ব্রহ্ম খণ্ড
হে মুগ্ধগণ! পুরাণ প্রভৃতি স্তুতিশাস্ত্র পাঠ করার আগে সেই সর্বব্যাপক ভগবানের উদ্দেশে প্রণাম নিবেদন করো, যিনি গণেশ, প্রজাপতি, ব্রহ্মা, দেবরাজ, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গিরিজা দুর্গা প্রমুখদের ও দেবী এবং মুনি শ্রেষ্ঠগণের প্রণম্য। তিনি স্থূল দেহে এই বিশাল বিশ্বকে নিজের লোমকূপে ধারণ করেছেন। তিনি স্থাবর ও জঙ্গম জগতের সৃষ্টিকারী। তার বন্দনা করো, সেই নিষ্ঠুণ নিরাকার। শ্রী হরির পদবন্দনা করো। যিনি ভক্তদের ধ্যানের জন্য অনুপম, সুচারু, শ্যামসুন্দর রূপ ধারণ করেছেন।
হে মায়ামুগ্ধ জীব, তোমরা সেই অপূর্ব মনোরম ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ রূপ পরমপ্রিয় দুধ পান করো, তার ধ্যান করো। নারায়ণ নরোত্তম নর, দেবী, দূর্গা, সরস্বতী ও ব্যাসদেবের চরণে প্রনাম নিবেদন করো।
ভগবান বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের পাদবন্ধনা সমাপ্তে নারায়ণ, নর, নরোত্তম এবং সরস্বতী দেবী ও অন্যান্য দেবতাকে প্রণিপাত জানিয়ে জয়ধ্বনি দাও। প্রকৃতি ব্রহ্মা বিষ্ণু এবং রুদ্রাদি প্রকাশ ঘটেছে, যা থেকে সেই পরম ব্রহ্মা অচ্যুত কৃষ্ণের ভজনা করো। হে শ্রোতৃবর্গ, তোমরা এই সুন্দর ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ উচ্চারণ করে আনন্দ লাভ করো।
ভারতীয় নৈমিষরণ্যে বলা হয়েছে শৌণক প্রভৃতি সহস্র ঋষিবৃন্দ নিজ নিজ নিত্য সুশাসনে ব্রতী হয়েছিলেন। এই সময় সৌতির আগমন ঘটে, ঋষিবৃন্দ তাকে আসন গ্রহন করার অনুরোধ করলেন। মুনিশ্রেষ্ঠ শৌণক অতিথির উদ্দেশ্যে ভক্তি প্রদর্শন করলেন, তাঁকে প্রীত করলেন ও তার কুশল জানতে চাইলেন।
যে পুরাণ বিষয় শ্রীকৃষ্ণ সখার দ্বারা যুক্ত সেই পুরাণ বিষয়ে সৌতির কাছে সুস্থির আসনে সমাসীন সর্বতত্ত্ব বিশারদ পুরাণবেত্তা মহামুনি শৌনক জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন যে পুরাণ মঙ্গলের আবাসক্ষেত্র, যে পুরাণ সুখ মোক্ষ প্রদানকারী। যে পুরাণ পাঠে তত্ত্বজ্ঞান জন্মায়। যে পুরাণে, স্ত্রী, পুত্র ও পৌত্র বর্ধনকারী। সেই পুরাণ সম্পর্কে দ্বিজ জানতে চাইলেন।
শৌণক বললেন, হে মহাভাগ, আপনার মঙ্গল কামনা করি। আপনার দর্শন লাভে আমরা কৃতার্থ। কলিযুগে আমরা সকলেই অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছি। মুক্তি লাভে ব্যক্তিদের উদ্ধারের কারণে আপনার এখানে আগমন। হে পুরাণ পরমবেত্তা, আপনি সাধু ও মহান ভাগ্যবান। সেই জ্ঞানবর্ধক পুরাণ বিষয় বর্ণনা করুন। যা শ্রবণ করে শ্রীকৃষ্ণ পদে মতি নিশ্চল থাকে।
হে সৌতে! আপনি সেই পরমব্রহ্মের গুণকীর্তন করুন যিনি জীবগুণের চিত্তে শ্বাশত সুখ ও আনন্দ দান করেন। সেই পরমাত্মার স্বরূপ আকার নিরাকার তাঁর ধ্যান কী ভাবে করা যাবে। তার ভাবনা কী ভাবে করতে হবে, বৈষ্ণবরা কী ভাবে তার জপ করেন, সাধু যোগীপুরুষগণ কী ভাবে ধ্যান করেন, সব কিছু আমাদের সামনে ব্যক্ত করুন।
যে পুরাণে প্রকৃতির আকার প্রকারের কথা বর্ণিত হয়েছে। যে পুরাণে গোলকের বৈকুণ্ঠের ও শিবলোকের বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে স্বর্গের বর্ণময় রূপ পরিস্ফুটিত হয়েছে। যেখানে প্রকৃত ও প্রহতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে। সেইসব শ্রবণ করতে আমরা আগ্রহী।
যে পুরাণ প্রকৃতির অংশ, যা সমগ্র চরিত্র, ধ্যান ও পুজো পদ্ধতি, শুভ স্তোত্র ইত্যাদি বর্ণনা করেছে। সে পুরাণ সম্পর্কে আমাদের অবগত করুন। দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, সাবিত্রী ও অমৃতের মতো অত্যন্ত অপূর্ব রাধিকার কাহিনী। মানুষ কর্মের বিপাকে ও নরকের বর্ণনা যেখানে বলা হয়েছে। কর্মের মন্তন এবং পাপ থেকে মুক্তি লাভের উপায় বলা হয়েছে। বর্ণানুসারে জীব যে যোনিতে জন্মলাভ করে কর্ম থেকে যেসব রোগের উৎপত্তি হয়, যে কর্ম করলে মানুষের মুক্তি লাভ হয় সব কিছু আপনি আমাকে শ্রবণ করান।
হে মুনিবর, যেখানে মনসা, তুলসী, কালী, গঙ্গা, পৃথিবীর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, শালগ্রাম শিলা ও দানের নিরূপণ এবং ধর্মাধর্মের নিরূপণ যেখানে করা হয়েছে, সেই পুরাণের বিষয়ে বলুন।
গণেশের জন্মবৃত্তান্ত, তার চরিত্র ও কাজের কথা, অত্যন্ত ফলদায়ী সূরকবচ মন্ত্রের কথা যেখানে বলা হয়েছে। এমন সব অপূর্ব কাহিনী যা আগে কেউ ব্যক্ত করেননি। একমাত্র আপনিই আমাদের এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। পরমাত্মা কৃষ্ণের জন্ম পুণ্যক্ষেত্র ভারতবর্ষের কোন পুণ্যবানের গৃহে হয়েছিল। কে বা সেই পরম পুণ্যবতী গর্ভধারিনী জননী? তিনি কেন জন্ম নিয়েছিলেন? কেনই-বা ফিরে এলেন? কে তাঁর কাছে এই পৃথিবীর ভাব অবতরণ প্রার্থনা করেছিল? গোলকধামে প্রত্যাবর্তনের জন্য কোন সেতু নির্মিত হয়েছিল? সেই দুলর্ভ পুরাণ কীর্তন করুন যা মুনিদের দধিজ্ঞেয় যা মনকে পবিত্র রাখার কারণ স্বরূপ।
সৌত বললেন– সিদ্ধক্ষেত্র থেকে আমার আগমন। নারায়ণের আশ্রম উদ্দেশ্যে গমন, আপনার পদ্মরূপ চরণযুগলের দর্শন লাভ করে আমরা মঙ্গল লাভ করলাম, হে ব্রাহ্মণবৃন্দ আপনারা আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। ভারতের পুণ্যদানের স্থান ধর্মমিষারণ্য দর্শন হেতু আগমন। দেবতা, ব্রাহ্মণ ও গুরু প্রণম্য। এ নীতি লঙঘনকারী কালসূত্র নরকে পচে মরে। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের বেশে ভারতের পুণ্য ভূমিতে সর্বদা চলমান। পুণ্যবান ও সুকৃতিবান বিনীত ভাবে হরিরূপী ব্রাহ্মণের পাদবন্দন করে।
হে ভগবান, আপনি কোন অভিপ্রায় আমার কাছে জিজ্ঞাসা রেখেছেন তা অনুমেয়। ব্রহ্মবৈবর্ত হল সর্বশ্রেষ্ঠ সারবান পুরাণ। অন্যসব পুরাণ, উপপুরাণ ও বেদের অপূর্ণতা দরকারী হরিভক্তি প্রদানকারী, তত্ত্বজ্ঞান বর্ধক। এই পুরাণ পাঠের ফলে গমেছুক কাম প্রবৃত্তি ও মোক্ষকামী মোক্ষলাভ করে। এই পুরাণ কল্পবৃক্ষের ন্যায় বৈষ্ণবদিগকে ভক্তি প্রদান করে। পরব্রহ্ম সমস্ত কিছুর মূলস্বরূপ ব্রহ্মখণ্ডে তা নিরূপিত হয়েছে।
হে শৌনক মহামুনি, সন্তযোগী পুরুষের বৈষ্ণবের কোনো পার্থক্য নেই। সাধুসন্তদের সঙ্গে থাকলে তিনি হন সপ্তপুরুষ আর যোগী পুরুষের সঙ্গলাভে হন যোগী পুরুষ। ভক্ত সঙ্গে বৈষ্ণব। এই ভাবে ক্রমে ক্রমে তারা সদযোগী পুরুষে পরিণত হন। প্রকৃতি খণ্ডে দেবতাদের সমস্ত জীবের সৃষ্টিকারী এবং দেবীদের শুভচরিত নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই পুরাণে জীবের কর্মের বিপাক ও শালগ্রাম শিলার নিরূপণ কবচ ও স্তোত্রমন্ত্র সবই নিরূপিত হয়েছে। প্রকৃতির অংশ কলা এবং লক্ষ্মণ সম্পর্ক নির্ণত হয়েছে। পাপ এবং পুণ্যের বিচারে স্বর্গ ও নরকের বর্ণনা করা হয়েছে। নানারকম রোগব্যাধির যুক্তির কথা এই পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে।
প্রকৃতির পরে আছে গণেশ খণ্ড। যেখানে গণেশের জন্ম ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। সেখানে অত্যন্ত গূঢ় কবচ স্তোত্র মন্ত্র এবং তন্ত্রের বিবৃত হয়েছে। গণেশ এবং ভৃগুর কথোপকথনের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বৃত্তান্ত। তার কাজকর্ম সমস্ত বর্ণিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খণ্ডে। এই খণ্ড সাধুজনদের সেতু বিধান নিরূপিত করেছে।
হে ব্রাহ্মণ, আমি আপনাকে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ কীর্তন করছি, যেখানে সমস্ত ধর্মের কথা ব্যক্ত হয়েছে। এ পুরাণ পাঠে সকলের অভীষ্ট পূরণ হয়। আশা আকাঙ্খ পূরণকারী, বেদ স্বরূপ এই পুরাণ সমস্ত পুরাণের সার। এখানে ব্রহ্মর পূর্ণতা সম্বন্ধে কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন। তাই এই পুরাণকে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ নামে অভিহিত করা হয়েছে। প্রথমে এই পুরাণ সূত্র ব্রহ্মাকে দান করা হয়েছিল। ব্রহ্মা আবার তা শ্রীকৃষ্ণকে দিয়েছিলেন।
তারপর এ পুরাণ চলে যায় নারায়ণের হাতে। এটি গ্রহণ করে দেবর্ষি নারদ তা মহানন্দে ব্যাসদেবকে দান করেন। ব্যাসদেব তা মহান রূপে প্রস্তুত করেন। আমি তার কাছ থেকে এই সুমনোহর পুরাণ লাভ করি। ব্যাসদেব বিরচিত আঠারো হাজার শ্লোক সমৃদ্ধ এই পুরাণ শ্রবণ করলে যে ফল লাভ করা যায় যে, একটা অধ্যায় পাঠে তার সমান ফল পাওয়া যায়।
মুনিশ্রেষ্ঠ শৌণকের বিনীত অনুরোধে সৌতি পরব্রহ্ম খণ্ড ব্যাখ্যা করলেন।
তিনি বললেন–মহাতেজস্বী গুরুদেব ব্যাসের পাদবন্দনা করে হরি প্রভৃতি দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের প্রণাম নিবেদন করি। হে ব্রাহ্মণ, শ্ৰী ব্যাসদেবের মুখ নিঃসৃত ব্রহ্মখণ্ড শ্রবণ করুন। প্রলয়ের পর এক উজ্জ্বল জ্যোতিঃপুঞ্জের প্রকাশ ঘটে। স্বেচ্ছাধীন ভগবানের ওই জ্যোতি ছিল অত্যন্ত মহান। তার অন্তরালে ছিল এই ত্রিভুবনের জ্যোতি। সবার ওপরে ছিল গোলকধাম। যা তিন কোটি যোজন জুড়ে বিস্তৃত। এ ধাম বহু মূল্য রত্ন সমৃদ্ধ ও তেজস্বরূপ। যেখানে বৈষ্ণবদের গমন ঘটে।
কিন্তু যোগীরা তা স্বপ্নেও দেখতে পারেন না। ভগবান সেই শ্রেষ্ঠ স্থানে অবস্থান করেছেন, এখানে রোগ, জরা, ব্যাধি, মৃত্যুর প্রবেশ নিষেধ। তার নীচে দক্ষিণে আছে বৈকুণ্ঠলোক এবং উত্তরে শিবলোক অবস্থিত–এই দুটি লোক পঞ্চাশ কোটি যোজন জুড়ে বিস্তৃত। গোলকধামের মতো এই দুটি ধামও অমূল্য রত্নরাজিতে সমৃদ্ধ। প্রলয়ের পরে সৃষ্ট বৈকুণ্ঠধামে লক্ষ্মী ও নারায়ণের সহচর, সহচারীগণ চতুঃহস্ত ও পদ বিশিষ্ট। জরা, মৃত্যু এঁদের গ্রাস করতে পারে না।
প্রলয়কালে শিবলোক শূন্য হলেও সৃষ্টির সময় তা শিব ও তাঁর অনুচরবৃন্দের দ্বারা পরিপূর্ণতা লাভ করে। গোলকধামের মধ্যে এক আনন্দপূর্ণ আকার শূন্য ও শ্রেষ্ঠতর জ্যোতি আছে। ভেতরের জ্যোতির গাত্রবর্ণ নতুন মেঘের ন্যায় শ্যামবর্ণের। চোখ দুটি যেন রক্ত পদ্ম। শরৎকালের পূর্ণিমার পূর্ণ চন্দ্রের শোভার ন্যায় অতি মনোহর শোভামণ্ডিত তার মুখ। তাঁর লাবণ্য এককোটি কামদেবের লাবণ্য স্বরূপ। তার হাতে বাঁশি, সদা হাস্যময় দুটি ওষ্ঠ, পরণে পীতবস্ত্র। তিনি মহামূল্যবান অলংকাররাজিতে সুশোভিত।
তিনি ভক্তদের সর্বদা মঙ্গল করেন। কস্তুরী চন্দনে তার দেহে সুবাসিত। তার মস্তকে মহামূল্যবান রত্নখচিত কিরীট। তিনি রত্ন সিংহাসনে আসীন। বুনো ফল তার ভূষণ। তিনি সনাতন পরম ভগবান। তিনিই পরাৎপর। তিনি রাসমণ্ডল রচনাকার। তিনিই সকলের মঙ্গলদায়ক। তিনি অব্যয়। তিনি সিদ্ধিদাতা। তিনি নির্গুণ। তিনি আদি পুরুষ। তিনি সত্যাসত্য স্বরূপ। তিনি অদ্বিতীয় ও অনন্য। বৈষ্ণবরা এই শান্ত পরমপ্রিয় রূপের আরাধনা করে থাকেন। দিক আর আকাশস্থ শূন্য বিশ্বকে তিনিই প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই পরমরূপধারী শ্রীভগবানের চরণে শতকোটি প্রণাম।
সৌত বললেন– হে ব্রাহ্মণ, বায়ু শূন্য, প্রাণী শূন্য, শস্যবিহীন, পাহাড় পর্বত ও সাগর শূন্য গোলককে প্রত্যক্ষ করে ভগবান নিজের ইচ্ছাতে এই সৃষ্টির সূচনা করেন।
প্রথমে তিনি তার ডানদিকে তিন গুণের আর্বিভাব ঘটালেন-সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। জগতের কারণ স্বরূপ এই ত্রিগুণ মহান, অহংকার, রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ। পরমপুরুষের দাক্ষিণ্যে আবির্ভূত হন স্বয়ং নারায়ণ, তিনি পীত বস্ত্রধারী, শ্যামবর্ণ, চারহস্ত বিশিষ্ট। তিনি চারহাতে শঙ্খ, চক্র, গদা, ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। তার গলায় কৌস্তভমণি শোভা পায়। তাঁর ধনু শৃঙ্গ নির্মিত চাঁদের ন্যায় প্রভাযুক্তা। তাঁর সুন্দর মুখমন্ডল। শ্রীবৎস চিহ্ন তাঁর বুকে স্থান পেয়েছে। তিনি শ্রীদেবীর দ্বারা বিভাবিত।
নারায়ণ সেই আদি পুরুষের গুণকীর্তন করলেন এইভাবে–হে প্রভু, তুমি বরের কারণ। তিনি কর্মের কর্মস্বরূপ। তুমি তপস্বীদের তপস্যায় প্রীত হয়ে বর দান করো। সেই আত্মারাম, মনোহর, নবঘন শ্যামকে বন্দনা করি। তুমি সকলের ঈশ্বর, সর্বোত্তম, সর্বকারণ স্বরূপ ফল দান করো। তুমি বেদজ্ঞ। তোমার চরণে প্রণিপাত জানাই, ভক্তিপূর্ণ স্তব শ্রবণ করে শ্রী কৃষ্ণ তার পাশের আসনে উপবিষ্ট হতে বললেন। ত্ৰি সন্ধ্যায় এই নারায়ণ স্তোত্র শ্রবণ বা পাঠ করলে পাপনাশ হয়। সন্তান লাভেছু সন্তান লাভ করে। রাজা রাজ্য লাভ করেন। ধনহীন ধন পায়। কারাগারে বসে এই স্তোত্র পাঠের গুণে বিপদমুক্ত হওয়া যায়। প্রাণ দিয়ে রোগী এই স্তোত্র জপ করার ফলে রোগমুক্ত হয়।
সৌতি বলতে থাকলেন–সেই পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের বামদিকে দিগম্বর মহাদেবের আবির্ভাব ঘটল। বিশুদ্ধ স্পটিকমণির মতো শুভ্র মাথায় তপ্ত সোনার মতো উজ্জ্বল জটাভার। তিনটি চোখ সমন্বিত মুখমণ্ডলে প্রসন্নতা বিরাজ করছে। চন্দ্র তার কপালের শোভা বৃদ্ধি করেছে। তিনি ত্রিশূলধারী। সেই মহাজ্ঞানী জ্ঞানানন্দময় পরমেশ্বরের এক হাতে পট্টিশ অন্য হাতে জপমালা। তিনি বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ। তিনিও ব্রহ্মতেজ সম্পন্ন। শ্রীকৃষ্ণের সামনে, তিনি করজোড় দণ্ডায়মান। শ্রীকৃষ্ণপ্রেমে তার দেহ পুলকিত।
তিনি অশ্রুসজল নেত্রে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করলেন হে ভগবান, তুমি জয়দাতা। তুমি অজেয়। তোমাকে আমি বন্দনা করি। তুমি বিশ্বপতি। বিশ্বের আধার, বিশ্বের কারণের কারণ। বিশ্ব তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়। আবার তুমিই তার লয় ঘটাও। তুমি তেজস্বী শ্রেষ্ঠ, তোমাকে প্রণিপাত।
শ্রীকৃষ্ণ মহাদেবের মুখনিঃসৃত স্তব শ্রবণ করে পুলক বোধ করলেন। এক রত্নময় সিংহাসনে তাঁকে বসতে বললেন। মহাদেব বর্ণিত এই কৃষ্ণস্তোত্র সকল কাজের সিদ্ধিদাত্রী। যে সংযতচিত্তে নিত্য এই স্তোত্র স্মরণ করে, সে জয়ী হয় সকল কাজে। বন্ধুবান্ধব ধনসম্পদের অধিকারী হয়। শত্রু নাশ হয়। এ হল পাপ ও দুঃখ হরা মন্ত্র।
সৌত বললেন– এবার আর্বিভূত হলেন মহাতপস্বী বৃদ্ধা ব্রহ্মা। কৃষ্ণের নাভিপদ্ম থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন, চতুর্ভুজ শ্বেতবস্ত্র পরিহিত, কমণ্ডলধারী। শুভ্র কেশ ও শুভ্র দন্ত। তিনি যোগী শ্রেষ্ঠ, তিনি সকলের গুরু ও জনক। শান্ত, সুন্দর, সমাহিত এ মূর্তি সরস্বতীর প্রিয়ভক্ত। তিনি সমস্ত কাজের স্রষ্টা ও বিধাতা। চারবেদের বিধানকর্তা ও জ্ঞাতা।
ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখে হাতজোড় করে দাঁড়ালেন, শ্রীকৃষ্ণপ্রেমে গদগদ হয়ে শুরু করলেন স্তুতি। ব্রহ্মা বললেন, আমি সেই গোবিন্দ কৃষ্ণের চরণ বন্দনা করছি। যিনি গোপবেশধারী গুণাতীত, যিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি অব্যয়, অক্ষয়। যিনিই বর্ষার জল ভরা মেঘের ন্যায় পীত বর্ণধারী। যিনি কিশোর বয়সে শান্ত গোপীদের প্রিয়। তুমি কামদেবের থেকেও সুন্দর। হে রাজেশ্বর রাসনিবাসী তোমাকে প্রণাম জানাই।
স্তব শেষ করে ব্রহ্মা নারায়ণ ও মহাদেবকে সম্ভাষণ জানালেন। শ্রীকৃষ্ণ তাকে রত্নসিংহাসনে উপবিষ্ট হতে আজ্ঞা করলেন। ব্রহ্মার বর্ণিত এই শ্রীকৃষ্ণের স্তোত্র সকল পাপের নাশ করে, দুঃস্বপ্ন দূর করে। নিত্য ভোরে এই স্তুতি যে পাঠ করে ধনেজনে তার সংসার ভরে ওঠে। সে দীর্ঘায়ু হয়।
এইভাবে শেষ হল ব্রহ্মার শ্রীকৃষ্ণ স্তোত্র পাঠ।
সৌতি বললেন– এবার সেই পরমাত্মার বক্ষস্থল থেকে ধর্ম উঠে এলেন। তিনি শুক্লবর্ণ জটাধারী ওষ্ঠপুটে স্মিত হাসির রেখা। তিনি দয়াবলে দ্বেষশূন্য। সর্বত্র তিনি সমান দৃষ্টি প্রদর্শন করেন। সমস্ত কর্মের স্বরূপ যিনি সেই ধর্ম শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করে বললেন– আমি সেই পরমাত্মার বন্দনা করি, যিনি কৃষ্ণ। বিষ্ণু বাসুদেব পরমাত্মা, ঈশ্বর গোবিন্দ, পরমানন্দ, এক ও অদ্বিতীয়। অক্ষয় ও অদ্ভুত। গোপেশ্বর গোপীশ, গোপ, গোরক্ষক, বিভু, গাভীদের পতি, গোঠ বিহারী, গোবৎস, পুচ্ছধারী, গো, গোত্র ও গোপীদের মধ্যে অবস্থানকারী প্রধান পুরুষোত্তম, নবঘনশ্যাম, রাসবিহারী, মনোহরণকারী।
শ্রীকৃষ্ণের স্তব শেষ করে ধর্ম ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে সম্ভাষণ করে শ্রীকৃষ্ণর অনুমতি ক্রমে এক রত্ন সিংহাসনে উপবেশন করলেন।
শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে ধর্ম যে চব্বিশটি নাম উল্লেখ করেছেন, প্রতি ভোরে তা উচ্চারণ করলে সর্বত্র জয়লাভ করা যায়। মৃত্যুর সময়ে হরির নাম উচ্চারণ করলে শ্রীহরিপদে আশ্রয় পাওয়া যায়। সে নিশ্চিত ভাবেই হরির দাসত্ব লাভ করে, ধর্ম তাকে সর্বদা আশ্রয় দেয়, অধর্ম তাকে ত্যাগ করে, চতুর্বেদের ফল সে লাভ করে। তার সমস্ত পাপ নাশ হয়। তার কোনো ভয় থাকে না। সে সকল দুঃখকে জয় করে।
এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ স্তোত্র শেষ হল। সুতপুত্র বলতে থাকেন–ধর্মের বাঁদিক থেকে উঠে এলেন পদ্মালয়া লক্ষ্মীর ন্যায় এক কন্যা মূর্তি। পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মুখ থেকে এক দেবীর সৃষ্টি করলেন। তিনি হলেন সরস্বতী। বাণী ও পুস্তক ধারিণী। শুভ্র গাত্রবর্ণা দেবী। চন্দ্রের ন্যায় সুষমামণ্ডিত।
তার আঁখিপল্লব যেন দুটি পদ্ম। তিনি আজ্ঞন রঙা পট্ট বস্ত্রে সুসজ্জিতা। বিভিন্ন অলংকার ও রত্নরাজিতে তিনি সুশোভিতা। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠা সুন্দরী নারী। শ্রুতি ও শাস্ত্র সকলের শ্রেষ্ঠা। তিনি জ্ঞানীদের কাছে উত্তম মাতা হিসেবে বিরাজিতা, তিনি জগধিষ্ঠাত্রী। তিনি শুদ্ধ সত্ত্বময়ী, তিনি শান্তরূপা। কবিগণ তাকে ইষ্টদেবী রূপে বন্দনা করে থাকেন।
বীণাধারিণী সরস্বতী শ্রীকৃষ্ণের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ালেন। শ্রীকৃষ্ণ দর্শনে তিনি সুখ লাভ করেন। তিনি বীণা বাজিয়ে শ্রীকৃষ্ণের স্তোত্র গীত করেন। নৃত্য প্রদর্শন করেন, তার নাচ গানের মধ্যে দিয়ে যুগে যুগে শ্রীহরির ক্রিয়াকলাপের প্রকাশ ঘটে। তিনি শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করলেন এইভাবে–আপন রাসমণ্ডলে অবস্থানকারী রাসোল্লিত। রত্নসিংহাসন আরূঢ়। রত্নভূষণে শোভিত। আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ, আপনি রাসেশ্বরী শ্রীরাধার সঙ্গী, আপনি রাসবিহারী, আপনার চরণে প্রণিপাত জানাই। আপনি প্রতিটি রাসে বিহারকারী, রাসোৎসুক গোপীগণের পরম কান্ত প্রিয়তম, আপনি সকলের মনোহরণকারী, আপনি শ্রীকৃষ্ণ, আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।
দেবী সরস্বতী তার কৃষ্ণস্তুতি শেষ করে হাসিমুখে সকলের সঙ্গে আলাপন সারলেন। তারপর শ্রেষ্ঠ রত্ন সিংহাসনে বসলেন। সরস্বতীর মুখ নিঃসৃত এই স্তোত্র যে প্রত্যহ ভোরে পাঠ করে সে হয় ধনবান। সে বিদ্যা ও পুত্র লাভ করে। তার দুর্বুদ্ধি নাশ হয়। সুবুদ্ধির উদয় হয়।
এইভাবে দেবী সরস্বতী তাঁর শ্রীকৃষ্ণ স্তোত্র সমাপ্তি করলেন।
সৌত বললেন– এবার শ্রীকৃষ্ণের মন থেকে উদিত হলেন দেবী মহালক্ষ্মী। তিনি গৌরবর্ণা, পীতবস্ত্র পরিহিতা, ঠোঁটে স্মিত হাসি। অল্পবয়সী, বিভিন্ন অলংকার ও রত্নরাজিতে বিভূষিতা। তিনি হলেন সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, স্বর্গে স্বর্গলক্ষ্মী এবং রাজার কাছে রাজলক্ষ্মী হিসেবে এই দেবী পূজিতা।
মহালক্ষ্মী শ্রীকৃষ্ণের সামনে হাতজোড় করে ভক্তি অবনত চিত্তে দাঁড়ালেন। তিনি পরমাত্মাকে প্রণাম জানালেন। বললেন–যিনি সত্য স্বরূপ, সত্যেশ্বর, যিনি সত্যের মূল, সেই সনাতন পরম পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। শ্রীহরিকে প্রণিপাত জানিয়ে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা দেবী স্বর্গলক্ষ্মী উপস্থিত সকল দেবদেবীকে অভিবাদন জানিয়ে রত্ন সিংহাসনে আরোহন করলেন।
এবার জন্ম নিলেন প্রকৃতি দুর্গাদেবী, শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধি থেকে যার সৃষ্টি। এই দেবী শতভূজা। ত্রিশূল, শক্তি, শাঙ্গধনু, খঙ্গা, বান, শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, অক্ষমালা, কমণ্ডল, বজ্র, অঙ্কুশ, পাশ, ভূশণ্ডী, নারয়াণস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র, রৌদ্রস্তু, পাশুপতাস্ত্র, পর্যন্যাস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র, গান্ধাস্ত্র ও বারণাস্ত্রে সুসজ্জিত। তিনি দুর্গতি নাশিনী, তিনি সমস্ত শক্তির অধীশ্বর, তিনি ভয়ংকরী, তিনি পরামাত্মার শক্তি স্বরূপা ও জগন্মাতা।
প্রকৃতি দুর্গাদেবী শ্রীকৃষ্ণের সামনে উপনীত হয়ে তার দর্শনে পুলক অনুভব করলেন। স্মিত হাস্যে তিনি পরমাত্মার স্তব করলেন এইভাবে-হে পরমানন্দ স্বরূপ, আপনাকে বন্দনা করি। আপনি জগতের স্রষ্টা, পালনকর্তা, সংহারকারী। আমি আপনার সৃষ্টি তাই আমি সর্বরূপিনী প্রকৃতি। আপনি পলকের মধ্যে ব্রহ্মার পতন ঘটাতে পারেন। আপনার ভ্রুকুটি ইঙ্গিতে কোটি কোটি বিষ্ণুর জন্ম হয়। আপনি লীলাচ্ছলে কত দেবীর আর্বিভাব ঘটান। আপনি আমার প্রণম্য। আপনি অসংখ্য বিশ্বের আশ্রয়স্থল, আমি সেই ঈশ্বরকে পরম শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর সমস্ত দেব, চারবেদ, এমন কি আমিও আপনার স্তব করতে অপরাগ। আমি সেই প্রকৃতির অতীত পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণকে বন্দনা করি।
দেবী দুর্গা কৃষ্ণস্তুতি বন্দনা শেষ করে তাঁকে প্রনাম জানালেন। তিনি রত্নখচিত এক সিংহাসনে বসলেন। দুর্গার পরমাত্মা কৃষ্ণের এই স্তোত্র যে পুজোর সময় পাঠ করে সে হয় সর্বজয়ী। সে সুখ লাভ করে, তার ঘরে দেবী দুর্গা অধিষ্ঠিত থাকেন, মৃত্যুকালে ওই ব্যক্তি শ্রীহরি লোকে গমন করে।
সৌতি বললেন–এরপর দেবী সাবিত্রী আবির্ভূত হলেন। পরমাত্মার রসনা থেকে তার উৎপত্তি স্ফটিক মণির মতো উজ্জ্বল তাঁর মূর্তি। তিনি শ্বেত বসনা, মূল্যবন মণিমাণিক্যখচিত আভরণে সজ্জিতা। তিনি জপমালা হস্তে ধারণ করেছেন। সাধ্বী সাবিত্রী পরব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণকে প্রণিপাত করলেন। শ্রীকৃষ্ণের সামনে নত মস্তকে তার গুণকীর্তন করলেন-হে নির্বিকার নিরঞ্জন, সমস্ত কিছুর মূল সনাতন ব্রহ্মজ্যোতি আপনি আমার নমস্কার গ্রহণ করুন।
বেদ জননী মুচকি হেসে শ্রীকৃষ্ণকে আবার প্রণাম জানিয়ে রত্ন সিংহাসনে উপবিষ্ট হলেন। এবার শ্রীকৃষ্ণ তার মন থেকে এক দিব্য পুরুষের আবির্ভাব ঘটালেন। তপ্ত সোনার ন্যায় বর্ণবিশিষ্ট সেই পুরুষ সমস্ত কামী ব্যক্তির মনকে পাঁচটি বান দিয়ে মথিত করেন, তাই তিনি মন্মথ।
মন্মথের বাঁদিকে এসে দাঁড়ালেন কামদেবের সর্বশ্রেষ্ঠ কামিনী রতি। অত্যন্ত সুন্দরী সেই নারীর ওষ্ঠে স্মিত হাসি। তিনি সকলের অনুরাগ প্রিয়।
ধনুর্ধারী পঞ্চবাণ কামদেব ও কামিনী রতি একত্রে শ্রীহরির পাদবন্দনা করলেন। তারপর তারা একটি সুদৃশ্য আসনে বসলেন। মারণ, স্তম্ভন, শোষণ, জ্বম্ভন, শোষণ ও উন্মাদন, এই পাঁচটি বাণ কামদেব ধারণ করেন। তিনি বাণ নিক্ষেপ করলেন। ভগবানের ইচ্ছায় সকলে কামপীড়িত হলেন। রতি অনুরাগী হয়ে ব্রহ্মার বীর্যপাত হল। মহাযোগী ব্রহ্মা লজ্জা পেলেন। তাড়াতাড়ি কাপড় দিয়ে তা আড়াল করলেন। কিন্তু সেই বীর্য থেকে সৃষ্টি হল আগুন। আগুনের লেলিহান শিখা কাপড় পুড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখী হল। একটি তাল গাছের সমান উঁচু হল সেই শিখা।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন অগ্নির বীভৎস ধ্বংসকারী চেহারা দেখে মুখ থেকে বিন্দুর ন্যায় তেজের প্রকাশ ঘটালেন। সেই তেজ নিশ্বাসের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল জল হয়ে। সেই জলধারায় আগুন নিভে গেল, বিশ্ব প্লাবিত হল। সেই থেকে অগ্নি শিখা সর্বদা জলকণার কাছে মাথা নত করে আছে।
