বৃন্দার সঙ্গে জালন্ধরের বিবাহ
ক্রমে ক্রমে জালন্ধর বড় হতে লাগল। বাল্যকালেই সিংহশাবক ধরে খাঁচায় বন্দী করে খেলাধুলা করতে লাগল। আকাশে উঠে বড় বড় পাখি ধরে মাটিতে ফেলতে লাগল। সাগর থেকে স্বর্গ পর্যন্ত তার ঘোর গর্জনে সকলেই ভীত, সন্ত্রস্ত। জালন্ধরের ভয়ে সমুদ্রে বসবাসকারী প্রাণীরা লুকিয়ে থাকল।
সাগরনন্দন ক্রমশঃ যৌবনে পদার্পণ করল। তখন জালন্ধর পিতা সমুদ্রকে বলল–আমায় বাসযোগ্য বিস্তৃত স্থান দান করুন। তার উত্তরে সমুদ্র বললেন–তোমাকে আমি ভূতলে দুর্লভ রাজ্য প্রদান করব। এই সময় দৈত্যগুরু শুক্রাচাৰ্য্য সমুদ্রের কাছে এলে সমুদ্র তার যথাবিধি অর্চনা করে বললেন–আপনার কোন্ কাৰ্য্য আমি সাধন করব বলুন।
শুক্রাচার্য বললেন–হে সাগর, তোমার পুত্র জালন্ধর অবশ্যই আপন বলে ত্রিভুবন ভোগ করবে। জাম্বুদ্বীপে এক মহাপীঠ আছে, ঐ পীঠই জালন্ধরের উপযুক্ত গৃহ। তোমার জন্যই সেই স্থান জলে প্লাবিত রয়েছে, এখন তুমি ওই স্থানকে জল মুক্ত করে তোমার পুত্রকে দান কর। জালন্ধর ওই স্থান থেকে অজেয় ও অবধ্য হবে।
শুক্রাচার্য্যের উপদেশমত সমুদ্র সেই পীঠস্থান থেকে সরে গেলে তা স্থলেই পরিণত হল। শত যোজন বিস্তৃত আর তিনশত যোজন দীর্ঘ সেই স্থানে সমুদ্রের নির্দেশমত ময়দানব একটি রত্নময় পুরী নির্মাণ করল। সেই পুরীতে সমুদ্র শুক্রাচার্য্যকে দিয়ে তার পুত্র জালন্ধরের অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। তারপর মহাপদ্ম জালন্ধরকে সহস্ৰ সংখ্যক সৈন্য অর্পণ করলেন। শুক্রাচার্য জালন্ধরকে স্নেহভরে মৃতসঞ্জীবনী ও রুদ্র মোহিনী মায়া বিদ্যা দান করলেন। সেই দেশ জালন্ধর নামে খ্যাত হল। কালনেমি প্রমুখ পাতালের দৈত্যরা সেখানে উপস্থিত হয়ে শুম্ভাসুরকে জালন্ধরের সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত করলেন। আর জালন্ধর নিজের সৈন্যদের বশীভূত করে মহা আনন্দে পিতৃদত্ত রাজ্য ভোগ করতে লাগল।
স্বর্গে স্বর্ণা এক অপ্সরা ছিল। ক্রৌঞ্চের দ্বারা তার বৃন্দা নামে এক কন্যার জন্ম হয়। অতি সুন্দরী জনমোহিনী প্রমদা বৃন্দাকে কার হাতে সম্প্রদান করবে, এই কথা চিন্তা করে অস্পরা স্বর্ণা দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যকে সব কথা বললেন। দৈত্যগুরু সেই কন্যাকে দেখে চমৎকৃত হলেন, পরে কন্যাকে বললেন–এই রূপ নিয়েই তুমি দীর্ঘায়ু ও সুখিনী হও। এ জগতে যাকে সবচেয়ে সুন্দর রূপে সৃজন করে বিধাতা নিজেই আশ্চর্য হয়েছেন, সেই বীরপুরুষকে পতিরূপে প্রাপ্ত হবে।
যথাসময়ে জালন্ধরের সঙ্গে বৃন্দার বিবাহ হল। বৃন্দাকে স্ত্রী রূপে পেয়ে জালন্ধরও খুব সুখী।
দৈত্যরাজ জালন্ধরের সঙ্গে দেবতাগণের যুদ্ধ, শ্রীহরি ও দেবতাগণের সহায় ইন্দ্র কর্তৃক বলাসুর বধ, বলাসুরের দেহ থেকে সকল রত্ন ও ঠাকুর উৎপত্তি, যুদ্ধে শ্রীহরির পরাজয় ও ক্ষীরসমুদ্র বাস।
ক্ষীরসাগর জালন্ধরের পিতৃব্য। ক্ষীরসাগর মন্থন করে জালন্ধরের সব ধনরত্ন দেবতারা চুরি করে নিয়ে যায়। এমনভাবে চুরি করার কারণ জানার জন্য জালন্ধর দুর্বারণ নামে এক পুত্রকে স্বর্গে পাঠান।
ইন্দ্র দূতকে আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। দুর্বারণ বলল–ত্রিভুবনের রাজা জালন্ধরের দূত আমি। আপনাকে এই কথা বলার জন্য আমাকে তিনি পাঠিয়েছেন যে, কেন আমার মহাধন পূর্ণ কোষাগার হরণ করেছেন? সেইসব, সম্পদ সত্বর প্রদান করে এই স্বর্গপুরী থেকে শীঘ্র চলে যান। তারপর দুর্বারণ বলল–হে ইন্দ্র, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, ফল চাও তবে, জালন্ধরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর।
ইন্দ্র দূতের কথা শুনে হেসে বললেন–জড়রুপী সাগর আমার শত্রু হিমালয়ের পুত্র মৈনাককে নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছে, ধর্মবিদ্বেষী দানবদের সাগর আশ্রয় দিয়ে নিত্য ঘৃত, দধি ক্ষীর দান করছে। এই কারণে আমরা তাকে মথিত, দণ্ডিত ও শ্রীভ্রষ্ট করেছে। জালন্ধর যদি তার সব সৈন্য নিয়েও আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, তবুও তাকে আমরা নাশ করব।
