রাজা শ্বেতের মৃত্যু ও শিবের বরে পুনরায় শিশুর প্রাণলাভ
আজ থেকে বহুদিন পূর্বে কোন এক সত্যযুগে পৃথিবীতে সবাই সুখে শান্তিতে বাস করত। কারো কোনো শোক ছিল না। সকলের পরমায়ু ছিল লক্ষ বৎসর। শিশুকালে কারো মৃত্যুও হত না।
তখন শ্বেত নামে এক বীর, মহাজ্ঞানী, বুদ্ধিমান রাজা ছিলেন। তিনি সুন্দরভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন। কারও কোনো অভিযোগ নেই। সকলেই সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে কাল কাটাচ্ছে। কিন্তু এমন অবস্থায় নেমে এল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। শ্বেতের মৃত্যু হল।
কপাল গৌতম নামে এক তো দূরের কথা, ওদিকে তাকাতেই পারছি না।
মৃত্যু দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল শিবের সব অনুচরেরা দণ্ড হাতে শ্বেতকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তা করল মৃত্যু যমরাজ দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাঁর চর আমি। আমি কাউকে ভয় পাই না। যতই দাঁড়িয়ে থাক শিবের অনুচরেরা, আমি যাব শ্বেতকে আনতে। মৃত্যু গিয়ে দাঁড়াল শ্বেতের পাশে। সে তখন শিবমন্ত্র যপ করছে।
পাশধারী মৃত্যুকে সেখানে দেখে এক শিবদূত বলল–কি হে মৃত্যু, তুমি এখানে কেন? কিছু কি উদ্দেশ্য? মৃত্যু বলল–আমার কাজ কি, তা তোমরা সকলেই জানো। এই শ্বেতের আয়ু ফুরিয়েছে, তাই ওকে নিতে এসেছি।
এই কথা বলেই মৃত্যু পাশ ছুড়ল শ্বেতের উপর, তাকে বাঁধবার জন্য। শিবের অনুচরেরা সঙ্গে সঙ্গেই দণ্ড দিয়ে সেই পাশ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে সেই দণ্ড মৃত্যুর মাথার উপর তুলে গর্জন করে বলল–ওরে মূর্খ তুই জানিস না,শিবের ভক্তের উপর তোদের যমেদের কোন অধিকার নেই? বলেই মৃত্যুর মাথায় আঘাত করল। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর তার মৃত্যু হল।
এতক্ষণ যমদুতেরা দাঁড়িয়ে দেখছিল এইসব কাণ্ড। যেইমাত্র মৃত্যুর ভবলীলা সাঙ্গ হল, তখনই তারা প্রাণ নিয়ে ছুটে চলল যম পুরীতে। সব কথা বলল যমরাজকে। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন যমরাজ। আমার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে শিবের অনুচরেরা, তখন তিনি তার প্রধানমন্ত্রী চিত্রগুপ্তকে ডাকলেন। আর ডাকলেন মহিষ, ভূত, বেতাল আধি-ব্যাধি সবাইকে। সকলকে নিয়ে যমরাজ চলেছেন শ্বেতের বাড়িতে।
এদিকে শ্বেতের বাড়িতে হাজির হয়েছেন কার্তিক, গণেশ আর নন্দী। সহসা সদলবলে যমরাজকে আসতে দেখে তারা বুঝতে পারলেন এভাবে আসার কারণ কী? সবাই প্রস্তুত যুদ্ধের জন্য।
আস্ফালন করতে করতে যমরাজ যখন এসে একেবারে শ্বেতের কাছাকাছি হাজির, শিবের দল সব ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। শুরু হল মহা সমর! একদিকে দেব সেনাপতি কার্তিক, তার সঙ্গে লড়াই করতে পারে, যম দলে এমন কে আছে? তার অস্ত্রে প্রহারে যমদূতেরা সব ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়তে লাগল। বহু ধর্মদূত মারাও পড়ল। মৃত্যুলোকের অধিপতি যমরাজও পার পেলো না। প্রাণহীন দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
তাদের মধে যারা বেঁচে ছিল, এই অবস্থা দেখে ছুটে গেল যমের পিতা সূর্যদেবের কাছে। সব শুনে সূর্য দেব গেলেন ব্রহ্মার কাছে। ক্রমে ক্রমে সকলে এই দুঃসংবাদ পেয়ে ব্রহ্মার কাছে এলেন। সবাই মিলে পরামর্শ করলেন–যেভাবেই হোক শিবকে সন্তুষ্ট করতে হবে। তিনি প্রসন্ন হলে যমরাজের বাঁচার জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু তিনি যদি ক্ষেপে যান তাহলে সর্বনাশ।
আর কালবিলম্ব না করে সবাই চলল শিবের কাছে কৈলাসে। স্তব স্তুতি শুরু করল। শিব ধীরে ধীরে শান্ত মূর্তি ধারণ করলেন। বললেন–দেবগণ! তোমরা আমার স্তুতি করছ কেন? কি চাই?