এই জল থেকে এক পুরুষের আবির্ভাব হল। তিনি জলের অধিদেবতা। তিনি হলেন বরুণদেব। তিনি সমস্ত জলজদের অধিপতি।
অগ্নির বাঁদিক থেকে স্বাহা নাম্নী এক সুন্দরী কন্যা উঠে এলেন। মনীষীরা তাকে বহ্নির স্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বরুণের পরম প্রিয়া। তিনি বরুণানী নামে খ্যাত। বিষ্ণুর নিশ্বাস বায়ু থেকে যে পুরুষের আর্বিভাব তিনি হলেন সকলের প্রাণস্বরূপ শ্রীমান পবনদেব। তিনি শ্রীকৃষ্ণের দেহ থেকে উৎপন্ন নিঃশ্বাস থেকে জাত।
বায়ুর বামদিকে থেকে উঠে এলেন এক কন্যা। তাঁকে সকলে বায়ুদেবের পত্নী হিসাবেই জানেন। তিনি বায়ুবী নামে বিখ্যাত।
কামদেবের নিক্ষিপ্ত বানে শ্রীকৃষ্ণের বীর্যপাত হলে তিনি লজ্জা ও সঙ্কোচে তা ছুঁড়ে জলে ফেললেন। হাজার বছর সেই বীর্য জলে ছিল। তা পরিণত হয় ডিমে, তা থেকে এক মহাপুরুষের সৃষ্টি হয়। তিনি সমগ্র বিশ্বের আধার। তার এক একটি লোমকূপে এক একটি বিশ্ব অবস্থান করছে। তিনি পরমাত্মা শ্রীহরির ষোলো ভাগের এক ভাগ। তবুও তাকে মনীষীরা মহাবিষ্ণু নামে জানেন।
মহাপ্রলয় কালে তিনি পদ্মপাতার ন্যায় মহাসাগরে গাত্র ভাসমান রেখেছিলেন। তাঁর কানের ময়লা দুই দৈত্যের জন্ম দেয়, তারা জল থেকে উঠে আসে। ব্রহ্মাকে বধ করার জন্য তেড়ে এলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাদের উরুতে ধারণ করেন এবং হত্যা করেন। তাদের দুজনের মেদ থেকে জন্ম হল এই বসুন্ধরার। যিনি সমগ্র পৃথিবীর দেবী।
মহামুনি শৌনক সৌতির কাছে জানতে চাইলেন গো, গোপ ও গোপীরা কি সত্য না কল্পিত। এর উত্তরে সৌতি বলেছিলেন–সৃষ্টি হবার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত এরা কল্পিত ছিলেন বটে। কিন্তু প্রলয় কাল পর্যন্ত এঁরা বর্তমান থাকেন। সৃষ্টি রহস্য আপনাকে ব্যাখ্যা করছি, শুনুন।
হে দ্বিজ, সর্বপ্রথম সৃষ্টিকালে নারায়ণ ও মহেশ্বর কল্পিত ছিলেন। প্রতিপ্রলয়ের সময় তাদের প্রকাশ ঘটে। প্রকৃতি দেবীর ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। ব্ৰহ্মকল্পের সূর্যি বৃত্তান্তের মধ্যে বারাহকল্প ও পদ্মকল্পের কথা বলছি। কল্প কী, সেটা আগে জেনে নিন। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি–এই চারটি প্রকার যুগের, তিনশো ষাট যুগ হলে হয় এক দিব্য যুগ। দিব্য একযুগও মিলে মন্বন্তর হয়। চৌদ্দ মন্বন্তরকে বলে ব্রহ্মার একদিন।
তিনশো ষাট দিন অতিক্রান্ত হলে তা হয় ব্রহ্মার একবর্ষ। একশো আট বছর ব্রহ্মার আয়ু এবং পরমাত্মা শ্রীহরির একনিমেষ কাল হল ব্রহ্মার পরিপূর্ণ আয়ু, ব্রহ্মার এই আয়ুস্কালকেই কালকল্প বলেছেন। ব্রাহ্ম, বারাহ, এবং পাদ্ম- কল্পের তিনটি প্রকার। সন্বত্ত ইত্যাদি নামে অনেক ছোটো ছোটো কল্পের জন্ম হয়েছে। ব্রহ্মার সাতদিন পর্যন্ত মহামুনি মার্কেণ্ডেয়র আয়ুস্কাল।
ব্ৰহ্মকল্পে সৃষ্টিকর্তা প্রভুর আদেশে মধু ও কৈটভের মেদে মেদিনীর জন্ম হলে তাঁর কাজ শুরু করেন। প্রলয় সাগরে হারিয়ে ও ডুবে যাওয়া মেদিনীকে বরাহরূপে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধার করেন, বরাহকল্পে তাই বর্ণিত হয়েছে। পাদ্মকল্পে সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণুর নাভিপদ্মে অবস্থান করে গোলক। বৈকুণ্ঠলোক, শিবলোক ব্রহ্মলোক ত্রিলোেকাদি সৃষ্টি করতে থাকেন। এই কাল সংখ্যা অনুসারে সৃষ্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
শৌণক প্রশ্ন করলেন, সৃষ্টি করার পর গোলকধামে কী হল তা আমরা শুনতে আগ্রহী। অনুগ্রহ করে আপনি তা বলে আমাদের জ্ঞান পিপাসা মেটান।
সৌতি বললেন– ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকলকে নিয়ে রাসমণ্ডলে অবস্থান করতে লাগলেন। চন্দন, অগুরু, কস্তরী, ও কুমকুম দিয়ে রাসমণ্ডল সুবাসিত করা হয়েছে। খই, দই, সাদা ধান, দুর্বা ও পাতা যুক্ত কলাগাছের স্তম্ভ, যা পাটের সুতো দিয়ে বাধা হয়েছে। উত্তম রত্নসার দিয়ে মণ্ডলগুলি নির্মিত। তিন কোটি রত্ন প্রদীপ জ্বলছে।
জগৎপতি শ্রীকৃষ্ণ সকলকে নিয়ে রাসমণ্ডলে উপস্থিত হলে সকলে বিস্মিত হলেন। এই সময় শ্রীকৃষ্ণ এক সুন্দরী যুবতীর সৃষ্টি করেন। তিনি কৃষ্ণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার চরণে পুস্পার্ঘ্য নিবেদন করলেন। তিনি হলেন কৃষ্ণ প্রাণাধিকা রাধা। রাধা শ্রীকৃষ্ণেরই এক অংশ।
তিনি ষোড়শ বর্ষের এক সদ্য যৌবনা দেবী। অনিন্দ সুন্দর মুখোনি, ঠোঁটে মুচকি হাসি। তার রাঙা ওষ্ঠযুগল দেখে কমলও বুঝি লজ্জা পাবে। তিনি সুন্দরী ও মনোহারিণী, তার চোখ দুটি শরকালের প্রস্ফুটিত পদ্ম। তিনি স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা। কপালে চন্দন, অগুরু, কস্তুরী ও সিন্দুরের ফোঁটা তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
সুবিন্যস্ত খোঁপায় মালতী ফুলের মালা, তাঁর চরণযুগল যেন স্থল পদ্ম। শ্রীরাধা স্মিত হাসলেন। শ্রীকৃষ্ণের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর সুন্দর রত্নসিংহাসনে বসলেন। এই সময় শ্রীরাধার লোমকূপ থেকে ঠিক তার মতো রূপ, বেশভূষা সম্পন্ন প্রায় তিরিশ কোটি গোপীকাদের জন্ম হয়। এরপর এল নানা রঙের গরুড়। যারা শ্রীকৃষ্ণের লোমকূপ থেকেই সৃষ্ট, এরাও স্থির যৌবনপ্রাপ্ত। সঙ্গে সঙ্গে জন্ম হল অসংখ্য বলদ, নানা ধরনের গোবৎস ও কামধেনুর। এরা তমসাবর্ণ যুক্ত ও উত্তম লক্ষণযুক্ত।
এইসব বলদের মধ্যে একটি বলদ শ্রীকৃষ্ণ শিবকে দান করলেন। এই বলদ কোটি সিংহানের সমান শক্তি ধারণ করে। শিব তা বাহন হিসেবে গ্রহণ করলেন। সুন্দর সুন্দর সবৎস রাজহংসী ও রাজহংসের জন্ম দিলেন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নখ থেকে। মহাযোগী ব্রহ্মা একটি প্রভূত শক্তিশালী রাজহংসকে। বাহন হিসেবে লাভ করলেন।
পরমাত্মা কৃষ্ণ তাঁর বাঁ কান থেকে অশ্বদের জন্ম দিলেন। তাদের থেকে খুব সাদা বর্ণের একটি অশ্ব ধর্মকে দিলেন, যা বাহন হিসেবে ধর্ম গ্রহণ করলেন। শ্রীকৃষ্ণের দক্ষিণ কান থেকে বেরিয়ে এল অসংখ্য শক্তিশালী সিংহের দল। তাদের মধ্যে থেকে মহাপরাক্রমশালী এক সিংহ পরম সমাদরে প্রকৃতি দেবীর হাতে তুলে দিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ যোগবলে পাঁচটি মনোহর রথ সৃষ্টি করলেন। এগুলি ছিল বিশুদ্ধ রত্নে তৈরি। রথগুলিতে ছিল এক লক্ষ চাকা ও এক লক্ষ খেলাঘর, রথগুলি বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারত। প্রত্যেকটি রথ বিভিন্ন ভোগ্য সামগ্রীতে পরিপূর্ণ। এই শ্রেষ্ঠ রথ পাঁচটির তিনটি নিজে রেখে বাকি দুটির একটি নারায়ণ ও একটি শ্রীরাধিকে দান করলেন।
শ্রীকৃষ্ণ তাঁর গুহ্যদেশ থেকে পিঙ্গলবর্ণের পুরুষের সৃষ্টি করলেন। এঁরা গুহ্যক নামে অভিহিত। গুহ্যকদের প্রধান হলেন কুবের। তিনি ধনেশ্বর নামে খ্যাত। কুবেরের পত্নী স্বামীর বাঁদিক থেকে উঠে এলেন, এই সময় কুবেরের গুহ্য দেশ থেকে বেতাল, ভূত, প্রেত, পিশাচ প্রভৃতির জন্ম হল।
শ্রীকৃষ্ণ তার মুখ থেকে সহচরদের জন্ম দিলেন। যাদের পরণে পীতবস্ত্র, তাদের চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, কিরীট ও কুলাধারী। বহু অলংকারে তারা সুসজ্জিত। এইসব চার হাতবিশিষ্ট সহচরদের কৃষ্ণ নারয়ণের হাতে তুলে দিলেন। কুবের পেলেন গুহ্যকদের দায়িত্ব এবং ভূত প্রেত অর্পিত হল মহাদেবের হাতে। শ্রীকৃষ্ণের চরণ যুগল থেকে সৃষ্টি হল যমের দাস সকল। শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মই তাদের মন, তারা কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা।
শ্রীকৃষ্ণের দক্ষিণ নেত্র থেকে ত্রিশূল আর পট্টিশধারী মহাভয়ংকর ত্রিলোচন চন্দ্রশেখর ভৈরবদের সৃষ্টি হল। বিরাট দেহধারী এইসব ভৈরবরা জ্বলন্ত, এরা শিবতুল্য। রুরু, সংহার, কাল, অসিত, ক্রোধ, ভীষণ, মহাভৈরব ও খট্টাঙ্গ–এই আট ভৈরব।
শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বামচোখ থেকে ঈশানের জন্ম দিলেন। তিনি ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত, তিনি ত্রিশুল, পট্টিশ, গদাধারী বিশালকার দিগম্বর। তিনি হলেন দিগপালদের রাজা। ডাকিনী, যোগিনী ও সহস্র সহস্র ক্ষেত্রপাল জন্ম নিল শ্রীকৃষ্ণের নাসারন্ত্রের মধ্য ভাগ থেকে। পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের পৃষ্ঠদেশ থেকে সহসা আবির্ভূত হলেন তিন কোটি দিব্য মূর্তির শ্রেষ্ঠ দেবতার দল।
সৌত বললেন–এরপর নারায়ণ শ্ৰেষ্ঠরত্নখচিত মণিমালা ভূষিত লক্ষ্মী ও সরস্বতাঁকে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে গ্রহণ করলেন। এভাবে ব্রহ্মা পেলেন সাবিত্রীকে। ধর্ম পেলেন মুত্তিকে। কামদেব পেলেন রতিকে এবং কুবের পেলেন মনোরমাকে। অন্য সব দেবতা ও পুরুষরা যে সমস্ত দেবী ও কন্যাদের সৃষ্টি করেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ তাদের সেইসব পুরুষ ও দেবতার হাতে সমর্পন করলেন।
সিংহবাহিনী দুর্গাকে রুদ্রের উদ্দেশ্যে সমর্পণ করতে চাইলে তিনি সম্মত হলেন না। জটাজুটধারী শিব বললেন– এই প্রকৃতি কামাতুরা, কামনা বাসনাকে তাড়িত করে, এই প্রকৃতি তত্ত্ব জ্ঞানকে আড়াল করে যোগদ্ধারের দরজা বন্ধ করে, মুক্তির ইচ্ছাকে প্রশমিত করে, সবুদ্ধির বিনাশ ঘটিয়ে সুবুদ্ধির জন্ম দেয়।
বিষয়বস্তুর প্রতি মোহ সৃষ্টি করে, হে নাথ, আমি প্রকৃতির স্বামী হতে চাই না। আপনি আমাকে ইচ্ছেমতো বরদান করুন। আমি পঞ্চমুখে আপনার মঙ্গলময় নাম ও গুণকীর্তন যেন স্বপ্নে জাগরণে সর্বদা গান করতে পারি ঘুরে ঘুরে। আমি আপনার রূপের ধ্যানে মগ্ন থাকতে চাই কল্পকাল ধরে। ভোগের প্রতি আমার যেন অনীহা জন্মায়।
হে শ্রেষ্ঠ বরদানকারী পরম পুরুষ আমি আপনার কাছে বর প্রার্থনা করছি। আপনার নাম, গুণের স্মরণ, কীর্তন ও শ্রবণ, আপনার সুন্দর রূপের ধ্যান, আপনার চরণ যুগলের বন্দনা, আত্মসমর্পণ, নিত্য ধনবেদ্য ভোজন–এই নয় রকম ভক্তিলক্ষণরূপ বর অভিলাষী। মুক্ত মহাপুরুষরা যে ছয়টি মুক্তির কথা বলেছেন, শ্রেষ্ঠী সালোক্য, সারূপ্য, সামীপ্য, সাম্য ও লীনতা, আপনি আমাকে সেই ছয়। মুক্তি দান করুন।
শ্ৰেষ্ঠী হল পরমেশ্বর তুল্য ষড়েশ্বর্য যুক্ত হওয়া। সালেক্য হল গোলকবাসী হওয়া। পরমেশ্বর তুল্য রূপ লাভ করা যায় সারাপ্য মাধ্যমে সামীপ্য পরমেশ্বর কাছাকাছি আনয়ণ করে, পরমেশ্বরের মমতা লাভ হয় সাম্যমুক্তিতে এবং পরমেশ্বরে বিলীন হল লীনতা।
আঠারো প্রকার সিদ্ধির কথা বলা হয়েছে দ্রুত বা হালকা হওয়া, ক্ষুদ্র হওয়া, কোনো কিছু লাভ করা, কামনা পূরণের সামর্থ্য, ঈশ্বরকে লাভ করা, বশীকরণ, সমস্ত রকম কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হবার ক্ষমতা, সর্বজ্ঞানী হওয়া, দুর থেকে শোনা, দুর থেকে বলা, পরদেহে প্রবেশ করা,
বাকসিদ্ধি, কল্পতরু হওয়া, সৃষ্টি ও নাশ করার ক্ষমতা লাভ, অমরত্ব ও সর্বশ্রেষ্ঠত্ব। যোগ, তপস্যা, দানধ্যান, ব্রত, যশ, কীর্তি, পূজার্চনা, দেবতা দর্শন, পৃথিবী প্রদক্ষিণ, স্বর্গলোক দর্শন ব্রহ্মলোক দর্শন, রুদ্রত্ব লাভ, বিষ্ণুত্ব পরমপদ- এ ছাড়াও আরও যেসব আকাঙ্খিত বস্তু আছে যা মুখে ব্যক্ত করা যায় না। হে হে সর্বেশ্বর, তা আমি আপনার কাছে ব্যক্ত করছি, সেইসবই আপনার ষোলো কলার ভক্তির এক কণাও হতে পারে না।
রুদ্রদেবের কথা শুনে ভগবান শ্রীহরি হেসে উঠলেন। তাঁকে বরদান করে বললেন– হে সর্বেশ্বর মহাদেব, শতকোটি কল্পকাল পর্যন্ত তুমি আমার পদসেবা করতে পারবে, তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী মহাপুরুষ হও, বেদজ্ঞান ও সর্বজ্ঞত্ব লাভ করো, যশ ও তেজে তুমি আমার সমান হও। তুমি আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত, আমার প্রাণাধিক প্রিয়। তুমি আত্মস্বরূপ, হে দেবাদিবের মহাদেব শত কোটি কল্প অন্তে তুমি প্রকৃতিকে তোমার ঘরণী রূপে গ্রহণ করবে।
দিব্য সহস্র বছর ধরে তোমরা দুজনে শৃঙ্গার সুখ উপভোগ করবে। আমি যেমন এক ঈশ্বর তুমিও তাই। তুমি যেমন সংসারী হতে পারো, তেমন হতে পারো যোগী পুরুষ। আবার কখনও হও স্বেচ্ছাধীন প্রভু। যেসব রমণী কু-স্ত্রী হয় তারা স্বামীকে দুঃখসাগরে ভাসায়, কিন্তু কুলজা ঘরণী স্বামীকে পুত্রস্নেহে পালন করে। কারণ কুলস্ত্রীর কাছে পতি হল সব। সে সৎ অথবা অসৎ, কৃপণ অথবা ধনী যাই হোক না কেন?
অসৎ বংশে যে কন্যার জন্ম, সে হয় পরভোগা, স্বামীর নিন্দাতে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। যে সতী স্ত্রী আমাকে এবং তোমার থেকেও পতি প্রাণাধিক হয় সে নারী স্বামীর সঙ্গে গোলোকে কোটি কল্পকাল সুখ ভোগ করে। তুমি শিব, প্রকৃতি হবে শিবা। নিজের মঙ্গলের জন্য তুমি ওই সাধ্বী স্ত্রীকে গ্রহণ করবে।
প্রকৃতির যোনি সংযুক্ত তোমার লিঙ্গ তীর্থক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সংযত ও জিতেন্দ্রিয় হয়ে পবিত্রভাবে পঞ্চ উপচারে দক্ষিণার সঙ্গে হাজারবার ভক্তি ভাবে পুজো করে সে গোলকে কোটি কল্প কাল ধরে আমার সঙ্গে বাস করে।
যে জন তীর্থক্ষেত্রে শিবলিঙ্গকে লক্ষবার পুজো করে উত্তম দক্ষিণা প্রদান করে, সে গোলকে বাস করে নিশ্চল ভাবে। গোবর, মাটি, ছাই বা তীর্থের বালি দিয়ে শিবলিঙ্গ গড়ে পুজো করলে অযুত কল্পকাল স্বর্গ বাস হয়। শিবলিঙ্গের পুজো যে জায়গায় করা হয়, সেই স্থান তীর্থের সমান। মৃত্যুপথযাত্রী শিব নাম উচ্চারণ করে স্মরণ করলে সে কোটি জন্মের পাপ থেকে উদ্ধার পায়।
শিব হল কল্যাণ ও মুক্তির অন্য নাম। পাপহরণকারী ‘শি’ এবং মুক্তি দানকারী ‘ব’ মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে শিব। শিব’ নাম উচ্চারণ করে কথা বললে কোটি জন্মের পাপ নাশ হয়। পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ এবার শিবকে কল্পবৃক্ষ স্বরূপ মন্ত্র প্রদান করলেন। তারপর তিনি প্রকৃতি দুর্গাদেবীর উদ্দেশে বললেন– হে সুমুখি! তুমি গোলোকে আমার কাছে অবস্থান কর।
মঙ্গলময় শিবের ভজনা করো। তোমাকে সমস্ত দেবতারা তেজপূর্ণ অস্ত্র প্রদান করবে। তুমি হবে অসুরমর্দিনীও সংহার রূপিণী। সকলে তোমাকে পুজো করবে। সত্যযুগে তুমি দক্ষের ঘরে জন্মলাভ করবে। সুশীলা সতী হয়ে শিবের ঘরণি হবে। দক্ষযজ্ঞে পতি নিন্দা সহ্য করতে না পেরে নিজের দেহ বিসর্জন দেবে।
এবার তোমার জন্ম হবে পার্বতী নামে হিমালয়ের ঘরে মেনকার গর্ভে। তখন শম্ভুর সঙ্গে দিব্য সহস্র : বৎসর ধরে বিহার করবে। এই সমস্ত কাল অতিক্রান্ত হলে তোমরা আবার মিলিত হবে। পৃথিবীবাসী প্রতি বছর তোমার শ্রীচরণে অর্ঘ্য প্রদান করবে। শারদীয়া মহাপূজা ধুমধামের সঙ্গে পালন করবে। গ্রাম্যদেবী হিসেবে তোমার আরাধনা করবে।
শিবের নানারকম শাস্ত্রে তোমার স্তোত্র যুক্ত করে পুজোর নিয়মবিধি লিখিত হবে। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ– এই চারবর্গের ফলভোগী হয়ে তোমার পরিচারকরা সিদ্ধ মহাপুরুষত্ব লাভ করবে। হে মা, পুণ্যক্ষেত্র ভারতভূমিতে যে তোমার পুজো করে সে যশ, কীর্তি, ধর্ম ও ঐশ্বর্য লাভ করে। সৌতি বলতে থাকেন হে ব্রাহ্মণ, একথা বলে শ্রীকৃষ্ণ কামবীজমুক্ত অত্যুতম এগারো অক্ষর যুক্ত মন্ত্র দুর্গাকে দান করলেন। তাঁর আজ্ঞায় বিধি অনুসারে ধ্যান মন্ত্র রচিত হল। সর্বব্যাপী শ্রীকৃষ্ণ সৃষ্টির উপযোগী শক্তি ও কামপ্রদানকারী সর্বসিদ্ধি এবং তার থেকেও বিশিষ্ট যে তত্ত্বজ্ঞান তা তাকে দান করলেন।
কবচ ও স্তোত্র যুক্ত তেরো অক্ষর বিশিষ্ট মন্ত্র শঙ্করকে দান করেন। এবার জগৎপতি শ্রীকৃষ্ণ কামদেব, বহ্নি, কুবের ও বায়ুকে একে একে উপদেশ দান করলেন। তাদের শ্রেষ্ঠ মন্ত্রাদিতে অভিষিক্ত করলেন। তারপর তিনি ব্রহ্মাকে উদ্দেশ করে বর প্রদান করলেন দিব্য হাজার বছর ধরে শ্রীকৃষ্ণের তপস্যা করে তিনি নানাবিধ শ্রেষ্ঠ জিনিস সৃষ্টি করুন। একটি সুন্দর মালা শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মাকে উপহার দিলেন। তারপর তিনি গোপ ও গোপিনীদের সঙ্গে নিয়ে ফিরে গেলেন বৃন্দাবনের দিকে।
সৌতি বললেন– শ্রীকৃষ্ণের বর লাভ করে ব্রহ্মা তপস্যায় সিদ্ধ হলেন। প্রথমে সৃষ্টি করলেন পৃথিবীকে। মধু ও কৈটভের মেদ থেকে যার উৎপত্তি। তারপর সৃষ্টি হল বহু পর্বতশ্রেণী। যেমন সুমেরু, কৈলাশ, মলয়, হিমালয়, উদয়, অস্ত, সুবেল এবং গন্ধমাদন। সৃষ্টি হল অসংখ্য সাগর, নদী, গাছপালা, গ্রাম, নগর আরও কত কী। প্রধান সাতটি সমুদ্রের মধ্যে আছে লবঙ্গ, ইক্ষু, সুরা, ঘৃত, দধি বা দুধ এবং জল। ব্রহ্মার সৃষ্টি পদ্মাকার। সাতটি দ্বীপ, সাতটি উপদ্বীপ ও সাতটি সীমান্ত পর্বত স্থান পেল এই পৃথিবীর বুকে।
হে দ্বিজ, জম্বু, শাক, কুশ, প্ল, ক্রৌঞ্জ, ন্যগ্রোধ অর্থাৎ বট এবং পুস্কর এই সপ্তদ্বীপ ব্রহ্মা আগে সৃষ্টি করেছিলেন। আটটি পুরী নির্মিত হল মেরু পর্বতের আটটি চূড়ায়। যেখানে আট দিকপাল ঘুরে বেড়াবেন। মেরু পর্বতের নীচে একটি পুরী নির্মাণ করা হল অনন্তের জন্য। সেই পুরীর উপরে শোভা পেল আরও সাতটি স্বর্গলোক। এই সাতলোকের মধ্যে আছে ভূর্লোক, ভূবলোক, অত্যন্ত সুন্দর স্বলোক, মহলোক, জনলোক, তপোলোক এবং সত্যলোক।
হে শৌনক, যেখানে চির যৌবন বিরাজিত সেই ব্রহ্মালোক স্থাপিত হল সুমেরু পর্বতের শৃঙ্গদেশে, তারও ওপরে সৃষ্টি হল অত্যন্ত সুন্দর ধ্রুব লোকের। অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, পাতাল, রসাতল–এই সাতটি তলের সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মা। সব থেকে ওপরের তল অতল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পাতাল। সাতটি পর্বত, সাতটি দ্বীপ এবং সাতটি পাতাল নিয়ে ব্রহ্মাণ্ড গড়ে উঠল। যার অধিপতি ব্রহ্মা স্বয়ং।
হে বিপ্র মহাবিষ্ণুর লোমকূপ থেকে এক একটি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর দেবতা ও মানুষ সকলেই শ্রীকৃষ্ণের মায়ায় আচ্ছন্ন। দিকপালগণ ব্রহ্মাণ্ড সমূহের সংখ্যা গণনায় অপরাগ ঈশ্বর বিশ্ব আকাশ ও দিক সমূহের সর্বত্র সংখ্যা গণনাতে সক্ষম হলেও ব্রহ্মাণ্ডের নির্ভুল সংখ্যা বলা অসম্ভব। এই বিশ্বের যা কিছু সবই কৃত্রিম, অনিত্য। এই বিশ্ববহির্ভূত আত্মা, আকাশ ও দিক বৈকুণ্ঠলোক, শিবলোক ও অন্যান্য গোলোকের মতোই নিত্য।
সুতপুত্র বললেন– বিশ্ব সৃষ্টির কাজ শেষ করে ব্রহ্মা পরম শ্রেষ্ঠ স্ত্রী সাবিত্রী দেবীর গর্ভে বীর্যপাত ঘটালেন, দিব্য একশো বছর ধরে সাবিত্রী দুঃসহ প্রসব বেদনা সহ্য করেন। তারপর তার গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয় তর্ক, ব্যাকরণ প্রভৃতি অন্যান্য শাস্ত্রসমূহ, ছত্রিশ রকমের দিব্য মনোরম রাগিণী, নানা ধরনের তালযুক্ত অত্যন্ত সুন্দর ছয় প্রকারের রাগ। তিনি সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলির জন্ম দিলেন। প্রসব করলেন বৎসর, মাস, ঋতু, তিথি, ক্ষণ, দিনরাত্রি, সকাল, সন্ধ্যা, পুষ্টি, দেবসেনা, মেধা, বিজয়া, জয়া, ষষ্টমৃত্তিকা। বিভিন্ন রকমের যোগ আর কারণগুলি।
হে মহাযোগী! দেবী সাবিত্রী সমস্ত মাতৃকাগণের শ্রেষ্ঠ বালাদেরও আরাধ্য দেবী। ব্রহ্ম, বারাহ ও কল্প– এই তিন পাদ্ম, নিত্য নৈমত্তিক দ্বিপাদ্ম ও প্রাকৃত চার ধরনের প্রলয় এবং সমস্ত রকম ব্যাধিকে তিনি প্রসব করলেন। ধাতার পৃষ্ঠভাগ থেকে অধর্মের উৎপত্তি স্থল। তার বামদিক থেকে উঠে এলেন কামিনী অলক্ষ্মী। শিল্পী গুরু বিশ্বকর্মা তার নাভিদেশ থেকে জন্ম নিলেন। মহাবলশালী ও পরাক্রমশালী অষ্টবসুর জন্ম হল। চারজন কুমারের উৎপত্তি হল ধাতা ব্রহ্মার মন থেকে। এরা প্রত্যেকে পাঁচ বছরের বালক, ব্রহ্মতেজে পরিপূর্ণ।
ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্ম হল স্বায়ম্ভর মনুর যাঁর সুন্দরী রূপবতী ভার্য্যা শতরূপা নামে খ্যাতা এবং শ্রীলক্ষ্মীর অংশ স্বরূপা। ব্রহ্মার আজ্ঞায় স্বংস্তু মনু স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করতে লাগলেন। ব্রহ্মা তাঁদের চারপুত্র সৃষ্টি করার কথা বললেন। কিন্তু তাঁরা অসম্মতি জানালে কৃষ্ণ ধ্যানমগ্ন হলেন। জগৎপতি ব্রহ্মা ক্রোধান্বিত হয়ে ললাট দেশ থেকে ব্রহ্মতেজ নির্গত করলেন যা থেকে এগারো জন রুদ্রের উৎপত্তি হল। সংহারকারী কালাগ্নিরুদ্র ছিলেন একজন। যিনি বিশ্ববাসীর কাছে তামস নামে খ্যাত। এ ছাড়া আছেন মহান, মহাত্মা, মতিমান, ভীষণ, ভয়ংকর, ঋতধ্বজ, উৰ্দ্ধকেশ, পিঙ্গলায়, রুচি এবং শুচি।
হে শৌনক। ব্রহ্মার দক্ষিণ কান থেকে পুলস্ত্য, বাম কান থেকে পুলহ, ডান ও বাম চোখ থেকে যথাক্রমে অত্রি ও ক্রতু, নাকের ছিদ্র থেকে অরণি, মুখ থেকে অঙ্গিরা, বাঁদিক থেকে রুচি ও ভৃগু এবং দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে রুদ্রের আর্বিভাব ঘটে। কর্ম সৃষ্টি করেছে ছায়াকে, পঞ্চশিখ এসেছে নাভি থেকে, বোঢ় এসেছে বুকের থেকে, কণ্ঠ দিয়েছে নারদকে। রহ্মার কাধ থেকে মরীচি, জিহ্বা থেকে অপান্তরতমা এবং অধর থেকে প্রচেতার সৃষ্টি হয়েছে। ব্রহ্মার বাঁদিকের উদর থেকে হংস এবং ডান দিকের উদর থেকে স্বয়ং যতির আবির্ভাব ঘটে। এইসব পুত্রদের তিনি সৃষ্টি করার কথা বললেন।
নারদ বললেন– হে পিতামহ ব্রহ্মা, আমাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের সনকাদিকের নিয়ে আসতে আজ্ঞা করুন। তাদের স্ত্রীযুক্ত করুন। তাদের আপনি তপস্যামগ্ন হতে আজ্ঞা করেছেন তাহলে আমরা গৃহী হই কী করে। সর্বশক্তিমানের বুদ্ধি ও মাঝেমধ্যে বিপরীতগামী হয়। হে পিতা, অমৃতের থেকেও বেশি প্রিয় শ্রীকৃষ্ণের সেবা। তা ত্যাগ করে কোন সুখ বিষয়সমূহের বিষ পান করা যা তুচ্ছ, যা অসত্য। তা মানুষের বিনাশ ঘটায়। বিজয়ী ব্যক্তিদের বিষয়ই হয় মৃত্যুর কারণ।
নারদ এবার থামলেন। তিনি তখন জ্বলন্ত আগুন শিখার ন্যায় ক্রোধে জ্বলছেন। পুত্রের এ আচরণে পিতা অত্যন্ত কুপিত হলেন। রাগে তার সমস্ত শরীর কম্পমান। তিনি বললেন–ওহে নারদ! তোমার দুঃসাহস দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। তোমাকে আমি অভিশাপ দিচ্ছি, তুমি সমস্ত তত্ত্বজ্ঞান ভুলে যাবে, তুমি হবে এক স্ত্রীলুব্ধ লম্পট যেন এক ক্রীড়ামৃগ।
পঞ্চাশজন স্থির যৌবনা রূপবতী রমণী তোমাকে সর্বদা সঙ্গ দান করবে। তুমি হবে তাদের প্রাণপ্রিয় ভর্তা। বিভিন্ন রকম শৃঙ্গারে নিপুণ ব্যক্তিদেরও মহাগুরু হবে, তুমি হবে শ্রেষ্ঠ বীণাবাদক, স্থির যৌবন, মধুর ভাষী, শান্ত, সুন্দর সুশীল। তুমি তখন উপবহণ নাম ধারণ করবে, দিব্য লক্ষ যুগ এইভাবে অতিবাহিত করবে। তারপর দাসীপুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবে। কামিনী সঙ্গ লাভে সুখী হবে।
হে পুত্র! বৈষ্ণবদের সঙ্গে কাল অতিবাহিত করবে। তাদের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করবে। তুমি কৃষ্ণের কৃপা লাভ করবে। তখন তুমি হবে আমার পুত্র। তোমাকে আমি হারানো দিব্য জ্ঞান ফিরিয়ে দেব।
সৌত বলতে থাকলেন–জগৎ গুরু ব্রহ্মা এই বলে চুপ করলেন। তখন নারদ অশ্রুপাতে বুক ভাসালেন। পিতার কাছে মিনতি করে বললেন– হে সংহারকারী পিতা, আপনি রাগ দমন করুন। আপনি সৃষ্টিকর্তা, আপনার এই রকম ক্রোধ করা কি সাজে? হে পিতা, আপনি আশীর্বাদ করুন যত নীচ যোনিতে আমার জন্ম হোক না কেন হরির প্রতি আমার ভক্তি যেন অটুট থাকে।
