পঞ্চপিশাচের কাহিনি
শ্রীহরি বললেন– এবার পাঁচ পিশাচের গল্প বলছি শোনো।
সংসারের অশান্তি সহ্য করতে না পেরে এক ব্রাহ্মণ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল এক গভীর অরণ্যে। ঘুরতে ঘুরতে গভীর অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করল। দেখতে পেল অত্যাশ্চর্য ভয়ঙ্কর দৃশ্য- গাছের ডাল থেকে ঝুলছে একটা মরা দেহ। আর পাঁচটা প্রেত সেই দেহ থেকে মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে আর উল্লাস করছে।
ব্যাপার স্যাপার দেখে ব্রাহ্মণের পিলে চমকে গেল। সর্বাঙ্গ কাঁপছে। পিশাচ তো নয়। যেন পাঁচ পাঁচটা জ্যান্ত কঙ্কাল। কোটরাগত চোখ। পেট-পিঠ আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। হাড়গুলো গোণা যায়, নাকহীন।
ব্রাহ্মণকে দেখে তারা মরাটাকে ফেলে এগিয়ে এল জ্যান্ত টাটকা মাংস খাবে বলে। সরু সরু কাঠির মতো পা ফেলে ছুটে এল, লম্বা হাত বাড়িয়ে দিল। এবার শুরু হল ব্রাহ্মণকে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া। প্রত্যেকেরই একই কথা– আমি আগে ধরেছি, তাই আমি আগে খাব।
ব্রাহ্মণ দেখল এই প্রেত-পিশাচের হাত থেকে একমাত্র শ্রীগোবিন্দই তাকে রক্ষা করতে পারে নতুবা প্রাণটা দিতে হবে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভগবানের স্মরণ করল- হে কৃষ্ণ, হে মধুসূদন, বিপদত্তারণ, এই সংকট থেকে আমাকে রক্ষা করো। তুমি আমার একমাত্র ভরসা, তুমিই অগতির গতি।
ব্রাহ্মণের সেই আকুল প্রার্থনা আমার সিংহাসন নড়িয়ে দিল। ব্রাহ্মণকে ওই পিশাচদের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সেখানে এলাম।
এখন পিশাচেরা ব্রাহ্মণকে নিয়ে আকাশপথে ওড়ার তোড়জোড় করছে, নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে খাবে বলে হয়তো। তখনই গাছের ডাল থেকে কীভাবে যেন মৃতদেহটা পড়ে গেল। পিশাচেরা তা লক্ষ্য করে ফিরে এল নীচে। একটাকে সামলাতে গিয়ে আর একটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তারা তাড়াতাড়ি ব্রাহ্মণকে নিয়ে ঐ মৃতদেহের সামনে এল।
জীবন্ত আর মৃত –দুটি দেহ নিয়ে তখন পিশাচেরা উড়ে চলেছে শূন্যপথে। আমি ওদের অনুসরণ করলাম, অবশ্য গোপনে। ঠিক সেই সময় ওই পথ দিয়ে যক্ষ মণিভদ্র যাচ্ছিল। তাকে বললাম– ওই পিশাচদের হাত থেকে ওই মৃতদেহটা ছিনিয়ে নাও, দেখো ব্রাহ্মণের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
আমার আদেশ পেয়ে যক্ষ বিশাল আকারের এক পিশাচের রূপ ধরল। সে তার লম্বা লম্বা হাতের দ্বারা সেই শব কেড়ে নিল পাঁচ পিশাচের কাছ থেকে।
পর্বতের মাথায় ব্রাহ্মণকে রেখে পিশাচেরা মণিভদ্রকে তাড়া করল। তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিলে তারা মানবে কেন? কিন্তু মণিভদ্রের শক্তির কাছে তারা হেরে গেল। মণিভদ্র বাগিয়ে দিল এক ঘুষি। মাথা ঘুরে পড়ে গেল সবকটা পিশাচ। মণিভদ্রও পালিয়ে গেল। তাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে এল পর্বতের ওপর, এবার আয়েস করে ব্রাহ্মণকে খাবে। কিন্তু অবাক কাণ্ড! ব্রাহ্মণকে স্পর্শ করতেই তারা বিদ্যুৎ পিষ্টের মতো ছিটকে গেল। তারা তাড়াতাড়ি হাত জোড় করে দাঁড়াল।
পিশাচদের এমন অনুগত ভাব দেখে ব্রাহ্মণ আশ্চর্য হল।
পঞ্চ পিশাচ বলল– হে ব্রাহ্মণ, আমাদের মাফ করুন। না জেনে আর একটা পাপ কাজ করে ফেলছিলাম।
বিস্মিত কণ্ঠে ব্রাহ্মণ জানতে চাইলেন– তোমাদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
–আপনার স্পর্শে আমরা গত জন্মের সব কথা মনে করতে পারছি।
ব্রাহ্মণ বললেন–তোমাদের পরিচয় কী?
