বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব
শ্রীবিষ্ণু বললেন–বৃষোৎসর্গ না করলে শ্রাদ্ধের ফল পাওয়া যায় না, সবই নিষ্ফল হয়।
বিনতানন্দন গরুড় বলল –বৃষ দান করলে কী ফল হয়? এর নিয়ম বিধিই বা কী? কোন্ সময় তা করা উচিত? কে প্রথম এই শ্রাদ্ধ করেছিলেন? প্রভু আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাকে শান্ত করুন। ভগবান বললেন– এ সম্বন্ধে এক পুরোনো কাহিনি আছে। তুমি শ্রবণ করো।
বিবাধ নগরে এক ধার্মিক রাজা ছিলেন। তার নাম বীরবাহন। মৃগয়ার উদ্দেশ্যে তিনি একদিন অরণ্যে প্রবেশ করলেন। বনের এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে দাঁড়ালেন বশিষ্ট মুনির আশ্রমে। তার দর্শন লাভের আশায়। রাজার মন উদগ্রীব হল। তিনি আশ্রমে প্রবেশ করলেন। অবনত মস্তকে করজোড়ে মুনিকে প্রণাম জানালেন। ধর্মতত্ত্ব জানার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন– হে মুনিশ্রেষ্ঠ, আমি ধর্ম অনুসরণ করে বহু কাজ করেছি, তবুও যমতাড়না আমার মনকে অশান্ত করে তোলে। নরক যন্ত্রণার হাত থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, আপনি দয়া করে সেই বৃত্তান্ত আমাকে বলুন।
বশিষ্ঠ মুনি বললেন– বহু ধর্ম কাজের মধ্যে পিতা-মাতার শ্রাদ্ধ কাজ একটি। সেই শ্রাদ্ধের মধ্যে বৃষোৎসর্গই শ্রেষ্ঠ বলে জানবে।
শ্রাদ্ধের উদ্দেশ্যে বৃষ যজ্ঞ করতে হয়। এর প্রভাবে প্রেতত্ত্ব নাশ হয়। একটি বৃষের ডান পাঁজরায় ত্রিশূল চিহ্ন ও বাম পাঁজরায় চক্র চিহ্ন এঁকে মৃতের উদ্দেশ্যে দান করাই নিয়ম। তার ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াবার সুযোগ পেলে, মৃতব্যক্তি প্রেতত্ত্ব থেকে এইভাবে মুক্তি পায়।
হে রাজা, এক উপাখ্যান বলছি শোনো। ত্রেতাযুগে এক নির্লোভ ধার্মিক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি কুশ সংগ্রহের জন্য বনে গিয়েছিলেন। আচমকা চারজন পুরুষ তাকে আক্রমণ করল। তাকে বন্দি করে বিমানযোগে আকাশ পথে উড়ে চলল। তারপর একসময় এক নগরে সেই বিমান এসে থামল।
সেখানকার মানুষদের চেহারা দেখে ব্রাহ্মণ অবাক হলেন। কেউ কেউ রোগা, কেউ মোটাসোটা, ভীষণ নোংরা জামাকাপড় তাদের পরনে। কেউ কেউ দামী দামী গয়নায় অলঙ্কৃত হয়েছে। কোনো মানুষ দেখতে অতীব সুন্দর। ঠিক যেন কোনো দেবতা।
চারজন পুরুষ সেই ব্রাহ্মণকে নিয়ে প্রবেশ করল মস্ত বড়ো এক প্রাসাদে, বুঝি রাজপুরী। সেখানে সোনার সিংহাসনে বসে আছেন রাজা, তাঁর মাথায় সোনার মুকুট, গায়ে মণি-মানিক্য খচিত পোশাক পরেছেন। তাকে ঘিরে আছে কয়েকজন অনুচর। তাদের কেউ রাজার মাথায় ছাতা ধরে আছে, আবার কেউ চামর দোলাচ্ছে। সবাই তার সেবাতে ব্যস্ত।
ব্রাহ্মণকে দেখেই সেই রাজা সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর পাদপদ্ম বন্দনা করলেন। তারপর অনুচরদের বললেন– এই ব্রাহ্মণকে ফিরিয়ে দিয়ে এসো। যেখান থেকে এনেছিলে সেখানে।