পাপীদের দেওয়া পাপের স্থলনের জন্য নিজেদের পবিত্রতার জন্য তীর্থক্ষেত্রগুলিও বৈষ্ণবদের স্পর্শ অভিলাষী হয়। এই ভাবে গুরুদেবের কাছ থেকে মন্ত্রোপদেশ পাওয়া মাত্রই মানুষ তার পূর্বতম কোটি পুরুষের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। মন্ত্র লাভের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কোটি জন্মের পাপ থেকে উদ্ধার পায়। যে গুরু শিষ্যের বিশ্বাসের অমর্যাদা করে অসৎ পথ প্রদর্শন করে, চন্দ্র সূর্য যতদিন থাকবে ততদিন সেই গুরু কুম্ভীপাক নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। শ্রীকৃষ্ণের পাদকমল যিনি বন্দনা করতে জানেন না তাকে গুরু বলি কী ভাবে, তিনি পিতা হতে পারেন না। পারেন না উত্তম স্বামী বা পুত্র হতে।
হে চতুরানন, আমি জানি আমি নির্দোষ। তবু আপনি আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন। শাস্ত্রজ্ঞরা বলে থাকেন হত্যাকারীর হত্যা করা উচিত। তাই আপনাকে আমি অভিশাপ দিচ্ছি আপনি সমস্ত কবচ, স্তোত্র, পুজোর মন্ত্র সব বিস্মৃত হবেন। সমগ্র বিশ্ব আপনাকে পুজো দিতে ভুলে যাবে। তিন কল্পকাল অপূজ্য হিসেবে কাটাবেন। তারপর পূজ্য ব্যক্তিদেরও পুজো পাবেন। তবে দেবীগণ সকলেই আপনার বন্দনা করবেন।
নারদ এবার চুপ করলেন। ব্রহ্মা তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হলেন। তারপর পিতার অভিশাপে নারদ উপবর্হন নামে গন্ধর্ব হলেন এবং দাসী পুত্র হন। পরে দিব্যজ্ঞান লাভ করে মহর্ষি নারদে পরিণত হন।
সূত্র পুত্র বললেন– এরপর ব্রহ্মার আদেশে অন্যান্য ছেলেরা সৃষ্টি কার্যে রত হলেন। মরীচি তার মন থেকে জন্ম দিলেন প্রজাপতি কশ্যপের, চন্দ্র আর্বিভূত হলেন ক্ষীরোদ সাগরে অত্রির নেত্রফল থেকে। এইভাবে প্রচেতার মন থেকে গৌতম এবং পুলস্ত্যের মন থেকে মৈত্রাবরুণ জন্মগ্রহণ করলেন। আকুতি, দেবদুতি ও প্রসূতি নামে তিন কন্যার জন্ম দিলেন মনুপত্নী শতরূপা। প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামে মনুর দুই পুত্র।
উত্তানপাদের পুত্রের নাম ধ্রুব। রুচি এবং দক্ষ যথাক্রমে আকুতি ও প্রসূতিকে গ্রহণ করেন। কর্ম গ্রহণ করেন দেবদুতিকে। তাদের গর্ভে ভগবান কপিলের জন্ম হয়। দক্ষ প্রজাপতির বীর্যে এবং প্রসূতির গর্ভে ষাটজন কন্যার জন্ম হল। তাদের মধ্যে আটজন ধর্মকে, এগারোজন রুদ্রকে, তেরোজন কশ্যপকে এবং সাতাশ জন কন্যা চন্দ্রকে দান করলেন। সতী নামে এক কন্যার পাণি গ্রহণ করলেন শিব।
হে ব্রাহ্মণ শ্ৰেষ্ঠ! শান্তি, পুষ্টি, ধৃতি, তুষ্ট, ক্ষমা, শ্রদ্ধা, মতি ও স্মৃতি– এই আট ধর্মপত্নীর গর্ভে মায়া জন্ম নিয়েছিলেন। তারা হলেন যথাক্রমে শান্তির সন্তোষ, পুষ্টির মহান, ধুতির ধৈর্য, তুষ্টির হর্ষ ও দর্প। ক্ষমার সহিষ্ণু, শ্রদ্ধার ধার্মিক, মতির জ্ঞান এবং স্মৃতির পুত্র জাতিস্মর। পূর্বপত্নী যুক্তির গর্ভে দুই ঋষির জন্ম হয়–নর ও নারায়ণ।
হে ব্রাহ্মণ! এবার বলি রুদ্রপত্নীর নাম, তারা হলেন কলা, কলাবতী, কাষ্ঠা, কালিকা, কলহপ্রিয়া, কালী, ভীষণা, প্রশ্লোচা ও শূকী, তাঁরা অনেক পুত্রের জন্ম দিয়েছেন এবং শিবের অনুগামী হন।
শিবপত্নী সতী স্বামীনিন্দা শুনে দক্ষযজ্ঞ স্থলেই দেহত্যাগ করেন এবং পরে হিমালয়ের কন্যা রূপে জন্মলাভ করেন। শংকরকে পতিরূপে গ্রহণ করেন।
কাশ্যপের স্ত্রীদের মধ্যে আছেন অদিতি, দিতি, রুদ্রু, বিনতা, সুরভি, সরমা ও দনু। অদিতি হলেন দেবমাতা, দৈত্যদের জন্ম দিয়েছিলেন দিতি, সাপদের মা হলেন কদ্রু। পাখীদের প্রসব করেন বিনতা। গোরু ও মহিষদের মাতা সুরভি। সারমেয় প্রভৃতি জন্তুদের মায়ের নাম সরমা। দানবদের মাতা হিসেবে দনু পরিচিতা।
হে ধার্মিক শ্রেষ্ঠ। ইন্দ্র, বারোজন আদিত্য ও উপেন্দ্র প্রভৃতি নামে পরাক্রমশালী ও শক্তিশালী দেবতারা অদিতির পুত্র নামে খ্যাত। ইন্দ্র ও শচীর পুত্রের নাম জয়ন্ত। বিশ্বকর্মার কন্যা সবর্ণার স্বামী সূর্য। তাদের দুই পুত্র শনৈশ্চর ও যম এবং কন্যা কালিন্দী। উপেন্দ্র ও পৃথ্বীর সন্তান মঙ্গল।
শৌনক জানতে চাইলেন- হে সৌতে! মঙ্গলের জন্ম রহস্য শ্রবণ করতে আমরা আগ্রহী, আপনি অনুগ্রহ করে সেই বৃত্তান্ত বলুন।
সুত পুত্র সৌতে এই প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন– বসুন্ধরা ছিলেন কামিনী, নব যৌবনে চলাচলে তাঁর অনুবাহার। তিনি চন্দন গাছের নতুন পাতায় ভরা মলয় পর্বতের নির্জন স্থানে চন্দনে সুবাসিত হয়ে বিচরণ করেছিলেন। তিনি স্মিত হাস্যে শ্রীনারায়ণের শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হন। সুন্দর মালতী মালা ও সুগন্ধ মুক্ত চন্দন তাকে দান করেন। পৃথ্বীর রূপ যৌবনে আকৃষ্ট হয়ে ভগবান উপেন্দ্র তার সঙ্গে নানারকম শৃঙ্গারে মেতে উঠেন। পৃথ্বীর গর্ভে উপেন্দ্র বীর্যপাত ঘটালেন। বসুন্ধরা মুছিত হয়ে পড়ে গেলেন।
সুখসম্ভোগে বেহুঁশ হাস্যমুখী বিপুল স্তনভার যুক্ত পৃথ্বীকে কিছুক্ষণ বুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ রেখে যাচ্ছিলেন। পৃথিবী দেবীকে জাগিয়ে তুলে এভাবে পড়ে থাকার কারণ জানতে চাইলেন। পৃথিবী সব কথা বললেন। নারায়ণ বীর্য ধারণ করতে দেবী অসমর্থ হওয়ার প্রবালের খনির মধ্যে তা নিক্ষিপ্ত হল। সেই বীর্য জন্ম দিল, প্রধান বর্ণের এক পুত্রের যে সূর্যের সমান তেজীয়ান। নারায়ণপুত্র মঙ্গল ও মেধার পুত্রের নাম ঘটেশ্বর। যিনি বিষ্ণুতুল্য তেজস্বী ও বরদাতা রূপে বিদিত।
হে যোগী শ্রেষ্ঠ! দিতির পুত্র এবং কন্যা যথাক্রমে হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ এবং সিংহকি। সিংহিকার গর্ভজাত পুত্র সিংহিকেয় রাহু। সিংহিকার অপর নাম নিঋতি। তাই রাহু নৈঋতি নামে চিহ্নিত। হিরণ্যা তখন যুবক, বিষ্ণু শূকরের রূপ ধরে তাকে হত্যা করেন। হিরণ্যকশিপুর পুত্রের নাম প্রহ্লাদ। তিনি পরম বৈষ্ণব। তার পুত্র বিরোচন এবং বিরোচনের পুত্র হলেন বলি। বলির পুত্র বান।
হে শৌণক, এবার শুনুন কদ্রুর সাপ সন্তানদের কথা। অনন্ত, বাসুকি, কালীয়া, ধনঞ্জয়, কর্কেটক তক্ষক, পদ্ম, ঐরাবত, মহাপদ্ম, শঙ্কু, শঙ্খ, সংবরণ, ধৃতরাষ্ট্র, দুর্ধর্ষ, দুর্মুখ, বল, গোক্ষ্য, বিরুপ ও গোকাসুক-এরা সবাই কমায়ের সন্তান কন্যা হলেন ইনি মহা তেজস্বিনী, লক্ষ্মীর অংশ লাভ করেছেন। জরকারু মুনির পত্নী হলেন মনসা, যিনি নারায়ণের অংশজাত। আস্তিক হলেন। মনসাদেবীর গর্ভজাত পুত্র। সুরূপা, বিনতার বংশের প্রথম দুই সন্তান গরুড় ও অরুণ। ধীরে ধীরে সমস্ত পক্ষীজাত এঁরা সৃষ্টি করেছেন।
চন্দ্রের পত্নীরা হলেন অশ্বিনী, ভরণী, কৃতিকা, রোহিণী, মৃগশির্ষা, আদ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মখা, পূর্বফাল্গুনী, উত্তরফাল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যোষ্ঠা, মূলা, পূর্বষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্বভাদ্রপদী, উত্তরভাদ্রপদী ও রেবতী–এই সাতাশ জন চন্দ্রের পত্নীদের মধ্যে প্রধান রোহিণী। তিনি রাসিকাপ্রিয়া।
তাই চন্দ্র সর্বদা এই পত্নীর প্রতি আসক্ত ছিলেন। অন্যান্য পত্নীরা স্বামীর সান্নিধ্য লাভের আশায় আক্রান্ত হলেন। রোগগ্রস্ত ক্ষয়প্রাপ্ত শরীর নিয়ে চন্দ্র ভগবান শঙ্করের কাছে আর্জি জানালেন। শিব চন্দ্রকে রোগমুক্ত করে নিজের শিরে স্থান দিলেন। সেই থেকে চন্দ্র হলেন অমর এবং নির্ভয়। চন্দ্রকে শেখরে স্থান দেওয়ায় শিবের আর এক নাম চন্দ্রশেখর।
চন্দ্ৰপত্নীগণ স্বামীকে রোগ মুক্ত দেখে কাঁদতে লাগলেন। তারা ছুটে এলেন পিতা দক্ষের কাছে। বললেন– হে পিতা, স্বামী সৌভাগ্য লাভের আশায় আপনার সাহায্যের প্রার্থনা করেছিলাম। অথচ আপনি আমাদের দুঃখ দিলেন। আমরা চোখ থাকতেও অন্ধ। স্বামী থাকলেও স্বামী সঙ্গসুখ ভোগ থেকে বঞ্ছিত হলাম। হে পিতা, এখন আমরা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পারছি। স্ত্রীদের কাছে স্বামী গতি, প্রাণ ও সম্পদ।
পতির মাধ্যমেই এই সংসার ধর্ম, কাম, অর্থ ও মোক্ষ লাভ হয়। নারায়ণ ব্রত ও সনাতন ধর্ম স্ত্রীদের পতি। পতির পদসেবন যে রমণী করে তাকে আর তীর্থে তীর্থে ঘুরে পুণ্য সঞ্চয় করতে হয় না। সমস্ত আত্মীয়পরিজন বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে সবার প্রিয় হল পুত্র, যে পতিরই অংশজাত।
যেসব নারী পতি নিন্দা করে বা পতিবিমুখ হয় তারা অসৎ বংশজাত, তারা চঞ্চল ও দুষ্টমনা। সতী নারী স্বামী দুষ্ট বা অসৎ যাই হোক না কেন, তাকে ছেড়ে অন্যত্র গমন করে না। পতি সগুণ বা নির্গুণ যাই হোন যে অসতী নারী বিদ্বেষবশত তাকে পরিত্যাগ করে, সে রমণী সূর্য ও চন্দ্র যতদিন থাকবে, ততদিন কালসূত্র নরক যন্ত্রণা ভোগ করবে। যেখানে ক্ষুধার তাড়নায় নিজের মাংস নিজেকে ভক্ষণ করতে হয়। হিংস্র প্রাণীরা তাকে কুরে কুরে খায়। সহস্র কোটি বার সে শকুনি হয়ে জন্মায়, শতবার শূকর, শতবার স্বাপদ হয়ে জন্মাবার পর বন্ধু হত্যাকারিণী রূপে মানুষ হয়ে জন্মায়।
হে পিতা! সৃষ্টি কর্তার পুত্র আপনি। আপনিও সৃষ্টি করতে পারেন, তাই আপনার কাছে বিনীত প্রার্থনা আমাদের স্বামীকে ফিরিয়ে দিন আমাদের কাছে।
কন্যাদের কাতর প্রার্থনা শুনে দক্ষ আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি শিবের কাছে গেলেন। শিব উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রণাম নিবেদন করলেন। দক্ষ তাকে আশীর্বাদ করলেন। বললেন– হে শঙ্কর! তুমি আমার জামাতাকে ফেরত দাও। আমার কন্যারা স্বামী বিরহে পাগলিনী হয়েছে। তাদের প্রাণাধিক পতিকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আজ্ঞা করছি। আর যদি তুমি আমার আদেশ অমান্য করো তাহলে এমন শাস্তি পাবে যে কেউ তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না।
করুণা সাগর শিব নিজ শ্বশুর দক্ষের কথা শুনে মোটেও ক্রুদ্ধ হলেন না। তিনি সুমিষ্ট বাক্য প্রয়োগ করলেন- হে দক্ষরাজ, আমি আপনার আদেশ পালন করতে অক্ষম। এর জন্যে যেকোনো প্রয়োগ করকে দিতে পারেনও হয়ে অভি
দক্ষ তখন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন, তা দেখে শিব বিপদত্ৰাতা কৃষ্ণের শরণাপন্ন হলেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণবেশী নারায়ণের আবির্ভাব হল। তিনি শিব ও প্রজাপতি দক্ষকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর শিবকে লক্ষ্য করে বললেন– হে শঙ্কর! নিজ আত্মা সকলের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার বস্তু। সেই প্রাণ আজ বিপন্ন। তুমি দক্ষের কাছে তার জামাতাকে ফিরিয়ে দাও। তুমি বৈষ্ণব প্রধান, তুমি যোগী শ্রেষ্ঠ, তুমি সমদৃষ্টি সম্পন্ন, তুমি দ্বেষ ও ক্রোধ শূন্য। আর ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ তেজস্বী, ক্রোধী।
শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ শুনে শঙ্কর মৃদু হাসলেন, বললেন– আমি আমার যা কিছু সব ত্যাগ করতে পারি এমন কি নিজ আত্মাও অন্য হাতে সমর্পণ করতে কুণ্ঠিত হব না। কিন্তু যে আমার শরণ নিয়েছে, আমার আশ্রিত, তাকে পরিত্যাগ করলে ধর্মের অবমাননা করা হবে। হে জগৎপতি, আমি সব কিছু হারাতে রাজি কিন্তু নিজের ধর্মের অমর্যাদা হতে দিতে পারি না। যে ধর্মকে রক্ষা করে ধর্ম হন তার সহায়। হে প্রভু, আপনাকে ধর্ম সম্বন্ধে কি আর ব্যক্ত করব। এই বিশ্ব চরাচর আপনারই সৃষ্টি, আপনিই পালনকারী এবং আপনি বিনাশ ঘটান, সেই আপনার পাদপদ্মে যার মতি, সে কীসে ভয় পাবে।
শ্রীকৃষ্ণ তখন শঙ্করের ললাট থেকে অর্ধচন্দ্রকে আকর্ষণ করে নামিয়ে নিয়ে এলেন। দক্ষকে অর্ধচন্দ্র প্রদান করলেন। সেই থেকে অর্ধচন্দ্র শিবের ললাটে অবস্থান করতে লাগলেন। যক্ষারোগগ্রস্ত চন্দ্রের আরোগ্য লাভের আশায় দক্ষ মাধবের শরণ নিলেন। দক্ষের স্তবে গোবিন্দ সন্তুষ্ট হলেন। তিনি বললেন– এক পক্ষকাল চন্দ্র পূর্ণ থাকবে, এবং এক পক্ষকাল ক্ষত গ্রস্থ হবে।
কৃষ্ণ ফিরে গেলেন নিজধামে। দক্ষ তার কন্যাদের হাতে চন্দ্রকে তুলে দিলেন। পত্নীদের কাছে পেয়ে চন্দ্র অত্যন্ত আহ্লাদ প্রকাশ করলেন। সেই থেকে চন্দ্র প্রত্যেকটি পত্নীর ওপর সমান নজর দিতে শুরু করলেন।
হে শৌণক, আমি এ পর্যন্ত যে ক্রম বর্ণনা করলাম তা আমাকে পুস্কর তীর্থে মুনিদের সভায় গুরুদেব শুনিয়ে ছিলেন। সতপুত্র বললেন, হে ব্রাহ্মণ! চ্যবন ও শুক্র নামে দুই পুত্র ভৃগুর জ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ক্রতুপত্নী ক্রিয়াদেবী বালখিল্যদের মাতা। বৃহস্পতি, উতথ্য ও মন্থর তিন মুনি অঙ্গিরার পুত্র। শ্রীমান কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন হরি হলেন পরাশরের পুত্র, পরাশরের পিতার নাম শক্তি, শক্তির পিতা বশিষ্ঠ। শিবের অংশজাত জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ শুকদেব হলেন ব্যসদেবের পুত্র। বিশ্বশ্রবা হলেন পুরস্ত্যের পুত্র এবং তাঁর পুত্র ধনেশ্বর। শৌনক প্রশ্ন করলেন–জন্মরহস্য অত্যন্ত জটিল। আপনি কি এ ব্যাপারে ব্যাখা করবেন?
সৌত বললেন–দিক পালগণের পূর্ব স্রষ্টা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন। পরে ব্রহ্মার অভিশাপে ধনেশ্বর কুবের বিশ্বশ্রবার ঘরে জন্ম নেন। বিশ্বশ্রবার আরও তিন পুত্রের নাম জানা যায়, রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও মহাত্মা ধার্মিক বিভীষণ। বাৎস্য হলেন পুলহের পুত্র, রুচির পুত্রের নাম শাণ্ডিল্য, ঋষি গৌতমের পুত্র মুনি শ্রেষ্ঠ সাবার্ণ।
এই পাঁচ মুনি পাঁচটি গোত্রের জন্মদাতা। কশ্যপ থেকে কাশ্যপ গোত্র, বৃহস্পতি থেকে ভরদ্বাজ, পুলহ থেকে বাৎস্য। গৌতম থেকে সাবর্ণ এবং শাণ্ডিল্য গোত্রের সৃষ্টি। ব্রহ্মা তার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ জাতির জন্ম দিয়েছেন। তাদের কোনো গোত্র নেই। চন্দ্র, সূর্য ও মনু এবং ব্রহ্মার বাহু থেকে ক্ষত্রিয় জাতির সৃষ্টি হয়েছে। ব্রহ্মার উরু থেকে বৈশ্য ও তার চরণ থেকে শূদ্র জাতির উৎপত্তি। তাদের সংমিশ্রণে বর্ণশঙ্করের উদ্ভব হয়েছে।
হে যোগী শ্রেষ্ঠ! গোপ, নাপিত, ভিল্ল, মোদক, কুবর, তাম্বুলিক, স্বর্ণকার আর বণিকদের বলা হয় সং শূদ্র। বৈশ্য ও শূদ্রর গর্ভজাত সকলে করণ নামে পরিচিত। যদি ব্রাহ্মণের ঔরসে বৈশ্যর গর্ভে সন্তান উৎপন্ন হয় তাহলে সে অশ্বষ্ঠ নামে পরিচিত হবে। মালাকার, কর্মকার, শঙ্কার, কুবিক, কুম্ভকার, কংসকার ছয়জন বর্ণশঙ্কর শিল্পকারী পুত্রের জনক-জননী বিশ্বকর্মা ও শূদ্রা। ব্রহ্মশাপে সূত্রধর, চিত্রকার ও সর্ণকার পতিত হয়ে অযাজ্য নামে পরিচিত।
মুনি শ্রেষ্ঠ শৌণক এবার জানতে চাইলেন-হে সৌতে, আমার মনে কয়েকটি প্রশ্নের উদয় হয়েছে। দেবশিল্পী কেন অধম শূদ্রার সঙ্গে শৃঙ্গারে লিপ্ত হয়েছিলেন? সূত্রধর, চিত্রকার ও স্বর্ণকার কেন ব্রহ্মশাপে পতিত হয়েছিলেন?
সৌত বললেন– পুস্করতীর্থে গমন কালে বিশ্বকর্মা কামবর্ধক মনোহর বেশধারী অপ্সরা ঘৃতাচীকে দর্শন করেছিলেন। বিশ্বকর্মা তখন সূর্যলোক থেকে ফিরছেন। স্বভাবতই মন তার প্রফুল্ল ও আনন্দিত। তিনি ওই অপ্সরার প্রতি কাম বোধ করলেন। ঘৃতাচি ষোল বছরের একস্থির যৌবনা নারী বিশাল, গোলকার এবং উঁচু তার দুটি স্তন। তার কটাক্ষে সদা চঞ্চলতা। তার মনমোহিণী রূপ এবং কটাক্ষপাতে মুনি ঋষিরা পর্যন্ত কামান্ধ হয়ে পড়েন।
কামশাস্ত্রবিদ বিশ্বকর্মা ওই অপ্সরার কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন– হে সুন্দরী, তুমি আমার প্রাণ হরণ করেছ, তুমি এখানে একটুক্ষণ দাঁড়াও। আমি সারা জগত তোমায় অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছি। তুমি আমার প্রাণের প্রাণ। তোমা বিনা আমি মৃত। ভেবেছিলাম আত্মহত্যা করব। যখন রম্ভা জানাল যে তুমি কামালোকে গমন করেছে, তখন আমি ছুটে এলাম।
আহা! কী মনোরম নির্জন উদ্যান। সরস্বতী থেকে উঠে আসছে ঠান্ডা বাতাস, এস আমরা এই পুষ্পেদ্যানে শৃঙ্গারে রত হই। তুমি স্থির যৌবনা, তুমি কোমলাঙ্গী। তুমি সুন্দরী শ্রেষ্ঠা আর আমি মৃত্যুঞ্জয় বর লাভ করেছি। বরুণ আমাকে দিয়েছে রত্নমালা, কুবের প্রাসাদ নির্মাণ করে দিয়েছি, পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছি প্রভূত ধনসম্পদ।
বায়ু দিয়েছেন স্ত্রী রত্নভূষণ। বহ্নিশুদ্ধ বস্ত্রযুগল অগ্নির কাছ থেকে লাভ করেছি। কামদেবের কাছ থেকে কামিনী মনোরঞ্জন কামশাস্ত্র আর চন্দ্রের কাছ থেকে পেয়েছি রতিবিদ্যা শিক্ষা।
আমার যা কিছু অলংকার, রত্নমালা, বস্ত্রযুগল সব তোমার। সুখসম্ভোগ শেষ হলেই আমি তোমার হাতে ওইসব সামগ্রী তুলে দেব।
কামুক বিশ্বকর্মার সুন্দর সুন্দর কথা শুনে ঘৃতাচি একটু হাসলেন। বললেন– হে কামপুরুষ, আপনার সব কথা আমি মেনে নিলাম। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, যে দিন যার উদ্দেশ্যে আমরা গমন করি সেদিন তার জন্যই আমরা প্রস্তুত থাকি, আজ আমি কামপত্নী। আর আমি হলাম আপনার গুরু পত্নী। কারণ আমি নিজ মুখে স্বীকার করেছেন যে কামদেবের কাছ থেকে কর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন।
বিদ্যাদাতা ও মন্ত্রদাতা গুরু পিতার থেকে লক্ষগুণে এবং মাতার থেকে শতগুণে শ্রেষ্ঠ। হে বীর্যবান পুরুষ, বেদে বর্ণিত হয়েছে, মাতার সঙ্গে সঙ্গমে যত না দোষ হয়, দোষ হয় গুরুপত্নী সঙ্গমে। যে নারীকে মা বলে একবার সম্বোধন করা হয় সেই নারী হয় মাতৃসম। তার সঙ্গে দেহ সম্ভোগ করলে চন্দ্র সূর্য যতদিন থাকবে, ততদিন কালসূত্র নরকে পচে মরতে হবে। গুরুপত্নীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হলে কুম্ভীপাক নরকে গমন হয়। ব্রহ্মার বয়সকাল পর্যন্ত সেখানে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
হে শৌণক, কুম্ভীপাক নরক সম্পর্ক বলা হয়েছে যে এই নরক দেখতে কুম্ভকারের চক্রের মতো গোলাকার, তার কিনারা খঙ্গের মতো তীক্ষ্ণ। মল-মূত্রতে পরিপূর্ণ। শূলের মতো তীক্ষ্ণবীর কৃমিরা সব সময় ঘুরে বেড়ায়। আগুনের মত এখানকার জল টগবগ করে ফুটছে। সব পাপীরা এখানেই ঠাঁই পায়। যেখান থেকে আর উদ্ধারের আশা থাকে না। হে যোগী, ঘৃতাচি তাই বললেন, অন্য পুরুষের সাথে গুরুপত্নী যদি স্বেচ্ছায় রমণ করে তাহলে তারা একই দোষে দুষ্ট হবে। তাই বলছি আজ আমি কামিনী কামদেবের ভবনে যাচ্ছি কামদেবের সঙ্গে রমন করব বলে। অন্যদিন আপনার ঘরনী হয়ে সেজে আসব। আমি চলি।
ঘৃতাচির এহেন আচরণে বিশ্বকর্মা অত্যন্ত রুষ্ট হলেন। তিনি তাকে ভূতলে শুদ্র যোনিতে জন্মগ্রহণ করার অভিশাপ দিলেন। ঘৃতাচি বললেন– তুমি স্বর্গ থেকে ভ্রষ্টা হয়ে মর্ত্যে জন্ম নেবে। আমি এই অভিশাপ দিলাম।
ঘৃতাচি চলে গেলেন কামদেবের ভবনে। তার সঙ্গে রমন ক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। তারপর পথে বিশ্বকর্মার সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে, সব বললেন।
ঘৃতাচি মর্তে জন্ম নিলেন ভারতবর্ষের প্রয়াগ, ধামে মদন নামে এক গোপের মেয়ে হয়ে। জাতিস্মর ধর্মপরায়ণা এই কন্যা মনোরম গঙ্গাতীরে তপস্যায় ব্যাপৃত হলেন। দেখতে দেখতে একশো বছর অতিবাহিত হল। তপস্বিনীর শরীরের কান্ত তখন তপ্তকাঞ্চন সম।
এদিকে ঘৃতাচির অভিশাপ শুনে বিশ্বকর্মা ব্রহ্মার দারস্থ হলেন। ব্রহ্মার পাদবন্দনা করে তাকে সব কথা শোনালেন। ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা পৃথিবীতে জন্ম নিলেন এক ব্রাহ্মণের ঘরে। তিনি ব্রাহ্মণ পুত্র হয়েও শিল্পকর্মে পারদর্শিতার পরিচয় দেন। রাজা ও গৃহস্থদের ভবনে তার ডাক পড়ে। যথেষ্ট খ্যাতি তার সর্বদা, কত রকমের শিল্পকর্ম, সৃষ্টিতে মেতে থাকেন।
প্রয়াগরাজের এক শিল্পকর্ম শেষ করে তিনি সেদিন গিয়েছিলেন গঙ্গায় স্নান করতে। তপস্বিনীকে দেখে সেই শিল্পীর গত জন্মের কথা মনে পড়ে গেল। এই তপস্বিনী আর কেউ নয় ঘৃতাচি। তিনি কাম আগুনে দগ্ধ হতে হতে ছুটে গেলেন তপস্বিনী রূপী ঘৃতাচির কাছে। বললেন– হে ঘৃতাচি, তোমাকে এখানে দেখে আমি আশ্চর্য হচ্ছি। আমি বিশ্বকর্মা, নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছ হে সুন্দরী! আমি তোমাকে গ্রহণ করতে চাই। কামদেব আমার মনকে পীড়া দিচ্ছেন। তুমি এসো সম্ভোগে লিপ্ত হও, এবং শাপমোচন করে স্বর্গে ফিরে যাও।
তপস্বিনী রূপী ঘৃতাচি বললেন– হে বিশ্বকর্মা, এই ভারতবর্ষ এক পুণ্য ক্ষেত্র। এই মনোরম গঙ্গাতীরে শৃঙ্গার দান করা কি সম্ভব? ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি তপস্যার বলে মোক্ষলাভ করার উদ্দেশে মর্তে আসে, বিষ্ণুর মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ থেকে নির্দিষ্ট কর্ম করে। ঈশানমায়া দুর্গাদেবী যার প্রতি সদয় হন, শ্রীকৃষ্ণ তাকে ভক্তি ও ইপ্সিত মন্ত্র দান করেন। আর যে বিষ্ণু মায়ায় মুগ্ধ হয়ে শ্রীকৃষ্ণের পুজো করতে ভুলে যায়, সে হল মূর্খ। হে কামুক, গত জন্মের কথা আমার সব মনে পড়েছে। অন্য জায়গায় পাপ করলে এই গঙ্গায় নাশ হয়। কিন্তু এই গঙ্গাতীরে পাপ কাজে লিপ্ত হলে পাপ লক্ষ গুণ বেড়ে যায়। তাই বলছি আপনি নিশি হয়। কিন্তু এই গঙ্গার কথা আমার সব মুগ্ধ হয়ে শ্রীকৃষ্ণের পুজে
বিশ্বকর্মা তখন ঘৃতাচিকে অদৃশ্যভাবে মলয় পর্বতের সেই চন্দন উদ্যানে নিয়ে গেলেন। সেখানে নির্জন স্থানে পুষ্পশয্যাতে তারা সম্ভোগে প্রবৃত্ত হলেন। বিশ্বকর্মার বীর্য ঘৃতাচি নিজের গর্ভে ধারণ করলেন। সেখানেই তিনি নয়টি পুত্রের জন্ম দেন। বিশ্বকর্মা ও ঘৃতাচি তাদের নয় পুত্রকে বরদান করেন। তারপর মানবদেহ পরিত্যাগ করে স্বর্গে ফিরে যান।
ব্রাহ্মণদের আদেশ লঙঘন করার ফলে বিশ্বকর্মার বংশের অনেকে ব্রহ্মার শাপে পতিত হয়েছিল। চিত্রকারের বীর্যে শূদ্রার গর্ভে অট্টালিকাকারের জন্ম হয়। এর বীর্যে এবং কুম্ভকার ও কোটক রমণীর মিলনে সৃষ্টি হয় তৈলকার জাতির। তীবর জাতি এল ক্ষত্রিয় রাজপুত রমণীর সম্ভোগের, স্ত্রীর গর্ভজাত লেট জাতি দস্যু ও পতিত। চণ্ডাল জাতির জন্ম দেয় শূদ্র বীর্য ও ব্রাহ্মণ কন্যার গর্ভ। চণ্ডাল বীর্যে ও চর্মকার গর্ভে মাংসচ্ছেদ জাতির জন্ম হয়।
হে মুনি, গঙ্গা তীরে লেট বীর্য ও তীবর কন্যার মিলনে জন্ম হয় গঙ্গাপুত্রের। বৈশ্য বীর্যে তীবর কন্যাতে শুন্ডী বা শুড়ি জাতির সৃষ্টি হল। বৈশ্য বীর্যে ও শুণ্ডি কন্যাতে শৌণ্ডক জাতির উৎপত্তি হল। রাজপুত জাতির সৃষ্টি হয় ক্ষত্রিয় বীর্য ও কুন কন্যার মিলনের ফলে। এইভাবে কৈবৰ্ত্ত, ধীবর, কোয়ালি, সদ্বস্বী, ব্যাধ, হুন্ডি, জাতির সৃষ্টি হল। ক্ষত্রিয় ঔরসে বৈশ্য গর্ভে ঋতুর প্রথমদিনে জাত পুত্রের নাম ধনুর্ধর। তিনি ছিলেন মহাপরাক্রশালী এক দস্যু।
ক্ষত্রিয় বীর্যে শূদ্রকন্যার ঋতুদোষের কারণে অবিনীত। কুর, নির্ভীক, রণদুর্জয় এক জাতির জন্ম হয়। তারা ম্লেচ্ছ নামে পরিচিত। ম্লেচ্ছর ঔরসে কুবিন্দ কন্যার গর্ভে জোলাজাতির সৃষ্টি হয়। জোলা ও কুবিন্দ মিলন সৃষ্টি হল শারক জাতি। বর্ণ সঙ্কর দোষে এই ভাবে নানা জাতির উৎপত্তি হয়েছে। অশ্বিনী কুমারের ঔরসে ব্রাহ্মণ কন্যার গর্ভে বৈদ্যজাতির সৃষ্টি হল। বর্ণসঙ্করের দোষে এইভাবে বহু জাতির উৎপত্তি হয়েছে, যার হিসাব কার ও জানা নেই।
শৌণক জানতে চাইলেন–সূর্যপুত্র অশ্বিনী কুমার কেন ব্রাহ্মণ কন্যাতে বীর্যপাত ঘটিয়ে ছিলেন, তা ব্যাখ্যা করবেন কি? সৌত বললেন– হ্যাঁ সেই কারণ আমি বর্ণনা করছি শুনুন। হে শৌনক অশ্বিনী কুমার একদিন পুষ্পেদ্যানে ভ্রমণ করছিলেন। পথে এক ব্রাহ্মণ রমণীকে হেঁটে যেতে দেখলেন। তিনি তীর্থে যাচ্ছিলেন। ওই রমণীকে দেখে অশ্বিনী কুমার কামাসক্ত হয়ে পড়েন। ব্রাহ্মণী বার বার আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু বলবান অশ্বিনী কুমারের সাথে পারবেন কেন? অশ্বিনী কুমারের বীর্য গর্ভে ধারণ করে ব্রাহ্মণ পত্নী গর্ভবতী হলেন। সেখানেই তাঁর এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হল। তার কান্তি যেন গলা পাকা সোনা। ব্রাহ্মণী পুত্রকে কোলে নিয়ে ফিরে এলেন ঘরে। লজ্জা ও সংকোচে তার মাথা অবনত।
.