–আমি হলাম পৰ্যষিত, পিশাচদের মধ্যে একজন বলল, আর এদের নাম সূচীমুখ, শীঘ্রক, রোধক আর লেখক।
–তোমরা পিশাচ হলে কীভাবে?
পর্য্যুষিত জবাব দিল –পিতৃশ্রাদ্ধাদি শেষ করে ব্রাহ্মণ ভোজন করালাম। কিন্তু এক ব্রাহ্মণ তখনও এসে পৌঁছাননি। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছিল। ওই ব্রাহ্মণের জন্য অপেক্ষা না করে আমি খেয়ে নিলাম। তারপরেই ওই ব্রাহ্মণ এসে হাজির হলেন। কিন্তু কী খেতে দেব? খাবার তো নেই। তাই পাত্রগুলোর গায়ে লেগে থাকা খাবার আর নিজের এঁটো খাবার থেকে কিছুটা নিয়ে ওই ব্রাহ্মণকে ভোজন করালাম। এ হল চরম পাপ। যার ফলে পিশাচ হলাম। সেই থেকে আমি হলাম পিশাচ পর্য্যুষিত।
সূচীমুখ তার কাহিনি শোনাল–ক্ষত্রিয় বংশে আমার জন্ম হলেও সেই ধর্ম মানতাম না। ভীষণ উগ্র স্বভাব। পরের ওপর অত্যাচার করে সুখ পেতাম। একবার এক ব্রাহ্মণীকে ধরে খুব আঘাত করলাম। তাঁর যা কিছু ছিল সব কেড়ে নিলাম। সঙ্গে ছিল তার পাঁচ বছরের ছোটো ছেলে। ছেলেটা জল খেতে চাইল। কিন্তু আমি তাকে জল খেতে দিলাম না। বরং তাকে বেত দিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দিলাম। একরত্তি ছেলে, পারে কী সহ্য করতে অত মার। ছটফট করতে করতে মারা গেল। এ দৃশ্য দেখে ব্রাহ্মণী আর বেঁচে রইল না। একটা কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিল।
দিনের পর দিন আমার অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে লাগল। এর জন্য কোনো তাপ-অনুতাপ হত না আমার। মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতাম। তাদের মুখকে সূচী করেছিলাম। তাই পিশাচত্ব লাভ করে হলাম সূচীমুখ। বিশাল পিশাচদেহ পেলাম আমি, কিন্তু মুখ পেলাম ক্ষুদ্র সূচের ছ্যাদার মতো। আপনার স্পর্শে আমি পিশাচমুক্ত হলাম।
শীঘ্ৰক বলল –আমি এক নরাধম, এমনটি সারা দুনিয়া ঘুরেও দ্বিতীয়টি পাবেন না। বণিক বংশে জন্ম নিয়েছিলাম, সর্বদা অকাজ-কুকাজে মেতে থাকতাম। একবার আমি আর আমার দাদা বিদেশে সওদা করতে গিয়ে প্রচুর মুনাফা করে ফিরে এলাম।
নদীপথে ফিরছি। মনে এক বদবুদ্ধি এল, এর কারণ কিন্তু আমি জানি না। ভাবলাম, দাদাকে যদি এখানেই সরিয়ে দিতে পারি, তাহলে মুনাফার অর্ধেক ভাগ দিতে হবে না। যেমন ভাবা, তেমন কাজ।
নৌকো তীরের কাছে নিয়ে এলাম। দাদাকে নিয়ে তীরে নামলাম। তারপর দাদাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিমেষে দ্রুত লাফিয়ে উঠলাম নৌকোতে, নির্দেশ পেয়ে মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল।
বাড়ি ফিরে এলাম। কাঁদতে কাঁদতে বৌদিকে বললাম দস্যুর আক্রমণ রুখতে গিয়ে দাদা মারা গেছে।