ইন্দ্রের এমন গর্বিত কথা দূতের মুখে শুনে জালন্ধর রাগে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভূতল আর রসাতলের সমস্ত দানবসৈন্যকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করলেন। ঐ সব দানবসৈন্যকে বিকট আকারে দেখতে। তারা সবাই স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করার জন্য স্বর্গ অভিমুখে ধাবিত হল। সেই সময় স্বর্গে দিব্য, ভৌম, অন্তরীক্ষে নানান উৎপাত শুরু হল। প্রচুর ধুলাবৃষ্টি হল। ইন্দ্রের বর্জ্য নিষ্প্রভ হয়ে নীচে পড়ে গেল। এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ইন্দ্র ভয় পেয়ে দেবগুরু বৃহস্পতিকে বললেন–হে গুরুদেব, আমি এখন কি করব? কার শরণ নেব? মনে হয় ভীষণ যুদ্ধ উপস্থিত।
তারপর বৃহস্পতির কথামতো ইন্দ্র দেবতাদের সঙ্গে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। তাঁরা বৈকুণ্ঠ দ্বারে এসে দাঁড়ালে, দ্বারপাল বিজয় প্রভু শ্রীহরির কাছে গিয়ে দেবতাদের আগমনের কথা জানালেন। তখন সমুদ্র নন্দিনী লক্ষ্মীদেবী নারায়ণকে বললেন–প্রভু, আমার ভ্রাতা জালন্ধরকে বধ করবেন না। লক্ষ্মীদেবীর কথা শুনে নারায়ণ ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাদের সামনে এলেন। ইন্দ্র শ্রীহরিকে নমস্কার করে সব কথা জানালে, শ্রীহরি ইন্দ্রকে যুদ্ধের আয়োজন করতে বললেন, এবং তিনি নিজে এই যুদ্ধ দেবতাদের সহায় হবেন একথাও জানালেন।
এরপর দেবতারা যুদ্ধের জন্য সজ্জিত হয়ে দৈত্যসৈন্যদের বধ করবার জন্য সুমেরুর উত্তর ভাগে জমায়েত হল। আর জালন্ধরের সৈন্যরা সুমেরুর দক্ষিণাংশে অবস্থান করল। ইতিপূর্বে শুক্রাচার্য্য বলেছিলেন যে, যে পক্ষ সুমেরুর দক্ষিণাংশে অবস্থান করে যুদ্ধ করবে, তারাই যুদ্ধে জয়লাভ করবে। তারপর দেব-দানবদের ভীষণ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল। উভয় পক্ষের সৈন্যগণের সংঘর্ষণে যেন ত্রিলোক বিধ্বস্থ হবার উপক্রম হল।
শ্রীহরি ক্রুদ্ধ হয়ে গদাঘাতে কালনেমিকে আহত করলেন। কালনেমি তাতে অজ্ঞান হয়ে গেলেও পরে চেতনা লাভ করে বিষ্ণুর অঙ্গে শরাঘাত করলেন। তখন ভগবান শ্রীহরি ক্রোধে কালনেমিকে বধ করলেন। চন্দ্র রাহুকে খড়গদ্বারা আঘাত করলে রাহু তাকে ত্যাগ করে সূর্যের দিকে ধাবিত হল। বহু যুদ্ধ করে সূর্যকে পরাস্ত করবার পর রাহু আবার চন্দ্রকে আক্রমণ করল। তারপর রাহু উচ্চৈঃশ্রবাকে নিয়ে জালন্ধরের কাছে গেল। ময়দানব পাশদ্বারা মৃত্যুকে বন্দী করে জালন্ধরের কাছে সমর্পণ করল। ইন্দ্র নমুচিকে পাশে বন্দী করে তাকে রসাতলে পাঠিয়ে দিল।
এরপর সমরে প্রবেশ করলেন জালন্ধর। তখন ইন্দ্র আর বল দানবের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ চলছে। ইন্দ্রের নিক্ষিপ্ত সমস্ত অস্ত্রই বলের দেহে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ইন্দ্র তখন ছল করে বজ্ৰদ্বারা বলকে আঘাত করলে তার দেহ খণ্ড বিখণ্ড হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। বলাসুরের সেই বিশুদ্ধ দেহের অংশগুলি রত্নবীজরূপে পরিণত হল। তার চোখ থেকে ইন্দ্রনীল মণি, কর্ণ থেকে মাণিক্য, রক্ত থেকে পদ্মরাগ, মেদ থেকে মরকত, জিহ্বা থেকে প্রবাল, দন্ত থেকে মুক্তা, নাসিকা থেকে গারুত্মতের সৃষ্টি হল। বলাসুরের বিষ্ঠাত্রে সৃষ্টি হল কাংস্য, বীর্য্যে রজত, মূত্রে তাম্র, নখরাজিতে সোনা, রক্ত থেকে রস, মেদ থেকে স্ফটিকাদি উৎপন্ন হল। এইভাবে পৃথিবীতে যত রত্ন ধাতু দেখা যায়, সবই বলাসুরের দেহ থেকে সৃষ্টি।
এইভাবে ইন্দ্র বলাসুরকে বধ করলে জালন্ধর ইন্দ্রকে বলল–হে অধম, কপটতার সাহায্যে বলাসুরকে নিধন করে তুই পালাবি কোথায়? এই কথা বলে শর নিক্ষেপ করে ইন্দ্রের সারথি, অশ্ব, গজ, রথ সব বিচ্ছিন্ন করে দিল। ইন্দ্র শরবিদ্ধ হয়ে মুচ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। চেতনালাভ করে ইন্দ্র জালন্ধরের দিকে বজ্র নিক্ষেপ করলে, জালন্ধর সেই বজ্র হাতে ধরে ইন্দ্রকে ধরবার জন্য তার দিকে ধাবিত হল। তাকে আসতে দেখে ইন্দ্র রথ ছেড়ে ছুটে পালালেন।