পথে যেতে যেতে ঘটেছিল যে ঘটনা সব স্বামীকে বললেন। ব্রাহ্মণ অত্যন্ত কুপিত হয়ে পত্নী ও পুত্রকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলেন। যোগবলে সেই ব্রাহ্মণী গোদাবরী নদীতে পরিণত হলেন। অশ্বিনী কুমার নিজে সেই পুত্রকে চিকিৎসাশাস্ত্র ও নানাধরনের শিল্পকর্মে পারদর্শী করে তুললেন। তাকে মন্ত্রদান করলেন। ওই পুত্র পৃথিবীতে গণক নামে পরিচিত। এই ব্রাহ্মণ লোভী। শূদ্রদের আগে দান গ্রহণ করে, মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দেওয়া দানও আগে গ্রহণ করে। তাই তারা অগ্রদানী। আমাদের পূর্বপুরুষ ধর্মবক্তা ও সুত যিনি ব্রহ্মার যজ্ঞের কুণ্ড থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। জাতি নির্ণয়ক কিছু পুরাবৃত্ত বর্ণনা করে শোনালাম।
হে শৌণক, এবার শুনুন সমস্ত জাতির মধ্যে কার সঙ্গে কার কী সম্বন্ধ। এ সম্বন্ধ ব্রহ্মা নির্ণীত। যিনি জন্মদান করেন তিনি পিতা, তাত নামে পরিচিত। প্রসব যিনি করেন তিনি হলেন মাতা, জননী। পিতার পিতা পিতামহ। তার পিতা প্রপিতামহ, তারও ওপরে আছেন যাঁরা হলেন সগোত্র ও জ্ঞাতি। মায়ের পিতা পিতামহী তাঁর পিতা প্রপিতামহী। মায়ের মাতা মাতামহী। তার মাতা প্রমাতামহী। পিতার ভাই পিতৃব্য বা কাকা, মায়ের ভাই মাতুল বা মামা। পিতার বোন হল পিতৃস্বসা বা পিসি।
মায়ের বোনকে ডাকা হয় মাসুরী বা মাসী নামে। পুত্রকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন তনয়, কন্যার স্বামী জামাতা। পতি, প্রিয়, স্বামী, ভর্তা ও কান্ত নামে স্বামীকে ডাকা হয়। স্বামীর ভাই দেওয়র বা দেবর এবং বোন ননান্দা বা ননদ। প্রিয়া, ভার্যা, জায়া, স্ত্রী নামে পরিচিতা তার ভাই স্বামীর সম্পর্কে শ্যালক এবং বোন শ্যালিকা, পত্নী বা স্বামীর পিতা ও মাতা যথাক্রমে শ্বশুর ও শাশুড়ি নামে ডাকা হয়।
শ্বশুর পিতা জন্মদাতা পিতার সমান পূজনীয়। অন্নদাতা, ভয়ত্ৰাতা, পত্নীর পিতা, বিদ্যাদাতা ও জন্মদাতা– এই পাঁচ ধরনের পিতা এবং মাতা, কন্যা, ভগিনী, অন্নদাতার স্ত্রী, গুরুপত্নী, মাতৃসদৃশপত্নী, পুত্ৰ পত্নী, মায়ের মা, বাবার মা, শাশুড়ি, বাবার বোন, মায়ের বোন, কাকার স্ত্রী, এবং মামার পত্নী এই চোদ্দ ধরনের মাতা জগতে আছে। পুত্রের পুত্র হল পৌত্র এবং তার পুত্র প্রপৌত্র। প্রপৌত্রের পুত্ররা হল কুলজ এবং বংশধর কন্যার পুত্র দৌহিত্র।
ভ্রাতার পুত্ররা হল জ্ঞাতি। গুরুপুত্র ও ভ্রাতাসম গুরুকন্যা ভগিনীসম। তাই সে মায়ের মতো পূজনীয়। পুত্রের ও কন্যার শ্বশুর সম্পর্কে ভ্রাতৃ স্থানীয় এবং বান্ধব। গুরুর শ্বশুরের গুরু ভাইয়ের গুরু সকলেই নিজের গুরুর মতো প্রণম্য। সুখের কারণে বন্ধুত্ব জন্ম নেয় যাকে বলা হয় মিত্র। আর দুঃখের কারণ শত্রুতা ডেকে আনে যাকে বলে রিপু, যোনিজ বিদ্যাজ ও প্রীতিজ, এই তিন রকম সম্বন্ধ মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। প্রীতিজ সৃষ্টি হয় মিত্রতা থেকে, যা জগতে অত্যন্ত বিরল। মিত্রের মা এবং পত্নী মায়ের সমান।
মিত্রের বাবা এবং ভাই নিজের বাবা ও ভাইয়ের সমান। উপপতি ও বন্ধুর সঙ্গে যে দুষ্টু রমণী সম্ভোগ করে তারা হল উপপত্নী। এদের তিনটি ভাগ আছে, নবাজ্ঞা, প্রেয়সী ও চিত্রহারিণী। দেশভেদে নাম সম্বন্ধের পরিবর্তন ঘটে। পুরুষদের চেয়ে স্ত্রী লোকের পক্ষে এই সম্বন্ধ বিশেষভাবে নিন্দনীয়। কিন্তু মহান ব্যক্তিরা এখনও এই সম্বন্ধ পরিত্যাগ করতে পারেনি। তাই অনেক দেশে এ সম্বন্ধে প্রচলিত আছে। তেজস্বী ব্যক্তিরা এই ধরনের সম্বন্ধকে দোষ বলে মনে করেন না। তাই যুগ যুগ ধরে এই নাম সম্বন্ধ চলে আসছে।
সৌত বললেন–হে ব্রাহ্মণ! এবার আমি সেই বৃত্তান্ত বর্ণনা করছি, যিনি নিজের পত্নীকে ত্যাগ করেছিলেন।
ওই ব্রাহ্মণ ছিলেন ভরদ্বাজ বংশজাত সুতপা। তিনি হিমালয়ে গিয়ে তপস্যায় ব্রতী হন। লক্ষ বছর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটায়, আকাশমার্গে পলকের জন্য শ্রীকৃষ্ণের জ্যোতির দর্শন লাভ করেন। তারপর তিনি দেখলেন সেই পরমাত্মাকে যিনি প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন। এ দৃশ্য দেখে ব্রাহ্মণ অত্যন্ত আহ্লাদিত হলেন। তিনি দাস্য ও ভক্তি বিষয়ক বর প্রার্থনা করলেন। স্বয়ং বিধাতা তাঁর প্রার্থনা পূর্ণ করলেন। সেখানে এসে হাজির হলেন এক মানসী কন্যা। সেই কন্যার গর্ভে কল্যান মিত্র নামে এক পুরুষের জন্ম হয়। তিনি হলেন মুনি শ্রেষ্ঠ। তিনি অশ্বিনী কুমারের উদ্দেশ্যে অভিশাপ বর্ষণ করলেন। সেই থেকে অশ্বিনী কুমারদ্বয় জগতে অপূজ্য ও অকীর্তিমান হিসেবে রয়ে গেলেন।
ব্রাহ্মণ সুতপা ছেলে কল্যাণ মিত্রকে নিয়ে ফিরে এলেন গৃহে। সূর্যদেব তার দুই পুত্রকে নিয়ে সেখানে এসে হাজির হলেন। তিনি ব্যাধিগ্রস্ত পুত্রদের সঙ্গে মুনিশ্রেষ্ঠ সুতপার বন্দনা করতে লাগলেন। সূর্যদেব বললেন–“হে মুনিশ্রেষ্ঠ! আপনি দয়া করে আপনার অভিশাপ ফিরিয়ে নিন। আপনি ভরদ্বাজ বংশজাত মুনীশ্বর বিষ্ণুর অংশ। যুগে যুগে ধরাধামে ব্রাহ্মণরূপে আপনার আর্বিভাব ঘটে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরাদি সমস্ত দেবতা ব্রাহ্মণ প্রদত্ত পুষ্প ফলফলাদি গ্রহণ করেন। এই ব্রাহ্মণদের দ্বারাই তাঁরা প্রতিপালিত হন। পৃথিবীতে তাই পুজো লাভ করেন।
ব্রাহ্মণদের থেকে শ্রেষ্ঠ দেবতা আর কেউ নেই। কারণ স্বয়ং হরি যেখানে ব্রাহ্মণরূপ গ্রহণ করেছেন। শ্রেষ্ঠ অতএব তিনি প্রীত হলে নারায়ণকে সন্তুষ্ট করা যায়। আর নারায়ণ সন্তুষ্ট হওয়ার অর্থ সমস্ত দেবতারও প্রীত। শ্রীকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ উত্তম বৈষ্ণব ভগবান শঙ্কর, সহিষ্ণু শ্রেষ্ঠ, পৃথ্বী, শ্রেষ্ঠ সাধ্বী পার্বতী, শ্রেষ্ঠ বলবান দেব, শ্রেষ্ঠ তীর্থ গঙ্গা যেমন তেমনই পুত্রের থেকে অধিকতর প্রিয় আর কেউ হয় না। একাদশী ব্রত যেমন শ্রেষ্ঠ ব্রত। শ্রেষ্ঠ রত্ন ধনের মধ্যে, সমস্ত ধনের মধ্যে বিদ্যা যেমন শ্রেষ্ঠ রত্ন তেমনই সমস্ত আশ্রমে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ এবং তার ন্যায় গুরু আর কেউ হয় না।
সূর্যদেবের মুখে নিজের স্তুতি শুনে ব্রাহ্মণ সুতপা প্রীত হলেন। তিনি সূর্যদেবকে প্রণাম করলেন। নিজের তপস্যার গুণে তার দুই পুত্রকে নীরোগ করে দিলেন এবং তিনি তার অভিশাপ ফিরিয়ে নিলেন। সেই থেকে অশ্বিনীকুমারদ্বয় যজ্ঞাংশ–ভাগী হলেন। তাঁরা হলেন জগতের পূজ্য।
সূর্যদেব ব্রাহ্মণ সুতপা সমীপে যে স্তব করেছিলেন। এই স্তব পাঠ করলে বিপ্রপাদ প্রসাদে সর্বত্র বিজয়ী হওয়া যায়, যে প্রত্যহ ভোরে ব্রাহ্মণেভ্যঃ নমঃ মন্ত্র উচ্চারণ করে, সে সমস্ত তীর্থের ফল লাভ করে। ব্রাহ্মণের পাদোদক এক মাস পান করলে মহারোগীও সুস্থ হয়ে ওঠে। যে মূর্খ ব্রাহ্মণ সর্বদা শ্রীহরিতে ভক্তিমান হয় তাহলে সে বিষ্ণুর সমান হয়। প্রতিদিন ব্রাহ্মণের পাদোদক ও নৈবেদ্য গ্রহণ করলে রাজসূয় যজ্ঞের সমান ফল লাভ করা যায়। একাদশী তিথিতে অনাহারে থেকে যে ব্রাহ্মণ কৃষ্ণ ভজনা করেন তার পাদোদকে সেই স্থান তীর্থ স্থানের সমান হয়। যে ব্রাহ্মণ শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদিত উচ্ছিষ্ট ভোগ গ্রহণ করেন তিনি পৃথিবীতে পবিত্র হয়ে জীবন্মুক্ত হন।
পদ্মযোনি ব্রহ্মা বলেছেন উচ্চ বংশজাত ব্রাহ্মণ যদি বিষ্ণুকে নিবেদন করা হয়নি এমন অন্ন ও দ্রব্য গ্রহণ করে, তাহলে সেই অন্ন জল মল ও মূত্রের সমান হয়। পিতা, মাতা, মাতামহ সহ ও গুরুর সংসর্গ দোষে যে ব্রাহ্মণ কৃষ্ণের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন না, তিনি মরে বেঁচে থাকেন। যে গুরু বা পিতা বা পুত্র বা সখা বা রাজা কৃষ্ণভক্তিতে মনকে উদ্বুদ্ধ না করে তার সঙ্গী কী দরকার।
যে ব্রাহ্মণ ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক করে না, পবিত্রতা পালন করে না, শ্রীকৃষ্ণ পদে যার মতি নেই, সে নামেই ব্রাহ্মণ। গুরুদেব যার কানে বিষ্ণুমন্ত্র দান করেন তিনি হলেন জীবন্মুক্ত মহাপবিত্র বৈষ্ণব। বৈষ্ণবরা সবসময় শ্রীগোবিন্দের পাদপদ্মের ধ্যান করেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রের ন্যায় পৃথিবীতে আর একটি জাতি আছে, তা হল বৈষ্ণব জাতি। স্বয়ং গোবিন্দ সর্বদা বৈষ্ণবদের রক্ষা করে চলেছেন।
ঋষি বংশের উৎপত্তি বিষয় বর্ণনা শেষ করে সুতপুত্র এবার প্রজাদের সৃষ্টি রহস্য সম্বন্ধে বলতে শুরু করলেন।
তিনি বললেন– হে শৌণক! হংসী যতি, অরুণী, বোয়ু, পঞ্জাশিখ, অপান্তরতমা ও শনক ছাড়াও ব্রহ্মার পুত্ররা পিতার আজ্ঞা পালন করে চলেছেন। নারদের অভিশাপে স্বয়ং ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিত্যাজ্যা পিতার অভিশাপে নারদ ও গন্ধর্ব কুলে জন্ম নিলেন। গন্ধর্বকুলে তিনি কী ভাবে জন্ম নিয়েছিলেন, সেই বৃত্তান্ত বলছি এখন, সমস্ত গন্ধর্বদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গন্ধর্বরাজ্যের অতুল ঐশ্বর্য ছিল তার, কিন্তু ছিল না কোনো পুত্র সন্তান। তাই মনোদুঃখে কাতর ছিলেন। গুরুর আদেশে তিনি পুস্করতীর্থে গিয়ে কৃপানু শঙ্করের ধ্যান করতে বসলেন।
বশিষ্ঠ তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে শিবের স্তোত্র, কবচ ও দ্বাদশ পক্ষের মন্ত্র প্রদান করলেন। গন্ধর্বরাজ পরম যত্নে দিব্যশত বছর শিবমন্ত্র জপ করেছিলেন। তারপর ব্রহ্মাতেজে তেজীয়ান এক আলোক পুরুষকে তিনি দর্শন করেন। ইনি হলেন ভগবান শঙ্কর, যিনি ভক্তদের সর্বদা কৃপা করেন। তাঁর দয়ায় সম্পদহীন সম্পদ লাভ করে। সেই ত্রিলোচন জটাধারী মহাদেব স্ফটিকের ন্যায় শুভ্রবর্ণ। তিনি ত্রিশূল ও পটিশ ধারণ করেন। নীলবর্ণ তাঁর গলদেশ। সর্বজ্ঞ সাপ তিনি উপবীতের মতো ধারণ করে আছেন। তিনি নিজে মৃত্যুঞ্জয় হয়েও সকলের সংহার করেন।
সমুখে হরি ভক্তি প্রদানকারী স্মিতহাস্য বদন শিবকে দেখে গন্ধর্বরাজ বললেন– হে প্রভু, আমাকে হরিভক্তি ও পরম বৈষ্ণব পুত্র দান করুন। ভোলা মহেশ্বর হেসে বললেন– ওহে বৎস। তুমি একবারেই ধন্য হবে। শ্রীহরিতে সর্বমঙ্গলময়ী সুদৃঢ় ভক্তি যার আছে, সে অনায়াসে এই ধরাধামকে পবিত্র করতে পারে। তার পুণ্যে কোটি বংশের কোটি পুরুষ ও মাতামহ বংশের শত পুরুষ উদ্ধার পায়।
কোটি জন্মের তিন রকম পাপ নাশ করে তবেই শ্রীহরির দাস হওয়া যায়। যতদিন সংসারের প্রতি আসক্তি থাকে, ততদিন শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের কথা সে বিস্মৃত থাকে। পরম বৈষ্ণবরা সহজেই কোটি কুলকে উদ্ধার করতে পারে। আমরা যেমন বিষ্ণুর দাস, তেমনই শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত, তাই তুমি অন্য কোনো বর প্রার্থনা করো। শ্রীহরির দাসত্ব প্রার্থনা কোরো না। তোমার প্রার্থনা পূরণ করতে আমি অপারগ।
হে শৌণক, গন্ধর্বরাজ একথা শুনে চমকে উঠলেন। তিনি বললেন–ব্রহ্মত্ব, ইন্দ্ৰত্ব, সিদ্ধি, অমরত্ম, জ্ঞান, কিছুই আমার চাই-না, আমি নির্বাণ বা মোক্ষ, কিছুই প্রার্থনা করি না। আমি দুর্লভ হরিদাস হতে অভিলাষী। হে কল্পতরু! আপনি আমাকে বিমুখ করবেন না, কৃপা করে হরিদাস্য ও বিষ্ণুভুক্ত একটি পুত্র দান করুন। আপনি যদি আমার অভিলাষ পূর্ণ না করেন তাহলে এই মূহুর্তে জীবন ত্যাগ করব। নিজের মাথা কেটে আগুনে উৎসর্গ করব।
কৃপা সাগর ভোলানাথ বললেন– ওহে তোমাকে আমি দুটি বর দান করব। প্রথম বরে হরিভক্তি হরিদাস্য আর দ্বিতীয় বরে পুত্র হবে দীর্ঘজীবী, গুরুভক্ত এবং জীতেন্দ্রিয়। হে মুনি এই কথা বলে শঙ্কর তাঁর নিজের ভবনে ফিরে গেলেন। সন্তুষ্ট চিত্তে গন্ধর্বরাজ ফিরে এলেন আপন গৃহে। গন্ধর্ব রাজের বৃদ্ধা স্ত্রী গন্ধমাদন পর্বতে এক পুত্রের জন্ম দিলেন, সেই পুত্র হলেন মানুষরূপী নারদ। ভগবান বশিষ্ঠ শিশুর নামকরণ করলেন উপবর্ণ অর্থাৎ যে বালক পূজনীয় পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুজা পায়।
সৌত বলতে লাগলেন–পুত্রের জন্ম উপলক্ষে গন্ধর্বরাজ আনন্দিত চিত্তে ব্রাহ্মণদের দান ধ্যান করলেন। যথাসময়ে উপবহণ গুরু পশিষ্ঠের কাছ থেকে হরিমন্ত্র লাভ করলেন। গুণ্ডকি নদীর তীরে তিনি তপস্যায় মগ্ন হলেন। এই নব যৌবনে প্রাপ্ত তপস্বীকে দেখে গন্ধর্ব পত্নীর পত্নীরা বিমোহিত হলেন। তারা তপস্যার ফলে যোগবলের মাধ্যমে প্রাণত্যাগ করলেন চিত্ররসের কন্যা হয়ে সেই একশ জন গন্ধর্ব পত্নী আবার জন্ম লাভ করলেন।
তাঁরা কামের বশবর্তী হয়ে আনন্দের অতিশয্যে উপবহণের গলায় মালা প্রদান করলেন, তিন লক্ষ বছর ধরে তিনি ওইসব গন্ধর্ব কন্যাদের সাথে নির্জনে শৃঙ্গার ক্রীড়ায় ব্যাপৃত রইলেন। তাদের সঙ্গে কিছুকাল রাজ্যসুখ ভোগ করলেন। একদিন তিনি হরির গুণকীর্তন করতে করতে পুস্করতীর্থে এসে হাজির হলেন। তখন দেব সভায় রম্ভা নৃত্য পরিবেশন করছিলেন। দেবতারা তা উপভোগ করেছিলেন।
রম্ভার মসৃণ উরুদেশ ও নিটোল স্তনযুগল দেখে উপবহণ নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। তিনি কাম পীড়িত হয়ে সেখানে বীর্যপাত ঘটালেন এবং মূর্ছা গেলেন। দেবতারা এ দৃশ্য দেখে সকৌতুকে হেসে উঠলেন। ব্রহ্মা অত্যন্ত রেগে গেলেন। তিনি অভিশাপ দিলেন– তুমি গন্ধর্বদেহ ত্যাগ করে শূদ্রপুত্র হয়ে জন্মাবে। বৈষ্ণব সংসর্গ লাভ করে আমার কাছে ফিরে আসবে তখন তুমি হবে আমার পুত্র।
হে শৌণক, উপবৰ্হণের নিজের দেহ ত্যাগ করার অদ্ভুত ঘটনা বলছি এবার শ্রবণ করুন। সেই গন্ধর্বপুত্র ছয় চক্র ও ষোলো নাড়ী ভেদ করে যোগবলে মনের সঙ্গে জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে সংযোগ করালেন। এইভাবে তিনি ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার লাভ করলেন। ত্রিতন্ত্রী বীণা বাঁ কাঁধে রেখে ডান হাতে শুদ্ধ স্ফটিকের শুভ্র মালা ধারণ করে বেদের সারমন্ত্র, পরাৎপর শ্রেষ্ঠ ও নিস্তারবীজ, পরম ব্রহ্ম ‘কৃষ্ণ’ দুটি বর্ণ জোরে জোরে চিৎকার করে কীর্তন করতে শুরু করলেন। তারপর পূর্বদিকে মাথা ও পশ্চিমদিকে রেখে কুশশয্যা গ্রহণ করলেন।
পুত্রের এই অবস্থা থেকে সস্ত্রীক গন্ধর্বরাজ শ্রীকৃষ্ণের স্মরণ নিলেন। উপবহণ যোগবলে ব্রহ্মত্ব লাভ করলেন। উপবৰ্হণের পঞ্চাশ জন পত্নী স্বামীর শোকে বিলাপ করতে শুরু করলেন। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন মালাবতী, শোকবিহ্বল হয়ে মালাবতী শোকবিলাপ করতে লাগলেন– হে নাথ! আমার রমণেশ্বর আমি তোমার শোকে পাগলিনী, দয়া করে দেখা দাও। যে শ্রীপাদ পদ্ম শোভিত গন্ধমাদন পর্বতের নির্জন সেখানে বসন্ত কালে তুমি এই হতভাগিনীর সঙ্গে রমনক্রীড়ায় মেতে উঠেছিলে।
এই মুহূর্তে সে কথা স্মরণ করে মন ব্যথাতুর হয়েছে। যেসব অমৃতবাক্য তুমি আমাকে শুনিয়ে ছিলে, তা মনে পড়ায় মর্মান্তিক কষ্ট পাচ্ছি। হায়! পরমাত্মা কী অতি দারুণ। পতি বিয়োগের মতো মর্মান্তিক ঘটনা আর কিছুই নেই। শয়নে, স্বপনে, ভোজনে, চলতে ফিরতে প্রতি সময়ে স্বামী বিচ্ছেদের কথা নতুন নতুন ভাবে উপস্থিত হয়। সকুলজাত রমণীদের কাছে স্বামীই পরম বান্ধব। হে দিকশ্রেষ্ঠ দিকপ্রাণ গন্ধ হে প্রজাপতি, হে ধর্ম, হে গিরীশ, হে কমলাকান্ত আপনাদের কাছে এই হতভাগিনী করুণ মিনতি জানাচ্ছে, কৃপা করে আমার স্বামীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।
শোকে মুহ্যমান হয়ে মালাবতী সেখানেই লুটিয়ে পড়লেন। প্রিয়কে বুকে চেপে ধরে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইলেন সারা রাত। দেবতারা তাঁকে রক্ষা করলেন। সকালে জ্ঞান ফিরতেই আবার চিত্ররথের কন্যা বিলাপ শুরু করলেন।
সেই সতী সাধ্বী স্ত্রী শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে প্রার্থনা জানালেন- হে প্রভু, হে শ্রীহরি। হে জগৎ রক্ষাকারী। আমি আপনার সৃষ্ট জগতের এক অভাগিনী। আমাকে রক্ষা করা আপনার কর্তব্য। আপনার মায়াতেই আমি আমার পতি বলে বিলাপ করেছি। এইসব হল কর্মের ছকে বাধা। আসলে আপনি জগতের সকলের স্বামী। হে নাথ! বিধাতার লিখনে আমরা যে যার ভূমিকা পালন করে থাকি। আমরা আসলে কেউ কারও নয়।
এ জগতে মুখলোকর সংযোগ ঘটালে দারুণ আনন্দ ও বিয়োগে প্রাণ সংকট উপস্থিত হয়। কিন্তু আত্মারামের কাছে এসব্য মূল্যহীন। বিষয়বস্তু, বন্ধুবান্ধব সবই নশ্বর। যিনি স্বেচ্ছায় সবকিছু পরিত্যাগ করেন, তিনি হলেন সুখী আর যিনি অন্যের কথায় ত্যাগ করে তিনি দুঃখ ভোগ করেন। এই জগতে সাধুজনরাই জ্ঞানী হতে পারল কই। তাই হে জগদ্বীশ্বর, আমি আমার স্বামীর প্রতি মোহগ্রস্ত। আমি মোক্ষ চাই না, আপনি আমার পতিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।
হে হরি! জগতে এমন একজনও নারী নেই, যে আমার মতো পতি লাভ করেছে। আমার স্বামী হরিভক্ত, হরিতুল্য আগুনের মতো যিনি ছিলেন বিশুদ্ধ, সাগরের মতো গম্ভীর, সূর্যের মতো মান দ্বীপ্তিচ্ছটা। বুদ্ধিতে বৃহস্পতি, শুক্রচার্যের মতো কবিত্বক্তি সম্পন্ন।
তিনি সর্বশাস্ত্রে সরস্বতীর তুল্য, ভৃগুর ন্যায় প্রতিভাধর, তিনি চন্দ্রের ন্যায় সুন্দর, কামদেবের মতো সুদৃশ্য, সহিষ্ণুতায় পৃথিবী তুল্য। হায়! এমন গুণসম্পন্ন স্বামী বিহনে আমি কেমন করে এখনও বেঁচে আছি? ধিক আমাকে।
ওহে নিষ্ঠুর দেবগণ! তোমাদের আমি অভিশাপ দেব। তোমাদের অযজ্ঞভাগী হতে হবে আমার অভিশাপে। হে নারায়ণ। আপনি আমার বৈধব্য যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিন। নতুবা অভিশাপ লাভ করবেন। হে প্রজাপতি ব্রহ্মা! আপনি আপনার পুত্রের অভিশাপেও জগতে অপূজ্য হয়ে আছেন। আমার অভিশাপে জগতের ওপর থেকে আপনার অধিকার লোপ পাবে। আর শিব ও ধর্ম এবং যমরাজও আমার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে না। জরা ও ব্যাধিতে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়নি। তাহলে তারা নীরব কেন?
মহামতী, পাগলিনী, সাধ্বী মালাবতী স্বামীর মরদেহকে বুকে করে এলেন কৌশিকী নদী তীরে। তিনি দেবতাদের উদ্দেশ্য অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন।
হে শৌনক! তখন দেবতারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। সকলে মিলে ক্ষীর সাগরের তীরে এলেন। বিষ্ণু সমেত সকলে সেই জলে স্নান করে জগদ্বীশ্বর পরমাত্মার স্তব করলেন।
ব্রহ্মা বললেন– হে মাধব! এই সঙ্কট থেকে আমাদের রক্ষা করুন। নিদ্রা, জাগরণে ও সব অবস্থায় আপনি সাধুজনদের সঙ্গ দান করেন। যে আনন্দচিত্তে শ্রীহরির পাদপুজো করে সে সকল বিপদ থেকে আপনার কৃপায় পরিত্রাণ পায়। তাই আপনার দ্বারস্থ হয়েছি আমরা। আমাদের প্রতি দয়াপরবশ হোন। হে প্রভু, যে সম্পদ আপনার কাছ থেকে প্রাপ্ত হয়েছি আজ তা চিত্ররথের কন্যা ও উপবহনের পত্নীর অভিশাপে হাতছাড়া হতে বসেছে।
মহাদেব বললেন– হে প্রভু আপনার কাছ থেকে লাভ করা সমস্ত দুর্লভ ও অত্যন্ত গোপনীয় মহাজ্ঞান আজ ওই মহিলার অভিশাপে নষ্ট হতে বসেছে। সমস্ত তেজ থেকে শ্রেষ্ঠ এই পতিব্রতার তেজ যার আগুনে আমি দগ্ধ হচ্ছি। আপনি আমাদের রক্ষাকর্তা, দয়া করে ওই নারীকে শান্ত করুন।
ধর্ম বললেন– হে শ্রীহরি। সমস্ত রত্নের শ্রেষ্ঠ সনাতন ধর্মরূপ রত্ন আপনি আমাকে দান। করেছিলেন, তা আজ নষ্ট হতে বসেছে। সপ্তমন্বন্তর কাল ব্যাপী তপস্যার ফলে যে ধর্ম আমি অর্জন করেছি তা এক নারীর অভিশাপে বিনষ্ট হবে। তা কী করে সহ্য করব?