স্বামীর শোকে বৌদি কান্নাকাটি করতে লাগল। তারপর চিতা সাজিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ দিল।
ধনসম্পদ সব আমার হল। মন ভরে সব ভোগ করলাম। কিন্তু এমন মহাপাপ করলাম, যার ফলে আমি পিশাচত্ব লাভ করলাম।
এরপর চতুর্থ পিশাচের পরিচয় প্রদানের পালা। সে বলল –আমি রোধক। চাষির ঘরে জন্ম। মা-বাবা-ভাই-বোন নিয়ে ভরা সংসার। আমার ভাই কোনো কাজ কর্ম করতে চাইত না, ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসত। খাওয়ার সময় হলেই তবে তাকে খুঁজে পাওয়া যেত। তাই তার বিষয়-আশয় আলাদা করে দিলাম। পৃথক হল সে। কয়েকদিনের মধ্যে জমি জায়গা বিক্রি করে দিল। দুবেলা খাওয়া পর্যন্ত জুটল না। মা-বাবাকে নিয়ে আমি তখন বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছি।
ছেলে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরছে, কোন বাবা-মা তা সহ্য করতে পারে বলুন? আমার সংসার থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে নিয়ে মা তার ছোটো ছেলেকে খাবার জোগাত। আমি একদিন টের পেয়ে মাকে যাচ্ছে তাই করে অপমান করলাম। ওদের ঘরে আটকে রেখে দিয়ে তালা লাগিয়ে দিলাম। সেই দুঃখে মা-বাবা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন।
আর আমার ভাই? সেও অনাহারে একদিন মা-বাবার পথ অনুসরণ করল। আমি হলাম পাপী। পাপের ফলে হলাম পিশাচ।
–অবন্তী নগরে আমার জন্ম; পঞ্চম পিশাচ বলতে শুরু করল। রাজপুরোহিত ছিলাম। ছিলাম খুব লোভী, রাজমন্দিরে ঠাকুরের গায়ে সোনার অলঙ্কার আমি চুরি করলাম। রাজা চুরির খবর পেয়ে ঘোষণা করলেন যে চোরকে ধরতেই হবে। তাকে শূলে চড়াব।
আমার কানেও এই রাজপ্রতিজ্ঞার কথা পৌঁছে গেল। ঠিক করলাম, রাজাকে খুন করব। একদিন প্রভাতে রাজবাড়িতে প্রবেশ করলাম। সকলের পরিচিত বলে কেউ বাধা দিল না আমায়। রাজার ঘরে গিয়ে পালঙ্কের নীচে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। রাত হল। ক্রমশ তা ঘন হল। ধারালো অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাজার গলা কেটে ফেললাম। বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। মন্দিরে এসে বিগ্রহের বাকি সব গয়না গাঁটি, প্রতিমার গা থেকে আঁচড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করে নিলাম। তারপর চোরের মতো সেখান থেকে চলে এলাম। বনের পথ ধরলাম। পড়লাম এক হিংস্র বাঘের মুখে। সে আমাকে ভক্ষণ করল। জীবনে যত পাপ করেছি, তার যন্ত্রণা ভোগ করলাম পিশাচ হয়ে। বিগ্রহের গায়ে আচঁড় কাটায় আমি হলাম লেখক পিশাচ।
পাঁচ পিশাচের কাহিনি শেষ হল।
ব্রাহ্মণ জানতে চাইল –তারা এখন কোথায় থাকে? কী খায়?