দেবতারা হাত জোড় করে সবিনয়ে বললেন–হে দেবাদিদেব মহেশ্বর! আপনি হোন আমাদের প্রতি প্রসন্ন! যমকে বাঁচিয়ে দিন।
শিব বললেন–তা হয় না। যম আমার অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে, মৃত্যুর দ্বারা তার প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে। তোমাদের অন্য প্রার্থনা থাকলে বল, পূরণ করব।
দেবতারা বলল–হে মহেশ, আপনি সকলের পূজনীয়, আপনার আদেশমত আমরা নিজ পদে অবস্থান করে প্রজা শাসন করছি। যার যেমন ক্ষমতা আছে সেই অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছি। যমকেও সকলের পাপ পুণ্যের বিচারের দায়িত্ব দিয়েছেন। সে তার দায়িত্ব ঠিকমতই তো পালন করছে। তাতে তার কোন অপরাধ তো আমরাই দেখতে পারছি না।
মহাদেব বললেন–আমার যারা ভক্ত তাদের ওপর যমের কোন অধিকার নেই। শ্বেত আমার পরম ভক্ত, যমের এত সাহস যে আমি অবাক হয়ে যাই। আমার ভক্তকে নিয়ে যেতে চায়? তোমরাও আমার ভক্ত, তাই তোমাদের আবেদন আমি রক্ষা করব, তবে একটা শর্তে। আমার ভক্তদের কখনও যমালয়ে নিয়ে যেতে পারবে না যম। এই শর্ত তোমরা যদি মেনে নাও, তাহলে আমি যমকে বাঁচতে দেব।
শিবের কথা শুনে দেবতারা চিন্তা করে বললেন–হে মহেশ্বর। আপনি পরম জ্ঞানী। কিন্তু আপনার বাক্য যদি আমরা মেনে নেই, তাহলে পৃথিবীর নিয়ম কেমন করে রক্ষা হবে? কেউ তো আর মারা পড়বে না। মরলেও আপনার লোকে এসে সকলেই অমর হয়ে থাকবে। স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীর পার্থক্য থাকবে কেমন করে?
শিব তার শর্তে অচল হয়ে, বললেন–যদি এই শর্ত মেনে নাও তাহলেই যমকে পাবে। আর একটা কথা যারা আমার ভক্ত, তারা যমের পাঠানো কোন ব্যাধিতেও ভুগবে না। যদি মান তাহলে ঠিক আছে হলে ফিরে যাও।
শিবের এমন কথার উপর আর কার কি বলার আছে? অগত্যা সকলে মেনে নিল মহাদেবের শর্ত। শিবের আজ্ঞায় নন্দী যমের গায়ে গোদাবরীর জল ছিটিয়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে উঠলেন অনুচরগণের সঙ্গে স্বয়ং যমরাজ। তারপর আপন পুরীর দিকে চললেন।
দেবতারাও মহেশ্বরের পূজা করে যে যার নিজ নিজ স্থানে চলে গেলেন।