তারপর শ্রীহরি ক্রুদ্ধ হয়ে দৈত্যবাহিনীর বহু সৈন্য বিনাশ করলেন। তখন জালন্ধরের আদেশে সৈন্যরা শ্রীহরিকে সব দিক থেকে ঘিরে ফেলল, আর বাণ নিক্ষেপ করল। বিষ্ণু ক্রোধে অসুরদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সকলকে ধরাশায়ী করলেন।
তারপর জালন্ধরের সঙ্গে ভীষণভাবে সংগ্রামে রত হলেন।
এদিকে শুক্রাচাৰ্য মন্ত্রবলে সমস্ত দৈত্য-সৈন্যগণকে জীবিত করে দিলে, তারা আবার দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে উঠল। তাতে বহু দেবতার বিনাশ হলে দেবগুরু বৃহস্পতি দ্রোণাচল থেকে ঔষধি এনে নিহতদের বাঁচিয়ে দিলেন। জালন্ধর এই ব্যাপার জানতে পেরে কৌশলে। দ্রোণাচলকে রসাতলে পাঠিয়ে দিল। আবার যুদ্ধ আরম্ভ হলে দেবতারা নিহত হলেন। তখন বৃহস্পতি। দ্রোণাচলের ক্ষয় হেতু ঔষধি না পেয়ে জীবিত দেবগণকে বললেন–ঔষধি আর পাওয়া যাচ্ছে না। অতএব দেত্যদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হওয়া কখনই সম্ভব নয়, তোমরা সকলে পালাও, তখন দেবগুরুর বাক্যে দেবতারা রণস্থল পরিত্যাগ করে চলে গেল। বৃহস্পতিও সেই পথ ধরলেন।
এরপর বিষ্ণু আর জালন্ধরের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ হল। হঠাৎ জালন্ধর বিষ্ণুর কাছে এসে এক হাতে বিষ্ণুর গরুড় এবং অন্য হাতে তার রথ ধরে শূন্যপথে ঘুরিয়ে শ্বেতদ্বীপে নিক্ষেপ করলেন। তখন শ্রীহরি রথ ও গড়ুর বিহীন হয়েও জালন্ধরের হৃদয়ে তীক্ষ্ণ শক্তি নিক্ষেপ করলেন। তাতে দৈত্যরাজ পতিত হল। আবার চেতনা লাভ করে জালন্ধর বিষ্ণুর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ শুরু করল। লক্ষ্মীর প্রেমে হরি জালন্ধরকে বধ করলেন না, পরন্তু তিনি নিজেই তার মারে পতিত হলেন।
তখন জালন্ধর জগন্নাথকে ধরাপৃষ্ঠে পতিত হতে দেখে রথে তুলে নিজ শিবিরে নিয়ে এল। লক্ষ্মীদেবী যেখানে উপস্থিত হয়ে অচেতন হরিকে দর্শন করে জালন্ধরকে বললেন–ভ্রাতঃ তুমি বিষ্ণুকে জয় করেছ। কিন্তু ভগিনীর বৈধব্য সম্পাদন করা উচিত নয়।
লক্ষ্মীর কথায় জালন্ধর বিষ্ণুকে যুক্ত করে ভগিনী এবং শ্রীহরিকে প্রণাম করলেন। তখন বিষ্ণু দৈত্যরাজকে বললেন–তোমার ব্যবহারে আমি তুষ্ট, তুমি বর প্রার্থনা কর। জলন্ধর বললেন–হে কেশব যদি তুষ্ট হয়ে থাকেন, তাহলে এই বর প্রার্থনা করছি, আপনি কমলার সঙ্গে আমার পিত্রালয়ে বাস করুন। শ্রীহরি তাকে বর প্রদানের জন্য কমলাকে নিয়ে ক্ষীরসাগরে গমন করলেন। জালন্ধরকে বধ হেতু দেবগণসহ বিষ্ণু ও শিবের উদ্যোগে, চক্ৰসৃষ্টি, রাহুকে দূতরূপে শিবের নিকট প্রেরণ, জালন্ধরের পুনরায় যুদ্ধযাত্রা, বৃন্দা কর্তৃক নিষেধকরণ এবং জালন্ধর ও শিবের মধ্যে তুমুল সংগ্রাম।
দেবতাগণ দেবাসুর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত হল। তারপর জালন্ধর শুম্ভকে স্বর্গ-সিংহাসনে আর নিশুম্ভকে যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত করে নিজে জালন্ধর পীঠে বহুকাল রাজত্ব করল। দৈত্যরাজ সকল যাতে ভাগ ভোগ করতে লাগল। তার রাজত্বকালে সকলেই সুখে-স্বচ্ছেন্দে বাস করতে লাগল। কোন জরা ব্যাধি ছিল না। সকলেই সৎপথে কাল যাপন করতে লাগল। কারও প্রতি কারও হিংসা-দ্বন্দ্ব ছিল না।
অন্যদিকে দেবতারা চরম দুর্দশা ভোগ করতে লাগল। যজ্ঞানুষ্ঠানও বন্ধ। তখন দেবতারা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে দুঃখের কথা জানালে, ব্রহ্মা তাদের নিয়ে শিবের কাছে গেল। শঙ্করের বহু স্তব স্তুতি করে দেবতারা তাদের দুঃখের কথা নিবেদন করলে দেবদেব মহাদেব বললেন–বিষ্ণুর হাতে যে শত্রুর নিধন হল না, সেখানে আমি কি করব? প্রাচীন অস্ত্রের দ্বারা জালন্ধরকে বিনাশ করা যাবে না, হে ব্ৰহ্মণ, আপনি সুরগণসহ ক্রোধযুক্ত তেজ নিঃসরণ করুন।
তখন শিবের বাক্যে ব্রহ্মাসহ সব দেবতারা তাদের ক্রোধযুক্ত তেজ ত্যাগ করলেন, স্বয়ং রুদ্রও ত্রিনেত্ৰজাত তেজ ত্যাগ করলেন। তারপর শিবের স্মরণে শ্রীহরি সেখানে উপস্থিত হলে, শিব বললেন, হে হরি, কি কারণে আপনি জালন্ধরকে বধ করলেন না? আর কি কারণে দেবগণকে পরিত্যাগ করে ক্ষীরোদ সাগরে শয়ন করে আছেন?