পিশাচেরা জবাবে বলল –লজ্জা, ধর্ম, ক্ষমা, ভীতি, জ্ঞান যেখানে বিরাজ করে সেখান থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে থাকি। এসব যেখানে নেই সেখানেই আমরা বাস করি। যা খাই তা তো নিজের চোখেই আপনি দেখলেন। অনাচারীদের রক্ত-মাংস আমরা আহার করি। আপনি একজন সিদ্ধ যোগী। তাই আপনার স্পর্শে আমরা আজ ধন্য হলাম। পূর্বস্মৃতি ফিরে পেলাম।
শ্রীহরির মুখ থেকে গরুড় এই কাহিনি শ্রবণ করছিল।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন–ওদের কথাবার্তা আমি অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। আমি তারপর ওদের সামনে নিজমূর্তি ধারণ করে দাঁড়ালাম। ওরা আমাকে দেখে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। পা জড়িয়ে ধরল। আমি তাদের নিরস্ত করলাম। ছ-টা দিব্য বিমানে করে ওই পাঁচ পিশাচ আর বিম্বকসেন নামে ওই ব্রাহ্মণকে নিয়ে গেলাম বৈকুণ্ঠধামে।
গরুড় শ্রীহরির চরণে প্রণাম নিবেদন করে বলল –হে ভগবান, আপনি দয়াময়, আপনার অসাধ্য কিছুই নেই।
বভ্রুবাহন ও প্রেতবাহন।
শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় বাহন গরুড়ের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন একটি একটি করে।
তিনি বললেন–শ্রাদ্ধ কালে পুত্র যে অন্নজল দান করে তা খেয়ে প্রেতলোকে পিতা তৃপ্তি লাভ করে। নরক থেকেও মুক্তি পায়।
গরুড় জানতে চাইল যারা পুত্রহীন, তাদের কী গতি হয়? তাছাড়া ছেলের দেওয়া অন্নজল পিতা যে গ্রহণ করল, তা কী করে বোঝা যায়? হে প্রভু, আপনি আমার এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাকে শান্ত করুন।
শ্রীভগবান বললেন–এ অতি উত্তম প্রশ্ন। সন্তানহীনদের ধনসম্পদের যে অধিকারী হয়, সে-ই অন্নজল দান করতে পারে। যে করবে শ্রাদ্ধ আর যার ধনসম্পত্তি কিছু নেই, নিঃস্ব, এক্ষেত্রে সে দেশের রাজাই তার পারলৌকিক ক্রিয়া করবে, কারণ রাজা হলেন সকলের পালন কর্তা।
এরপর শ্রীকৃষ্ণ একটি সুন্দর উপাখ্যান বললেন।
পুরাকালে বজ্ৰবাহন নামে এক প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। সেই রাজ্যে সর্বদা শান্তি বিরাজ করত। একদিন রাজা তার লোকলস্কর নিয়ে মৃগয়া করতে বেরোলেন। বনে ঢুকেই একটা হরিণকে দেখে তীর নিক্ষেপ করলেন। হরিণের পায়ে লাগল। আহত হয়েও সে প্রাণের তাগিদে ছুটতে শুরু করল। রাজা তার পিছু ধরলেন। ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। কিন্তু খানিক যাওয়ার পর হরিণটাকে আর দেখতে পেলেন না।
এ সময়ে রাজার খুব জলতেষ্টা পেল। সামনেই এক সুন্দর সরোবর, তিনি ঘোড়া থেকে নেমে শীতল জল গন্ডুষ করে পান করলেন। শরীর ও মন জুড়াল। গাছের তলায় বসলেন জিরিয়ে নেবার আশায়। ফুরফুরে বাতাসে রাজার চোখে ঘুম এল। তিনি ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লেন।
আধো ঘুম আধো তন্দ্রার মধ্যে রাজা একটা বিশ্রী কটু গন্ধ পেলেন। নাক কুঁচকে চোখ মেলে দিলেন। কী আশ্চর্য দৃশ্য! ভূতরাজা তার বিশাল ভূতবাহিনী নিয়ে রাজার দিকেই এগিয়ে আসছে।
রাজা তড়াক করে উঠে বসলেন। ধনুকে তীর সংযোজন করলেন। ভূতের দলকে লক্ষ্য করে তাক করলেন।
ভূত রাজা বলল –দাঁড়ান, ধনুক নামান, তীর ছোঁড়ার আগে আমার কথা শুনুন।
রাজা ধনুকসহ হাত নামিয়ে নিলেন।
ভূতরাজ বললেন– হে রাজা, আমি হলাম প্রেতবাহন, পিশাচদের রাজা। গতজন্মে আমি ছিলাম এক বণিক, তখন নাম ছিল সুদেব। সে সময়ে দানধ্যান করেছি অনেক। সৎপথে থেকেছি। ধর্ম মেনে চলেছি। তবুও আমাকে মৃত্যুর পরে ভূত হতে হল।
রাজা অবাক হলেন। জানতে চাইলেন– এর কারণ কী?
