোনো পার্থক্য নেই।
এই বলে দেবী বামহাতে স্তন ধরলেন, এবং ডান হাতে ছুরি দিয়ে তা কেটে ফেললেন। এবং তা শিবলিঙ্গের উপর দিলেন। তিনি পঞ্চাশর মন্ত্র উচ্চারণ করে পূজা করলেন। তারপর অন্য স্তনটিও ছেদন করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তখন অকস্মাৎ শিব দিব্যমূর্তি ধারণ করে সেই সোনার লিঙ্গের উপর দাঁড়িয়ে দর্শন দিলেন দেবীকে।
তাঁর সারা গায়ে ভস্ম মাখা, ত্রিলোচন, নীলকণ্ঠ শিবের জটাজুট, এবং সহাস্যবদন, কটিতটে ব্যাঘ্রচর্ম নাস-যজ্ঞ উপবীত, হাতে ত্রিশূল তুলে দেবী লক্ষ্মীকে তিনি বললেন–দেবী তুমি তোমার স্তন ছেদন করো না। তোমার অন্তরে যে আমার প্রতি ভক্তি আছে তা আমি আগেই বুঝেছি, তোমার ছেদন করা স্তনটি আবার আগের মত হয়ে যাবে। আর আমার লিঙ্গের উপর যে, স্তন দিয়ে তুমি পূজা করেছ, তা বৃক্ষরূপে জন্মাবে তার নাম হবে শ্রীফল। যতদিন ধরাতলে চন্দ্র সূর্য উদয় হবে, ততদিন ধরে গোটা জগৎবাসী তোমার গুণগান করবে।
শ্রীফল অর্থাৎ বিপত্রে আমার পূজা করলে আমি সন্তুষ্ট হব। আমার স্বর্ণলিঙ্গ তৈরি করে সোনা, রুপো, মুক্তো দ্বারা পূজা করলে আমি সন্তুষ্ট হব না। কিন্তু কেউ যদি বিল্বপত্র দ্বারা পূজা করে তাহলে আমি তুষ্ট হবো। আমার লিঙ্গের উপর ভক্তিভরে কেউ যদি বিল্বপত্র দেয় এবং পূজা করে, তাহলে তাকে আমি মোক্ষ প্রদান করবো।
দেবী শঙ্করের স্তব-স্তুতি করলেন। শিব তখন দেবীকে বললেন, তোমার পূজায় আমি তুষ্ট এখন তুমি কি বর চাও বলো।
লক্ষ্মীদেবী শঙ্করকে বললেন, ভাগ্যবলে আপনার দেখা পেলাম, আর কোনো বরের প্রয়োজন নেই। আপনার কাছে একটি বর চাই, সারাজীবন আপনাতে যেন আমার ভক্তি অটুট থাকে।
শিব বললেন, তাই হবে। তিনি লক্ষ্মীদেবীর কাটা স্তনটি নিয়ে ত্রিশূলের দ্বারা মাটিতে পুঁতে দিলেন। তারপর সেখান থেকে অন্তর্হিত হলেন।
স্তন পদ্মবীজ আস্তে আস্তে অঙ্কুরিত হল। সেটি ক্রমে বৃক্ষরূপ ধারণ করে। অপূর্ব সুন্দর তার পাতা, একটি বৃন্তে তিনটি পাতা।
সেই বৃক্ষকে দেখবার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং সকল দেবতাগণ এলেন। সকলে সেই বিল্বপত্রকে প্রণাম করলেন।
নারায়ণ সকলকে বললেন, এই বিপত্রের উপরের পত্রটি স্বয়ং শিব, বামপত্রে ব্রহ্মা আর দক্ষিণ পত্রে আমার অধিষ্ঠান। এই বিপত্রে কেউ পা দিলে বা স্পর্শ বা লঙ্ঘন করলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। সূর্য ও গণেশের পূজা এই পত্র দিয়ে করা যাবে না। যেখানে এই বৃক্ষ থাকবে তা বারাণসী সমান পুণ্যস্থান হবে। সেখানে মহেশ্বরের সঙ্গে উমা বিরাজ করবেন। বিল্বপত্র দিয়ে শিব পূজা করলে লক্ষ ধেনুদানের ফল পাওয়া যাবে। বিল্ববৃক্ষ কখনও ছেদন করা যাবে না বা একে পোড়ানো চলবেনা। চৈত্র থেকে চার মাস বিল্বপত্র এবং জল দান করলে পিতৃকুল পরিতৃপ্ত হয়।
বিপত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন জনার্দন। পরে ব্রহ্মা ও আদি দেবতাগণ সেই বিপত্রের দ্বারা মহেশ্বরের পূজা করলেন। তারপর যে যার নিজ স্থানে চলে গেলেন।