শিবের প্রশ্নের উত্তরে বিষ্ণু বললেন–আমার ভাৰ্য্যা সাগর নন্দিনী, আর জালন্ধর সাগরনন্দন, আমি যদি জালন্ধরকে বিনাশ করি তাহলে লক্ষ্মী আমার প্রিয়া থাকবে কেমন করে? তাই হে হর, আপনিই জালন্ধরকে যুদ্ধে বিনাশ করুন।
শিবের ইচ্ছায় বিষ্ণু ক্রোধযুক্ত তেজ ত্যাগ করলেন। এরপর দেবদেবি শম্ভু হাস্য করে সব তেজের উপর উৎপতিত হয়ে নৃত্য শুরু করলেন। আর দেবতারা সহর্ষে বাদ্যধ্বনি করলেন। তখন শম্ভুর নর্তন ও মর্দনে এক চক্র উৎপন্ন হল। শিব সেই চক্র উৎপন্ন ব্রহ্মার হাতে তুলে দিলেন কিন্তু সেই চক্রের তেজে ব্রহ্মার মস্তক দগ্ধ হতে থাকলে শিব সেই চক্র নিয়ে নিজের কাছে রাখলেন।
তারপর দেবর্ষি নারদ জালন্ধরের কাছে গিয়ে বধের জন্য শিব সচেষ্ট হচ্ছে জানালে, জালন্ধর ক্রোধে রাহুকে পুত্র রূপে কৈলাসে শিবের কাছে পাঠাল। রাহু শিবের কাছে উপস্থিত হয়ে বলল–হে গিরিশ, তুমি নিষ্ঠুন, তপোনিষ্ঠ, ধর্ম বর্জিত, তোমার পিতামাতা নেই, কোন গোত্রও নেই। মহাবাহু জালন্ধর ত্রিভুবনপতি, তাই তুমি তার বশ্য।
কিন্তু মহেশ্বর রাহুর কথার কোন উত্তর দিলেন না। তখন রাহু নন্দীকে বলল–তোমার প্রভু আচার ভ্রষ্ট, তাকে শিক্ষা দাও তুমি, ইনি আমার প্রভুর ক্রোধের সমরে নিহত হবেন। এই কথা বলে রাহু জালন্ধরের কাছে এসে সব কথা জানাল। এমনকি গৌরীর রূপের কথাও জানাল।
দূতের কথায় জালন্ধর সৈন্য সজ্জিত করে শিবের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য উদ্যত হয়ে প্রথমে অনন্ত শয্যায় শায়িত শ্রীহরিকে বলল–আমি তোমার ভোগের নিমিত্ত কি প্রদান করতে পারি?
নারায়ণ হেসে বললেন–তোমার কি প্রিয় কাৰ্য্য আমি করব?
তার উত্তরে জালন্ধর বলল–আমি যুদ্ধে যাচ্ছি, এই সাগরেই তুমি সুখে অবস্থান কর। এই কথা বলে দৈত্যরাজ পিতাকে প্রণাম করে বলল-পিতা, আমাকে আশীর্বাদ করুন, যাতে আমি রুদ্রকে জয় করতে পারি।
তখন সমুদ্র পুত্রকে বললেন–আমার প্রদত্ত রাজ্য ভোগ করে তুমি সুখেই আছ। মর্তকে স্বর্গের থেকেও উন্নত করেছ। তোমার রাজ্যে ধরিত্রী বৈকুণ্ঠের মত বিরাজ করছে। হরিকে তুমি লক্ষ্মীর সঙ্গে এনেছ। তাই তোমাকে আমি নিষেধ করছি, ভিক্ষুক শিবকে তুমি পরিত্যাগ কর। তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব কর না।
কিন্তু জালন্ধর পার্বতীর ওপর অনুরাগবশতঃ পিতার কথা আগ্রাহ্য করে সৈন্যদের কাছে উপস্থিত হলেন। জালন্ধরের পত্নী বৃন্দাদেবী স্বামীকে যুদ্ধের জন্য সজ্জিত দেখে তাকে বললেন–হে নাথ, আপনি শঙ্করের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না। পার্বতীর প্রতি আপনার মন নিবিষ্ট হয়েছে, তা আপন নিবরণ করুন। গৌরী তপস্বিনী, নিরাশ্রয়া, বন্ধ্যা, কাজেই আপনি তাকে ত্যাগ করে আমার ভজনা করুন।
তখন জালন্ধর বৃন্দাকে নানা সান্ত্বনা বাক্যে তুষ্ট করে যুদ্ধের জন্য কৈলাস অভিমুখে যাত্রা করল। কিন্তু মহেশ্বর কৈলাস ত্যাগ করে মানসোও নামে এক দুর্গম মহাপর্বতে গেছেন। এই বার্তা জালন্ধরকে শুক্রাচাৰ্য্য দিলে, জালন্ধর বলল–যেখানে শঙ্কর আছে আমিও সেখানে যাব। তারপর শুক্রাচার্যের সঙ্গে জালন্ধর মানসোও গিরিতে উপস্থিত হল। অসংখ্য দৈত্য সৈন্যতে সেই স্থান বেষ্টিত হল।
সেই সুবিশাল দৈত্য বল দর্শন করে মহেশ্বর পার্বতীকে গিরিশৃঙ্গে সখীদের কাছে রেখে বহুতর প্রমথ সৈন্য নিয়ে নন্দীর সঙ্গে যুদ্ধে গমন করলেন। তারপর তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। প্রমথদের তীক্ষ্ণ বাণে বহু দানব নিহত হল। প্রথমদের দানবরাও আহত করল। কার্তিক গণেশও পরাজিত হলেন। মহেশ্বর তাই দেখে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করলেন। জালন্ধর ও মহেশ্বরের যুদ্ধ বর্ণনাতীত।
মহেশের রূপ ধারণ করে জালন্ধরের পার্বতীর নিকট গমন ও তাকে মোহিতকরণ। শ্রীহরির মায়ায় বৃন্দার দুঃস্বপ্ন দর্শন, শ্রীহরির মায়াপুণ্যাশ্রমে গমন ও বৃন্দার সতীত্বনাশ, বৃন্দার পরমপদ প্রাপ্তি ও বৃন্দাবন নামের সৃষ্টি।