প্রেতরাজ বলল –আমি ছিলাম নিঃসন্তান। এমনকি কোনো আত্মীয়স্বজন না থাকায় অন্নজল পেলাম না। তাই হলাম পিশাচ।
–আর ওরা? রাজা ভূত-বাহিনীর দিকে চোখ তুলে জানতে চাইলেন।
ভূতরাজা বলল –ওদের অবস্থাও আমারই মতো। আমাদের বীভৎস চেহারা দেখে সকলে ভয় পায়। কেউ সামনে আসতে চায় না। মনের দুঃখের কথা কাউকে বলতে পারছি না। আপনি দেশের পালনকর্তা। আপনাকে সব বললাম। আপনি আমাদের জন্য পিণ্ডদান করুন। বৃষ দান করে শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন করুন।
ঠিক এই সময়ে রাজার লোকজন রাজাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে হাজির হল। ভূত বাহিনীকে আর দেখা গেল না।
রাজা নিজ রাজ্যে ফিরে এসে নিয়মমতো বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ করলেন ওইসব ভূত পিশাচের উদ্দেশ্যে।
শ্রীহরি এবার বললেন–রাজা হলেন প্রজার পাপতানেষু কারণ। তিনি প্রজাকে পাপ থেকে উদ্ধার করতে পারেন।
গরুড়ের দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে শ্রীহরি বললেন–তোমাকে এমন এক কাহিনি শোনাব, নিষ্ঠাভরে পারলৌকিক ক্রিয়া করলে, নবরূপে পিতৃগণ পৃথিবীতে সেইস্থানে ফিরে আসে বুঝতে পারবে।
পিতৃসত্য পালনের জন্য রামচন্দ্র, তাঁর ভাই লক্ষণ ও স্ত্রী সীতাদেবীকে নিয়ে বনবাসে গিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে ভাই ভরতের কাছ থেকে জানতে পারলেন, অযোধ্যার রাজা ও তাদের পিতা দশরথ মারা গেছেন। তিনি বউ এবং ভাইকে সঙ্গে নিয়ে অরণ্য মধ্যে অশৌচ পালন করলেন। তারপর পিতার উদ্দেশ্যে অন্নজল দান করলেন। শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গেলে অতিথিরা খেতে বসলেন। সেখানে বহু মুনি-ঋষিরা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু বনবাসী রামচন্দ্রের আয়োজন ছিল অত্যন্ত অল্প।
সবাইকে সাদরে আসন গ্রহণ করতে বললেন–রাম। তারপর সীতাকে ডাকলেন পরিবেশন করার জন্য। সীতা অন্নের পাত্র নিয়ে সেখানে এসে দাঁড়ালেন। কয়েকজনের পাতে অন্ন দিয়ে তিনি চলে গেলেন। সীতাকে ফিরতে না দেখে রামচন্দ্র উদগ্রীব হয়ে তাকে ডাকতে লাগলেন– সীতা, সীতা, কোথায় গেলে? অতিথিরা যে বসে আছেন?
কিন্তু কোনো সাড়া পেলেন না। তিনি নিজে ভেতরে এলেন। দেখলেন, সীতা নতমস্তকে ভূমিতে বসে অঝোরে কাঁদছেন।
রামচন্দ্র অবাক হয়ে জানতে চাইলেন –সীতা, তুমি কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?
সীতাদেবী চোখ মুছে বললেন–আমি এই বাকল পরে ওই অতিথিদের সামনে যেতে পারব না। তাছাড়া তোমার আয়োজন এত সামান্য, সব মুনিঋষিদের তৃপ্ত করা সম্ভব নয়।
রামচন্দ্র বললেন– অতিথিরা সবাই তোমার আমার পরিচিত। ওই মুনি-ঋষিদের সামনে তুমি কয়েকদিন ধরেই বাকল পরে কাটিয়েছ। অথচ আজ কী এমন হল, যে তুমি ওদের সামনে যেতে চাইছ না?
সীতাদেবী বললেন–আজকের ব্যাপারটা একেবারে আলাদা। অতিথিদের শেষের দিকে বসেছেন তোমার পিতা, তার পাশে তার পিতা, তাঁর পাশে তার পিতা, অবশ্য এঁরা আমার অচেনা। কিন্তু তোমার পিতাকে আমি চিনতে ভুল করিনি। নববধূ রূপে অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে তাকে আমি সোনার থালায় খেতে দিয়েছি। রুপোর গ্লাসে জল। ভালো কাপড় জামা ও অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়েছি। তাই আজ বাকল পরে তাদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জা করছে।
এই বলে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন সীতা দেবী। অগত্যা ভাই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে রামচন্দ্র অতিথিদের ব্যঞ্জনাদি পরিবেশন করলেন। সকলে খেয়ে তৃপ্ত হলেন। আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন তারা।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন–বিনতা নন্দন, সীতা দেবী যা দেখেছেন, তা একবর্ণও মিথ্যা নয়। মৃত্যুর পর । অন্নজল পাওয়ার জন্য সকল পিতৃ পুরুষ উদগ্রীব হয়ে থাকে। বিধি মেনে শ্রদ্ধা সহকারে যে এই কাজ করে সে তাদের দেখতে পায়।