রাজার ব্যবহার দেখে ব্রাহ্মণ একেবারে অবাক হয়ে গেলেন।
বিনীত কণ্ঠে ব্রাহ্মণের উদ্দেশ্যে রাজা বললেন–আমার অপরাধ মার্জনা করুন। আপনার দর্শনাভিলাষী ছিলাম আমি। তাই আমার আদেশে আমার দূতেরা আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এখন আমার লোকেরা আপনার জায়গাতেই রেখে ফিরে আসবে।
ব্রাহ্মণের বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে গেল।
তখন রাজমন্ত্রী বললেন– এই রাজা গতজন্মে বিশ্বম্ভর নামে এক বণিক ছিলেন। বিরাজ নগরে বাস করতেন। সেখানে ছিল ব্রাহ্মণদের বাস। বণিক তার অর্জিত অর্থের বেশির ভাগটাই ব্রাহ্মণদের সেবায় খরচ করতেন। একসময় বিশ্বম্ভর তীর্থ যাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন। বহু তীর্থস্থান ঘুরলেন। এবার বাড়ি ফেরার পালা। পথে দেখা হল এক মুনির সঙ্গে, নাম লোমশ।
মুনিকে নতমস্তকে প্রণাম জানিয়ে বণিক জানতে চাইলেন- হে মুনি, আমি বহু তীর্থস্থান দর্শন করলাম, ভ্রমণ করলাম বহু পথ। কিন্তু বিষয়-আশয়ের প্রতি আসক্তি আমার নিবৃত্ত হল না। আপনি দয়া করে আমাকে সেই উপায় বলে দিন, যার ফলে আমি বিষয় তৃষ্ণা থেকে মুক্তি পাব।
লোমশ মুনি বললেন– দান-ধ্যান করতে হবে। দেব-দ্বিজ ভক্তি প্রদর্শন করো। ধীরে ধীরে বিষয়াসক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। তখন বিষয় হবে বিষ। যাও পুষ্করতীর্থে বৃষোৎসর্গ করে সব তীর্থ দর্শনের ফল লাভ করো।
মুনির বাক্য মাথায় করে বণিক এলেন পুষ্করে। সেখানে নিষ্ঠার সঙ্গে বৃষ দান করে যজ্ঞ করলেন। তারপর একদিন তার মৃত্যু হল। দিব্য বিমানে চড়ে স্বর্গে এলেন। স্বর্গসুখ ভোগ করলেন। তারপর রাজপুত্র হয়ে জন্মালেন। নাম হল বীর পঞ্চানন, যাকে আপনি সামনে দেখছেন।
ব্রাহ্মণ জানতে চাইলেন- পথে আসতে আসতে নানা ধরনের মানুষ দেখলাম। এর কারণটা বলবেন কি?
মন্ত্রী বললেন– দেবতাদের মতো দেখতে যাদের, তারা বৃষোৎসর্গের শ্রাদ্ধে সাহায্য করেছিল। যারা মোটাসোটা, তারা ওই সময় দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। তাদের থেকে দূরে যারা ছিল, তারা ময়লা নোংরা কাপড় পরা রোগা চেহারাধারী।
ব্রাহ্মণ বিস্মিত মনে স্বস্থানে ফিরে এলেন।
মহামুনি বশিষ্ঠের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাজা বীরবাহন এলেন মথুরায়। সেখানে বৃষোৎসর্গ যজ্ঞ করলেন। এবার এলেন নিজের রাজ্যে।
যথাসময়ে ওই রাজার মৃত্যু হল। যমরাজার অনুচররা তাকে নিয়ে চলল। পথে দেখা হল স্বয়ং ধর্মরাজের সঙ্গে। তিনি রাজার চরণে প্রণাম নিবেদন করলেন। এবং তার আদেশে যমদূতরা রাজাকে স্বর্গে নিয়ে গেল।
রাজা বীরবাহন জানতে চাইলেন– তাকে কেন ধর্মরাজ প্রণাম করছেন। কেনই বা তাকে স্বর্গে পাঠানো হল।
ধর্মরাজ বললেন– হে রাজন, আপনি মহাত্মা। আপনি এমন বড়ো পুণ্য কাজ করেছেন, যার ফলে আপনার স্বর্গধাম হল। বৃষোৎসর্গ করে আপনি সেই পুণ্য অর্জন করেছেন, এমন পুন্য কাজ জগতে আর একটিও নেই।