জালন্ধর বহুক্ষণ যুদ্ধ করবার পর চিন্তা করল নারদের মুখে গিরিজার যে রূপ শুনেছি, তাতো আমার তখনও দেখা হল না। তারপর মতলব খাঁটিয়ে শুম্ভ দৈত্যকে ডেকে বলল হে শুম্ভ, তুমি যুদ্ধে আমারই মত পরাক্রমশালী, এখন আমার বস্ত্রাদি নিয়ে তুমি এই সংগ্রাম পরিচালনা কর। এই বলে জালন্ধর নিজের যুদ্ধের পোষাক শুম্ভকে দিয়ে গৌরীকে দেখবার জন্য চললেন। সবার অলক্ষে মানসোত্তর গিরির সুরক্ষিত গুহায় গিয়ে শঙ্করের রূপ ধারণ করল তার দূত দুর্বারণ নন্দীর রূপ ধারণ করল।
সখীগণের সঙ্গে যেখানে গৌরী আছেন, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলে, গৌরীর সখীরা মহেশ্বর ও নন্দীকে দেখে জিজ্ঞাসা করল হে প্রভু, কে এমন দশা করেছে আপনার? হে নাথ, শল্যযুক্ত হয়ে আপনি সংসারী লোকের মত কেন রোদন করছেন? শঙ্কর নন্দীর কাঁধে ভর দিয়ে আসছেন দেখে শঙ্করী। বিস্মিত হলেন, তারপর দেবী যখন শঙ্করের হাতে কার্তিক ও গণেশের ছিন্নমুণ্ড দেখলেন, তখন ‘হা রুদ্র’ বলে কাঁদতে লাগলেন। তার সখীরাও শোকাতুরা হয়ে কাঁদতে লাগল।
কপট শিব দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে গিরিজাকে বললেন–প্রিয়ে, নিহত পুত্রদ্বয়ের জন্য শোক করে আর লাভ কি? এখন তোমারা সানন্দে আমাকে পরিত্রাণ কর।
শঙ্করের এমন অসময়োচিত কুবাক্য শুনে দেবী বললেন–হে নাথ, ভয়ে সমাধি অবস্থানে, শ্রাদ্ধ যাত্রা কালে, গুরু ও বৃদ্ধাজনের সন্নিধানে রতিক্রিয়া জ্ঞানীগণ নিষিদ্ধ বলেছেন। তাই বর্তমান অতীব দুঃখিতা আমাকে কেন আকাঙ্ক্ষা করছেন?
কপট শঙ্কর অম্বিকার এমন কথা শুনে তাঁর রূপে মোহিত হয়ে আপন স্বার্থসাধনের জন্য বলল যে স্ত্রী প্রার্থনাকারী পুরুষকে রতিদান করে না, সে নরকে পতিত হবে, আমি সময়ে পুত্রহারা, প্রমথগণ শূন্য হয়ে ধনশূন্য ছিলাম। সম্প্রতি গৃহশূন্য হয়ে সর্বশূন্য হলাম। এখন আমি স্বগৃহ ত্যাগ করে পত্নী ত্যাগ করে তীর্থে ভ্রমণ করব। নন্দী তুমি আমার আগে গমন কর।
মায়া মহেশের এমন বাক্য শুনে দেবী গিরিজা শোকে একেবারে অভিভূত হলেন। কিন্তু শঙ্করের এই দারুণ ক্ষোভে কোন উত্তর দিলেন না। যিনি স্থাবর জঙ্গম সর্বচরাচর মোহিত করে রেখেছেন, তিনিই মায়া মহেশ কর্তৃক মোহিত হলেন।
এদিকে হরির হৃদয় হঠাৎ ক্ষুব্ধ হল। আরও বিষম উৎপাতের লক্ষণ দেখে তিনি গড়ুরকে পাঠিয়ে সব কিছু অবগত হয়ে বৃন্দাদেবীর সতীত্ব নাশ করবার জন্য যোগমায়া বলে অন্যরূপে নির্গত হলেন। শ্রীহরির সঙ্গে অনন্তদেবও জটা বল্কল ধারণ করে সর্বকাল ফলপ্রদ এক পুণ্যাশ্রম প্রস্তুত করলেন। তারপর হরি সেই বনে মন্ত্রবলে জালন্ধরের ভাৰ্য্যা বৃন্দাকে আকর্ষণ করলেন। বৃন্দার অন্তরে তখন প্রিয় সমাগম চিন্তা প্রকট হল। রাতে এক ভয়ানক বৈধব্য সূচক স্বপ্ন দেখলেন–জালন্ধরের মস্তক বিচ্ছিন্ন, মুক্তকেশী করাল বদনী কালী হাতে খপ্পর নিয়ে তা ভক্ষণ করছে। বৃন্দা গৃহে স্থির থাকতে না পেরে রথে আরোহণ করে এক সৌভাগ্য কাননে এসে উপস্থিত হলেন।
সেই বন তাঁকে সুখ দিতে না পারলে, অন্য বনে বৃন্দাদেবী গেলেন। সেই সময় এক রাক্ষস এসে তাকে বলল আমি শুনেছি, তোমার পতি জালন্ধর শিবের হাতে নিহত হয়েছে। তাই তুমি আমাকেই পতিরূপে বরণ কর।
এই কথা শোনামাত্র বৃন্দাদেবী অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। তখন জটা বল্কলধারী শ্রীহরি সেখানে উপস্থিত হলেন। বৃন্দায় স্মরদূতী তাদেরকে দেখে বিলাপ করলে মাধব বললেন–ভয় নেই, আমরা তোমাদের উদ্ধার করবার জন্য এসেছি, এই বলে তিনি ক্রোধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সেই রাক্ষসকে ভস্ম করে দিলেন।
তারপর শ্রীহরির মায়ামুগ্ধা বৃন্দাদেবী বললেন–কে আপনি, হঠাৎ এখানে এসে আমাকে রক্ষা করলেন আমি আপনার আশ্রমে বাস করে তপস্যা করব।
জটা বল্কলধারী শ্রীহরি বললেন–আমি ভরদ্বাজের পুত্র দেবশর্মা। সকল প্রকার ভোগ ত্যাগ করে এই শিষ্য বালকের সঙ্গে অরণ্যে এসেছি। যদি তুমি আমার আশ্রমে থেকে তপস্যা করতে চাও, তাহলে চল অন্য বনে গমন করি, এই বলে পূর্বদিকে শ্রীহরি গমন করলেন। তার পশ্চাতে স্মরদূতী সহ বৃন্দাদেবীও চললেন।
তারপর বৃন্দাদেবী ছদ্মবেশী শ্রীহরির সঙ্গে আশ্রমে প্রবেশ করে দেখলেন তার পতিদেবতা দিব্যপাল শয়ন করে আছেন। বিস্মিতা বৃন্দাদেবী বললেন–হে নাথ, এই আশ্রমে তুমি কেমন করে এলে? কিভাবে শিবের সঙ্গে যুদ্ধ হল?