সমস্ত দেবতারা সমস্বরে বললেন– হে গোবিন্দ, আপনার বরে আমরা যজ্ঞাংশ ভাগী হতে পেরেছি, ঘৃত ভোজনের অধিকার লাভ করেছি। সেই অধিকার আজ বিপদগ্রস্ত, আপনি আমাদের রক্ষা করুন।
দেবতারা সকলে সেখানে নীরবে অবস্থান করতে লাগলেন। হঠাৎ শোনা গেল আকাশবাণী: ওহে দেবতাগণ! তোমরা সকলে সেই নারী মালাবতীর কাছে গিয়ে অবস্থান করো। আমি তোমাদের শান্তি ও রক্ষার ব্যবস্থা করছি। জনার্দনকে পাঠাচ্ছি, সে ব্রাহ্মণবেশে সেখানে হাজির হবে।
দেবতারা আনন্দিত চিত্তে কৌশিকী নদীর তীরে এসে উপনীত হলেন। সাধ্বী মালাবতীর পরণে তখন আগুনরঙা বিশুদ্ধ বস্ত্র, কপালে সিন্দুরের টিপ শোভা পাচ্ছে। অঙ্গ নানা অলঙ্কারে সজ্জিত। তার উজ্জ্বলতা শরৎকালের চাঁদকেও হার মানায়। তার দেহ সুষমায় চারদিক উদ্ভাসিত।
দীর্ঘকাল ধরে তিনি পতির সেবা করছেন। সেই পুণ্য মহান ধর্মের সঞ্চিত তেজে শরীর যেন জ্বলন্ত আগুন শিখা। যোগাসনে বসে মালাবতী বুকে আগলে রেখেছেন স্বামীর মরদেহ। তাঁর ডান হাতে স্বামীর বীণাখানি এবং স্ফটিকের মালা তর্জনী অঙ্গুষ্ঠার মাথায় ধরে আছেন। প্রিয়তম পতির মুখোনি তিনি বারবার অবলোকন করেছেন। ধর্মভীরু দেবতারা এ দৃশ্য দেখলেন এবং বিস্মিত হলেন।
সৌতি বলতে থাকলেন- হে মুনি, শিব ও ব্রহ্মা সমেত অন্যান্য দেবগণ মালাবতীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। মালাবতী তাদের ভক্তি সহকারে প্রণাম জানালেন। মৃত স্বামীকে তাঁদের পায়ের কাছে রেখে বিলাপ করতে শুরু করলেন।
সেখানে এমন সময় লাঠি, ছত্রধারী, শ্বেতবসনা এক বালকের আবির্ভাব ঘটল। তার কপালে টিপটিপ জুলজুল করেছে। তার হাতে একটি মস্ত বড়ো বই। চন্দন চর্চিত দেহখানি ব্রহ্মাজ্ঞ সম্মুজ্জ্বল। সেই বিচক্ষণ বালক দেবতাদের মাঝখানে উপবেশন করলেন। ঠিক যেন, নক্ষত্র মাঝে চাঁদের আবির্ভাব। তিনি প্রত্যেক দেবতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন– এখানে আপনাদের আগমনের কারণ কী? জগতের সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ব্রহ্মা কেন এখানে পাদপদ্ম রচনা করেছেন?
শঙ্করই বা কী জন্য এখানে আবির্ভূত হয়েছেন? ত্রিভুবনের সমস্ত কাজের হিসাব রাখেন যিনি, সেই ধর্মকেও এখানে দেখতে পারছি। সূর্য দেব চন্দ্র, অগ্নি, কাল, সূত্যু কন্যা ও যম আপনারা কেন এখানে এসেছেন? তারপর মালাবতীর দিকে তাকিয়ে সেই বালক বললেন–মালাবতী, তুমি কার শুকনো মরদেহ বুকে আগলে আছ? জীবিত স্ত্রীর কোলে এই শবদেহ মানায় না।
মালাবতী সেই বালক ব্রাহ্মণকে প্রণাম জানালেন। বললেন– হে ব্রাহ্মণরূপী জনার্দন! আমি এক শোক পীড়িতা নারী। আমি চিত্ররসের কন্যা, গন্ধর্বরাজ উপবর্হন আমার স্বামী। আমি মালাবতী, হে। শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ, সতী নারীর পতির প্রতি কী ধরনের স্নেহ থাকে, তা আশাকরি আপনার অজানা নয়। ব্রহ্মার শাপে হঠাৎ আমার স্বামীর মৃত্যু হয়। আমি তাই শোকবিহ্বল হয়ে পড়েছি। দেবতাদের কাছে নিবেদন জানাচ্ছি তারা যেন আমার স্বামীর দেহে প্রাণ সঞ্চার করেন। কিন্তু আমার এই হাহাকার এই শোক ক্রন্দন কারও কানে পৌঁচচ্ছে না।
সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত, স্বার্থপরের দুঃখ শোনার মতো সময় কোথায় তাদের। সুখ, দুঃখ, ভয়, শোক সন্তাপ, ঐশ্বর্য, জন্ম, মৃত্যু সবই সৃষ্টি করেছেন দেবতারা। তারা সকলে কর্মানুসারে বর দান করেন। কর্মরূপ বৃক্ষের মূল তারা ইচ্ছেমতো তুলে ফেলতে পারেন। দেবতারা হলেন শ্রেষ্ঠ দয়ালু ও দাতা, তাদের ওপরে আর কেউ নেই। দেবতারা হলেন কল্পবৃক্ষ। তাদের কাছে যা প্রার্থনা করা যায়, তাই পাওয়া যায়। আমার মনোবাঞ্ছা পূরণে যদি তারা অপরাগ হন, তাহলে আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন তারা। তাদের আমি অভিশাপ দেব, যা নিবারণ করার ক্ষমতা দেবতাদের নেই।
হে শৌণক! সেই ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ জনার্দন বললেন– হে মালাবতী। দেবতারা ফলদাতা একথা অস্বীকার করি না। তবে ফল দানের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়, ঠিক যেমন বীজ বোনার সঙ্গে ধান পাওয়া যায় না। এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই ভারতের মাটিতে পুণ্যবান জনেরা দীর্ঘকাল তপস্যা করার পরে কর্মফল লাভ করে। তাই বল, সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য, ধন, স্ত্রী, পুত্র, পতি কোনো কিছুই তপস্যার তুল্য নয়। মহাত্মা জ্ঞানানন্দ, মঙ্গল পরমেশ্বর মৃত্যুঞ্জয় শিবকে যে পুরুষ বা নারী ভক্তি ভরে ভজনা করে সে সতীস্ত্রী বা সৎ পতি লাভ করে। ভোলা মহেশ্বর তাকে জ্ঞান, বিদ্যা, পুত্র, সংসার, ঐশ্বর্য, বল ও বিক্রম দান করেন। ব্রহ্মাকে প্রীত করতে পারলে শ্রী বিদ্যা, ঐশ্বর্য, আনন্দ ইত্যাদি লাভ করা যায়। দীননাথ সূর্যের উপাসনা ভক্তি ভরে করলে বিদ্যা, আরোগ্য, ধন, পুত্র লাভ হয়। সমস্ত দেবতাকে পুজো করার আগে যে দুর্গা-নন্দন গণেশের আরাধনা করে সে স্বপ্নে ও জাগরণে সমস্ত রকমের বিঘ্নের বিনাশ ঘটাতে পারে। সুরেশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে পারলে সমস্ত অভীপ্সা পূর্ণ হয়। তার নিষ্কাম মোক্ষলাভ হয়। মূর্খ লোক বিষ্ণুর পুজো দিয়ে বর প্রার্থনা করে সে বিষ্ণুর মোক্ষ মায়ায় আচ্ছন্ন হয়, কিন্তু নারায়ণী তাঁকে বিষ্ণুমন্ত্র দান করে কৃতার্থ করেন।
ধার্মিক ব্যক্তি ধর্মের ভজনা করে সকল ধর্মকে জয় করে। সেই ব্যক্তির ইহলোকে গমন হয়, এবং বিষ্ণুঃসঙ্গ লাভ করে। আগে যে দেবতাকে পুজো করে তুষ্ট করা যায় সেই দেবতার অপার করুণা তার ওপর বর্ষিত হয়। কিন্তু নির্গুণ লোক প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে ভজনা করে সে জীবন্মুক্ত। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর যে ভগবানকে আরাধনা করেন, তিনি সকলের পূজনীয়, তিনি অক্ষয়। পরম ব্রহ্মা তার কোনো আকার নেই, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি পরমানন্দ।
হে মালাবতী! কৃষ্ণভক্তের কাছে মুক্তি, ব্রহ্মত্ব, অমরত্ব ও নির্বাণ মোক্ষ মূল্যহীন। তার কাছে। ধনসম্পদ মাটির ডেলা ছাড়া আর কিছু নয়। সেই ভক্ত সবসময় কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা থাকে সে। শ্রীকৃষ্ণের দাস হতে চায়। সেই সুস্থির ব্যক্তির পুণ্য ফলে নিজের কোটি কুল, মাতার শতকুল এবং শ্বশুরের পূর্বকূল অনায়াসেই উদ্ধার পায়। কৃষ্ণভক্ত গোলোকে গমন করে কৃষ্ণ সেবা করে সে গর্ভ থেকে মুক্তি পায়। তার আগে পর্যন্ত সে যম যন্ত্রণা ভোগ করে। তখন সে হয় সংসারী। ভোগ বাসনা করে। গুরু যার কানে বিষ্ণুমন্ত্র উচ্চারণ করেন, যমরাজ ভীত হয়ে তার ললাট লিখন পালটে দেন।
সেই হরিভক্তের কোটি জন্মের পাপও ধুয়ে মুছে যায়। তার যত পুরোনো ভালোমন্দ কর্ম সব শ্রীকৃষ্ণের চক্রের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। ওই চক্রের ভয়ে জরা ও মৃত্যু ওই কৃষ্ণভক্তের কাছ ঘেঁষতে সাহস পায় না। তখন সেই ব্যক্তি নির্ভয় নিজের মানবদেহ ত্যাগ করে গোলোকে গমন করে। সেখানে গিয়ে দিব্য দেহ ধারণ করে এবং মনপ্রাণ কৃষ্ণ সেবায় সঁপে দেয়। গোলোকে কৃষ্ণ যতদিন অবস্থান করবেন ওই হরিভক্ত ততদিন সেখানে থাকতে পারবেন।
জনার্দন বলতে থাকেন– ও হে সাধ্বী নারী! তুমি কী জানো, কোন ব্যাধিতে তোমার স্বামী মারা গেছে? আমি একজন চিকিৎসক। রোগে মৃত বা মৃতের ন্যায় যে কোনো লোককে আমি ব্যাধি মুক্ত করতে পারি। কোন কোন কারণে মানুষের শরীর রোগক্রান্ত হয়। তাও আমার অজানা নয়। যে লোক যোগ বলে বা দুঃখ শোকে প্রাণ হারায় তাকে আমি যোগধর্মের সাহায্যে বাঁচিয়ে তুলতে পারি।
ব্রাহ্মণরূপী জনার্দনের এসব কথা শুনে মালাবতী অত্যন্ত খুশী হলেন। বললেন– সত্যি, আজ আমি ধন্য হলাম। দেখতে বালকের ন্যায়। অথচ জ্ঞান দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যাচ্ছি। আপনি আমার স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে দেবার প্রতিজ্ঞা করেছেন। আমি ধরেই নিতে পারি, তিনি আবার বেঁচে উঠেছেন।
কারণ সৎ ব্যক্তি কখনও কথার খেলাপ করেন না। হে শ্রেষ্ঠ, বৈদজ্ঞ পুরুষ আমি জানি, আপনি আমার স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে দেবেন। তবুও কয়েকটা প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দিচ্ছে। এখানে যেসব দেবতারা উপস্থিত আছেন, আপনার মতো শ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ পুরুষ আছেন, কিন্তু আপনারা কেউই আমার নিয়ন্তা নন।
স্বামীই স্ত্রীকে রক্ষা করে আবার শাস্তি দেয়– এক্ষেত্রে কেউ বাধা দান করতে পারে না। নারীদের কাছে স্বামীই কর্তা, পরম অভীষ্ট, দেবতা ইন্দ্র, ব্রহ্মা বা রুদ্রের থেকেও স্বামী হয় পূজনীয়। সদবংশ জাতা কন্যা পতির বশে থাকে, কিন্তু নীচবংশে যে নারীর জন্ম হয় সে সর্বদা পরপুরুষাভিমুখী হয়, সে হয় কুলটা এবং স্বেচ্ছাচারী। স্বামী নিন্দায় তারা সর্বদা মুখর থাকে।
হে ব্রাহ্মণ! আমার প্রথম পরিচয় আমি উপবনের ঘরণী। চিত্ররথ আমার পিতা, গন্ধর্বরাজ আমার শ্বশুর। আমি একজন পতিভক্তা নারী। হে বেদজ্ঞ! আপনার ক্ষমতা অসীম। কাল, যম ও মৃত্যুকন্যার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। দয়া করে তাঁদের এই সভায় আনয়ন করুন।
জনার্দন মুহূর্তের মধ্যে সকলকে সেখানে হাজির করলেন। প্রথমে দেখা গেল শ্রেষ্ঠকন্যা মৃত্যুকে, শান্ত, ছয়হাত বিশিষ্টা কালো বর্ণা, গাঢ় রক্তবর্ণ বসনা। সেই ভয়ংকরী রূপধারী দেবীর মুখে স্মিত হাসি। স্বামী মহাকালের বাঁদিকে তিনি অবস্থান করেছেন। তার চৌষট্টি পুত্রকেও তার সঙ্গে দেখা গেল।
ছয় মুখ ষোলোটি হাত, চব্বিশটি চোখ আর ছয়টি পা বিশিষ্ট এক ভয়ংকর মূর্তির দিকে মালাবতী নজর দিলেন। তিনি হলেন মহাকাল। নারায়ণের অংশজাত, গ্রীষ্মের সূর্যের ন্যায় তার তেজ কালো বর্ণের উত্তম লালবস্ত্র পরিহিত। ইনি হলেন সংহারকারী। তিনি ভগবান সনাতন, সকলের নিয়ন্ত্রক তাঁকে খুব সুখী মনে হল কারণ তার ঠোঁটে হাসির টুকরো, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ পরম ব্রহ্মা শ্রী কৃষ্ণের উদ্দেশ্য জপমালা ঘুরিয়ে জপ করছেন।
তারপর এলেন ধর্ম স্বরূপ এবং ধর্মাধর্ম বিচারকারী সনাতন ভগবান যমরাজ। তিনি ও পরমব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণের স্তবে ব্যাপৃত।
মালাবতী সকলকে দেখে খুশি হলেন। তিনি প্রথমে যমরাজের কাছে প্রশ্ন রাখলেন– হে ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ মহাপণ্ডিত যমরাজ! আপনি কি বলতে পারেন, অকালে আমার স্বামীর প্রাণ কেন কেড়ে নিলেন?
যমরাজ জবাবে বললেন–হে সতী সাধ্বী নারী! মৃত্যুর সময় না হলে কেউ কারো প্রাণ কেড়ে নিতে পারে না। ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ দাস আমি। যাদের পরমায়ু শেষ হয়, তারাই ঈশ্বরের মৃত্যুকন্যা ও দুর্দান্ত ব্যাধি, মৃত্যুদেশে প্রেরিত হয়। মৃত্যুকন্যা বিচার করে পরমায়ু শেষকারীকে গ্রহণ করে আমি তাকে অধিকার করি। তাই মৃত্যুকন্যাই তোমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে।
মালাবতী বললেন– হে মৃত্যুকন্যা! স্বামীর শোক যন্ত্রণা যে কী দুঃসহ, তা তোমার অবিদিত নয়, তা হলে তুমি কেন আমার স্বামীকে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করলেন?
মৃত্যুকন্যা বললেন– এই কাজ করার জন্য বিধাতা পুরুষ আমাকে জন্ম দিয়েছেন। কোনো সদবংশজাতা তেজস্বী নারী যদি আমাকে অভিশাপ দিয়ে ভস্ম করে দিতে পারে, তবেই আমি ধ্বংস হব। তাই বলছি হে সুন্দরী! আমি এবং আমার পুত্র ব্যাধি কালের দ্বারা প্রেরিত হয়ে সব কাজ সমাধা করি। আমাদের কোনো দোষ নেই।
মালাবতী এবার ধর্ম মহাত্মা কালের কাছে প্রশ্ন রাখলেন– হে ভগবান মহাকাল! আপনি সমস্ত কাজের সাক্ষী। সমস্ত কর্মের নিয়ন্তা আপনি, নারায়ণের অংশরূপ, আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। আপনি সর্বজ্ঞ, তাই আমার দুঃখের কারণ আপনার অজানা নয়। বলুন কেন আপনি আমার পতির প্রাণ কেড়ে নিলেন।
মহাকাল বললেন– হে সতী তুমি ভুল করছ, এই বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি কর্তাই আসল মালিক।
আমরা কে? আমরা তাঁর আজ্ঞাবহ দাস মাত্র। যার ভয়ে বায়ু বয়, সূর্য আলো দেয়, যাঁর আজ্ঞায় ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, যাঁর শাসনে ভগবান শিব সমস্ত জগত সংসার ধ্বংস করেন, ধর্ম যার আজ্ঞা পালন করেন, সমস্ত কাজের সাক্ষী থাকেন, যার আজ্ঞায় রাশি চক্র ও গ্রহগুলি আপন কাজ করে চলেছে, যার ভয়ে ক্ষমাবতী পৃথিবী মাঝে মাঝে আন্দোলিত হয়, এমনকি প্রকৃতি দেবীও তার ভয়ে মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠেন, যার আজ্ঞায় পৃথিবীতে জল গাছপালা, পাহাড়, পর্বত ইত্যাদির সৃষ্টি হয়েছে, বেদ পুরাণাদি সমস্ত যার স্তুতি বন্দনা করে, যিনি পরাৎপর, যিনি মৃত্যুরও মৃত্যু, যিনি কালের কাল সেই সমস্ত বিঘ্ন নাশকারী সৃষ্টিকর্তা শ্রীকৃষ্ণের পুজো করো।
তিনি কৃপার সাগর। তিনি তার ভক্তের সকল অভীষ্ট পূরণ করেন।
কালপুরুষের কথা শেষ হলে ব্রাহ্মণরূপী জনার্দন বললেন– হে শুভাকন্যা! তুমি কি আর কোন প্রশ্ন করতে চাও? মালাবতী আনন্দিত চিত্তে বললেন– হ্যাঁ, আপনি এমন উপায়ের কথা বলুন, যার সাহায্যে প্রাণীরা অমঙ্গলকর প্রাণনাশকারী ব্যাধির হাত থেকে রেহাই পায়। আপনি দয়া করে এর ব্যাখ্যা বিস্তৃত করুন।
ব্রাহ্মণবেশী নারায়ণ বৈদিকী সংহিতা ও সংহিতার্থ বলতে শুরু করলেন। যিনি বেদ ও বেদাঙ্গের বীজের বীজ স্বরূপ সেই শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম নিবেদন করি, সেই পরমেশ্বরকে বন্দনা করি যিনি সকল মঙ্গলের মঙ্গলকর বীজ স্বরূপ। মঙ্গলের কেন্দ্ররূপ হল চারটি বেদঋক, সাম, যজুর ও অথর্ব। প্রজাপতি ব্রহ্মা আয়ুর্বেদ নামে আর একটি বেদের সৃষ্টি করেছেন। সেই পঞ্চম বেদ সূর্যদেবতাকে ব্রহ্মা উপহার হিসেবে দিলেন। অথর্ববেদ থেকে সূর্যদেব সংহিতা নামে আর একটি বেদ রচনা করে শিষ্যদের মধ্যে দান করলেন। শিষ্যরা তাদের সংহিতা শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে এক-একটি সংহিতার জন্ম দিলেন।
ষোলজন ব্যাধিনাশক বৈদ্য হলেন–ধন্বন্তরি, দিবোদাস, কপিরাজ, অশ্বিনীর দুই পুত্র নকুল, সহদেব, যমরাজ, চ্যবন, জনক, বুধ, জাবাল, জাজলি পৈল, করথ ও অগস্ত্য। এঁরা বেদ ও বেদাঙ্গ শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ বিশারদ। এঁরা প্রত্যেকেই চিকিৎসা সম্পর্কীয় গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ধন্বন্তরি চিকিৎসাতত্ত্ব বিজ্ঞান দিবোদাস–চিকিৎসা দর্পণ, কাশিরাজ–চিকিৎসা কৌমুদী, অশ্বিনী পুত্রদ্বয় চিকিৎসাসার তন্ত্র। নকুল–বৈদ্যক সর্বস্ব, সহদেব-ব্যাধিসিন্ধুবিমর্দন যমরাজ-জ্ঞানার্নব। চ্যবণ–জীবদান। জনক–বৈদ্যসন্দেহ ভঞ্জন। চন্দ্র পুত্র বুধ– সর্বসার, জাবাল-তন্ত্রসার। জাজলি-বেদঙ্গসার। পৈল-নিদান করথ-সর্বধর এবং অগস্ত্য মুনি দ্বৈধনির্ণয়তন্ত্র নামে তন্ত্র রচনা করেন। গ্রন্থে রোগদূর করার মূল কারণ ও শক্তি সঞ্চয়ের বিধান দেওয়া আছে।
হে সুন্দরী! বৈদ্য কেবল আযুর্বেদশাস্ত্র জানে, চিকিৎসা ব্যাপারে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, বৈদ্যত্বই তার পরিচয়। কিন্তু আয়ুদান করার ক্ষমতা তার নেই। রোগের উৎপত্তির মূল কারণ জ্বর। তিনটি পা, তিনটি মাথা, ছয়টি হাত এবং নয়টি চোখ বিশিষ্ট ভয়ংকররূপী জ্বর ভস্মরূপ অস্ত্র ধারণ করে আছে। কালান্তক যমের সমান এই জ্বর, এই শিবভক্ত এবং যোগী জ্বর জন্ম লাভ করে মন্দাগ্নি থেকে। শ্লেখা, পিত্ত ও বায়ু হল মন্দাগ্নির জন্মদাতা। বায়ুজ, পিত্তজ, শ্লেষ্মজ ও ত্রিদোষজ এই জ্বরের চারটি প্রকার।
হে মালাবতী! ব্যাধির ৬৪ রকম ভেদ আছে– যেমন পান্ডু, কামলা, কুষ্ঠ, শোথ, কাশ, ব্রণ, প্লীহা, শূল, জরা, অতিসার, হলীমক, মূলুকৃচ্ছ, গুল্ম, রক্তদোষ, বিকার বিষমেহ, কুজ, গোদ গলগণ্ডক, ভ্রমরী, গ্রহণী অগ্নিপাত, বিসূচী দারুনী, প্রভৃতি। জরা বাদে এরা সকলেই মৃত্যু কন্যার পুত্র, জরা তার কন্যা। উপায়বেত্তা ও সংযত যারা তাঁদের কাছে ঘেঁষতে এরা ভয় পায়। চোখে জল দিলে, ব্যায়াম করলে, পায়ের নীচে তেল দিলে, দুই কানে ও মাথায় তেল দিলে জ্বরা ও ব্যাধির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বসন্তকালে ভ্রমণ করে যে অল্প পরিমানে অগ্নিসেবা এবং যথা সময়ে যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, জরা তার থেকে দূরে থাকে।
খিদে পেলে যে পেট ভরে আহার করে, জল পান করে তেষ্টা মেটায়, প্রতিদিন পান খায়, সেই লোকের ধারেকাছে জরা এগোয় না। শীতকালে গরম জামাকাপড় পরলে, অল্প গরম খাবার খেলে, অল্প গরম জলে স্নান করলে জরাকে জয় করা যায়। যে লোক সংযোগী প্রতিদিন, দুধ, দই, খই, গুড় খায়, সে লোক জ্বরা দ্বারা আক্রান্ত হয় না। যে লোক হেমন্তকালে ঘরের জলে স্নান করে, আগুন পোহায়, অল্প গরম নবান্ন খায় সে জরাগ্রস্ত হয় না।
যে লোক বৃষ্টির জলে স্নান করে না, প্রতিদিন রুটিনমাফিক ভোজন করে তার কাছ থেকে জরা অনেক দূরে থাকে। যে লোক সদ্য মাংস ও নতুন ভাত খায়, যুবতীর সেবা করা দুধ, ঘি খায়, জরা তার কাছে যেতে ভয় পায়। যে লোক খাতের ঠান্ডা জলে স্নান করে, গায়ে চন্দন লেপন করে এবং গ্রীষ্মকালে মুক্ত বায়ু গ্রহণ করে তার জুরা ব্যাধি হয় না।
ওহে সতী নারী! যে লোক রাতের বেলায় দই খায়, কুলটা ও রজঃস্বলা স্ত্রীর কাছে যায়, জরা এবং তার ব্যাধি ভাইরা তার কাছে গিয়ে হাজির হয়। রজঃস্বলা, কুলটা, সবীরা, জার, দুতিকা, শূদ্রযাজকপত্নী ও ঋতুহীনা নারীর কাছ থেকে অন্ন খেলে যে পাপ হয় তা ব্রহ্মা হত্যার সমান। এইসব লোক খুব শীঘ্র জুরা দ্বারা আক্রান্ত হয়। ব্যাধি, জরা, দৈন্যতা, দুঃখ, শোক–সব কিছুর মূলে আছে পাপ, যে সর্বদা বর্ণ মেনে চলে, ব্রত ও উপবাস পালন করে, তীর্থে ভ্রমণ করে, গুরু, দেবতা ও অতিথির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, যে হরির সেবা করে সে তোক জরা এবং ব্যাধিগুলিকে জয় করতে পারে। তবে এসবই একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত। সময় হলে সবই ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে।
হে নারী! এবার শোনো, রোগ কী ভাবে প্রাণীদেহে সংক্রমিত হয় তার কথা, প্রথমে পিত্ত সৃষ্টির কারণগুলি সম্পর্কে বলছি, তাল ও বেল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি জল পান করা হয় তাহলে পিত্তের সৃষ্টি হয়। প্রচন্ড খিদের সময় খাবার না খেলে পিত্ত দেখা দেয়। শরঙ্কালে গরম জল ও ভাদ্র মাসে তেঁতো রস পান করার ফলে পিত্ত দেখা দেয়। ঠান্ডা চিনির জলে ধনের গুঁড়ো, ছোলা এবং দই ও ঘোল ছাড়া অন্যান্য সব রকম গব্য, পাকা বেল ও তাল, আখের রস থেকে তৈরি সবরকমের খাবার। আদা, মুগকলায় জুস, চিনি মেশানো তিলের গুঁড়ো এসব বস্তু পিত্ত নাশ করে, পুষ্টি ও বল বৃদ্ধির সহায়ক হয়।
এবার শ্লেষ্মর কারণগুলি বলছি। তেষ্টা না পেলেও জল পান করা, আহারের পরে স্নান করা, বাসি খাবার, পাকা কলা, পাকা তরমুজ খেলে, অত্যন্ত ঠান্ডা জল, বৃষ্টির জল, চিনির জল, নারকেলের জল পান করলে, তিল তেল, ঠান্ডা তেল ব্যবহার করলে, বর্ষাকালে জলে স্নান করলে শ্লেষ্মা আক্রমণ করে। ব্রহ্মর চক্র শ্লেষ্মর উৎপত্তি স্থল। শ্লেষ্মর দ্বারা আক্রান্ত হলে দেহের শক্তি কমে যায়। শ্লেষ্ম বিনাশকারী হিসেবে শুকনো ও পাকা হরতকী, ঘি মেশানো হলুদের গুঁড়ো। ঘি মেশানো শুকনো চিনি, পিপুল, শুকনো আদা, জীবক, কাঁচকলা ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারো। এর ফলে বল ও পুষ্টিলাভ হয়।
আহারের পরেই ছুটোছুটি করা বা দৌড়ানো, আগুনের তাপ গ্রহণ করলে, ঘুরে বেড়ালে, যখন তখন স্ত্রী সম্ভোগ, বৃদ্ধা স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস, অত্যন্ত শুকনো কোনো কিছু খেলে, ঝগড়া করলে, খারাপ কথা বললে, ভয় ও শোক পেলে বায়ুর উৎপত্তি হয়। আজ্ঞাচক্রে এর জন্ম হয়। বীজ সমেত পাকা কলা, চিনির সরবত, নারকেলের জল, টাটকা তত্ত্ব, মোষের দুধ এবং সেই দুধ থেকে তৈরি দই অথবা চিনি মেশানো দই, বাসি অন্ন, সৌবীর, ঠান্ডা জল, পাকা তেল, বিশুদ্ধ তিলতেল, নারকেল, তাল, মেথি, খেজুর, শীতল জলে স্নান, সুগন্ধ-চন্দন মাখা, স্নিগ্ধ পদ্মপত্রের শয্যায় শয়ন করা, শীতল পাখার বাতাস খাওয়া এইসব বায়ু নাশকারী দ্রব্য।
আমি তোমাকে যেসব ব্যাধির কারণ ও তার বিনাশের কথা বর্ণনা করলাম, এইসব সাধু ব্যক্তিরা নানা তন্ত্রগ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছে। বিচক্ষণ মহাত্মারা যে সমস্ত রোগ ক্ষয়কর তন্ত্রসমূহের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। তুমি কি জানো, কোন রোগ তোমার স্বামীর মৃত্যুর কারণ আমি তাহলে হয়তো একটা উপায় বলতে পারি। যার সাহায্যে তুমি তোমার জীবন্ত স্বামীকে ফিরে পেতে পারো।
উপবর্হন ঘরণী বললেন–আমার স্বামী ব্রহ্মার অভিশাপে লজ্জা ও সঙ্কোচ নিয়ে যোগবলে প্রাণত্যাগ করছেন। আপনি এতক্ষণ যে মনোহর উপাখ্যান শোনালেন, তাতে বুঝলাম, বিপদ ব্যতীত কারোরই কোনো মঙ্গল হয় না। হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, তাই বলছি, আপনি অনুগ্রহ করে আমার প্রাণাধিক পতির দেহে প্রাণ সঞ্চার করুন। আমি আপনাদের প্রণাম করে আনন্দিত চিত্তে নিজগৃহে গমন করি।
.
সৌতি বলতে থাকলেন– এই কথা শুনে ব্রাহ্মণরূপী শ্রীকৃষ্ণ অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। ব্রাহ্মণ সমস্ত দেবতাদের সম্বোধন করে মধুর ভাষায় প্রাণীদের হিতকর এই সত্য কথা শোনালেন।
ব্রাহ্মণ বললেন– উপর্বহনের ভার্য্যা ও চিত্ররথের কন্যা পতিশোকে কাতর হয়ে স্বামীর প্রাণভিক্ষা করেছে। এই অবস্থায় আমার কী করা উচিত, আপনারাই তার বিধান দিন। ওই সতীসাধ্বী রমণী আপনাদের অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে আমিই তাঁকে নানা কথা বলে শান্ত করেছি। আপনারা শ্রীহরির দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আপনাদের বিপদ থেকে কেন রক্ষা করতে এলেন না। কেবল দৈববাণী শোনলেন– তোমাদের শান্তির ব্যবস্থা করাচ্ছি। এইসব কি কেবল কথার কথা।
জগদগুরু ব্রহ্মা বললেন–সেই চরম সত্য কথা– আমার পুত্র নারদ আমরাই অভিশাপে উপবর্হন নামধারী গন্ধর্ব রূপে জন্ম নিয়েছিলেন। আমিই তাকে যোগবলে দেহত্যাগ করার শাপ দিয়েছি। সে লক্ষ যুগ ধরে পৃথিবীতে থাকবে। তারপর শূদ্র যোনিতে জন্ম দেব। তারপর আমি আমার পুত্র হিসেবে তাকে গ্রহণ করব। সেই নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হতে এখনও হাজার বছর বাকি। বিষ্ণুর কৃপায় আমি তার জীবন ফিরিয়ে দেব।
কোনো অভিশাপ তাকে যাতে স্পর্শ করতে না পারে তারও উপায় এবার করব। হে ব্রাহ্মণ! আপনার কথা ধরেই বলছি, শ্রীহরির পাদস্পর্শ এখানে পড়েছে। তিনি এখানে উপস্থিত, অথচ আমরা তাকে কেউ দেখতে পারছি না। কারণ তিনি নিরাকার। নিরাকারের কোনো অবয়ব হয় না। ভক্তদের প্রতি দয়া করে সেই পরম ব্রহ্ম নিজ মূর্তি ধারণ করেন। তিনি সর্বদ্রষ্টা, তিনি সর্বজ্ঞানী, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, ‘বি’ ওষ ব্যাপ্তি এবং ‘ণু হল সর্বত্র কাজে বোঝায় অর্থাৎ, বিষ্ণু সেবা করলে দেহ ও মন পরিশুদ্ধি লাভ করে।
হে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ! অসম্পূর্ণ কাজ বিষ্ণুর অনুগ্রহে সম্পূর্ণতা লাভ করে। তার আজ্ঞায় আমি জগতের সৃষ্টিকর্তা হয়েছি। মহাদেব সংহারকর্তা আর ধর্ম সমস্ত কাজের সাক্ষী। যার আদেশে ভীত হয়ে মহাকাল সমস্ত লোককে সংহার করেন, যমরাজ সকলকে শাস্তি দেন আর মৃত্যু তাকে গ্রাস করে। যে প্রকৃতি সকলের মূল, সকলের জননী, সকলের ঈশ্বরী, তিনিও তাঁর আজ্ঞা পালনের জন্য তটস্থ থাকেন। সেই পরম পুরুষের কথা আপনি জানেন নি?