তার উত্তরে কপট নারায়ণ বললেন–প্রিয়ে রুদ্রদেব, রৌদ্র চক্ৰদ্বারা আমার মস্তক ছেদন করলে তোমার সাধনাযোগে আমার ছিন্ন শির দেহের সঙ্গে মিলিত হয়ে পুনরায় জীবিত হল।
মায়ারূপী জালন্ধরের এই কথা শুনে বৃন্দার হৃদয়ে পূর্বভাগ জাগরিত হল। প্রিয়তম জ্ঞানে নারায়ণকে গাঢ় আলিঙ্গনে ও রতিলালসায় চুম্বন করতে লাগলেন। তখন শ্রীহরি সুরত ব্যাপারে পরম সুখ অনুভব করলেন। রতিশ্রম জনিত বৃন্দার দেহস্বেদ থেকে তুলসীর জন্ম হল।
এইভাবে কয়েকদিন বৃন্দার অঙ্গ সঙ্গসুখ অনুভব করে শিবকাৰ্য্য স্মরণ করলেন। একদিন রতিক্রিয়ার পর বৃন্দাদেবী দেখলেন, সেই পূর্বের দেখা মুনি তার কণ্ঠলগ্ন হয়ে রয়েছে। হঠাৎ তাকে এই রূপে দেখে কণ্ঠ থেকে বাহুবন্ধন ছিন্ন করে বললেন–মুনিবেশ ধারণ করে আমাকে মোহিত করলেন, আপনি কে?
শ্রীহরি বৃন্দার কথা শুনে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–আমি নারায়ণ। বৃন্দা তোমার স্বামী মায়ারূপে পার্বতীকে মোহিত করবার জন্য কৈলাস শিখরে গেছে। কিন্তু যে শিব, সেই আমি। আমার অভিন্ন হয়েও ভিন্নাকারে বিরাজিত। তোমার জালন্ধর সমরে নিহত হয়েছে, কাজেই এখন আমাকেই তুমি ধ্যান। কর।
শ্রীহরির কথা শুনে বৃন্দা কুপিতা হয়ে বললেন–যদি নিত্য ধর্মের পতি, কেন তিনি পরস্ত্রীতে রত? মনীষীগণ বলেন–ভগবানকেও কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয়। তাই তুমি যেমন আমাকে, মায়া তপস্বীবেশে মোহিত করলে, তেমনি তোমার বধূকেও কোন মায়া তপস্বী হরণ করবে।
বৃন্দার দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে হরি অন্তর্হিত হলে, বৃন্দার বুঝতে বাকী থাকল না যে, এ সবই বিষ্ণুর কাৰ্য। এক সরোবরে বিষ্ণুঃসঙ্গ দূষিত দেহ, ধৌত করে সেই সরোবরের তীরে নির্বিকার চিত্তে আপন দেহকে শোষণ করতে লাগলেন। তারপর তিনি যোগাভ্যাসের দ্বারা পরমপদ প্রাপ্ত হলেন। দেবগণ তার প্রশংসা করে পুষ্পবৃষ্টি করলেন। বৃন্দার স্মরদূতী তাঁর পবিত্র দেহ কষ্টদ্বারা ভস্মে পরিণত করে নিজেও সেই অগ্নিতে প্রবেশ করল। দুই সতীর ভস্মশেষ অপ্সরাগণ মন্দাকিনীর জলে নিক্ষেপ করল। বৃন্দা যেখানে দেহত্যাগ করে মোক্ষধাম প্রাপ্ত হলেন, গোবর্ধন গিরির সমীপেস্থ সেই স্থানই বৃন্দাবন নামে খ্যাত হল। জায়ার দ্বারা পার্বতীর মায়া শিবকে পরীক্ষা, পুনরায় জালন্ধর ও শিবের যুদ্ধজালন্ধর কর্তৃক মায়া গৌরী ও মায়া জয়া সৃষ্টি করে শিবকে মোহিত করেন এবং শিব কর্তৃক জালন্ধরের বধ হল।
মহারাজ যুধিষ্ঠির নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন-হে দেবর্ষি, শিবের রূপ ধরে জালন্ধর কীভাবে পার্বতীকে মোহিত করল, আমাকে বলুন। তার উত্তরে দেবর্ষি বললেন–পুত্রশোকে ব্যথিতা পার্বতীকে মায়া শিব যখন আকাঙ্ক্ষা করল, তখন পার্বতী মনে মনে চিন্তা করলেন আমার স্বামী দেবদেব মহশ্বের কখনই এই অবস্থায় আতুর হতে পারেন না।
এই চিন্তাকরে মায়া শিবকে উপেক্ষা করে স্থান ত্যাগ করে গঙ্গাতীরে গমন করলেন। সেই জলে সখীসহ স্নান করে দেহ সংস্কার করে সখী জয়াকে বললেন–জয়া, আমার রূপ ধরে তুমি ঐ ব্যক্তির কাছে গিয়ে জানবার চেষ্টা কর প্রকৃতই উনি শিব না অন্য জন। যদি তোমাকে আলিঙ্গন, চুম্বনাদি করে, তাহলে নিশ্চয় জানবে, সে কোন অসুর। যদি তোমাকে দেখে আমার শুভাশুভ তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তা হলে জানবে নিশ্চয় তিনি দেবদেব মহেশ্বর।
পার্বতীর আদেশে জয়া মায়া শিবের কাছে গেলে কামপীড়িত জালন্ধর তাকে পার্বতী জ্ঞানে জোর করে আলিঙ্গন ও সুরত ক্রিয়ায় রত হল।
জয়া তখন নিজ রূপ ধারণ করে বলল দৈত্য, আমি পার্বতী নই। তুই বড় দুরাচারী। এই পাপেই তুই মহেশের হাতে নিধন হবি, এই কথা বলে জয়া পার্বতীর কাছে গিয়ে সব বললে দেবী ভীত হয়ে একটি পদ্মের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
এদিকে মানসোত থেকে ফিরে জালন্ধর তার দূতের মুখ থেকে বৃন্দার সব কথা শুনে ক্রোধে বলল–বুদ্ধিমান লোক গৃহস্থিত জামাতাকে কখনও বিশ্বাস করবে না। তারপর চিন্তা করে দুর্বারণকে জিজ্ঞাসা করল এখন কোন কর্তব্য আগে করা দরকার আমার? উত্তরে দুর্বারণ বলল যে যেমন কর্ম আগে করে তেমন কর্মফল তাকে ভোগ করতে হবে। হে দৈত্যপতি, আপনি গৌরীকে হরণ করতে গিয়েছিলেন, আর হরি আপনার বন্ধুকে হরণ করেছেন, আগে আপনি শিবের সঙ্গে সংগ্রাম করুন। যদি হরিকে আগে জয় করতে যান, তাহলে রুদ্র পশ্চাৎ দিক থেকে আপনাকে সংহার করবে। আগে মহেশকে জয় করুন।
এই কথা শুনে জালন্ধর শিবের উদ্দেশ্যে রণক্ষেত্রে গমন করে ভীষণ ভাবে যুদ্ধ শুরু করল। বহুক্ষণ যুদ্ধ হবার পর শিব এক মহাবান দ্বারা জালন্ধরের হৃদয় ভেদ করলেন। এই দেখে দৈত্যগণ শিবকে আক্রমণ করল। যতক্ষণ জালন্ধর অচেতন ছিল ততক্ষণ শিব বহু দৈত্য সৈন্য বিনাশ করলেন।
জালন্ধর চেতনা লাভ করে দেখলেন তার বহু সৈন্য নিহত। ভীত হয়ে শুক্রাচার্য্যকে স্মরণ করলে তিনি সকল সৈন্যকে সঞ্জীবনী মন্ত্রের দ্বারা জীবিত করে দিলেন। আবার প্রচুর দৈত্যসৈন্য যুদ্ধ করছে। দেখে চিন্তিত শিব দেখতে পেলেন ভাগবকে। তাকে বধ করার জন্য উদ্যত হলে, হঠাৎ তার মনে হল ভার্গব ব্রাহ্মণ, ব্রহ্মহত্যা মহাপাপ। একে নিগৃহীত করা উচিত। এই চিন্তা করে তিনি তৃতীয় নয়নদ্বারা এক কৃত্যার সৃষ্টি করে তার দ্বারা শুক্রাচাৰ্য্যকে আবদ্ধ করে রাখলেন।
এই দৃশ্য দেখে জালন্ধর ক্রুদ্ধ হয়ে শিবকে বলল হে শিব, যেখানে বিষ্ণু আছে, তোমাকে সেখানে নিক্ষেপ করব, ক্ষমতা থাকে নিজেকে রক্ষা কর। তারপর ব্রহ্মকেও সাগরে নিক্ষেপ করব। তিন দেবতাকে আবদ্ধ করে আমি সর্বেশ্বর হব। তারপর তুমুল যুদ্ধ শুরু হল।
জালন্ধর মায়াবলে গৌরী ও জয়াকে সৃষ্টি করে শিবের কাছে পাঠাল তাকে মোহিত করবার জন্য। মায়া জরা কাঁদতে কাঁদতে শম্ভুকে বলল হে প্রভু, পার্বতীকে জালন্ধর দৈত্য মানসোত্ত শৈল থেকে হরণ করেছে।
প্রিয়া হরণ বার্তা শুনে শঙ্কর চিন্তান্বিত হলেন। দৈত্যমায়ায় শঙ্কর আপন স্বরূপ বিস্মৃত হলেন। এই সময়ে জায়া পার্বতীকে নিয়ে জালন্ধর শিবের সামনে উপস্থিত হল। শত্রুর রথের ওপর আপন পত্নী গৌরীকে দেখে শিব বিলাপ করতে লাগলেন। সেই সময় গৌরীও পতি বিরহে কাতর হয়ে রোদন করছে। শিব তাকে গ্রহণ করবার জন্য উদ্যত হলে, শুম্ভাসুর উমাকে নিয়ে আকাশে উঠে গেলেন। শম্ভ শুম্ভাসুরকে বধ করার জন্য শূল ছুঁড়লে, তা দেখে শুম্ভাসুর পার্বতীকে ছেড়ে দিলেন। পার্বতী সেই শূলের উপরে পতিত হয়ে শিবের সামনে প্রাণত্যাগ করলেন।
মায়া গৌরীকে মৃত দেখে শঙ্কর শোকে মোহে আচ্ছন্ন ও মূচ্ছিত হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। চেতনা লাভ করার পর তিনি শুম্ভাদি সহ অসুরদের অভিশাপ দিলেন গৌরীই তোদেরকে বিনাশ করবে।
শঙ্করের সেই অভিশাপের ফলেই গত মন্বন্তরে শুম্ভাদি অসুরগণ দেবীর হাতেই নিহত হয়েছে।