শিব বললেন– হে ব্রাহ্মণ, আপনার পরিচয় কী? কোন বংশে জাত? মুনি, আপনার গুরু কে? পরমাত্মা দেহত্যাগ করলে সে দেহ শূন্য হয়ে পড়ে থাকে। সেই পরমাত্মার পেছন পেছন যায় জীবাত্মা, মন, জ্ঞান, চেতনা, প্রাণ, ইন্দ্রিয় সব কিছু শক্তি সর্বদা অনুসারী ঈশ্বর হয়। কারণ এসব শক্তি তারই আজ্ঞা পালনকারী মাত্র। পরমাত্মাবিহীন দেহ অস্পৃশ্য ও ত্যাজ্য হয়। সেই মহান শক্তিধরকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। যুগ যুগ ধরে শ্রীহরির আজ্ঞা অনুসারে ব্রহ্মা সৃষ্টি করে চলেছে। শ্রীচরণ কমল সব সময় ধ্যান করেন, সেই ব্রহ্মা কখনও তার দর্শন লাভ করতে পারেনি।
আমি শিব, সর্বদা তার শ্রীচরণ বন্দনা করে চলেছি। তবুও আশ মেটে না, পাঁচ মুখে তার নাম গান করি বলেই মৃত্যু আমায় গ্রাস করতে পারে না। যে লোক সর্বদা হরিনাম সংকীর্তন করে তাকে মৃত্যু স্পর্শ করতে পারে না। অনন্তকাল ধরে তপস্যা ও তার নাম জপ করার পুণ্যফলে আমি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সংহারকারী হতে পেরেছি। আগুন ও স্ফুলিঙ্গের মধ্যে যেমন কোনো পার্থক্য থাকে না, সেই রকমই তাঁর এবং আমাদের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। গোলকে, বৈকুণ্ঠে, শেতদ্বীপে একাই তিনি বিরাজ করছেন। আমি এবং অন্যান্য ঋষিগণ সেই পরামাত্মা শ্রীকৃষ্ণের অংশ মাত্র। তার মহিমার কথা বলে শেষ করা যায় না।
সৌত বললেন– শঙ্করের বলা শেষ হলে ধর্ম কৃষ্ণের মাহাত্ম শোনাতে মুখর হলেন। তিনি বললেন– হে ব্রাহ্মণ! তোমার প্রশ্ন শুনে আমি হতবাক হয়ে যাচ্ছি। যিনি সকলের অন্তরাত্মা, সাধুজন যাকে সর্বদা প্রত্যক্ষ করে, দুরাত্মাকে যিনি প্রত্যক্ষ করেন না, যিনি সর্বত্র বিরাজমান, যিনি সবকিছু চোখ দিয়ে দেখছেন তিনি কেন এই দেব সভায় উপস্থিত হননি। সে প্রশ্ন শুনে বুঝতে পারছি মুনিদেরও। মতিভ্রম হয়। কোনো মহাত্মা কোনো সাধুর নিন্দা শোনেন না।
যে নিন্দা শোনে এবং যে নিন্দা করে উভয়েই পাপী সাব্যস্ত হয়। কুম্ভী পাক নরকে গমন করে। যদি বা কোনো ব্যক্তি কোনো মহাত্মার নিন্দার কথা শ্রবণ করেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিষ্ণুর জপ করেন। তার সমস্ত পাপ নাশ হয়। যে ইচ্ছাতে অথবা অনিচ্ছাতে শ্রীবিষ্ণুর নিন্দা করে বা শোনে সে ব্রহ্মা যতদিন অক্ষয় থাকবেন, ততদিন কুম্ভীপাকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। ত্রিজগতে বিষ্ণু ও গুরু সকলের পিতা। তারা জ্ঞান দান করেন, পালন করেন, নির্ভয়ী করেন, বর দান করেন।
ব্রাহ্মণ শ্ৰেষ্ঠ তখন শিব ও ধর্মের কথা শুনে হেসে উঠলেন। বললেন– হে ধার্মিক দেবতাগণ, আমি তো একবারও বিষ্ণু নিন্দা করিনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম যে আকাশবাণী অনুযায়ী তার এখানে পদার্পণ হয়নি। অর্থাৎ দৈববাণী মিথ্যে। আপনাদের কাছে একটা প্রশ্ন করি আপনারাই বলেছেন, শ্রীবিষ্ণু সর্বত্র বিরাজমান, তাহলে কেন নিজেদের বাঁচানোর জন্য দেবলোক ছেড়ে শতদ্বীপে হাজির হয়েছিলেন।
পরমাত্মার অংশ ও অংশীর মধ্যে কোনো ভেদ যদি নাই থাকে, তাহলে সাধুজনেরা কলা পরিত্যাগ করে পূর্ণতমের সেবা করেন। বামন যেমন চাঁদকে মুঠোবন্দি করার জন্য প্রয়াস চালিয়ে যায় তেমনই ক্ষুদ্র, অক্ষুদ্র সকলেই মহান পদ লাভে আগ্রহী। আপনারা দেবতারা যে বিশ্বে অবস্থান করছেন সেই সুরলোক ও ওই চরাচর সবই প্রতিবিম্বে থাকে। ভক্তদের কৃপা করার জন্য সেই পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণই সকলের ঈশ্বর। সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের একেবারে শীর্ষে বৈকুণ্ঠধাম। সেই ধাম থেকে গোলকধাম আরও পঞ্চাশ কোটি যোজন উঁচুতে অবস্থিত। যেখানে স্বয়ং চতুর্ভুজ নারায়ণ তার প্রিয় লক্ষ্মীদেবীকে নিয়ে বিরাজ করছেন।
ইনি পরিপূর্ণতম ও সমস্ত দেহধারী জীবদের আত্মা। তিনিই রাসমণ্ডলে ইচ্ছেমতো রূপ গ্রহণ করে অবস্থান করেন। সাধুজনেরা সব সময় সেই উজ্জ্বল নিরাময় মণ্ডলাকার জ্যোতির ধ্যানে নিমগ্ন। সেই শ্রীকৃষ্ণ পীত বসনধারী, তিনি কামদেবের ন্যায় লাবণ্য বিশিষ্ট, তিনি কিশোর ও মনোহর, সেই ঈশ্বর সত্যাবিগ্রহের ধ্যান ও সেবা মহান ব্যক্তিরা করে। আপনারা বৈষ্ণব, আমার বংশ পরিচয়, নাম ধাম জানতে চেয়ে ছিলেন, এখন আর সে সব প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কে মূর্খ তা বিচারের মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে? হে সুরেশ্বর! হে দেবেশ্বর। এখন শীঘ্র ওই সতী মালাবতীর পতির মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করুন।
সৌত বললেন– হে শৌণক, ব্রাহ্মণের কথা শুনে ব্রহ্মা, শিব এবং অন্যান্য দেবতারা মুগ্ধ হলেন। তারা ওই ব্রাহ্মণের সঙ্গে এলেন শ্বেতদ্বীপে। যেখানে মালাবতী আগলে বসে আছেন তার পতির মরদেহ। ব্রহ্মা কমণ্ডলু থেকে মৃতদেহের ওপর জল ছিটিয়ে দিতেই মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার ঘটল, দেহ হল লাবণ্যময়, শিব দিলেন জ্ঞান, ধর্ম দিলেন ধর্মজ্ঞান, আর ব্রাহ্মণ দান করলেন জীবন।
অগ্নিদেব দিলেন জঠরানল, কামদেব কামনার সঞ্চার ঘটালেন। বায়ুর আবির্ভাবে তার শ্বাসপ্রশ্বাস শুরু হল। সূর্যদেব দিলেন দৃষ্টি শক্তি, বাগদেবী সরস্বতী দান করলেন বাক্য এবং স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর দর্শনে শোভার প্রকাশ ঘটল। এতসব করা সত্ত্বেও সেই দেহ মরার মতো পড়ে রইল। ওঠার ক্ষমতা নেই, অর্থাৎ তখনও পর্যন্ত তার মধ্যে পরমাত্মার প্রবেশ ঘটেনি। তাই সে বোধশক্তি হীন। তখন ব্রহ্মা ওই সতী নারীকে শ্রীবিষ্ণুর বন্দনা করতে বললেন। মালাবতী নদী থেকে স্নান করে এলেন। শুদ্ধ বসন পরিধান করে হাতজোড় করে পরমেশ্বরের স্তব করতে লাগলেন- হে শ্রীকৃষ্ণ, আপনি সমস্ত কারণের কারণস্বরূপ, সব কাজে নির্লিপ্ত থাকেন বটে, কিন্তু সাক্ষী হিসেবে বিরাজ করেন। যার সেবা করে ব্রহ্মা জগতের স্রষ্টা হয়েছেন, স্বয়ং মহাদেব সংহারকর্তা আর শ্রীবিষ্ণু পালনকারী, সেই শ্রীকৃষ্ণের চরণে প্রণাম নিবেদন করছি।
আপনি পরাৎপর, আপনি সাকার আবার নিরাকার, আপনি তপস্বীকে ফলদান করেন। ভক্তদের অনুগ্রহ করার জন্য রূপ ধারণ করেন। কোটি সূর্যের মতো যার উজ্জ্বল ও মণ্ডলাকার তেজ তা অতি কমনীয় এবং অতি মনোহর। যাঁর গায়ের রং নতুন মেঘের মতো শ্যামবর্ণ, যার দুটি ওষ্ঠ পল্লব, যার সর্বঙ্গ চন্দনে সুবাসিত, যিনি কোটি সংখ্যক কামদেবের ন্যায় লাবণ্যময়, যিনি কিশোর, শান্ত এবং অক্ষয়। যিনি গোপনীদের সঙ্গে নির্জন স্থানে বিহার করেন। বৃন্দাবনে গোপবালকদের সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠেন, আমি সেই শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করি। যিনি কখনও নিজের অংশরূপে জগতকে পালন করার জন্য বিষ্ণুরূপ ধারণ করে শ্বেত-দ্বীপে পদ্মার সেবা গ্রহণ করেন। যিনি নিজের অংশে মঙ্গলরূপী মঙ্গল দান করেন। যিনি নিজের ষোলো ভাগের এক ভাগ দিয়ে বিরাটাকার প্রাপ্ত হয়েছেন। যিনি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনকারী, যিনি বারে বারে নিজের অংশে সৃষ্ট বিভিন্ন অবতার রূপে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন, যিনি যোগীদের মধ্যে বাস করেন, আবার সাধুদের মধ্যে বাস করেন, আবার সাধুদের মধ্যেও তার দেখা মেলে, সেই নির্গুণ পরমাত্মা পরমেশ্বরকে আমি এক অবলা নারী হয়ে কীভাবে স্তব করব? পঞ্চানন শিব, চুতমুখ ব্রহ্মা, গজমুখ গণেশ, ছয় মুখ কার্তিক এমনকি হাজার সুখের অনন্তদেব যাঁর স্তব করতে অক্ষম, যার স্তব করতে গিয়ে স্বয়ং সরস্বতী বাহিত হয়ে যান, যাঁর স্তব করতে বেদ পর্যন্ত পারে না, সেখানে আমি এই শোককাতরা রমণী তো সামান্য? আমি কীভাবে আপনার স্তুতি করব। আপনার প্রশস্তির সীমা পরিসীমা নেই, আপনি অনন্ত।
গন্ধর্বী মালাবতী চুপ করলেন এবং অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। আর কৃপাসাগর শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য প্রণাম জানালেন। পরমাত্মা নিরাকৃতি শ্রীকৃষ্ণের শক্তির সঙ্গে উপবনের দেহে প্রবেশ করা মাত্র তিনি উঠে দাঁড়ালেন। স্নান সারলেন, বাঁহাতে বীণা তুলে নিলেন, দেবতাদের প্রণাম জানালেন। দেবতারা আনন্দিত হলেন। আকাশ থেকে এই গন্ধর্ব স্বামী-স্ত্রী ওপর বর্ষিত হল পুষ্পসকল।
মালাবতী তার স্বামীকে নিয়ে ফিরে এলেন আপন গৃহে। ব্রাহ্মণ ভোজন করলেন, তাদের দান ধ্যান করলেন। হরিনাম সংকীর্তনে মেতে উঠলেন।
হে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, যে বিষ্ণু ভক্ত এই সম্পূর্ণ স্তব উচ্চারণ করে সে হয় হরিদাস্য। যে আস্তিক লোক পরম ভক্তি ভরে এই স্তব করে তার সকল অভীষ্ট পূরণ হয়। সে ভোগ ও মোক্ষ লাভ করে। আসক্ত ভরে এই স্তব পাঠ করার ফলে পুত্রহীনা পুত্র লাভ করে। নির্ধন ধন পায়। অধার্মিক সুধর্ম লাভ করে। যশপ্রার্থী যশ পায়। রাজ্যহারা রাজা রাজ্য লাভ করে। ব্যাধিগ্রস্ত ব্যাধিমুক্ত হয়। কারাগারে বন্দি থেকে যে শ্রীকৃষ্ণ স্তব করে সে অচিরেই মুক্তি পায়। দাবানলে বা সাগরে ডুবতে ডুবতে এই স্তব করলে প্রাণ সংশয় থাকে না।
.
সুতপুত্র বুললেন– মালাবতী এবার নানা বেশভূষায় নিজেকে সজ্জিত করলেন। স্বামী সেবা ও শুশ্রূষার প্রতি নজর দিলেন। তারা বহু বছর সুখে শান্তিতে কালানিপাত করেছিলেন। বশিষ্ঠ পুস্করতীর্থে শ্রীহরির স্তোত্র, পুজোর বিধান ও একমন্ত্র মালাবর্তী ও উপবর্হনকে দান করেছিলেন। গন্ধর্ব কুমার পুজোর বিধান কৃপাসিন্দু বশিষ্ঠ আবার উপবর্হনকে মনে করিয়ে দিলেন।
বশিষ্ঠদেব মালাবতাঁকে পরমেশ্বর যে স্তব দান করেছিলেন তা হল এইরকম– ষোল অক্ষর যুক্ত মন্ত্র। ওঁ নমো ভগবতে রাসমন্ডলেশায় স্বাহা। এই মন্ত্র পূর্বে গোলকে শ্রীকৃষ্ণ শঙ্করকে শুনিয়ে ছিলেন। কুমারকে পুস্করতীর্থে এই মন্ত্র দিয়েছিলেন। বেদে যে বিষ্ণুর ধ্যানের কথা বলা হয়েছে, তাও শঙ্কর লাভ করেছিলেন। নৈবেদ্য এবং অন্যান্য উপাচার নিবেদন করার সময় মূলমন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। আমি বাবার মুখে ভগবানের অত্যন্ত গোপন এই কবজের কথা শ্রবণ করেছি। পূর্বে গোলকধামে রাসমন্ডলে শ্রীকৃষ্ণ এই কবচ ব্রহ্মা, শঙ্কর ও ধর্মকে দান করে ছিলেন। গঙ্গার তীরে ভোলানাথের কাছ থেকে এই কবচ লাভ করেন, ব্রহ্মা, শিব এবং ধর্ম ব্রহ্মাণ্ডপাবণ নামক কবচের মাহাত্ম্য জানতে চাইলে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন- এই কবচ অত্যন্ত দুর্লভ এবং গোপনীয়। এই কবচের ঋষি হলেন স্বয়ং শ্রীহরি ছন্দ গায়ত্রী আর দেবতা, আমি জগতের প্রভু শ্রীকৃষ্ণ। হে ব্রহ্মা, তুমি এই কবচ গ্রহণ করে ত্রিজগতের স্রষ্টা হও। হে শঙ্কর, তোমাকে এই কবচ দান করলাম। তুমি হও সংহার কর্তা।
তিন লক্ষ বার পাঠঅন্তে এই কবচের গুণে সিদ্ধিলাভ হয়। যে সিদ্ধ কবচ লাভ করবে সে তেজ, সিদ্ধযোগ জ্ঞান ও বিক্রমে আমার সমান হবে। প্রণব আমার মাথা, নমো রামেশ্বর আমার কৃষ্ণ আমার। দুটি কান, হে হরি আমার নাক, কপাল। ‘স্বাহা’ জিহ্বাকে ও শ্রীকৃষ্ণায় স্বাহা এই অক্ষরে গলা, হ্রীং কৃষ্ণায় নমঃ ‘মুখ’ ক্লীংকৃষ্ণায় নমঃ মন্ত্র আমার দুটি হাত রক্ষা করুন। নমো গোপাঙ্গ নেশায় এই আট অক্ষরের মন্ত্র আমার কাঁধ, নমো গোপীশ্বরায় মন্ত্রে দুই পাটি দাঁত আর ঠোঁট দুটিকে রক্ষা করুন।
ষোলো অক্ষর বিশিষ্ট ওঁ নমো ভগবতে রাসমণ্ডলেশায় স্বাহা মন্ত্রে আমার বুক রক্ষা করুন। ওঁ গোবর্ধন ধারণে স্বাহা মন্ত্র উচ্চারণ করে বলতে হয়, হে কৃষ্ণ আমার সমস্ত শরীরকে রক্ষা করুন। পশ্চিমদিকে গোবিন্দ, বায়ু কোণে রাধিকেশ্বর, উত্তর দিকে রাসেশ, এবং ইশাণ কোণে স্বয়ং অচ্যুত আমাকে রক্ষা করুন। পরমাত্মা নারায়ণ আমাকে সর্বত্র ভাবে সবসময় আমাকে রক্ষা করুন।
এই কবচ ধারণ করার নিয়ম সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন–স্নান করে বস্ত্র অলংকার ও চন্দন দ্বারা বিধিমতো গুরুদেবের আরাধনা করবে। গুরুদেবকে প্রণাম জানাবে, কবচকে প্রণাম জানাবে, তারপর কবচ ধারণ করবে। এই কবচের গুণে মনুষ্য জীবনের মুক্তি ঘটে, যে সিদ্ধ কবচ হয়, সে হয় বিষ্ণুতুল্য।
সৌত বললেন– হে শৌণক, ব্রাহ্মণ্ডপাবণ কবচের কথা শুনলেন। এবার বলি শঙ্কর কবচের কথা, যে মন্ত্র বশিষ্ঠ গন্ধর্বকে দান করেছিলেন এই মন্ত্র আগে রাবণ ব্রহ্মার কাছ থেকে লাভ করেছিলেন। মহাদেব আবার বানরাজ ও দুর্বাসা মুনিকে এই কবচ প্রদান করেছিলেন। শিব পুজো করা কালে ধ্যায়েন্নিতাং মহেশ্বং পুস্পার্ঘ্য নিবেদন করার বিধান দেওয়া হয়েছে।
বাণেশ্বর সংসারপাবন কবচের মাহাত্ম শুনতে আগ্রহী হলে মহাদেব বললেন– শোনো বৎস, অতন্ত দুর্লভ ও গোপন এই কবচ তোমাকে দান করছি। প্রজাপতি ছন্দ, গায়ত্রী এবং আমি শঙ্কর এই সংসার পাবন কবচের ঋষি। চতুর্বগ অর্থাৎ ধর্ম, কাম, অর্থ ও মোক্ষ এতে নিয়েজিত। পাঁচ লক্ষবার জপ করলে এই কবচ সিদ্ধ হয়।
সিদ্ধিলাভকারী হয় তেজসম্পন্ন। তপস্যা ও বিক্রমে সে হয় আমার তুল্য। আমার মস্তক হল শম্ভ, মুখ মহেশ্বর, দাঁত নীলকণ্ঠ, অধর হর, কণ্ঠ চন্দ্রচূড়, স্তনদ্বয় বৃষভবাহন, বুক- নীলকণ্ঠ, পিঠ-দিগম্বর এবং সবদিক বিশ্বেশ। আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রক্ষা করুন। ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থায় আমি হলাম স্থাণু। এই কবচ যে ধারণ করে সে সমস্ত তীর্থের সমান পুণ্য সঞ্চয় করে। না জেনে এই কবচ কু লোক পাঠ করলে শত লক্ষ বার সিদ্ধ হতে পারে না। যে সুধী ব্যক্তি ভক্তি সহকারে এই কবচ ধারণ করে সে অনায়াসে ত্রিভুবন জয় করতে পারে।
শঙ্কর প্রদত্ত কবচের বৃত্তান্ত শেষ করে সুত পুত্র বললেন– হে যোগী শ্রেষ্ঠ বানররা কী ভাবে সংসার পাবণ কবচের স্তুতি করেছিলেন তা শুনুন।
বাণরাজ বলেছিলেন–আমি সেই মহাদেবকে প্রণাম জানাই যিনি দেবতা শ্রেষ্ঠ, সুরেশ্বর নীললোহিত, যোগীশ্বর। যিনি জ্ঞান ও আনন্দময়, জ্ঞানস্বরূপ, জ্ঞানের বীজ, সকল তপস্যার ফল ও সকল সম্পদ দান করেন, যিনি তপস্যার বীজ, যিনি মুনিদের ধনস্বরূপ ভোলা মহেশ্বরের বন্দনা করি। তাঁর দেহ হিম, চন্দন, কুন্দফুল, চাঁদ, কুমুদ ও পদ্মফুলের ন্যায় শুভ্র। তিনি ব্রহ্মজ্যোতি স্বরূপ। ভক্তদের তিনি অনুগ্রহ দান করেন এবং নিজের দেহ ধারণ করেন। তিনি বাঘছাল পরিধান করেন, পট্টিশ ও ত্রিশূলধারী মস্তকে অর্ধচন্দ্রকে ধারণ করছেন। তিনি স্মিতহাস্য।
হে মুনি! এই স্তোত্র পূর্বে বশিষ্ঠ গন্ধর্বকে শুনিয়েছিলেন। আপনি এখন আমার কাছ থেকে এই মহাস্তোত্র শ্রবণ করলেন। ভক্তি সহকারে যে জন এই স্তোত্র পাঠ করেন, সমস্ত তীর্থ স্থান যে ফল পাওয়া যায় তার সমান ফললাভ হয়। এই স্তোত্র একবছর ধরে যে শ্রবণ করে সে পুত্র লাভ করে। যে জন গলিত কুষ্ঠ অথবা মহাশূল রোগে আক্রান্ত হয়েছে, সে লোক যদি হবিষ্যান্ন গ্রহণ ও সংযম পালন করে এবং মহাদেবকে প্রণাম করে এক বছর ধরে এই মহাস্তোত্র শ্রবণ করে তাহলে তার রোগ মুক্তি ঘটে।
আস্থা ভরে ধনহারা এই স্তব করলে ধনবতী হয়। রাজ্যহারা রাজ্যলাভ করে। রোগব্যাধি আক্রান্ত ব্যক্তি এক বছর কাল স্তব পাঠ করে শঙ্করকে তুষ্ট করতে পারলে ব্যাধি থেকে মুক্তি পায়। সে লোক বিধিসম্মতভাবে প্রতিদিন জপ করে সে ত্রিজগত জয় করে। গুরুর উপদেশের ন্যায় যে মূর্খ এই স্তোত্র শ্রবণ করে সে বিদ্যা ও বুদ্ধি লাভ করে। কর্মদোষে দুঃখী ও দরিদ্র ব্যক্তি এই স্তবরাজ শুনলে সুখ লাভ করে। প্রত্যহ তিন সন্ধ্যায় এই উৎকৃষ্ট স্তোত্র শুনলে মহাদেবের পার্ষদ পদ লাভ করা যায় এবং শিবলোকে শিবের সঙ্গে অবস্থান করতে পারে।
.
গন্ধর্ব উপবৰ্হন তারপর মালাবতী ও অন্যান্য স্ত্রীদের নিয়ে নির্জন স্থানে রমন করে সময় কাটাতে লাগলেন। তারপর একদিন নিয়তির ডাকে সাড়া দিয়ে গন্ধর্বরাজ ও তার পত্নী সুশীলাদেবী গঙ্গার নির্জন স্থানে প্রাণত্যাগ করলেন। তাঁরা হলেন বৈকুণ্ঠবাসী। গন্ধর্বপুত্ৰ উপবর্হন বাবা মায়ের সন্ধার কার্য শেষ করে ব্রাহ্মণদের ভোজন করালেন। তাঁদের বহু মূল্য সামগ্রী ও সম্পদ দান করলেন। তারপর যথাসময়ে ব্রহ্মার অভিশাপ অনুসারে উপবহনের মৃত্যু হল। তিনি ব্রাহ্মণের বীর্যে শূদ্রানীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন। এ জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে আমি পরে বলছি। তার আগে মালাবতীর কথা শুনুন।
সতী মালাবতী পুষ্করতীর্থে ব্রহ্মার যজ্ঞকুণ্ডে নিজের বাঞ্ছিত কামনা করে প্রাণত্যাগ করলেন। তারপর তিনি অনুবংশজাত রাজা সৃঞ্জয়ের স্ত্রীর গর্ভে জন্ম লাভ করেন। তিনি ছিলেন জাতিস্মর এবং পুণ্যবতী। সুন্দরী শ্রেষ্ঠা মালাবতী মৃত্যুর প্রাক্কালে গন্ধর্ব উপবর্হনকে নিজের পতি হিসেবে কামনা করেছিলেন।
সৌত বললেন– হে শৌণক। কান্যকুজ দেশে গোপিদের রাজা ছিলেন দ্রুমিল। পতিব্রতা কন্যা। তাঁর স্ত্রী হলেন কলাবতী। স্বামীর দোষেই তিনি ছিলেন সন্তানহীনা।
স্বামীর আদেশে কলাবতী একদিন এক গভীর অরণ্যে এসে প্রবেশ করলেন। সেখানে কাশ্যপ মুনি শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। মধ্যাহ্নের সূর্যের ন্যায় সেই মুনির চারদিক উদ্ভাসিত, কলাবতী একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কৃষ্ণ ভক্ত মুনি শ্রেষ্ঠ একসময় চোখ খুললেন। অনতিদূরে স্থির যৌবনা সুন্দরী বধুকে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। আহা! কী অপুর্ব দেহ বল্লরী, চম্পক ফুলের বর্ণচ্ছটা তার তনু বাহার, চোখ দুটি যেন শরতের পদ্মফুল, শরতের চাঁদের মতো রমণীয় তার মুখ। সে মূল্যবান ভূষণে ভূষিত, স্তন মন্ডল অত্যন্ত মাংসল, নিতম্ব বিরাট এবং ভারী, সে পীতবস্ত্র পরিহিতা, মুখে স্মিত হাসি, আলতার রেখা তার দুটি পায়ের শোভা বৃদ্ধি করেছে, তার কপালে সিন্দুরের ফোঁটা তাঁকে আরও মোহময়ী করে তুলেছে। সেই স্ত্রীলোক মুনির রূপে আকৃষ্ট হয়ে কামসিক্ত হয়ে পড়ল। সে তার স্তনযুগল ও শ্রোণীমণ্ডল মেলে ধরল। তুমি কে? কী তোমার পরিচয়? তুমি কি এক বীরাঙ্গনা।
মুনির প্রশ্ন শুনে কলাবতী তখন কম্পমান। সে শ্রীহরির স্মরণ করে বলল– হে যোগী শ্রেষ্ঠ, আমি গোপরাজ মিলের ভার্যা। স্বামীর আদেশে এ স্থানে আমার আগমন। আমি এক পুত্র প্রার্থীণী! আপনি দয়া করে আমার গর্ভে বীর্যপাত ঘটান।
অগ্নি যেমন যেকোনো কাজ করে দোষের ভাগী হয় না, তেমনই মহাত্মা তেজস্বী ব্যক্তিকে কোনো কিছুই দুষ্ট করতে পারে না। তথাপি কাশ্যপ রেগে বললেন–ধিক সেই পুরুষকে, যে তার পত্নীকে অন্যের ভোগের জন্য প্রেরণ করে। বেদ বলেছে, এমন পতি মুখ ও লক্ষ্মীছাড়া হয়। তুমি আর কোনোভাবেই মিলের ভোগযোগ্য হবে না। আর যদি সে কামাকেরিকে বিরক্ত হয়ে পরিত্যাগ করে থাকে তাহলে তোমাকে গ্রহণ করার প্রশ্নই ওঠে না। অল্পজ্ঞানী যে ব্রাহ্মণ শূদ্রপত্নীকে গ্রহণ করে সে হয় চণ্ডাল সমান। ব্রাহ্মণের কোনো কাজেই তার কোনো অধিকার থাকে না। সে শালগ্রাম শিলা স্পর্শ করে দেবতা পুজো করতে পারবে না। পিতৃশ্রাদ্ধ, যজ্ঞ সমস্ত থেকে সে হয় বঞ্চিত। সে তার মাতামহ এবং নিজের বংশের উপরের দিকের দশ পুরুষ এবং নীচের দিকের দশ পুরুষকে নিয়ে কুম্ভীপাক নামক নরকে গমন করে। তার করা তর্পণ ও পিণ্ডদান মূত্র মলের সমান। তার দেওয়া ধনৈবদ্য ও জল দেবতাও গ্রহণ করেন না। সন্ন্যাসী ও ব্রাহ্মণদের সে অন্নজল দান করতে পারে না। যে নীচবংশ জাত ব্রাহ্মণ শূদ্রদের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করে এবং শূদ্র পত্নীর অধর চুম্বন করে সে হয় শূদ্রের তুল্য। তাকে চৌদ্দ জন ইন্দ্রের কাল কাল সূত্র নামক নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার জন্য সে ব্রাহ্মণও শাস্তি ভোগ করে। আঠারোজন ইন্দ্রের পরিমিত কাল পর্যন্ত সে কালসূত্র নরকে কৃমিদের দ্বারা যন্ত্রণা ভোগ করে, শেষে ওই ব্রাহ্মণী চণ্ডাল যোনিতে জন্মলাভ করে। আর শূদ্রও কুষ্ঠরোগগ্রস্ত হয়। সে জ্ঞাতিদের দ্বারা পরিত্যাজ্য হয়।
হে শৌণক! সুতপুত্র আবার কাশ্যপের কথা টেনে এনে বললেন, গোপপত্নীর গলাও ঠোঁট তখন শুকিয়ে কাঠ। ঠিক এই সময় ঐ পথ দিয়ে অপ্সরা মেনকা যাচ্ছিল। তাকে দেখে মুনি কাশ্যপের বীর্যপাত হল। বৃষলী তৎক্ষণাৎ আনন্দিত চিত্তে ওই বীর্য পান করল। মুনিকে প্রনাম জানিয়ে ফিরে এল স্বামী গৃহে। সে সমস্ত ঘটনা স্বামীকে জানাল।
দ্রুমিল খুব পুলকিত হল। বলল– তুমি হবে এক বিষ্ণুভক্ত পুত্রের জননী, পরম ভাগবতী সতী। তুমি কোনো এক ব্রাহ্মণের আশ্রয়ে দিন কাটাও, বৈকুণ্ঠ ধামে হরির সামনে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে।
রাজা দ্রুমিল এবার দান ধ্যানে মেতে উঠলেন। ইষ্ট দেবের পুজো করলেন। চার লক্ষ ঘোড়া, একলক্ষ হাতি ও একশো পাগলা হাতি দান করলেন। পাঁচলক্ষ উচ্ছেঃশ্রবা ঘোড়া, হাজার রথ, তিনলক্ষ শকট, বারো লক্ষ গরু, তিন লক্ষ মোষ ও রাজহাঁস, একলক্ষ পায়রা, একশো শুকপাখি ও একলক্ষ দাসদাসী ব্রাহ্মণদের হাতে তুলে দিলেন। এমনকি অসংখ্য ভূষণ ও রত্ন অলংকারে সুসজ্জিত প্রিয় পত্নী কলাবতাঁকে ব্রাহ্মণদের হাতে তুলে দিলেন। শেষ পর্যন্ত নিজ রাজ্যও ব্রাহ্মণ হস্তে সমর্পন করলেন। শ্রীহরিকে স্মরণ করে তিনি মনের মতো দ্রুতগামী হয়ে বদরিকাধামে এসে হাজির হলেন। গঙ্গার নির্জন স্থানে ধ্যানে বসলেন। একমাস পরে মহর্ষিদের যোগবলে সেখানে প্রাণত্যাগ করলেন। বৈকুণ্ঠধামে হরিদাস হয়ে শ্রীহরির চরণে ঠাঁই পেলেন।
হে শৌণক! স্বামীর দ্বারা পরিত্যাজ্য হয়ে কলাবতী উচ্চস্বরে ক্রন্দন করতে লাগল। প্রাণ বিসর্জন দেবে ভেবে আগুনে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হল। এক ব্রাহ্মণ এসে সে কাজ থেকে তাকে বিরত করে। ব্রাহ্মণ তাকে মা সম্বোধনে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে যথাসময়ে কলাবতী এক শ্রেষ্ঠ সন্তান প্রসব করল। সেই পুত্র ব্রহ্মতেজে উজ্জ্বল, তপ্ত গলানো সোনা তার গায়ের রং। পদ্ম ও চক্র চিহ্নিত তার পা দুটি; পদ্মের ন্যায় দুটি আঁখি, কামদেবের মতো সে লাবণ্যময়, আশপাশের গৃহ থেকে অন্যান্য ব্রাহ্মণ পত্নীরা ছুটে এল। সেই তেজসম্পূর্ণ অপূর্ব শান্তিময় দেবশিশুকে দেখে সুখে আহ্লাদিত হল। ব্রাহ্মণ বাড়িতে বালক ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগল।
.
সৌতি বলতে থাকেন, সে বালক ছিল জাতিস্মর ও জ্ঞানী। পূর্বের মন্ত্রের কথা সে ভুলে যায়নি। তাই সর্বদা কৃষ্ণমন্ত্রে মুখর থাকত। কৃষ্ণগান গাইতে গাইতে কখনও তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ত। আপন মনে নেচে উঠত। কৃষ্ণের লীলাকথা বা তাকে কেন্দ্র করে কোনো পুরাণ পাঠের খবর পেলেই সে ছুটে যেত। হরি বিনা সে কিছু জানাত না, এমনকি নাওয়া খাওয়ার কথা পর্যন্ত ভুলে যেত।
হে শৌণক! এই বালক জন্মের আগে পৃথিবী অনাবৃষ্টির রুক্ষ শুষ্ক হয়ে উঠেছিল। এই বালক ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বসুন্ধরার জলের ধারা নেমে আসে। “নার অর্থাৎ জল, তাই তার নাম হয় নারদ। আবার অন্যান্য বালকদের সে “নার” ও জ্ঞান দান করত, তাই তাকে ডাকা হত নারদ নামে। নারদমুনীন্দ্রের ঔরসে তার জন্ম বলে সে নারদ নামে প্রসিদ্ধ।
শৌণক জানতে চাইলেন– ওই মুণিবরের নাম নারদ হওয়ার কারণ কী?
সৌতি বললেন– ধর্মের পুত্র নর নামে মুনি অপুত্রক কশ্যপকে ওই পুত্র দান করেন, তাই তিনি নারদ?
শৌনক জানতে চাইলেন ব্রহ্মপুত্র নারদের নাম নারদ হওয়ার কারণ কি আপনি বর্ণনা করবেন?
সৌতি বললেন–ব্রহ্মার কণ্ঠকে নরদ বলে, কারণ সেখান থেকে বহু মানুষ জন্ম নিয়েছিল। ব্রহ্মার কণ্ঠনিঃসৃত বালকই হল নারদ। ব্রহ্মা তার এই নাম রেখেছিলেন। ব্রাহ্মণের গৃহে সেই গোপিকা ও তার ছেলে কালাতিপাত করতে লাগল, ব্রাহ্মণ তাদের কন্যা আর নাতি হিসেবে দেখত। বালকের বয়স যখন পাঁচ তখন চার তেজস্বী বালকের আবির্ভাব ঘটল ওই বাড়িতে। তাদের তেজ যেন গ্রীষ্মের মধ্যদুপুরের সূর্যের তেজকেও হার মানায়। ব্রাহ্মণ তাদের সাদরে আপ্যায়ন জানাল, তারপর সেই পাঁচ বছরের চার তেজস্বী বালকের উচ্ছিষ্ট গোপিকা পুত্র গ্রহণ করল। চতুর্থ তেজস্বী বালক ওই শিশুপুত্রকে সানন্দে কৃষ্ণমন্ত্র দান করলেন।
একদিন পথে সাপের কামড়ে তার মায়ের মৃত্যু হল। মৃত্যুকালে হরিনাম স্মরণ করেছিল। তাই সে বিষ্ণুধামে স্থান পেল। নারদ সেই চার ব্রাহ্মণের সাথে পালক ব্রাহ্মণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। নারদ তাদের কাছ থেকে নানাতত্ত্ব জ্ঞান লাভ করল। তারপর তারা ফিরে গেল স্বস্থানে আর নারদ গঙ্গার জলে স্নান করে সেখানে বসেই বিষ্ণুমন্ত্র জপে নিমগ্ন হল। যে মন্ত্র ক্ষুধা, রোগ, শোক নাশ করে সেই বিষ্ণু মন্ত্র জপ করতে করতে বহু বছর কেটে গেল।
সৌতি বলতে থাকেন–পূর্বে গোলোকে শ্রীকৃষ্ণ এই মন্ত্র ব্রাহ্মণকে দান করেছিলেন। বাইশ অক্ষর বিশিষ্ট এই মন্ত্র পরে কুমার ব্রহ্মার কাছ থেকে লাভ করেন। সেই মন্ত্র সনকুমারের কাছ থেকে বালক নারদের কাছে চলে আসে। কল্পবৃক্ষের মতো এই শ্রীকৃষ্ণমন্ত্র হল– ওঁ শ্রীনমো ভগবতে রাসমণ্ডলেশ্বরায় শ্রীকৃষ্ণ স্বাহা। যোগীরা, সিদ্ধ পুরুষেরা ও দেবতারা এই মন্ত্রর উচ্চারণ করে কোটি সূর্যের তেজসম্পন্ন শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করেন। তার রূপ কালো মেঘের ন্যায় শ্যাম বর্ণের, তার চোখ দুটি শরতের পদ্ম, মুখ যেন শরতের পূর্ণিমার চাঁদ, পাকা বিম্ব ফলকেও হার মানায়, তার দুটি সুন্দর অধর, তার দাঁত মুক্তোর থেকেও বেশি উজ্জ্বল, তিনি পীতবস্ত্র পরিধান করেন, তিনি দ্বিভুজ, ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান, গলায় রত্নহার, মাথায় চূড়া, তাতে ময়ূরের পেখম শোভা বর্ধন করছে, বুনোমালায় সজ্জিত, চন্দনে সুবাসিত। শ্রীকৃষ্ণের এই রূপ বৈষ্ণবরা চিন্তা করেন। কৃষ্ণের বুকে রাধা অবস্থান করছেন, গোপিকারা তাদের ঘিরে নৃত্য প্রদর্শন করছে। ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাকে তারা পুজো করছেন। কিশোর রাধিকানাথ শান্ত, পরাৎপর, নির্গুণ, নিরাকার প্রকৃতির অতীত যিনি, সেই শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করি।
হে মুনি! মন্ত্রের উপযোগী ধ্যান, স্তোত্র, কবচ ও কল্পবৃক্ষরূপে মন্ত্রের কথা শুনলেন।
দিব্য সহস্র বছর ধরে আহার নিদ্রা, ত্যাগ করে বালক নারদ ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কিন্তু তিনি দুর্বল হয়ে পড়েননি। সিদ্ধ মন্ত্রের প্রভাবে তিনি ছিলেন বলশালী ও মোটাসোটা। তিনি ধ্যানচোখে প্রত্যক্ষ করলেন এক বালককে, যিনি নানা অলংকারে বিভূষিত হয়ে রত্নসিংহাসনে বসে আছেন। কিশোর বয়সী সেই বালকের দেহের রং শ্যামবর্ণ, তিনি গোপের বেশ পরেছেন, ঠোঁটে মৃদু হাসি, গোপগোপীদের মাঝখানে তিনি পীতবসন পরিধান করে বাঁশি বাজাচ্ছেন। তার দুটি হাত, চন্দন চর্চিত শরীর। ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু সকল দেবতারা তাকে স্মরণ করে ধ্যান করছেন।
এক সময় সেই বালক শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি গোপিকাপুত্র নারদের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এমন সময় শোনা গেল আকাশবাণী– নারদ, তুমি কু যোগী, তাই একবার যে রূপ প্রত্যক্ষ করেছ, তা দ্বিতীয়বার দেখার চেষ্টা করো না। মৃত্যু অন্তে দিব্য দেহ লাভ করে জরাব্যাধি নাশকারী গোবিন্দের দর্শন আবার পাবে।
এই বাণী শুনে বালক নারদ কান্না থামিয়ে আনন্দ করল। মরণকালে সে শ্রীকৃষ্ণের পদ- যুগলের কথা চিন্তা করতে করতে প্রাণ দিল। স্বর্গ থেকে পুষ্প বৃষ্টি হল। শোনা গেল দুন্দুভি বাজানোর শব্দ। অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলেন মহামুনি নারদ। ব্রহ্মার শরীরে তিনি আশ্রয় পেলেন। হে শৌণক! নারদ ছিলেন স্থির যৌবন, তথাপি তাঁকে জন্ম নিতে হয়েছিল এবং মরণ বরণ করতে হয়েছিল। কারণ এসবই হল কর্মফল।
.
সুতপুত্র বললেন– ব্রহ্মার গলা থেকে নারদের জন্ম হল। যেহেতু ব্রহ্মার কণ্ঠকে নরদ বলা হয়, তাই ঐ মুনির নাম হল নারদ। বিধাতার চিত্ত থেকে নারদের উৎপত্তি হয়েছিল বলে তিনি প্রচেতা নামেও পরিচিত। বিধাতার ডানদিক থেকে যে জন্ম নেয় এবং সমস্ত কাজে যে পারদর্শী, সে হল দক্ষ। বিধাতার ছায়া থেকে তার জন্ম হওয়ায় সে হল কর্দম, বেদে এই শব্দের অর্থ বলেছে ছায়া। ব্রহ্মার তেজ অর্থাৎ মরীচি থেকে যে অতীতে তেজস্বী মুনির জন্ম হয় তিনি হলেন মরীচি, অন্য জন্মে হলেন যে পুত্র অনেক যজ্ঞ করে তিনি হলেন ক্রতু, ব্রহ্মার প্রধান অঙ্গ মুখ থেকে অঙ্গিরার জন্ম হয়। ভৃগু শব্দের অর্থ অতি তেজস্বী, পুত্রের নাম ভৃগু। ব্রহ্মার আর এক পুত্রের নাম অরুণী, কারণ তিনি অরুণ বর্ণের ছিলেন, এবং তপস্যাবলে উপরের দিকে অরুণ বর্ণের তেজ প্রজ্বলন ঘটিয়ে ছিলেন। আর যোগী শ্ৰেষ্ঠর নাম হংসী, তিনি হংসীদের বশীভূত করেছেন যোগবলে। বশিষ্ঠ শব্দের অর্থ যিনি ব্রহ্মার বশীভূত এবং পরমপ্রিয়।
হে মুনিশ্রেষ্ঠ! যতি অর্থাৎ যিনি তপস্যা যত্ন সহকারে করেন এবং কর্মে সংযত থাকেন। পুলহ হলেন প্রস্ফুট তপস্যা স্বরূপা। পুলস্ত্য অর্থাৎ পূর্ব জন্মে যার তপস্যা আছে। ত্রিগুণা প্রকৃতি এবং বিষ্ণুর প্রতি যিনি সমান ভক্তি প্রদর্শন করেন, তিনি হলেন অত্রি। পঞ্চশিখ শব্দের অর্থ যার মস্তকে তপস্যা ও তেজ থেকে সৃষ্ট পাঁচটি জ্বলন্ত শিখা আছে। অপান্তরতমা হলেন সেই মুনি যিনি গত জন্মে অপান্তরতম জায়গায় কঠিন তপস্যা করেছিলেন। যে মুনি নিজে তপস্যায় রত হন এবং অন্যকে তপস্যা করার ইন্ধন জোগান, তিনি বটু নামে পরিচিত। রুচির মনে তপস্যার রুচি বা ইচ্ছে আছে। বিধাতা কুপিত হয়ে এগারোজন মুনির জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁরা রুঘ্র নামে পরিচিত, তাঁদের কোপন স্বভাব এবং তারা ক্রন্দনরত।
সৌতি বলতে থাকেন, রক্ষাকর্তা বিষ্ণু সত্ত্বগুণের সৃষ্টিকর্তা, ব্রহ্মা রজো গুণের এবং দুর্ধর্ষ ভয়ংকর রুদ্ররা তমোগুণের অধিকারী, এইসব রুদ্রদের মধ্যে একজন ছিলেন কালগ্নি নাম্নী। ইনি শঙ্করের অংশজাত এবং ধ্বংসে মেতে উঠতেন। কিন্তু মঙ্গলদায়িনী শিব হলেন শুদ্ধসত্তা। বিষ্ণু ও শিব পরিপূর্ণ শ্রীকৃষ্ণের অংশে সৃষ্টি, বাদবাকি অন্যরা শ্রীকৃষ্ণের অংশ সনক মায়ায় মোহিত হয়ে মুনিরাও বিপরীতগামী হন। সনন্দ, সনাতন ও ভগবান সনকুমার। এরা হলেন ব্রহ্মার পুত্র। তিনি পুত্রদের সৃষ্টি কাজ শুরু করতে বললেন। কিন্তু তারা অস্বীকার করলেন। তখন ব্রহ্মার কোপ থেকে যাদের সৃষ্টি হয়েছিল তারাই হল রুদ্র। সনক ও সনন্দ অর্থাৎ যারা সবসময় আনন্দে গা ভাসিয়ে দেয়। তাই ব্রহ্মার দুই পুত্রের নামকরণ করলেন সনক ও সনন্দ। সনাতন কথার অর্থ, সে সর্বদা কৃষ্ণপদে মতি রাখে। সনৎ অর্থাৎ নিত্য এবং কুমার অর্থাৎ শিশু, তাই থেকে সৃষ্টি হয় সনৎকুমার।
.
শৌনক বললেন– ব্রহ্মার পুত্রদের নামের ব্যুপত্তি সম্পর্কে অবগত হলাম। এবার দয়া করে নারদের নামের অর্থ ব্যাখ্যা করুন।
সৌতি বললেন–বেদাঙ্গ পারদর্শী নারদকে পিতা ব্রহ্মা কাছে ডাকলেন বললেন, তুমি আমার প্রাণাধিক প্রিয়, আমার কুলশ্রেষ্ঠ। তোমার কৃপায় অজ্ঞানী জ্ঞান লাভ করে, প্রণম্য দেবতাদের মধ্যে পিতা হলেন শ্রেষ্ঠ গুরু। যিনি শিক্ষক ও মন্ত্র দান করেন তিনি একাধারে বাবা, অন্যধারে মন্ত্র গুরু। তুমি বিবাহ করলে আমি সন্তুষ্ট হব। হে বৎস, যে পুত্র পিতৃআজ্ঞা পালন করে এবং গুরু আদেশ মাথা পেতে গ্রহণ করে সে হল প্রকৃত শিষ্য ও পুত্র। আর যে তা করে না, সে হল চরম মূর্খ। গৃহস্থ আশ্রমই হল সকল আশ্রমের সেরা। কারণ পর্বকালে পিতৃ পুরুষরা আর তিথি কালে দেবতারা গৃহস্থের কাছে আসে। নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য– এই তিন ধরনের অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে গৃহীরা নানা ধরনের সুখভোগ করে এবং মৃত্যুর পরে স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে। নিজের ধর্ম পালন করে যে সে পুণ্যবান, সে যশ ও ধন লাভ করে। যশস্বী ও কীর্তিমান পুরুষ মরণের পরেও তার কীর্তির জন্য অমর থাকে।
পিতা ব্রহ্মার এই সত্ব উপদেশ শুনে নারদ ভয় পেলেন। বললেন– হে পিতা। এর আগে এই বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে তর্ক বেঁধেছিল, আপনি আমায় অভিশাপ দিয়েছিলেন, আমি গন্ধর্বযোনি ও শূদ্রয়োনি জন্ম নিয়ে কর্মফল ভোগ করেছি। আর আমার শাপে আপনি জগতে অপূজ্যা হয়েছেন।
কালের নিয়মে আমি সেই শাপ মোচন করে স্বস্থানে ফিরে এসেছি। আপনিও আবার জগৎবাসীর পুজো পাবেন। আমাদের এই অমীমাংসিত বিরোধ হল নির্গুণ। যে শ্রীকৃষ্ণের চরণ সর্বদা বন্দনা করে, সেই শ্রীহরি তার সখা হয়। তিনি হন সেই কৃষ্ণপ্রেমিকের পিতা গুরু ও পুত্র। ইনিই হলেন প্রকৃত ঈশ্বর। পুত্র অসৎ পথে গেলে কৃপার সাগর শ্রীকৃষ্ণ তাকে সুপথে নিয়ে আসেন। আর আপনি পিতা হয়ে পুত্রকে সেই বিষরূপ সংসারে প্রবেশের আজ্ঞা দিচ্ছেন। স্ত্রী গ্রহণ করলে তপস্যা, স্বর্গ, ভক্তি, মুক্তি সর্বনাশ হয়, কেবল লাভ হয় দুঃখ। সাধ্বী, ভোগ্যা ও কুলটা– এই তিন ধরনের স্ত্রীরা নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যস্ত থাকে। স্বাধ্বী নারী পরলোকের ভয়ে এবং ইহকালে নিজের যশ বৃদ্ধির জন্য স্বামীর মনরক্ষা করে চলে। ভোগ্যা সর্বদা নিজের কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য স্বামীমুখী হয়। কুলটা স্ত্রী কপটতার আশ্রয় নেয়। সে হয় সংসারের কলঙ্কিনী। এরা কামবাসনা পূরণের জন্য অন্য পুরুষের সঙ্গ লাভ করে। এদের উপপতির সংখ্যা অনেক। উপপতির জন্য এই শ্রেণীর নারীরা স্বামীকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয় না। এই তিন শ্রেণীর স্ত্রী বাইরে দেখায় কত স্বামী অনুগত প্রাণা, অথচ মনে তাদের ক্ষুরধার করাত। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে স্বার্থ হাসিল করতে চায়। যদি ঈপ্সিত ইচ্ছা পূরণ না হয় তাহলে সাপের মতো ফুসলে ওঠে, গালিগালাজ করে।
হে জগৎগুরু। আপনি তো জানেন, স্ত্রীদের আহার দ্বিগুণ, নিষ্ঠুরতা তার দ্বিগুন এবং কাম প্রবণতা তার দ্বিগুণ। এইসব নারীদের ওপর কি ভরসা করা যায়। রমণী সম্ভোগ তেজ ম্লান হওয়ার কারণ বেংসূর্যালোক বলে। গল্প করলে যশের ক্ষতি হয়। বেশি প্রেম প্রদর্শনের ফলে ধনক্ষয় হয়, বেশি আসক্তিতে দেহ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। রমণীর সঙ্গে সহবাসে পৌরুষ নষ্ট হয়। তার সঙ্গে বা কথা। কাটাকাটি করলে সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। যে স্বামী ব্যাধিগ্রস্ত বৃদ্ধ বা দরিদ্র, তাকে লোকাঁচারের ভয়ে সামান্য খেতে দেয়। নারীকে বশে রাখতে হলে চাই ধন, তেজ, ঐশ্বর্য ও যোগ্যতা। যে পুরুষের এইসব নেই সে ক্লীবে পরিণত হয়! হে বিভু, আপনি আত্মারাম ও ঈশ্বর, আপনি সর্বজ্ঞ। আপনাকে আমি নতুন করে কী জ্ঞান দেব। আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি মঙ্গলকর, শ্রীকৃষ্ণ ধ্যানে ব্রতী হই।
কথা বলা শেষ করে নারদ ব্রহ্মাকে প্রণাম জানালেন। আর ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।
এতক্ষণ নীরবে ব্রহ্মা সব কথা শুনছিলেন। আর তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেন না। আত্মারাম মহাত্মা ঈশ্বর পুত্রের বিচ্ছেদ ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ছোট্ট শিশুর মতো হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। নারদকে বুকের মাঝে টেনে নিলেন। চুম্বনে চুম্বনে তাকে অস্থির করে তুললেন। নিজের জানুর ওপর পুত্রকে বসালেন।
.
সৌত বললেন– হে শৌণক! ব্রহ্মা তখন বিষ্ণুর মায়ায় মোহিত হয়ে পুত্র বিচ্ছেদে কাতর ও শোক পীড়িত হয়ে পড়লেন। তিনি পুত্র নারদকে বললেন– বৎস! তুমি যদি তপস্বী হও, তাহলে আমার সংসার করার কী প্রয়োজন? সনক; সনাদ, তৃতীয় সনাতন এবং চতুর্থ পুত্র সনৎকুমার কেউই গৃহী হল না। মতী, হংসী, অরুণি বোঢ় এবং পঞ্চশিখ তারাও আমার বাক্য শ্রবণ করল না। কেবল মরীচি, অঙ্গিরা, ভৃগু, রুচি, অত্রি, কর্দম, প্রচেতা, ক্রতু, মনু ও বশিষ্ঠ, আমার বাধ্য। বাকি সবাই বড়ো বেশি বিবেকী। তাই সংসার ত্যাগ করে আমিও শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্শনে গোলকধামে যাব ঠিক করেছি।
হে পুত্র, তোমাকে বেদসম্মত চারটি বর্গের সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দিই। ধর্ম হল বেদের স্বরূপ। আর বাকি সব অধর্ম। যজ্ঞসূত্র ধারণ করে ব্রাহ্মণ নিয়মমতো বেদ পাঠ করে, তারপর গুরুকে দক্ষিণা দান করে, তারপর কোনো এক উত্তম বংশের কন্যাকে বিয়ে করে সংসারী হয়। সদ্বংশজাত নারী কখনও স্বামীর বিরোধিতা করে না। যে কন্যা নীচ বা খারাপ বংশে জন্মায় সে তার পিতা মাতার দোষে দুষ্ট হয়। যারা স্বর্গের সার অংশে জন্মায় তারা অসদ্বংশে জন্ম নেয়। এবং তারা হয় দুর্বিনীত। যে নারী সতী সে নির্গণ স্বামীকে সেবা করে। কিন্তু কুলটা নারী স্বামী যতই গুণবান হোক না কেন, নিন্দা করতে ছাড়ে না। তাই সদ্বংশের কন্যাকেই সাধুলোকেরা বিবাহ করেন।
বৎস! তুমি বেদ সম্পর্কে আমার কাছে শুনলে, জ্ঞান লাভ করলে। আমি তোমার গুরু হিসেবে দক্ষিণা চাইছি। তুমি যদি তোমার পূর্বপত্নী মালতাঁকে বিবাহ করো, তাহলে সেটাই হবে আমার দক্ষিণা। সেই সতী মনুবংশের সৃঞ্জয়ের ঘরে জন্ম নিয়েছে। এখন সে তপস্যায় মগ্ন। সে লক্ষ্মীর অংশজাত। ভারতবর্ষের মাটিতে বসে যে তপস্যা করে, তার তপস্যা কখনও বৃথা হয় না। বেদ বলেছে, প্রথমে সংসারে তারপর বাণপ্রস্থ এবং তপস্যা, যা মোক্ষ লাভ ঘটায়। সে বৈষ্ণব শ্রীহরির পূজার্চনা করে তাকে আর আলাদা করে তপস্যা করার জন্য বনে যেতে হয় না। তুমি ঘরে বসে সংসার করার মাঝে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে বিভোর হতে পারো। যার মনের ভেতরে ও বাইরে শ্রীহরি তার আর তপস্যার প্রয়োজন হয় কি? তপস্যার দ্বারা যাঁকে আরাধনা করা হয়, তিনি স্বয়ং শ্রীহরি। কৃষ্ণ সেবার নামই তপস্যা। তাই আমি বলছি, তুমি সংসার ধর্ম পালন করো। রমণীর স্পর্শ সুখ যে পায় না সে অত্যন্ত দুর্লভ জিনিস হারায়। তাই প্রেয়সীকে প্রিয়া নামে ডাকা হয়। পুত্রের থেকে প্রিয় কিছু আর কে হতে পারে। সেই প্রিয় বন্ধুর সন্ধান দিতে পারে তোমার পত্নী। কথায় আছে পুত্রের কাছ থেকে পরাজয়ের গ্লানি লাভ করলেও তা অতি মিষ্টি লাগে, কিন্তু অন্যের কাছে তা হয় তিক্ত। যদিও আত্মা প্রিয়। কিন্তু পুত্র তার চেয়েও প্রিয়। প্রিয়তম পুত্রকে আত্মার থেকেও শ্রেষ্ঠ ধন দান করবে।
মহাজ্ঞানী নারদ বললেন– হে পিতা। বেদ ও দর্শনশাস্ত্র জ্ঞাত হয়েও আপনি আমাকে সংসারে প্রবেশ করাতে চাইছেন, আপনাকে আমি দয়ালু পিতা বলি কী করে, সংসার অনিত্য ও ক্ষণস্থায়ী জলের রেখার মতো মুছে যায়। কিছুদিন পরে, স্ত্রী পুত্র ইত্যাদি সম্পর্কগুলি সৃষ্টি হয় কাজের খাতিরে। যে লোক হরিপদ ছেড়ে সংসার বিষ সাগরে নামে, সে ডুবে মরে অতলে। যে লোক ছেলেকে কুপরামর্শ দেয়, সে শত্রু নামে পরিচিত। আর ছেলেকে যে সৎ উপদেশ দেয়, সে বাবা এবং গুরু। হে পিতা! বেদের মূলতত্ত্ব সম্পর্কে যা জানি, তাই বললাম। এই তত্ত্ব এতটুকু মিথ্যে নয়। তবুও আপনার আদেশ আমি মাথায় করে নিলাম আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, পাণিগ্রহণ করব। তবে এখন না। আগে আমি যাব বদরিকা আশ্রমে। সেখানে নারায়ণের মাহাত্ম কথা শ্রবণ করব।
নারদ চুপ করলেন। তার ওপর পুস্পবৃষ্টি হল।
নারদ আবার বললেন– পানিগ্রহণ করার আগে আমি আপনার কাছ থেকে কৃষ্ণ লীলা সম্বন্ধীয় ও কৃষ্ণ মাহাত্ম্যযুক্ত কথা শুনতে চাই। আমার ইপ্সিত সেই কৃষ্ণমন্ত্র দান করুন। মনের বাসনা পূরণ হলে চিত্ত পুলকিত হয়। তখন যে কোনো কাজ করতে ভালো লাগে।
নারদের কথা শুনে পিতা ব্রহ্মা অত্যন্ত খুশি হলেন, তিনি বললেন– পিতা এবং পতি কখনও মন্ত্র দান করতে পারে না। এমনকি আশ্রমবাসী যে নয়, তার কাছ থেকে মন্ত্র নিলে, তা মোটেও মঙ্গলজনক হয় না। মন্ত্র গুরু, স্ত্রী, বিদ্যা, সুখ, দুঃখ ও ভয়–এইসবই নিয়তির নির্দেশমতো মানুষের জীবনে আসে। পৌরুষ যা করতে চায়, তাই তুমি করতে পারো না। তুমি বরং সেই মঙ্গলদায়ক শান্ত ও জ্ঞানী গুরুর কাছে যাও, যিনি আমাদের থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ, সেই মহেশ্বর তোমাকে কৃষ্ণমন্ত্র দান করতে পারে, কৃষ্ণ লীলা ও মাহাত্ম বিষয়ক কথা শোনাবেন। তুমি শিবলোক থেকে ঘুরে না আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব, তুমি এখন আসতে পারো।
মহাজ্ঞানী নারদ পদ্মযোনি পিতা ব্রহ্মাকে প্রণাম নিবেদন করে সে স্থান ত্যাগ করলেন।
.
সৌতি বললেন– মুণি শ্রেষ্ঠ, নারদ অল্পক্ষণের মধ্যেই শিবলোকে এসে পৌঁছোলেন। ধ্রুবলোক থেকে লক্ষযোজন ঊর্ধে শিবলোকের অবস্থান। মহাদেব নিজের পরিকল্পনাতে এই রত্নখচিত সুন্দর প্রাসাদটি তৈরি করিয়েছেন। এখানে অনেকগুলি বাড়ি আছে। মূল আশ্রম যেখানে স্বয়ং শিব বিরাজমান, সেটি যোগবলে শূন্যমার্গে ভেসে আছে। পুণ্যত্ম সাধক শ্রেষ্ঠরা সাধনাবলে ওই শিবলোক মানবচক্ষে দেখতে পারেন। এখানে চন্দ্ৰসূর্যের আলো প্রবেশ নিষেধ, প্রাচীরাকার অত্যন্ত লম্বা ও উঁচু এবং অগনিত উজ্জ্বল শিখাসমেত আগুনের শিখা চারিদিক বেষ্টন করে আছে, সেখানে আছে মন্দার প্রভৃতি সুন্দর ফুল ও দেবগাছ। শিবলোকের আকাশ কামধেনুতে সুসজ্জিত। প্রধান শিবসেবকরা কল্পকাল পর্যন্ত এই শিবলোকে বাস করেন। এখানে সিদ্ধ পুরুষের সংখ্যা শতকোটি লক্ষ, শিবপার্ষদ আছেন তিন কোটি লক্ষ, তিনলক্ষ ভয়ংকর ভৈরব ও চার লক্ষ ক্ষেত্রপালের বাস।
শিবলোকের সৌন্দর্য দেখে নারদ বিস্মিত হলেন। জ্ঞানী ও যোগীদের গুরুর পথেই তো এমন বিচিত্র কাজ করা সম্ভব। শিবপুরীতে ভয়, মৃত্যু, রোগ, শোক, ও জরার প্রবেশ নিষেধ। শিব তখন শান্ত ও মনোহর ভঙ্গিতে তার আসনে বসেছিলেন। নারদ সেই রূপ প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন ভালোভাবে আহা! কী অপরূপ রূপ, কপালে চন্দ্রের শোভা, মাথায় গঙ্গাকে ধারণ করেছেন, চাঁদের ন্যায় পাঁচটি মুখ, ত্রিনেত্র যেন এক একটি পদ্ম ফুল। সোনারঙের মতো জটাজুট নেমে পড়েছে। মাথা থেকে। তিনি বাঘছাল পরেছেন। গলা থেকে খুলে পড়েছে মারত্মক বিষাক্ত সাপ। তিনি নীলকণ্ঠ। তিনি সিদ্ধিবিধানের কারণ ও সিদ্ধেশ্বর যোগীন্দ্র, মুনীন্দ্র ও সিদ্ধেগণ তার ধ্যান করছেন। তিনি মঙ্গল ও বরদান করেন।
নারদ এগিয়ে গেলেন আশুতোষের দিকে, তারপর করজোড়ে মাথা অবনত করে প্রণাম জানালেন। তার সমস্ত দেহ পুলকিত হল। তিনি বীণা বাজিয়ে কৃষ্ণ গানে বিভোর হলেন। সেই পরমেশ্বর শূলপানি নিজের আসন থেকে উঠে এলেন। সঙ্গে এলেন যোগীন্দ্র, মুনিন্দ্র ও সিদ্ধেন্দ্রদের দল। মহেশ্বর নারদকে সম্ভাষণ জানালেন। স্মিত হেসে তাকে উত্তমাসন গ্রহণ করতে বললেন। মহাদেব নারদের আসার কারণ জানতে চাইলেন।
শিব তার পার্ষদদের নিয়ে নিজের আসনে ফিরে গেলেন। নারদ কিন্তু বসলেন না। তিনি দাঁড়িয়ে থেকেই ভক্তি সহকারে প্রভুর স্তব করতে শুরু করলেন। গন্ধর্বরাজের কাছে থেকে লাভ করা শিব স্তোত্র উচ্চারণ করলেন। তারপর মহাদেবের বাঁদিকে আসন গ্রহণ করলেন।
.