শিবকে দৈত্যমায়ায় মোহিত জেনে অন্তরীক্ষ থেকে ব্রহ্ম অবতরণ করে বললেন–হে প্রভু, পার্বতী, আপনারই অর্ধাঙ্গরূপিণী, তিনি কখনও বিপন্না হতে পারেন না। এটি জালন্ধরের মায়া। আপনি এই মায়া নাশ করুন। কমলকেশের মধ্যে পার্বতী বিরাজ করছেন। কোন চিন্তা না করে আপনি যুদ্ধ করুন।
অদৃশ্যবাণী শুনে শঙ্কর এটি দানবীমায়া বুঝতে পেরে আবার ভীষণভাবে যুদ্ধ শুরু করলেন। আবার শম্ভুকে মায়ামুক্ত দেখে জালন্ধরে মায়া বিস্তার করলে, বিমোহিত শিবকে শ্রীহরি মায়াযুক্ত করলেন। তখন শিব কুপিত হয়ে সৃষ্টি সংহারকর রূপ ধারণ করলেন। তখন শুম্ভ, রাহু প্রভৃতি দৈত্য রুদ্রকে দেখে ভয় পাতালে প্রবেশ করল। জালন্ধর শিবের রুদ্ররূপ দেখে বলল হে হর, আপনি চরাচর সংহার করেন, আপনার এই রূপ ত্যাগ করে যোগবল ছেড়ে অস্ত্র ধরে সংগ্রাম করুন।
এই কথা শুনে শিব বললেন–দৈত্যরাজ, তুমি আমার ভয়ঙ্কর রূপ দেখেও নির্ভয়ে রয়েছ, সেজন্য তোমার প্রতি আমি প্রসন্ন। তুমি বর প্রার্থনা কর। জালন্ধর সাযুজ্য মুক্তি প্রার্থনা করলে, শিব বললেন–যদি আমার পরম পাদে লীন হতে চাও তাহলে শরদ্বারা আঘাত করে আমার কোপ উৎপন্ন কর, তাহলে তোমাকে নিধন করব, আর তুমি আমার আলয়ে যেতে পারবে।
দুজনের মধ্যে আবার তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। জালন্ধর মায়া বলে সহস্র হস্ত হয়ে শিবকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করল। তখন শঙ্কর কৃপাণের সাহায্যে দৈত্যের সব বাহু ছেদন করলে দৈত্যরাজ অস্ত্রহীন, হস্তহীন হয়েও শিবের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে প্রীত করলে, শিব তাকে পুনরায় বর দিতে চাইলেন।
তখন জালন্ধর বলল–আমি বাহু ও অস্ত্রহীন বলে আমাকে অবজ্ঞা করবেন না। আমাকে আত্মপ্রদ দান করুন। অন্যথা আমি আপনাকে সংহার করব। এই কথা বলে দৈত্য যোগবলে বাহু ধারণ করে শঙ্করের বক্ষে আঘাত করল।
তারপর শঙ্কর যে চক্র পূর্বে সৃষ্টি করেছিলেন তার দ্বারা জালন্ধরের শিরচ্ছেদ করলেন। তখন দৈত্যের ছিন্ন শির আকাশে উঠে গেলে রুদ্রদেব আবার দৈত্যের মস্তক চক্রের দ্বারা ছেদন করলেন। দ্বিধা বিভক্ত সেই মস্তক হিমাচলে পতিত হল। তারপর দুই মস্তক খণ্ড রুদ্রদেহে প্রবেশ করল। জালন্ধরের স্কন্ধ দেশ থেকে শত সহস্র দৈত্য উৎপন্ন হলে রুদ্রের চক্রাঘাতে তারাও বিনাশপ্রাপ্ত হল। এই ভাবে বারে বারে যত দৈত্য সৃষ্টি হল, সবই রুদ্রের দ্বারা ধ্বংস হল। জালন্ধরের মেদ রাশি দ্বারা সমস্ত পৃথিবীপুরি পূরিত হল। দৈত্যরাজের শোনিত রাশি কৈলাসের উত্তরভাগে যেখানে শৈলাকার হয়েছিল, সেই স্থানেই শোনিতপুর প্রতিষ্ঠিত হল।
জালন্ধরের মাংসরাশি সর্বস্থানে পড়ে বীভৎস আকার ধারণ করেছে দেখে, মহাদেব যোগিনীদের স্মরণ করলে, তারা হরের ইচ্ছানুসারে ক্ষণকালের মধ্যে তা ভক্ষণ করে নিঃশেষ করে দিল। অতঃপর মহেশ্বর পার্বতী ও আপন বাহন বৃষকে স্মরণ করা মাত্র সেখানে উপস্থিত হল। তখন মহেশ গিরিজার সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রীত হলেন। তারপর গৌরী মহেশের সঙ্গে কৈলাসে যাত্রা করলেন। করুণাময় শঙ্কর অতঃপর দেবগণকে স্ব স্ব পদে স্থাপন করলেন। দেবতাগণ স্বরাজ্য লাভ করে আবার পূর্বের মতো যজ্ঞভোজী হলেন।
দেবর্ষি নারদ বললেন–হে রাজা যুধিষ্ঠির, সমুদ্র নন্দন জালন্ধরের বশ্য হয়ে আজও শ্রীহরি ক্ষীরোদ সমুদ্র ত্যাগ করতে পারেন নি। সুতরাং স্বকৃত কর্মফল সকলকেই ভোগ করতে হয়। কর্মের গতি সদা বলবতী, এই কথা জেনে তুমি ধৈৰ্য্য ধারণ কর। শত্রু জয় করে পুনরায় স্বরাজ্য লাভ করবে।