সৌতি বললেন– হে শৌণক! অভীপ্সা মতো শিব নারদকে হরির কবচ, মন্ত্র, স্তোত্র, পুজোর নিয়মাবিধি, ধ্যান জন্মান্তরীণ-জ্ঞান দান করলেন। মনোবাসনা পূর্ণ হতে নারদ অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। গুরু মহাদেবকে প্রণাম করে নারদ জানতে চাইলেন, যার দ্বারা প্রতিদিন স্বধর্মের পালন হয়ে থাকে, সেই আহ্নিক কর্তব্য কী।
এই প্রশ্নের উত্তরে শিব বললেন– ব্রাহ্মমুহূর্তে ব্রাহ্মণ বিছানা ত্যাগ করে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করবে। ব্রহ্মারন্ধ্রের মধ্যেকার পদ্মের মধ্যেই গুরুকে স্মরণ করবে, যে পদ্মের সূক্ষ্ম হাজার পাপড়ি আছে, যা নির্মল ও গ্লানিশুন্য। গুরুকে সাক্ষাৎ ব্রহ্মস্বরূপ চিন্তা করবে। তিনি শান্ত মুখে স্মিত হাসি, গুরু শিষ্যের ধ্যানে সন্তুষ্ট হলে ইষ্টদেবের ধ্যান করার আদেশ দেবেন। নির্মল শুভ্র হাজার পাপড়ি সমেত বিস্তীর্ণ হৃদয়পদ্মে ইষ্টদেবের অবস্থান। পরে তার অনুমতি পেলে অন্য সব দেবতার ধ্যান। করতে হয়। যে দেবতার যেমন ধ্যান তাঁকে সেইভাবে চিন্তা করা কর্তব্য। ইষ্টদেবের থেকে গুরু শ্রেষ্ঠ। কারণ, ইষ্টদেব গুরু নির্দেশিত পথেই গমন করেন। ব্রহ্মা কে? বিষ্ণু কে? কে বা মহেশ্বর? সবই গুরু। গুরুই সৃষ্টির প্রধান সহায়ক। চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, বায়ু, বরুণ, মাতা, পিতা বন্ধু– সবই গুরু। গুরু সর্বশ্রেষ্ঠ প্রণম্য এবং পূজনীয়। গুরু কুপিত হলে তাঁকে শান্ত করার ক্ষমতা কোনো দেবতার নেই, কিন্তু ইষ্টদেব ক্রোধান্বিত হলে গুরু তাঁকে শান্ত করতে পারেন। গুরুমাকে যে তুষ্ট করতে পারে, সে সর্বজয়ী হয়। আর গুরুকে রুষ্ট করলে সর্বনাশ অবধারিত। তাই গুরুদেবকে আগে পুজো করা কর্তব্য, নচেৎ ব্রহ্মহত্যার সমান পাপ হয়। গুরু ও ইষ্টদেবের ধ্যান ও বন্দনা শেষ করে মল মূত্র ত্যাগ করবে। বেদ বলেছে নদীর মধ্যে মন্দিরের সামনে গাছের গোড়ায়, পথে চাষবাসের স্থানে, শস্যক্ষেত্রে গোচারণ ভূমিতে, কোনো প্রাণীর সম্মুখে, গ্রামের মধ্যে মানুষের বাড়ির সামনে, ফুলের বাগানে, শরবনে, শ্মশানে, আগুনের সামনে, সেতুতে, খেলার মাঠ, নিবিড় অরণ্যে, পরিষ্কার কোনো স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করা বাঞ্ছনীয় নয়। তবে কোথায় প্রাত্যহিত কাজ সম্পন্ন করবে। বেদে বর্ণিত হয়েছে, উল্লিখিত স্থানগুলি বাদে যেখানে গর্ত খুঁড়ে মলমূত্র ত্যাগ করা উচিত। দিনের বেলায় উত্তরে, রাত্রি বেলায় পশ্চিমদিকে এবং সন্ধেবেলা দক্ষিণ দিকে মুখ করে ওই সব কাজ সারবে।
কী ভাবে শৌচ, করবে, তা শোনো। মাটি ও জল দিয়ে শৌচ ক্রিয়া করবে। লিঙ্গে একবার, বাঁ হাতে চারবার, এবং দুহাতে দুবার মাটি দেবে এবং জল দিয়ে ধুয়ে নেবে। মৈথুনের পর এর দ্বিগুণ হবে শৌচের মাত্রা এবং মূত্র শৌচ করতে হয় চারগুন। মলত্যাগের পর শৌচ করা নিয়ম বলা হয়েছে! এইভাবে লিঙ্গে একবার, গুহ্যে তিনবার, হাতে দশবার, দুহাতে সাতবার এবং দুপায়ে দুবার মাটি দিয়ে ধৌত করতে হয়।
গৃহী সাধকরা এইভাবে মল ও মূত্র শৌচ করবে। ক্ষত্রিয় বৈশ্যরা গৃহী ব্রাহ্মণদের মতো শৌচ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। গৃহীদের চারগুণ পালন করবে। সন্ন্যাসী ব্রহ্মর্ষি, ও ব্রহ্মচারীদের তবে নিয়ম করে পালন করতেই হবে। অতিরিক্ত বার শৌচ কর্ম করলে ফলভোগ করতে হয়। ব্রাহ্মণ মাটি দিয়ে শৌচ করলে তবেই সে শুচি হবে, নতুবা নয়, কোন মাটি শৌচ কর্মে ব্যবহার করা যায়? এ সম্পর্কে শ্রীহরির বিধান, উই ও বেড়ালের ভোলা মাটি, একবার শৌচ করা হয়েছে, সে মাটি, ঘরের মাটি, লাঙ্গলের মুখের মাটি, যেখানে প্রাণী মরে পড়ে আছে, এমন মাটি, কুশ দুর্বা ও অশ্বথের মূলের মাটি, চারপথৈর মাটি, গোষ্ঠের মাটি–এসব মাটি ছাড়া অন্য সব মাটিতে শৌচ কাজ করা যাবে।
এরপর মুখ শুদ্ধি করতে হবে। ব্রাহ্মণ মলমূত্র ত্যাগ করে এসে স্নান না করলেও চলে। কিন্তু মুখ শুদ্ধ করতেই হবে। এক্ষেত্রে বলা হয় ব্রাহ্মণ মুখে মাটি দিয়ে ষোলোবার কুলকুচি করে ফেলে দেবে। তারপর আবার মুখ বেধে কাঠি দিয়ে দাঁত মাজবে। তারপর ষোলোবার মুখ ধোবে, অপামার্গ, সিন্ধুবার, আম, করবী, খদির, শিরীষ, জাতি, পুন্নাগ, শাল, অশোক, অর্জুন, ক্ষীরি, কদম, জাম, বকুল, যজ্ঞডুমুর আর পলাশ গাছের কাঠ দিয়ে দাঁতের কাঠি তৈরির কথা বলা হয়েছে। কুল, মাদার, আকন্দ, শিমূল, পিপুল, পিয়াল, তেঁতুল, তাল, খেজুর, নারকেল, তাল এবং লতাছাড়া কাঁটাওয়ালা গাছের কাঠ দিয়ে দাঁত মাজলে প্রায়শ্চিত করতে হবে। যে গৃহীব্রাহ্মণ দন্ত মার্জনা করে না, সে কখনও শুদ্ধি নয়। আর এইসব ব্রাহ্মণ কোনো কাজে যোগ দিতে পারে না।
শৌচ কর্মাদি সেরে সে ধোয়া কাপড় পরে চাদর গায়ে জড়াবে। পা ধোবে তারপর আচমন করতে বসবে। যে ব্রাহ্মণ ত্রিসন্ধ্যায় সন্ধ্যাবন্দনা করে তীর্থ স্থানের সমান ফললাভ হয়। যে এর ব্যতিক্রম, সে অন্য সব আহ্নিক করলেও কোনো সুফল দেয় না। যে ভোরে আহ্নিক না করে অন্য দুইবার উপাসনা করে সে ব্রহ্ম হত্যা ও আত্মহত্যার পাপের ভাগী হয়। একাদশী উপবাসী না থাকলে এবং সন্ধাক্কি না করলে কালমূত্র নরক যন্ত্রণা ভোগ করে।
একজন উত্তম সাধক ব্রাহ্মণের উচিত, প্রাতঃ আহ্নিক শেষ করে গুরু, ইষ্টদেব এবং অন্যান্য দেবতাদের বন্দনা করে ঘি, আয়না, মধু ও সোনা স্পর্শ করে স্নান করা ধার্মিক ও জ্ঞান ব্রাহ্মণ। পরের পুকুরে বা জলাশয়ে স্নান করার আগে পাঁচ মুঠো পাঁক তুলে নিয়ে, স্নান করে সংকল্প করতে হয়, তারপর আবার মাথা জলে ডোবাতে হয়। সংকল্প শেষ করে দেহ শুদ্ধি করবে গায়ে মাটি মেখে। এসব যে মন্ত্রোচ্চারণ করতে হয় তা বেদে বলা হয়েছে। নাভি পর্যন্ত জলে ডোবাবে। চার হাত জায়গা ছড়িয়ে একটি মণ্ডল রচনা করবে মাত্র। বলতে হবে–হে বসুন্ধরা, তুমি অশ্বক্ৰান্তা, রথক্ৰান্তা ও বিষ্ণুক্রান্তা এই তিনটি প্রকার। হে মৃত্তিকা, শ্রীকৃষ্ণ বরাহ রূপ ধরে তোমাকে উদ্ধার করেছেন। তার শত হাত দিয়ে এখন তুমি আমার গায়ের পাপ নাশ করো। হে মহান, আমাকে পুণ্যবান করো। স্নান করার অনুমতি প্রদান করো। তারপর ওই জলের ওপর হাত রেখে গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু ও কাবেরী তীর্থকে আহ্বান জানাবে, তারপর দেবীদের স্মরণ করবে, যেমন নলিনী, নন্দিনী, সীতা, মালিনী, ত্রিপথগামিনী বিশ্বকায়া শিবা, অসিতা, মহাপাথগা, ক্ষেমা, বৈষ্ণবী সুভগাপূৰ্থী, ভোগবতী, লোপামুদ্রা, দূর্গা, মহালক্ষ্মী, তুলসী, শান্তিপ্রদায়িনী সরস্বতী, সুপ্রসন্না বিদ্যাধরী, কৃষ্ণপ্রাণাধিকা, শতরূপা, অরুন্ধতী অদিতি, অহল্যা, সংজ্ঞা স্বধা, স্বাহা, রতি, দেবহূতি, স্বর্ণরেখা, বিধ্যাধরী এবং কৌশিকী। এরপর মন্ত্র পড়ে স্নান সেরে কপালে তিলক কাটবে। তিলকহীন ব্রাহ্মণ সব কাজের অযোগ্য। গলায়, বুকে ও হাতের ওপর দিকে তিলক কেটে সন্ধ্যাহ্নিক করতে হয়। দেবতাদের উদ্দেশ্যে ভক্তিসহকারে প্রণাম জানাবে।
স্বয়ং হরি বলেছেন, পা ধুয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকবে। যে পা ধৌত করে না, তার স্নাত জপ হোম, সবকিছু বিসর্জন যায়। পুজো করার বিধি বেদে বর্ণিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে শালগ্রাম শিলাকে পুজো দেবে। এ ছাড়া মণি, যন্ত্র প্রতিমা, জল, স্থল, গোরুর পিঠ, গরু এবং ব্রাহ্মণকেও শ্রীহরির উদ্দেশ্যে পুজো করা চলে। শালগ্রাম শিলার জলে অভিষিক্ত হলে সমস্ত তীর্থ স্নান এবং সমস্ত যজ্ঞে, সমান ফল লাভ হয়। শালগ্রাম শিলা ধোয়া জল প্রতিদিন পান করলে মোক্ষ লাভ হয় এবং গোলোকে শ্রীহরির সঙ্গ পায়।
হে নারদ, প্রত্যেক তীর্থস্থানে শালগ্রাম শিলাচক্র থাকে জানাব। কারণ এখানে সচক্র ভগবান বাস করেন। জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ওই স্থানে মৃত্যু হলে রত্নযানে চেপে সে গোলোকে যায়। শালগ্রাম শিলা ব্যতীত পুজো করা বিধেয় নয়।
নারদ এবার তোমাকে পুজোর ক্রম বর্ণনা করছি। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রীহরির পাদ বন্দনা করতে পারো। কেউ ষোলো কেউ বারো, কেউবা পাঁচরকম উপকরণ দিয়ে নারায়ণের পুজো দেয়। তবে একথা জানবে, উপচার যেমনই থাকুক না কেন, আসল হল ভক্তি। যার ভক্তির অভাব, সে হাজার রকম উপচার দিয়ে শ্রীহরিকে তুষ্ট করতে পারে না। যে ষোলোটি উপকরণ শ্রীহরির পুজোয় লাগে তার মধ্যে আছে আসন, পাদ্য, বস্ত্র অর্ঘ্য, আচমনীয়, ফুল, ধূপ, দীপ, চন্দন, উত্তম নৈবদ্য, সুবাস, মালা, নরম ও মনোহর শয্যা, সাধার জল ও অন্ন এবং পান। দ্বাদশ উপাচারের মধ্যে আছে সুবাস, অন্ন, শয্যাও পান ছাড়া উপরোক্ত সবগুলি। পঞ্চ উপচার–পাদ্য, অর্ঘ্য, জল, নৈবেদ্য ও ফুল মূলমন্ত্র উচ্চারণ করে ব্রাহ্মণ এইসব উপকরণ একটি একটি করে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করবে।
গুরুর দান করা মন্ত্রই সব কাজে প্রযোজ্য, কুর্ম দেবতার পুজো করার আগে বর্ণন্যাস করবে এবং অর্ঘ স্থাপন করে সেখানে ত্রিকোণাকৃতি মণ্ডল মনজল তৈরি করবে। তার আগে মন্ত্ৰন্যাস, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ন্যাস, প্রাণায়াম এবং ভূত শুদ্ধি করতে হয়। জলশঙ্খে জল দিয়ে জল দেবতার পুজো করবে। সমস্ত তীর্থের আবাহন করবে। তারপর ওই শাঁখের জলে ওই সমস্ত উপচারগুলি ধুয়ে নেবে। একটা ফুল হাতে নিয়ে যোগাসন করে বসবে একমনে শ্রীকৃষ্ণকে ধ্যান করে মূলমন্ত্রে তার উদ্দেশ্যে সব কিছু উৎসর্গ করবে। তারপর ওই মন্ত্রে ইষ্টদেবতাকে বন্দনা করা কর্তব্য। স্তবকবচ পাঠ করার সময় নানা উপকরণ নিবেদন করতে হয়। মাটিতে মাথা নুইয়ে প্রণাম জানাতে হয় এবং বলতে হয়– হে শ্রীকৃষ্ণ! হে দেবতাগণ, আমাকে রক্ষা করুন। বেদ ও স্মৃতি অনুসারে বৈশ্ববলি প্রদান করে নিত্যশ্রাদ্ধ ও যথা শক্তি ধন দান করা উচিত। তারপর অন্যান্য কাজ করার কথা বলা হয়েছে। এই হল বেদে বর্ণিত কৃতী ব্রাহ্মণের প্রতিদিনের কাজের বিধি।
.
নারদ বললেন, হে প্রভু! আপনি দয়া করে বলুন, ব্রাহ্মণ, গৃহস্থ সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারী, বিষ্ণব বা বিধবা কী ধরনের আহার করবে?
মহাদেব বললেন–লোকের খাওয়ার রুচি একরকম নয়। কোনো মুনি কেবল বায়ু খেয়ে জীবন কাটান। কারও জীবন কেবল ফলের ওপর নির্ভর করে। তবে গৃহস্থ ব্রাহ্মণ হবিষ্য খাবে। নিজে আহার করার আগে নারায়ণকে নিবেদন করে সেই প্রসাদ গ্রহণ করা উচিত। ঠাকুরকে নিবেদন না করে অন্নজল গ্রহণ করলে তা হয় মল ও মূত্রের সমান। একাদশী তিথিতে উপবাসী না থেকে অন্নজল গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণের ত্রৈলোক্য জনিত পাপ হয়।
শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব, কোনো গৃহী ব্রাহ্মণ একাদশীতে একেবারেই অন্ন স্পর্শ করবে না। তাহলে তাকে কালমূত্র নরকে কৃমিদের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় চৌদ্দজন ইন্দ্রে সময়কালব্যাপী একাদশীতে অন্ন গ্রহণ করার ফলে যত না পাপ হয় রামনবমী, শিবরাত্রি ও জন্মাষ্টমীতে অন্ন স্পর্শের ফলে দ্বিগুণ পাপ হয়। নিরম্বু উপবাসী না থাকলেও চলবে। ফলমূল, জল খেতে পারে। কারণ খিদের তাড়নায় উপোসী শরীর কষ্ট পেলে তা আত্মহত্যার সমান। বিষ্ণুকে নিবেদন করে হবিষ্যান্ন ও দিনে একবার খাওয়া যেতে পারে। ভারতের গৃহী ব্রাহ্মণদের জন্য বলা হয়েছে একাদশীর দিন নির্জলা উপবাসী থাকলে বৈকুণ্ঠধামে গমন করা যায় এবং ব্রহ্মার বয়স পর্যন্ত সেখানে বাস করতে পারে।
বৈষ্ণব মতি ও ব্রহ্মচারীদের খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রতিদিন শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদিত অন্নজল ও ফলমূল খায় যে বৈষ্ণব সে শত উপবাসের ফললাভ করে। সে দেবতা সমান হয়। তীর্থে দেবতারা তার স্পর্শ পেতে আগ্রহী হয়। তার সঙ্গে কথা বললে বা তাকে দর্শন করলে সমস্ত পাপ নাশ হয়। সেদ্ধ চালের অন্ন ও চিঁড়ে ব্রাহ্মণ খাবে না এবং শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করবে না। যতি, বিধবা ও ব্রহ্মচারীদের পান খাওয়া নিষেধ। স্বয়ং শ্রীহরি সামবেদে আহ্নিক ক্রম বর্ণনায় বলেছেন –তামার গ্লাসে দুধ পান করা, এঁটো পাতে ঘি খাওয়া, লবণ দিয়ে দুধ খাওয়া ব্রাহ্মণদের পক্ষে হিতকর নয়। এসব হল গোমাংসের ভক্ষণ করার সমান কাঁসার পাত্রে নারকেলের জল, তামার পাত্রে মধু এবং আখ থেকে তৈরি যে খাদ্যদ্রব্য ব্রাহ্মণের কাছে সুরার সমান। ব্রাহ্মণের কাছে সুরার সমান হল। এটা হাতে তুলে জল খাওয়া উচিত নয়, সে সমস্ত কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ব্রাহ্মণ কার্তিমাসে বেগুন, মাঘ মাসে মূলো এবং হরিশয়নে কলমী শাক খাবে না, তা নিশ্চয়ই গোমাংসের মতো, ব্রাহ্মণদের মাছ, মুসুর ডাল এবং সাদা রঙের ডাল খাওয়ার নিয়ম নেই, যদি বা মাছ খাওয়া হয় তাহলে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধ হতে হবে। প্রতিপদে কুমড়ো খেলে অর্থ নাশ হয়। দ্বিতীয়াতে ছোটো বেগুন খেলে শ্রীহরিকে পুজো করার অধিকার হারাতে হয়। তৃতীয়াতে পটল গ্রহণের ফলে শত্ৰু সংখ্যার বৃদ্ধি হয়, ধননাশ হয়। চতুর্থীতে মূলো খেলে, পঞ্চমীতে বেল খেলে কলঙ্ক, ষষ্ঠীতে নিম খেলে পরজন্মে তির্য্যগ যোনি লাভ হয়, সপ্তমীতে তাল খেলে ব্যাধি হয়, অষ্টমীতে নারকেল খেলে রোগ বুদ্ধি নাশ, নবমীতে লাউ ও দশমীতে কলমী শাক গোমাংসের মতো। একাদশী তিথিতে, শিম দ্বাদশীতে, পুঁইশাক, ত্রয়োদশীতে বেগুন, চতুর্দশীতে মাংস খেলে মহাপাপে পড়তে হয়। গৃহস্থরী অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে মোটেও মাংস ভক্ষণ করবে না।
হে নারদ, সরষের তেল ও পাকা তেল যদি ভোরে স্নানে, শ্রাদ্ধের দিনে, অমবস্যা পূর্ণিমাতে সংক্রান্তি, চতুর্দশী ও অষ্টমীতে ব্যবহার করা হয় তাহলে সুফল পাওয়া যায়। স্ত্রী সহবাস, তিলতেল মাখা, লাল রঙের শাক খাওয়া এবং কাঁসার থালায় ভোজন রবিবার, শ্রাদ্ধের এবং ব্রতের দিন বর্জনীয়। যে গৃহী ভোরবেলা, দুপুর বেলা এবং সন্ধেবেলা নিদ্রা যায় রাতে দই খায় বা ঋতুমতী স্ত্রী সম্ভোগ করে সে নরক লাভ করে। রজঃস্বলা স্ত্রী, অবীরা, বেশ্যা, শূদ্রের শ্রাদ্ধের অন্ন সুদখোরগণক, অগ্রদানী ব্রাহ্মণের অন্ন গ্রহণ করলে পাপ হয়। হস্তা, চিত্রা ও শ্রবণা নক্ষত্রে তেল ব্যবহার করা বারণ। মূলা, মৃগশিরা ও ভাদ্রপদ নক্ষত্রে মাংস রান্না করবে না। তা হয় গোমাংসের সমান। দেবতা বা মৃত পিতার উদ্দেশে তর্পণ করার আগে স্ত্রী সম্ভোগ বা ক্ষৌর কাজ করা উচিত নয়। তাহলে অর্পিত জল রক্তের সমান হয় এবং যে জল নিবেদন করে তার অনন্ত নরক বাস হয়। এই হল খাওয়ার বিধিনিধেধ, মঙ্গল অমঙ্গলের কথা।
নারদ বললেন–হে সর্বজ্ঞ! আপনার দয়ায় আমি প্রভূত জ্ঞান অর্জন করলাম। ব্রহ্ম স্বরূপ সম্পর্কে জানতে আমি আগ্রহ। আপনি কি এ বিষয়ে আমাকে জ্ঞান দেবেন।
.
নারদের কথা শুনে জগৎগুরু একটু হাসলেন। তিনি বললেন–ব্রহ্ম নিরুপণ বিষয়ে বলছি, শোনো। তুমি অত্যন্ত গূঢ় প্রশ্ন করেছ। এ এমন জ্ঞান, যা বেদ ও পুরাণেও পাওয়া যায় না। ব্রহ্মের প্রকৃততত্ত্ব নিরুপণ করা সাধ্যের বাইরে। এই একই প্রশ্ন বৈকুণ্ঠধাম শ্রীকৃষ্ণের কাছে আমি রেখেছিলাম, ধর্ম ও ব্রহ্মারও একই জিজ্ঞাসা ছিল। শ্রীহরি এ বিষয়ে যা বলেছিলেন, তার কিছু জ্ঞান তোমাকে দান করছি। ব্রহ্মতত্ত্ব সমস্ত ত্বত্তের মূল ঠিক যেন অন্ধকারের চোখের মতো। সমস্ত দেহে পরব্রহ্ম সনাতন পরমাত্মা স্বরূপ বিরাজ করে।
তিনিই সমস্ত প্রাণীর কাজের সাক্ষী থাকেন। বিষ্ণুর মন হল প্রজাপতি ব্রহ্মা, আমি অর্থাৎ মহাদেব তার জ্ঞানের আধার, তার প্রকৃতি হলেন স্বয়ং ঈশ্বরী প্রকৃতি। তা সত্ত্বেও আমরা তার দান। তিনি যেমন চালান, আমরা তেমন চলি। অর্থাৎ, বীজ ব্রহ্মের প্রতিবিম্ব স্বরূপ, আসলে সে সমস্ত কাজের ফলভোগ করে, সৃষ্টির সংহার ঘটলে জীবের মৃত্যু হয়। কিন্তু পরম ব্রহ্ম বিদ্যমান থাকেন। আমরা এবং এই জগৎ চরাচর অবশেষে তার মধ্যেই বিলীন হয়ে যাই। তার বিস্তার আকাশের ন্যায়।
কোটি সূর্যের তেজও তার তেজের কাছে ম্লান হয়। তিনি অক্ষয়, তার কোনো আকার নেই। তার ক্ষয় নেই, বৃদ্ধিও নেই। যোগীরা তাকে দেখতে পান, তারা ওই তেজপুঞ্জকে সর্বমঙ্গলময় ও সনাতন ব্রহ্মজ্ঞানে পুজো করেন। তার ধ্যান করেন। তিনি সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন আবার সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত। তিনি পরমপুরুষ, তিনি পরমানন্দের কারণ। নির্গুণ পরমব্রহ্মে নির্গুণ প্রকৃতি স্বাভাবিক গুণ মাত্র, ঠিক যেন আগুনের দাহিকা শক্তি।
হে মুনি, সেই পরমানন্দ পরমপুরুষ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে নিজের ইচ্ছায় আপন অংশে সগুণ প্রকৃত বিষয়ী পুরুষে পরিণত হন। তখন ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি তার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকে। মাটি ছাড়া কুমোর যেমন ঘট তৈরি করতে পারে না। তেমনই প্রকৃতি ভিন্ন সৃষ্টিকার্য চলে না। মৃত্তিকা নিত্য কিন্তু ঘট অনিত্য, তেমনই প্রকৃতি ও পরমব্রহ্ম নিত্য, কিন্তু তাদের সৃষ্টি সব অনিত্য, অনেকে বলে থাকেন প্রকৃতির থেকে ব্রহ্ম শ্রেষ্ঠ, আসলে তারা দুজনেই সমান, তাদের নিত্যতা ধ্রুব সত্য। বেদ ব্রহ্মের লক্ষণ উল্লেখ করে বলেছেন –ব্রহ্ম সকলের আত্মা, তিনি নির্লিপ্ত ও সাক্ষীস্বরূপ। তিনি সকলের জায়গা জুড়ে অবস্থান করছেন। তিনি সকলের আদি। সমস্ত কিছুর মূল যে প্রকৃতি সে হল ব্রহ্মের শক্তি, শক্তি ব্রহ্মে অবস্থিত–এই হল প্রকৃতির লক্ষণ, সেই জ্যোতির্ময় ব্রহ্মার ধ্যান যোগীরা করেন। কিন্তু পরম বিবেকে বৈষ্ণব তা মানে না।
তাদের মতে, পুরুষ ব্যতীত সেই তেজের ধ্যান করা কীভাবে সম্ভব, এই তেজ কোথা থেকে এল। তেজ থাকলেই আধার থাকবে। আর আধার হলেই তেজ অবস্থান করবে। তাই তারা এক মনোহর রূপের চিন্তা করে যিনি লক্ষ কোটি যোজন বিস্তৃত চার কোণ বিশিষ্ট অতি সুন্দর গোলক পুরীতে বাস করেন। এই গোলকধামের কোনো আধার বৈকুণ্ঠধামের থেকে পঞ্চাশ কোটি যোজন ঊর্ধ্বে এর অবস্থান। বিরজা নদী একে বেষ্টন করে আছে। এখানে গোপ ও গোপীরা তার পার্ষদ। তুলসী বনে ভরা। গোলকধামের মধ্যে আছে লক্ষ কোটি আশ্রম ও একশো মন্দির, বনে বনে পরিজাত ফুলেরা ফুটে আছে। কস্তুভমনি ও ইন্দ্রনীলমনির ফল গাছে গাছে ঝুলছে। হীরে দিয়ে তৈরি সিঁড়ি। উৎকৃষ্ট মনির তৈরি কপাট। রত্ন প্রদীপ সর্বদা গোলকধাম আলোকিত করে রেখেছে।
চিত্রবিচিত্র শোভামণ্ডিত সুন্দর রত্নসিংহাসনে সবার ঈশ্বর এক পরম পুরুষ উপবেশন করে আছেন। তার চোখদুটো শরৎকালের মেঘহীন দুপুরের সূর্যের তেজকেও হার মানিয়ে দেয়। তার মুখের সৌন্দর্যের কাছে পূর্ণিমার চাঁদও বুঝি লজ্জা পায়। তার ঠোঁটে অল্প হাসি, হাতে বাঁশি। পীত রঙের বস্ত্র তিনি পরিধান করেছেন। হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছে মালতী মালা। ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় তিনি দণ্ডায়মান। তার পায়ে নূপুর, ময়ুরের শিখি তার মাথার চুড়ার সৌন্দর্য, বৃদ্ধি করেছে। তিনি চন্দনে সুবাসিত। তার টিকালো সুন্দর নাক। ঠোঁট দুটি যেন পাকা বিম্বফল। তিনি গোপিকাদের দ্বারা বেষ্টিত।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এবং অন্যান্য দেবতারা তার পুজো করেন। তিনি সুরসিক রাসেশ্বর। তিনি ভক্তদের দয়া প্রদর্শন করেন। তিনি সিদ্ধিদাত্রী সর্ব স্বরূপ, তিনিই ঈশ্বর। রাসমণ্ডলে গোপ গোপিনীদের সঙ্গে শ্রীরাধিকা কৃষ্ণ লীলায় মেতে উঠেছিলেন। দুই হাতবিশিষ্ট কিশোর শ্রীকৃষ্ণই শ্রীরাধিকার ঈশ্বর। “কৃষি” অর্থাৎ সমস্ত কিছু আর “ন” কথার অর্থ আত্মা। অর্থাৎ যিনি সর্বাত্মা, তিনিই হলেই পরম ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণ, আবার কৃষ্ণ হলেন আদি পুরুষ অর্থাৎ “কৃষির সব এবং “ন” এর আদি।
শ্রীরাধিকার দুই হাত বিশিষ্ট কৃষ্ণ যখন বৈকুণ্ঠধামে কমলার পতি হিসেবে বিরাজ করেন, তখন তার চার হাত দেখা যায়। তার পার্ষদরাও চতুর্ভুজ। তিনি বিষ্ণু রূপে জগতের রক্ষাকর্তা, আবার শ্বেতদ্বীপে লক্ষ্মীর স্বামী, আমরা সব সময় যে বাঞ্চত, পরমব্রহ্মের ধ্যান, সেবা ও চিন্তা করে থাকি।
নারদ এবার গন্ধর্ব রাজের কাছ থেকে পাওয়া শিবস্তব পাঠান্তে প্রণাম করলেন। নারদের স্তবে মৃত্যুঞ্জয় মহাদেব অত্যন্ত তুষ্ট হলেন। তার অভীষ্ট পূরণ করলেন। এবং নারায়ণের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
.
সৌতি বললেন–মহাদেবের আদেশে নারদ মুনি এসে হাজির হলেন নারায়ণের আশ্রমে। কুলগাছে ছাওয়া সেই আশ্রম। নানারকম ফুল গাছ। হিংস্র প্রাণীরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য ঋষির প্রভাবে ওইসব জানোয়ারেরা হিংসা করতে ভুলে গেছে। এই মনোরম আশ্রম স্বর্গের সৌন্দর্যকেও হার মানায়। দুর্গম বনের চারপাশ পরিপূর্ণ, মাঝে আশ্রম। তাই সচরাচর সেখানে যেতে অনেকে ভয় পেত। সভার মধ্যস্থলে পঞ্চাশ কোটি মহর্ষি পরিবৃত্ত হয়ে জ্যোতি তেজসম্পন্ন সেই মনোহর ঋষিকে নারদ দেখতে পেলেন। তার পার্ষদ সিদ্ধ, পুরুষের সংখ্যা তেষট্টি কোটি। যোগীদের গুরু নারায়ণ এক রত্নসিংহাসনে বসে কৃষ্ণার্জুনমরুলীলা সঙ্গীত শুনছিলেন, বিদ্যাধরীরা নৃত্য প্রদর্শন করছে। নারায়ণ তখন পরমাত্মা পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের জপ করছিলেন।
ব্রহ্মপুত্র নারদ নারায়ণকে প্রণাম জানালেন, রত্নসিংহাসন থেকে উঠে এলেন নারায়ণ। নারদকে আলিঙ্গন করলেন। তার আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। রত্নসিংহাসনে বসতে বললেন।
নারদ নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করলেন। তারপর সেই ঋষি শ্রেষ্ঠ সনাতন ভগবান নারায়ণকে প্রশ্ন করলেন– হে ভগবান, দুর্গম বেদসমূহ সম্পর্কে আমার পিতা ব্রহ্মার কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেছি। স্বয়ং মহাদেবও আমাকে মন্ত্র ও জ্ঞান দান করেছেন। তথাপি আমার জ্ঞান পিপাসা মেটেনি। জন্ম, মৃত্যু, জরা বিনষ্ট হয় যে কৃষ্ণের গুণগান শুনলে, আপনি তা আমাকে বলুন। দেবতারা, মুনিরা, বুদ্ধিমান মনুরা যার ধ্যান করেন। সৃষ্টি কার থেকে হয় এবং কোথায় গিয়ে তা বিলীন হয়? যিনি সমস্ত কিছুর কারণ সেই সর্বেশ্বর বিষ্ণু আসলে কে? হে বিভু। আপনি কৃপা করে আমার কৌতূহল নিরসন করুন।
নারদের প্রশ্ন শুনে নারায়ণ মুচকি হাসলেন।
.
শ্রী নারায়ণ বললেন–হে নারদ, তুমি সেই ভুবনপাবনীর পবিত্র কথা শুনতে আগ্রহী। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহশ্বেরাদি দেবতারা মুনীরা, যোগীন্দ্র, মনু, সরস্বতী, লক্ষ্মী, দূর্গা– সকলেই সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের চরণ বন্দনা করেন। স্ত্রীরূপ সাপে ঘেরা অত্যন্ত ভয়ংকর গভীর সংসার সাগর পার হয়ে যে হরির দাস হতে চায়, সে শ্রীহরির পাদবন্দনা করবে। যিনি বেদ বেদাঙ্গের বিধান কর্তা, জন্ম, মৃত্যু ও শোকের আকুল হওয়া লোক সেই শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের পুজো করবে। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বরাহ রূপ ধরে দাঁতের সামনের দিক দিয়ে মেদিনীকে উদ্ধার করেছিলেন, তিনি নিজের লোমকূপের সমান অংশ দ্বারা বিশ্বকে ধারণ করে আছেন, তাঁর চরণে শতকোটি প্রণাম। প্রকৃতি থেকে আলাদা, সর্বব্যাপী বিরাজমান, সেই ভগবানের ধ্যান সকলে করে। এ জগতে এমন কেউ নেই যে, তার কাজের হিসাব দিতে পারবে। তুমিও সেই শ্রীহরির পাদপদ্ম বন্দনা করো। ব্রহ্মা, মহাদেব, বিষ্ণু, প্রভৃতি দেবতারা সেই মহান বিরাট অংশে সৃষ্ট। আমরা, তোমরা, সুরপতিগণ, মুনি ও মুনীরা সেই ভগবানের কলার কলাংশ মাত্র। তিনি হাজার মস্তক বিশিষ্ট অনন্তদেব। একটি সাদা সরষের মতো এই জগৎ চরাচরকে মস্তকে ধারণ করে আছেন। তিনি কচ্ছপের ওপর হাতির পিঠে মশার ন্যায় অবস্থান করছেন। সেই কচ্ছপ তার কণার কণা দিয়ে তৈরি।
সেই সর্বব্যাপী গোলকপতি, পরমেশ্বর, পরমব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণের যশের কথা বেদসমূহ ও পুরাণগুলি স্পষ্ট করে বলতে অক্ষম। হে নারদ, তুমি সেই সর্বেশ্বর ঈশ্বরকে ধ্যান করো। সেই পরমেশ্বর বিধাতার বিধাতা সবার আগে। তিনি নিত্য প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেন, যিনি জগতের মাতা সকলে যাকে ভক্তিদায়িণী শ্ৰী বলে বর্ণনা করে থাকে। প্রকৃতি ও পরমেশ্বরের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। সমস্ত নারীজাতি তার অংশজাত। শ্রীকৃষ্ণ নিজে পরমাত্মা, তবুও প্রকৃতি ছাড়া তিনি শক্তি প্রদর্শন করতে পারেন না, তাঁকে বাদ দিলে সৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে যাবে।
হে বৎস, তুমি বাবার কাছে ফিরে যাও। পিতা হলেন গুরুর গুরু। তাঁর আদেশ পালন করা পুত্রের কর্তব্য। এর ফলে তুমি হবে সর্বত্র জয়ী এবং পূজনীয়। বস্ত্র, অলংকার, চন্দন দিয়ে যে ব্যক্তি স্ত্রীকে বিশেষভাবে ভালোবাসে, তার প্রতি, প্রকৃতি সদয় হয়। স্ত্রীদের অপমান করার অর্থ প্রকৃতিদেবীকে অমর্যাদা করা। রাধিকা হলেন শ্রীকৃষ্ণের অন্য সব কান্তার থেকে বেশি প্রিয়। সর্বসম্পৎ স্বরূপিণী সেই প্রকৃতি লক্ষ্মী নারায়ণেরও প্রিয়া। নারায়ণের প্রিয়া সরস্বতী, যিনি বিদ্যা ও রাগের দেবী। সাবিত্রী হলেন বেদমাতা ও বিধাতার প্রিয়। গণেশ জননী দূর্গা মহাদেব প্রিয়া এই হল প্রকৃতির পাঁচটি প্রকার।